নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ২০২০

লুইস গ্লুকের কাব্যময়তা, দার্শনিক সৌন্দর্যবোধের স্বীকৃতি ও দু’টি অনূদিত কবিতা

বুধবার, ১৪ অক্টোবর ২০২০ | ১২:৫১ পূর্বাহ্ণ | 2249 বার

লুইস গ্লুকের কাব্যময়তা, দার্শনিক সৌন্দর্যবোধের স্বীকৃতি ও দু’টি অনূদিত কবিতা

॥ আদনান সহিদ ॥

সদ্য ঘোষিত নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী ২০২০-এর নাম প্রকাশের আগ অবধি গোটা বিশ্বের সাহিত্যেপ্রেমীদের পছন্দ ও ভাবনাকল্পের প্রত্যাশিত তালিকায় মিলান কুন্ডেরা, নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো, হারুকি মুরাকামি, মার্গারেট অ্যাটউড, লিউডমিলা উলিৎস্কা, ম্যারিস কোন্দে, জয়েস ক্যারল ওটস, অ্যাদোনিস, জ্যামাইকা কিনকেড, অ্যান কার্সন, চিমামান্দা নগুজি আদিচিসহ জনপ্রিয় আরও সাহিত্যিকরা স্থান পেলেও লুইস এলিজাবেথ গ্লুকের নামটি অনুপস্থিতই ছিল বলা চলে। অবশেষে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ‘অসাধারণ কাব্যভাষা ও দার্শনিক সৌন্দর্যবোধের মাধ্যমে ব্যক্তিসত্তাকে সার্বজনীন করে তোলার’ স্বীকৃতিস্বরূপ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ২০২০ লাভ করলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবি লুইস এলিজাবেথ গ্লুক। তিনি গত দশ বছরে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত চতুর্থ নারী এবং ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার প্রচলনের পর থেকে ১৬তম নারী হিসেবে এই সন্মান লাভ করলেন।

 

 

 

লুইস এলিজাবেথ গ্লুক ১৯৪৩ সালে নিউইয়র্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন, বেড়ে ওঠেন লং আইল্যান্ডে। হাইস্কুলে পড়াকালীন তিনি ‘অ্যানোরেক্সিয়া নারভোসা’ রোগে আক্রান্ত হন এবং ক্রমান্বয়ে আরোগ্য লাভ করেন। তিনি সারাহ লরেন্স কলেজ এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করলেও কোনো ডিগ্রি লাভ করেননি। লেখালেখিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ‘কবিতার শিক্ষক’ হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন।গ্লুক বর্তমানে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে খন্ডকালীন শিক্ষকতা করছেন। বসবাস করছেন ম্যাসাচুসেটসের ক্যামব্রিজে।

গত ৮ অক্টোবর, ২০২০ সাহিত্যে নোবেল বিজেতার নাম ঘোষণাকালে নোবেল কমিটির সভাপতি অ্যান্ডার্স অলসন বলেন, ‘গ্লুকের কাব্যভাষা সুমিষ্ট এবং আপসহীন। কবিতায় প্রাঞ্জলভাব বজায় রাখায় তিনি সচেষ্ট।পাশাপাশি হাস্যরস ও তীক্ষ্ণ কৌতুকবোধের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘গ্লুকের বারোটি কাব্য সংকলন স্বচ্ছ ও নির্মলতায় ভাস্বর’। ‘এমিলি ডিকিন্সনের মতো গ্লুকেরও সরল বিশ্বাসকে উপেক্ষা ও নাকচ করার তীব্র ইচ্ছা রয়েছে’ বলে উল্লেখ করেন অ্যান্ডার্স অলসন। ‘পুরস্কারটি এমন একজন অর্জন করেছেন যিনি সাহিত্যকে অনন্য সাধারণ এক আদর্শিক অভিমুখে পৌঁছে দিয়েছেন’, যোগ করেন অলসন।

বহু সমালোচকদের মতে লুইস গ্লুক আমেরিকার ‘সমসাময়িক মেধাবী’ কবিদের মধ্যে অন্যতম। কবিতায় অতিকথনমুক্তি, সংবেদনশীলতা এবং পারিবারিক সম্পর্ক, বিচ্ছেদ, মৃত্যু ও একাকিত্বের প্রতি গভীর অন্তর্দৃষ্টি তাঁকে ব্যতিক্রমী করে তুলেছে। মার্কিন কবি রবার্ট হ্যাসের ভাষায় লুইস গ্লুক ‘মার্জিত ও শুদ্ধতম এক সমসাময়িক গীতিকবি’।

 

প্রকৃতপক্ষে, লুইস গ্লুকের রচনায় অন্তর্বেদনা, আকাঙ্ক্ষা ও প্রকৃতির সাবলীল পরিস্ফুটন লক্ষণীয়। তাঁর অধিকাংশ সাহিত্যকর্ম আত্মজীবনীমূলক ইঙ্গিত বহন করলেও তাঁকে পূর্ণাঙ্গ ‘স্বীকারোক্তিমূলক কবি’ আখ্যায়িত করা যাবে না বরং তাঁর রচনায় ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা ও আধুনিক জীবন উপস্থাপনায় প্রগাঢ় আবেগসহ পৌরাণিকতা, ইতিহাস ও প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত ছাপ স্পষ্ট।কবিতাসমূহে মানুষের করুণ বাস্তবতা, শৈশব ও পারিবারিক জীবন, বিষণ্নতা, একাকিত্ব, বিচ্ছেদ ও মৃত্যু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ফুটে উঠেছে।স্থানিক পরিমন্ডল ভেদ করে বিশ্বজনীন আত্মপ্রকাশের প্রচেষ্টা তাঁর সাহিত্যকর্মের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তাঁর প্রথম কাব্য সংকলন ‘ফার্স্টবর্ন’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘দ্য ট্রাম্ফ অব একিলিস’ (১৯৮৫), ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিস’ (১৯৯২), এভার্নো (২০০৬) ও ‘ফেইথফুল এন্ড ভার্চুয়াস নাইট’ (২০১৪) বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির আগেই ৭৭ বছর বয়সী এই সাহিত্যিকের পুরস্কার ও স্বীকৃতির ঝুলি বেশ সমৃদ্ধ ছিল। লুইস গ্লুক তাঁর কাব্য সংকলন, ‘দ্য ওয়াইল্ড আইরিস’ এর জন্য ১৯৯৩ সালে ‘পুলিৎজার পুরস্কার’ এবং ২০১৪ সালে ‘ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। তাছাড়া, ২০০১ সালে কবিতার জন্য ‘বলিঞ্জেন পুরস্কার’, ২০০৮ সালে ‘ওয়ালেস স্টিভেন্স অ্যাওয়ার্ড’, ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল হিউম্যানিটিজ মেডেলসহ জিতেছেন ‘ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক সার্কেল অ্যাওয়ার্ড’। তিনি ‘দি আমেরিকান পোয়েট্রি ১৯৯৩’ কাব্য সংকলনের সম্পাদকও ছিলেন। ২০০৩-০৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কবির দায়িত্বও পালন করেছেন লুইস গ্লুক।

 

সদ্য নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী এই মেধাবী কবিকে শুভকামনাস্বরূপ পাঠকদের জন্য তাঁর দুটি ইংরেজি কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন আদনান সহিদ

প্রথম স্মৃতি

বহুদিন আগে
আমার অভ্যন্তরে ছিল
এক জখমের অস্তিত্ব
যাকে সঙ্গী করে বেঁচেছিলাম কেবল
বাবার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবার প্রত্যয়ে,
বাবা কেমন ছিলেন তারচে’
আমি কেমন ছিলাম
তা-ই বিবেচ্য ছিল আমার।

শৈশবের প্রারম্ভেই বুঝেছিলাম,
যন্ত্রণাযোগ মানে
আমি ভালোবাসা বঞ্চিত-এমন নয়,
যন্ত্রণাযোগ মানে বরং-
আমিই ভালোবাসতে চেয়েছিলাম!

[লুইস গ্লুকের ‘ফার্স্ট মেমোরি’ কবিতা অবলম্বনে অনূদিত]

 

লাল পপি

একটি হৃদয়ের অধিকারী হওয়া
কোনও মহৎ বিষয় নয়,
বরং আমার মাঝে বিদ্যমান অনুভূতিকেই
মূল্য দিতে চাইবো তারচে’ অধিক
যার নিয়ন্ত্রণাধীন আমি!

ঐশ্বরিক এক সূর্যরূপী প্রভু আছে
যাকে আমার উন্মুক্ত, তেজস্বী হৃদয়খানা দেখাতে চাই
ঈশ্বরের সতেজ উপস্থিতির ন্যায় জ্বলজ্বলে সে হৃদয়!

হৃদয়হীনতার গরিমা কেমন হতে পারে, বলো তো?
ওহে আমার ভাইবোনেরা!
বহুকাল আগে,
মানবতা ধারণের ঠিক আগে
তোমরা কি আমার মতোই ছিলে?

কখনও কি উন্মুক্ত করার
অনুমতি দিয়েছিলে নিজেকে?
অনুমতি দিয়েছিলে এই ভেবে যে
হয়তো ভবিষ্যতে আর কখনোই
উম্মুক্ত হবার সুযোগ পাবে না?

প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হয়ে এখন
তোমাদের স্বরেই কথা বলছি
হ্যাঁ কথা বলছি।
কারণ, আমি চূর্ণবিচূর্ণ এক অস্তিত্ব যে!

[লুইস গ্লুকের ‘দি রেড পপি’ কবিতা অবলম্বনে অনূদিত]

 


[ বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের যে কোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : desherboi@gmail.com ]

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD