থ্রিলার ফেস্টের ষষ্ঠ দিনে আলোচনা পর্ব ছিল তিনটি। ‘থ্রিলারের মুদ্রণ সৌকর্য ও প্রচ্ছদ : সেকাল ও একাল’, ‘পেশা কি থ্রিলার লেখার সহায়ক হয়?’ এবং ‘থ্রিলার লেখার প্রস্তুতি ও লেখার সময় লেখকের মনের গতিবিধি’।
প্রথম পর্বে ‘থ্রিলারের মুদ্রণ সৌকর্য ও প্রচ্ছদ : সেকাল ও একাল’ শীর্ষক আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন মুদ্রণ গবেষক সুস্নাত চৌধুরি, প্রচ্ছদশিল্পী পার্থপ্রতিম দাস, প্রচ্ছদ গবেষক সোমব্রত সরকার ও প্রকাশক-লেখক সুদীপ ভট্টাচার্য। আলোচনায় উঠে আসে পেপারব্যাক আন্দোলন, সত্যজিত রায়ের বইয়ের প্রচ্ছদ, পেপারব্যাক ও থ্রিলারের সম্পর্ক, শরদিন্দুর উপন্যাসের চিত্রণের যে পরিবর্তন তার বিভিন্ন পর্যায় ও অন্যান্য বিষয়। বাংলা বইয়ের গুণগত মান সেভাবে ভালো না হওয়ার কারণ হিসেবে সুস্নাত চৌধুরি বলেন, ‘এক্ষেত্রে উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাব অনেক বেশি করে দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতির অভাবের কারণে গুণগত মান আটকাচ্ছে এরকমটা নয়। আর প্রচ্চদের কাজ বই ও পাঠকের মধ্যে দূরত্ব কমানো।’
সোমব্রত সরকার বলেন, ‘প্রচ্ছদ আসলে ভীষণ রহস্যময়, প্রচ্ছদ তো একটা কথা বলে, বইয়ের প্রচ্ছদটা মূল। প্রচ্ছদের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে একটি বই, সেটা থ্রিলার হোক বা প্রবন্ধ।’
সুদীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘প্রচ্ছদ হলো শিল্প। প্রচ্ছদ আসলে এক-একটা ছবি। আগের থেকে এখন প্রচ্ছদ অনেক ভালো হয়েছে।’
পার্থপ্রতিম দাস বলেন, ‘প্রচ্ছদ দেখে হয়তো কেউ বই কেনেন না কিন্তু প্রচারের ক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় বিষয়।’ এছাড়াও আলোচনায় এদিন উঠে আসে চিত্রণ প্রচ্ছদ থেকে প্রতীকি প্রচ্ছদ যাত্রার কথা। সবশেষে একটা বিষয় উঠে আসে এই আলোচনায়, মোবাইল আসার পর পেপারব্যাক বই কতটা প্রতিযোগিতার সম্মুখীন।
দ্বিতীয় পর্বে আলোচনার বিষয় ছিল ‘পেশা কি থ্রিলার লেখার সহায়ক হয়?’ আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক-লেখক পার্থ বন্দোপাধ্যায়, নাট্য অভিনেতা ও লেখক অরুণ বসু, লেখক রানা দাস, প্রকাশনা সম্পাদক গৌরব অধিকারী, পাঠক মৌসুমী রায় ও দেবানী পোদ্দার। থ্রিলারের বিভিন্ন উপাদান, বাস্তব ঘটনা কিভাবে থ্রিল হয়ে ওঠে?, থ্রিলারের গল্পের নায়কসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই পর্বে। বক্তব্যের মধ্যে সাধারণ যে কথাটা বারবার উঠে আসে তা হলো, থ্রিলার গল্পের প্রধান তাগিদ থাকা উচিত গল্প বলা, এর জন্যে প্রথম এবং প্রয়োজনীয় বিষয় পড়াশোনা আরও সহজ করে বললে সেই বিষয়ে জ্ঞান এবং আগ্রহ। এডগার এলান পো’র সময়কালে থ্রিলার গল্পের নায়ক থেকে শুরু করে ব্যোমকেশ বা সমসাময়িক যে থ্রিলার গল্প লেখা হচ্ছে তার নায়ক, এই চরিত্রগুলোর মধ্যে যে পরিবর্তন উঠে এসেছে তা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে আলোচনায়।
পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, থ্রিলার লেখার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ‘লেখাতে কোনো ভুল তথ্য না থাকে, সেটা পড়াশোনা করে জানা যেতে পারে আবার সেটা পেশার কারণেও জানা যেতে পারে।’ তিনি কলকাতায় আমেরিকান সেন্টার হামলা থেকে খাদিম-কর্তা অপহরণ, কাশ্মীরের জঙ্গি হামলা থেকে আমেরিকায় টুইন টাওয়ার ধ্বংসের কাহিনি বলে এই পুরো ঘটনা যে এক সুতোয় গাঁথা তা দেখিয়ে দেন। তিনি আরও বলেন, ‘জীবন গল্পের থেকেও বেশি থ্রিলিং।’
গৌরব অধিকারী বলেন, ‘বিশ্বসাহিত্যে, ইংরেজি সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যে যারা থ্রিলার লিখেছেন বা লেখেন, তাঁরা নিজেদের পেশাগত জীবন থেকে প্রচুর উপাদান পেয়েছেন এমনটা নয়।’
অরুণ বসু বলেন, ‘থ্রিলার লেখার জন্যে পেশা বিশেষভাবে সাহায্য না করলেও পেশা কিছু কিছু ক্ষেত্রে লেখার জন্যে খুব প্রভাবিত করে।’
রানা দাস বলেন, ‘কালি, কলম, মন লেখে তিনজন। যেকোনো ধরনের গল্প বা যেকোনো সময়ের গল্পের প্রধান জিনিস হলো গল্প বলা। এই গল্প বলাটা যদি ঠিকমতো বলতে পারা যায়, আর কিছুর মনে হয় প্রয়োজন হয় না। পেশা ফ্যাক্টর নয়, নেশাটা বড়ো কথা।’
দেবানী পোদ্দার বলেছেন, ‘পেশা একমাত্র উপাদান থ্রিলার লেখায় বিষয়টা এরকম নয়, কিন্তু একটা উপাদান তো বটেই।’ তিনি পুলিশ অফিসার সুপ্রতিম রায়, রেল-তদন্ত অফিসার তুষার সরদারের নাম করেন। মৌসুমী রায় বলেন, ‘একজন লেখকের নেশা, পেশা, পড়াশোনা সবকিছুরই প্রভাব তাঁর লেখার মধ্যে থেকে যায়।’
থ্রিলার লিট ফেস্টের বারোতম পর্ব অর্থাৎ ষষ্ঠ দিনের সবশেষ পর্বের বিষয় ছিল ‘থ্রিলার লেখার প্রস্তুতি ও লেখার সময় লেখকের মনের গতিবিধি’। অনুষ্ঠানের সূচনায় সুমেধা চট্টোপাধ্যায় জানান, ‘থ্রিলারের শেষ পাতায় যাওয়ার জন্য অসম্ভব একটা উত্তেজনা থাকে কতক্ষণে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছব। দৈনন্দিন জীবনে থ্রিলার জড়িয়ে থাকে। সেটাকে আমরা কখনওই অস্বীকার করতে পারি না। থ্রিলার পড়তে গিয়ে লেখককে ভাবতে হয় সে কী করে অপরাধী হয়ে উঠল?’
অনুভা নাথ বলেন, ‘থ্রিলারে টুইস্ট থাকা অত্যন্ত জরুরি। তবে আমার মনে হয় গল্পের প্রথমে যাঁকে খুনি দেখানো হচ্ছে শেষে গিয়ে যদি দেখা যায় সে খুনি নয়, খুনি তাঁর যমজ কেউ তাহলে তাঁকে থ্রিলার বলা যায় না।’ থ্রিলার কি নেতিবাচক বিষয় নাকি ইতিবাচক বিষয়ের মধ্যেও থ্রিলারের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়? রূপম চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘যে কোনো ধারার লেখাই থ্রিলার হতে পারে। খুন, জখম ছাড়াও থ্রিলার হয়। যে কোনও রুদ্ধশ্বাস, টানটান লেখাই থ্রিলার।’ অন্য লেখার পাশাপাশি থ্রিলার লেখকের ক্ষেত্রেও চরিত্রকে নিয়ে সময় কাটাতে হয়, তাদের ভেতরে ঢুকতে হয় এমনই অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেন তিনি। ‘থ্রিল খুব জটিল অনুভূতি, হাসি, কান্না যত সহজে প্রকাশ হয় থ্রিল কিন্তু অত সহজ নয়। খ্রিস্ট পূর্ব ২১ শতকে গিলগামেশের সময় থেকে থ্রিলকে নিয়ে মানুষ লিখে চলেছে’, এমনটাই মতো অ্যানথ্রোপলজির ছাত্রী পিয়া ঘোষ দস্তিদারের। অনন্যা সাহা ব্যানার্জি এখানে ভিন্নমত পোষণ করছেন। তিনি বলছেন, ‘গোয়েন্দা শব্দের সঙ্গে পরিচিত হলেও থ্রিলার শব্দের সঙ্গে পরিচিতি কিন্তু কয়েক বছর ধরেই ঘটেছে। গোয়েন্দা গল্পে গোয়েন্দাই সেরা কিন্তু থ্রিলারে অপরাধীকে নিয়ে কালচার করা হয়, তাঁর মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতি ফুটিয়ে তোলেন লেখক। সমাজের অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরে শেষে যদি শুভ বার্তা দেওয়া যায়, এর থেকে ভালো কিছু হয় না। এইভাবেও থ্রিলার লেখা যেতে পারে।’
অভিযান পাবলিশার্সের আয়োজনে এবং বিভা, অক্ষর সংলাপ, অভিনব মন প্রকাশনা, কলকাতা ক্রিয়েটিভ পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় প্রথম কলকাতা থ্রিলার লিট ফেস্ট শেষ হবে আগামী ২৫ মে। কলেজস্ট্রিট কলেজ স্কোয়ারের অভিযান বুক ক্যাফেতে চলছে কলকাতায় প্রথমবারের মতো আয়োজিত এই উৎসব।
[ বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বুক ইন্ডাস্ট্রির যেকোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : boideshnews@gmail.com ]
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD