॥ সুপ্রিয়া দেবনাথ ॥
যে কোন শিল্পই তার সময়, সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতাকে কেন্দ্র করে সৃজিত হয়। ঠিক তেমনিভাবেই নাট্যকার সেলিম আল দীন বিংশ শতকের জীবনবোধ ও শিল্পচৈতন্যের আলোকে মহাভারতের দুষ্যন্ত- শকুন্তলা উপাখ্যানকে উপজীব্য করে সমসাময়িককালের জীবন ভাষ্য তুলে ধরেছেন তার ‘শকুন্তলা’ নাটকে। ‘শকুন্তলা’ নাটকের রচনাকাল ১৯৭৭ সাল। নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাঙালি জাতি ভৌগোলিক মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক মুক্তির সংগ্রামেও একাত্ম হয়। তারই ধারাবাহিকতায় পুরাণাশ্রয়ী ধ্রুপদী কাহিনীকে উপজীব্য করে নাট্যকার রচনা করলেন জীবন চেতনা সমৃদ্ধ আধুনিক নাটক ‘শকুন্তলা’।
‘স্বর্গীয় খণ্ড’ ও ‘শকুন্তলা খণ্ড’এই দু’ভাগে বিভক্ত-নাটকটির একদিকে উঠে এসেছে মানবীয় অমরত্ব প্রাপ্তির চিরায়ত বাসনা, অন্যত্র মানুষকে সেই অধিকার থেকে সরিয়ে দেবার অভিপ্রায়ে দেবতারা হয়ে উঠেছেন অনেকটা মানবীয় চরিত্র। স্বর্গ ও মর্তের বিরোধকে উপেক্ষা করে ধর্মীয় বিশ্বাস ও দেবতাদের প্রতি আস্থার জায়গাটি এখানে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অমরত্ব প্রাপ্তির যে বাসনা ত্রিশঙ্কু থেকে বিশ্বামিত্রে বাহিত হয় তা সবশেষে শকুন্তলার মাধ্যমে চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছায়। নিঃসন্দেহে নাটকটি শুধু আধুনিক নাটকই নয় বরং নাট্যজগতে সেলিম আল দীন নির্মাণ করলেন এক দৃঢ় ও সাহসী নারী চরিত্র শকুন্তলা যে বিংশ শতকের তথা সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এক জাতির অস্তিত্বহীনতার সংকটকে সার্বজনীন মানবিকরূপে তুলে ধরে সর্বজনসম্মুখে। আত্মহননের পথ সে চরিত্র বেছে নেয় না বরং নবজীবন লাভের আকাঙ্ক্ষায় নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটে।
কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ নাটকের কাহিনী মহাভারতের আদিপর্ব (সম্ভব পর্ব ৬৮-৭৪) থেকে গৃহীত। ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ নাটকের মূল কাহিনী হস্তিনাপুরের অধিপতি দুষ্যন্ত কন্বাশ্রমে কন্বের পালিত কন্যা শকুন্তলার রূপে মুগ্ধ হয়, শকুন্তলাও তার অনুরাগিনী হন। তাদের গান্ধর্ব মতে বিবাহ এবং পরে দুর্বাসার অভিশাপে শকুন্তলাকে দুষ্যন্তের প্রত্যাখ্যান। শেষে মারীচাশ্রমে পুত্র ভরতসহ দুষ্যন্তের সঙ্গে শকুন্তলার মিলন। নাট্যকার সেলিম আল দীন ধ্রুপদী এই কাহিনীর শকুন্তলার জন্ম অংশটা ঠিক রেখে নাট্য কাহিনীতে নতুন জনজীবন, চেতনা ও নতুন মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে অবলম্বন করে সৃজন করলেন শকুন্তলা চরিত্র যিনি প্রেয়সী বা মাতা নন বরং নিজেই অস্তিত্বের সংকটে প্রশ্নবিদ্ধ, সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র মানবকূলের প্রতিনিধিও বটে।
‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ নাটকের মত শকুন্তলা নাটকে বিদূষক চরিত্রের উপস্থিতি নেই, শকুন্তলার জীবনে দুষ্যন্তের অবস্থান ও অলৌকিক ঘটনায় নাট্য কাহিনীর মোড় পরিবর্তন চোখে পড়ে না বরং নাটকটি শুরু ও শেষ হয় সূত্রধরের কথকতা দিয়ে।
শকুন্তলা নাটকটির রচনাকাল বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭১ সালে ভৌগলিক মুক্তির পর কিছুকাল অতিবাহিত হবার পর ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, সামরিক স্বৈরশাসন, সাম্প্রদায়িক এবং মৌলবাদী শক্তির উত্থানের ফলে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র চরম হুমকির সম্মুখীন হয়। এই সমসাময়িক সময়ের নাটক ‘শকুন্তলা’। সামগ্রিকভাবে জনজীবনের অস্থিরতা, অস্তিত্বহীনতার সংকট ও সর্বোপরি বিপর্যস্ত সামাজিক জীবন শকুন্তলা চরিত্রের মধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে। তাই শকুন্তলার মধ্যে শুধু শারীরিক অসুস্থতা নয় বরং চোখে পড়ে মানসিক অস্থিরতাও। শকুন্তলা নাটকের শকুন্তলা খণ্ডের সমগ্র আখ্যানভাগ সেলিম আল দীনের নিজস্ব উদ্ভাবন। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, স্বর্গ ও ঈশ্বরকেন্দ্রিকতাকে অতিক্রম করে নাট্যকার প্রশ্ন তুলেন সেই চির বিশ্বাসের ভিত্তি ভূমি ঈশ্বরই যখন ষড়যন্ত্রের নিয়ামক, তখন অসহায় মানুষের স্থান কোথায়? নাট্যকার এখানে স্বশরীরে স্বর্গ জয়ের এবং পচনশীল দেহের বন্ধন মুক্তির চিরায়ত বাসনাকে তুলে ধরেছেন। বিশ্বামিত্রের কঠোর তপস্যায় স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র ভীত। নাট্যকার তার সার্থক সংলাপ দিয়ে তুলে ধরেছেন ইন্দ্রের মানসিক অবস্থা,-‘ইন্দ্র: তপস্যা শেষ হলে আমাদের স্বর্গ বিশ্বামিত্রের পদানত হবে। শুধু স্বর্গই নয় এই নদী কৌশিকীও বিশ্বামিত্রের মন্ত্রের বলে মন্দাকিনীর মত অক্ষয় হবে। আর তাহলে মানুষের কাছে দেবতারা হবে হাস্যকর। আজ তাই গোপন যুদ্ধ স্বর্গের সঙ্গে পৃথিবীর।’ (তিনটি মঞ্চনাটক, পৃষ্ঠা-৫৩)।
১৯৭৫ সালে লেখা ‘আতর আলীদের নীলাভ পাট’ এ মানুষের শারীরবৃত্তির পরিণতি নিয়ে নাট্যকারের মনে ক্ষোভ জেগেছিল। শকুন্তলা চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে তিনি সেই ভাবনাটিকে বিস্তৃততর পটভূমিতে সংস্থাপন করলেন। শকুন্তলা ভাবে, তার শরীরে স্বর্গের শোণিত, তবু কেন পৃথিবীর দায়ভার বহন করবে সে! মাংস নয়, জীবনবৃত্তের প্রতি ঘৃণা জমে ওঠে তার। এ প্রশ্ন কালিদাসের শকুন্তলার মধ্যে ছিল না। কালিদাসের শকুন্তলা নির্দ্বিধায় তার ভাগ্য ও পরিণতিকে মেনে নেয়। সেলিম আল দীনের শকুন্তলা সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে প্রমাণ করে অমানবিক জননীর ঔরসজাত কন্যা হলেও অস্থি, মজ্জা, মাংসে সে মর্তমানব। তাই তার যাতনা হয়, নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না তার ভাবাবেগ। শকুন্তলার যন্ত্রণার মধ্যে সদ্যপ্রসূত বাঙালি জাতির দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সূচনালগ্নের বিধ্বস্ত সময়কেই দেখতে পাই।
সেলিম আল দীনের শকুন্তলার গায়ে নীল ঘামাচি, অশৌচ রক্তক্ষরণে ক্লান্ত অবসন্ন শকুন্তলা বাঁচার ইচ্ছেই হারিয়ে ফেলে। চিৎকার করে বলে, ’এই কষ্ট, এক ক্লেদ। ও চাঁদ- কেন আমার অন্রভরা গোপন অসুখ।’ (শকুন্তলা পৃষ্ঠা-৮২)। যে নীল রঙ্গ প্রণয়ের ও যৌবনের নির্দেশক সেই নীল শকুন্তলার দেহে প্রকটিত। এই রঙ্গ তার জীবনে কোন প্রেমবার্তা নিয়ে আসে না, নিয়ে আসে তার জন্ম রহস্যের সেই কটু সত্যকে যা মেনে নিতে সে অক্ষম। নশ্বরতাকে মানুষ সর্বদাই কাটিয়ে উঠে হতে চেয়েছে অবিনশ্বর, অমর। শকুন্তলাও তাই চেয়েছে আর এখানেই সে হয়ে ওঠে এক অতিমানবিক চরিত্র।
শকুন্তলাকেও দেখি হ্যামলেটের মতো একই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে, ‘to be or not to be that is the question.’
কার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে শকুন্তলা? কারণ স্বর্গের শোনিত যেমন তার রক্তে প্রবাহিত তেমনি মর্ত মানবের রক্তধারাও একই দেহে প্রবাহিত হচ্ছে। স্বর্গও মর্ত সবই তার। তাই তার বিরোধ তার পক্ষ ও বিপক্ষ উভয় দিকেই।
সেলিম আল দীন মানব-মনের মর্ত ও স্বর্গ- প্রীতির দ্বান্দ্বিক অবস্থানের সঙ্গে পচনশীল দেহ ও আত্মা সম্পর্কিত চিরন্তন কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন নাটকে। স্বশরীরে কোন মানব স্বর্গরোহন করতে পারে না। তাই শকুন্তলা তার মাংসল কায়াকে প্রত্যাখ্যান করছে। শকুন্তলার জন্ম রহস্য, আত্ম যন্ত্রণা ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষার মধ্যে অস্তিত্ববাদী চরিত্রের বীজ উপ্ত হয়ে আছে।
নাটকের আখ্যান ভাগে বেশকিছু বিষয় নাট্যকার তুলে ধরেছেন।
১. স্বর্গ ও মর্তের বিরোধ।
২. মানবের অমরত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষা
৩. শকুন্তলার সঙ্গে গৌতমীর বন্ধন তা রক্তের বন্ধন না হলেও মানবিক সম্পর্কের বাঁধন; তা সমাজ স্বীকৃত হলেও রাষ্ট্র দ্বারা আইনসিদ্ধ বলে গৃহীত নয়।
৪. তক্ষকের কণ্ঠ নাট্যকার তার সমাজদর্শন যা সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থাকে বিশ্বাস করে তাই তুলে ধরেছেন।
সমাজে সম্মানীয় শ্রেণির প্রতিনিধি বিশ্বামিত্র ছদ্দবেশী তক্ষককে কৌশিকী নদীর পবিত্র জল পানের অনুমতি দেন। তক্ষকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় সহস্র বছরের শূদ্র সমাজের কাঙ্খিত ধ্বনি-‘নদী সকলের। তৃষ্ণার পানিতে শুকর, শূদ্র ও মানুষের সমান অধিকার।’
স্বর্গের নটী মেনকার মৃত্যুভীতিও চোখে পড়ে। স্বর্গনটী পত্রলেখার কাছে স্বর্গের বেশ্যা জীবনও শ্লাঘনীয়। স্বর্গের নিম্নস্তরের জীবন ধারণও তাদের কাছে লোভনীয়। কারণ স্বর্গে রোগ-শোক নেই, আছে সুখ আর বিলাস বৈভবের উপস্থিতি।
সদ্য ঋতুমতী শকুন্তলার কাছে মর্ত জীবন বড় দুর্বিষহ। সে চায় রোগ-শোক থেকে মুক্তি আর চায় স্বর্গীয় জীবন। এতদিনের লালিত জীবন তার কাছে এক অমোঘ সত্য দিয়ে শেষ হয়ে যায়। তা হলো তার জন্মরহস্য। শকুন্তলা জানতে পারে তার জন্ম ভালোবাসার প্রতিরূপ নয় বরং সাময়িক যৌনসম্ভোগের ফল। যে কোন নারীর জন্যই এ সত্য বড় লজ্জার। তাই এই অবমাননাকর জীবন থেকে মুক্তি চায় সে। বারবার তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় বিদ্রোহ। সে বলে, ‘আকাশের মধ্যে থাকো জননী আমাকে তুমি দিব্য শরীর দাও-নীল রক্তে ভরে দাও সকল ধমনী।’ (সেলিম আল দীন রচনাসমগ্র-২ পৃষ্ঠা: ৭৮)।
‘তবে কি এইখানেই থেকে যাবে….আমার শরীর।….কেবলই কানামাছি….কেবলই অন্ধকার।’ (সেলিম আল দীন রচনা সমগ্র ২, পৃষ্ঠা:৭৯)।
দেবতাদের ক্ষমতা, স্বেচ্ছাচার, বিধি-বিধান এবং মানুষের প্রতি তাদের অবিচারের ইতিবৃত্ত উঠে আসে পত্রলেখার আলোচনায়। বিশ্বামিত্রের পরাজয় মানবজাতির পরাজয়ের চিহ্নপাতে কলুষিত।
নিঃসন্দেহে শকুন্তলা এক বিদ্রোহী নারী চরিত্র যে প্রচণ্ডভাবে সোচ্চার, উৎক্ষিপ্ত ও একই সঙ্গে বিভ্রান্তও। বর্তমান অবস্থানে অটল থেকে সে প্রত্যাখ্যান করে তার অতীত প্রতিপালন ও অন্যান্য সকল সম্পর্ককে। কালিদাসের শকুন্তলা প্রশ্ন করতে পারে না কারণ সে প্রশ্ন করতেই জানে না। কিন্তু সেলিম আল দীনের শকুন্তলা নিজে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, তেমনি সমাজ ও মানবজীবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আত্মপরিচয় লাভের পর নাট্যকার শকুন্তলাকে উপস্থিত করেন উদ্ভ্রান্তভাবে ঠিক এইভাবে, ‘আত্মপরিচয় লাভের পর বিমূঢ় শকুন্তলা হেসে ওঠে।’ এই হাসি যেন সমগ্র সৃষ্টি ও ঈশ্বরের ক্রুরতার প্রতি। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাস সুখপাঠ্য নয়। তাই নাট্যকারের রচনায়ও শকুন্তলার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে বিকৃত সমাজ, সময় ও মানুষের চিত্র যা ভঙ্গুর, অস্থির ও সমস্যা জর্জরিত। যেহেতু সাহিত্যের বিষয়বস্তু সর্বদাই সমসাময়িক ঘটনা নির্ভর তাই শকুন্তলা নাটকটিও এর ব্যতিক্রম নয়। যুদ্ধ পরবর্তী বাঙালি হৃদয়ের অস্থিরতা ও চিরায়ত মানবিক আর্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে ‘শকুন্তলা’ নাটকের শকুন্তলা চরিত্রটির মধ্য দিয়ে।
তাই বলতে পারি শুধু নাট্যকারের রচনার দিক থেকে ও রচনাকালের দিক থেকেই শকুন্তলা নাটকটি ব্যতিক্রম নয় বরং নাট্যজগতে শকুন্তলা এক বিদ্রোহী নারী চরিত্র, যা সমসাময়িক ও এক অস্তিত্ববাদী চরিত্র।
—
দেশের বই পোর্টালে লেখা পাঠাবার ঠিকানা : desherboi@gmail.com
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD