।। হেমন্ত হাসান ।।
জলপাই গাছের গোড়ায় ছাগলটা বাঁধা। একই গাছে সামান্য উঁচুতে, ওর মুখ বরাবর বাঁধা দুটো কলাপাতাও। ছাগলটার অবশ্য সেদিকে খুব একটা আগ্রহ নেই। মাঝেমধ্যে সে এক আধবার কলাপাতায় মুখ লাগায়, তারপরই ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। আর একটু পর পরই ম্যাঁ ম্যাঁ করে চেঁচিয়ে ওঠে জোরে। এমনিতে দড়ি ছাড়া থাকলে এই প্রাণী এখানে-ওখানে ঘুরে ঘুরে শুকনো পাতা এমনভাবে চিবুবে যেন, বিয়ে বাড়ি থেকে ভরপেট পোলাও মাংস খেয়ে এই মাত্র মিষ্টি জর্দা দিয়ে পানটা মুখে দিয়েছে। অথচ, এখন তার মুখের কাছে তাজা কলাপাতা। সে সব তার ভালো লাগছে না। এ জন্যই কি এই প্রাণীর নাম ছাগল?
রোজা রেখে শুকনো মুখে ঘরের দুয়ারে পিঁড়ি পেতে বসে সে কথাই কি ভাবছিল সুরুজ মিয়া? নাকি তার ভাবনা জুড়ে অন্যকিছু? অন্য কোনো বোধ, সুখের কিংবা অসুখের- রোদের মতো ছেয়ে আছে কি সুরুজ মিয়ার মন? ছাগলটি আবার ম্যাঁ ম্যাঁ করতেই, সুরুজ মিয়া বিরক্তিতে ধমকে ওঠে, ‘হুর…হুর…! এত ভ্যাবাস ক্যা?’
ছাগলটা কী বোঝে কে জানে- চুপ করে যায়। এদিক-ওদিক তাকায়। কলাপাতা শোঁকে। আবার তাকায় এদিক আর ওদিক। সুরুজ মিয়াও তাকিয়ে আছে। তার উঠোন শেষ হলেই ভাইয়ের উঠোন শুরু। সেখানে পাকা বারান্দায় বসে বসে তার দশ বছর বয়সী ভাতিজি খেলার সাথীদের ইদের জন্য কেনা নতুন জামা দেখাচ্ছে। সুরুজ মিয়ার আট বছর বয়সী মেয়ে সুমিও তাদের দলে।
নীল রঙের লম্বা জামাটা বারংবার নিজের গায়ের সাথে জড়িয়ে জড়িয়ে দেখছিল। কী ভাবছিল সুমি? মুখে বলে না দিলেও সে সব কথার প্রতিটি শব্দই জানা আছে সুরুজ মিয়ার। পরশু সন্ধ্যায় চুলার পারে বসে মাকে বায়না করছিল সে, ‘মা, ইবারও কি ঈদে নতুন একটা জামা কিনা দিব না আব্বায়?’
ডালে সাম্ভার দিতে মনোযোগী সুমির মায়ের চোখের পাতার মতো যেন কানেরও পাতা আছে। সে যেন কিছুই শুনতে পায় না, গরম তেলে পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ ছেড়ে দেয়। তাতে যে শব্দ ওঠে, ওই শব্দেই ঢাকা পড়ে যায়, তার বুকের ভেতরকার যাবতীয় কান্নার শব্দ। সুমি আবার ডাকে, ‘মা।’
সুমির মা কিছু শোনে না। সত্যিই যেন বধির-বোবা। ছাগলটা আবার ম্যাঁ ম্যাঁ করে হঠাৎ। বিরক্ত লাগে খুব।
অনেক কিছুতেই এখন সুরুজ মিয়ার ভীষণ বিরক্ত লাগে। কিন্তু শুধু সয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। এই সংসার, যাপিত জীবনের এত আক্ষেপ- বিরক্তি ছাড়া আর কী দিতে পারে?
গত একটা বছর মহামারী করোনার আগ্রাসন। সারাক্ষণ আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক। সারাক্ষণ ভয়। তার থেকে বড় বিভীষিকার নাম ক্ষুধা। গত বছর এই মহামারীর সাথে ছিল বন্যার আঘাতও। লোকালয়ে বানের জলের দীর্ঘ প্রেমের কারণে কতজনের সংসারই ভেঙে যাবার উপক্রম! ধানী জমির ক্ষেতগুলো ডুবে থাকল দিনের পর দিন। ঠিক সময়ে আবাদ করা গেল না। পুরো মৌসুমটাই বরবাদ হয়ে গেল।
এ বছর আবাদ যা হয়েছে তাতেও যেন গজব পরেছে। কী এক রোগে শুকিয়ে গেছে ধানের ছড়া। চিটে হয়ে গেছে সব। সেই চিটে ধান কেটে দেওয়ার কামলাও পাওয়া যায় না। পেলেও দিন নয়শ টাকা মাইনে। আবার দুইবেলা খাবার। তাও খিচুড়ি চলবে না, চলবে না পান্তাও। গ্রামের অনেকের জন্যই এই সংকটের সময়ে কামলা রাখা আর মেয়ে-জামাই দাওয়াত করে খাওয়ানো সমান কথা।
কলেজ পড়ুয়া ছেলেটার পড়ালেখা বন্ধ। সে সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমায়। এখানে ওখানে বসে থাকে। এ সব দেখে মাঝেমধ্যে মেজাজ চড়ে যায় সুরুজের। নিজেকে সামলায়। তবু তো ভালো, ছেলেটা বাড়িতেই থাকে। পাড়ার অন্য ছেলেদের মতো নেশা-আড্ডা-মাস্তানি করে বেড়ায় না। অবশ্য যারা এসব করে তাদের সাথে মানিয়েও চলতে পারবে না সে- আচরণে কিংবা পোশাকে। উঠোনে বাঁশের আড়ের ওপর ছেলের লুঙ্গিটা শুকাতে দেখা যাচ্ছে। দুই যায়গায় ফেঁসে গেছে। পাশে স্যান্ডো গেঞ্জিটা ন্যাকড়ার মতো লাগছে। সুরুজ মিয়া লম্বা করে শ্বাস ছাড়ে। ছেলের ঘরের দিকে তাকায়। দরজা বন্ধ। মহামারী করোনার কারণে সারা পৃথিবীর সব কিছুর দরজাই এমন করে বন্ধ হয়ে আছে। শুধু ক্ষুধার কোনো বন্ধ নাই।
কৃষি ছাড়া আয় রোজগারের আর কোনো পথ নাই সুরুজ মিয়ার। গোলার ধান নীচে নেমে যাচ্ছে দ্রুত। হাঁটুর ব্যথা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। সুমির মায়ের কোমরেও বাসা বেঁধেছে ব্যথা। সেই ব্যথা ভরা কোমরে ঝাঁকা ভরতি শুকনো পাতা নিয়ে চুলার পারের দিকে হেঁটে যায় সে। তার ময়লা ছেঁড়া আঁচল হাওয়ায় দোলে। কোমরের কাছে ছেড়া শাড়ির জানালায় উঁকি দেয় বছর পুরনো পেটিকোট। সেদিকে তাকিয়ে থাকে সুরুজ মিয়া। ছাগলটা তখন আবার ডেকে ওঠে ম্যাঁ ম্যাঁ করে, অসহ্য।
ঈদের আর একদিন মাত্র বাকি। এ বাড়ি ও বাড়ির সবাই যে যেমন পারে কেনাকাটা সারছে। চোখে না দেখলেও বাতাসে সে সবের কথা কিংবা ঘ্রাণ ভেসে আসে। নতুন কাপড় অথবা দারুচিনি এলাচের ঘ্রাণও যে এতটা বিষাদ মাখানো- সুরুজ মিয়া এর আগে কবে সে কথা অনুভব করেছে? ছেলেটা মিষ্টি খেতে ভালোবাসে খুব। আর গরুর মাংসের ঝোল আলু। অথচ এখন শুধু আলুভর্তা ভাত জোগানোই দুঃসাধ্য মনে হয়। কেন? সুরুজ মিয়ার বুকে ব্যথা করে। ব্যথায় নীল হাঁটুতে হাত বুলায় সে। আচ্ছা, ছাগলটার সমস্যা কী? অকারণে ম্যাঁ ম্যাঁ করে পাগল বানিয়ে ছাড়বে নাকি!
সুমি এখনও নীল জামাটা তার হাতে ধরে রেখেছে। আরও একবার গায়ের সাথে লাগিয়ে ধরে দেখল। তারপর চকিতে এদিকে ফিরে তাকিয়ে দেখে বাপ তার দিকেই তাকিয়ে আছে এক মনে। আট বছরের মেয়েটা কী বুঝল কে জানে? দ্রুত জামাটি নামিয়ে রাখল নীচে। দৃশ্যটা এতটাই দুঃখ ঢেলে দেয়, এত বেশি মন খারাপ করে দেয়- তাকিয়ে থাকা যায় না।
আস্তে ধীরে উঠে সুরুজ মিয়া উঠোনে নেমে আসে। কোথাও আর কাউকে দেখা যায় না। মেয়েগুলো পাশের উঠোন থেকে সরে গেছে অন্য কোথাও। সুমির মা আবার কোথায় কোন কাজে গেল ভাঙা কোমর নিয়ে? সে দুই কদম হেঁটে সামনে যায়। এক কেজি গরুর মাংস, একটা সেমাইয়ের প্যাকেট, এক কেজি চিনি, একটা নীল জামা, একটা প্যান্ট আর গেঞ্জি, দুটো সুতি শাড়ি, চুলের ফিতা, নেইল পলিশ, মুখে মাখার ক্রিম…. মনে মনে বাজারের লিস্টিটা রেডি করতে থাকে, ‘আজ বাংলাবাজার হাট না?’ হ্যাঁ, মনে পড়ে। সে আকাশের দিকে তাকায়। ঢের সময় বাকি এখনও সূর্য ডুবতে।
ঘরের ভেতর গিয়ে কুচিমুচি শার্টখানা গায়ে চাপায় সুরুজ মিয়া। টিনের বেড়ার কাঠের চিপায় ভাঁজ করে রাখা বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে আরও একটু ভালো করে মুড়িয়ে নেয়। তারপর দুপুর কাটা রোদের আলোয় জলপাই গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায়। তাকে দেখে আবার ম্যাঁ ম্যাঁ করে ছাগলটি। নাহ্, এ শালা তো মাথা খাবে দেখছি! ওকে আর সহ্য হয় না সুরুজ মিয়ার। গাছ থেকে দড়ির বাঁধন খুলে সে ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে হাঁটা শুরু করে। গলায় দড়ির টান পড়ার আগে ছাগলটি একবার কলাপাতা মুখে টেনে নেয়। জলপাই গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে তখন দিবস শেষের রোদ।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD