জ্যোৎস্নার গর্ভ থেকে উঠে আসা প্রেম
যৌবনের রোদে স্বাগত জানাই তোমাকে, তুমিও
সেরে নাও স্নান, রৌদ্রস্নানে ভাসুক পৃথিবী। যারা
মূঢ়, অজ্ঞতাকে বুকে নিয়ে ঘোরে, তাদের মস্তিষ্কে
কিলবিল করে অসূয়া-অশুচি! পাত্তা দিও না
ওদের; কূটচালে ওরা পারদর্শী, চতুরবিশেষ!
আমি জানি, একদিন মঙ্গল-আলোয় তুমি রচনা
করবে মহামূল্য পাণ্ডুলিপি। অজন্তা-ইলোরা ঠিক
সন্ধ্যার আলোয় নেচে উঠবে তুমুল! যত আছে
চর্যার হরিণী, বনের গোপনে ওরা জ্যোৎস্নাস্নানে
মাতাবে নদীদের! আর ওতপাতা শিকারিরা ঢেউ
ঢেউ জোয়ারের উল্লাসে ধারালো ছুরি হাতে
কেটে নেবে মায়া হরিণীর স্তন! ওরা তো নিষ্ঠুর!
শিকারের নেশা অন্ধ করে রেখেছে ওদের! পরিযায়ী
পাখিরাও মৃত্যুমুখে পদে পদে ওদের শিকার!
তবু যৌবনের রোদে স্বাগত জানাই তোমাকে, তুমিও
ভালোবাসো খুব, ভালোবেসে আজ আমিও রোমিও।
নতুন ধান, মা ও দুলদুল ঘোড়া
নতুন ধানের গন্ধে জেগে ওঠে ঘোর মাতৃমন
ফেলে আসা দূর গাঁয়ে বিলের বাতাসে দোলে
সোনালি ধানের শিষ; খর রোদে আমি পুড়ি;
আমার বুকের কোণে ভিজে ওঠে কার মুখ!
মায়ের আঁচল থেকে পরম স্নেহের মতো ঝরে
পড়ে তপ্ত মুড়ি-গুড়! চোখ বুজলেই টের পাই
এমন মধুর স্মৃতি তোলা আছে নকশি শিকায়!
আজ মনে পড়ে, কেন জানি সন্ধ্যার আঁধার
নেমে এলে হোসেনের দুলদুল ঘোড়া মায়ের
চোখের জলে ভাসে! আমিও বিষণ্ন হয়ে উঠি!
বলি : মা, চলো তো দেখে আসি ফুরাতের তীর;
কারবালা! সিমারের ছুরি কেন রক্তের নহর
বয়ে আনে! দূরদেশে কে বাজায় বাদ্য ঝনঝন!
চোখ মুছে মা, আমিও, দৃশ্যপটে চলে ঘোরতর রণ!
যে জীবন প্রেমের অধিক
পিপীলিকা যেভাবে সঞ্চয় করে ভবিষ্যতের খাবার
আমিও তেমনি ভালোবেসে সঞ্চয় করছি প্রেম,
স্বপ্ন আর রাশি রাশি অভিমান, যে দৃশ্যে জীবন
নেচে ওঠে মুহুর্মুহু সত্যের অধিক সত্যে…আমি তো
তেমনি জীবনের গল্প রচনা করতে চাই! অদৃষ্ট
কোথায় নেবে জানি না কিছুই! তবু প্রতি পদে পদে
সুদূরকে মিলাতে চেয়েছি নিকটের সঙ্গে। এই যে
করুণ মৃত্যুরেখা মাঝে মাঝে জ্বলে ওঠে লেলিহান!
আমি তো নিভাতে চাই প্রাণপণে! জীবনের নদীগুলো
কুড়াতে কুড়াতে আমি ঠিক পৌঁছে যাব পিপাসার্ত
অগণন মানুষের কাছে। রোদের উত্তাপে রোজ
বৃক্ষরাশি জনে জনে অক্সিজেন বিলাবেই। আবারও
জীবনের পক্ষে দাঁড়াবে সময়; পুবাকাশে সূর্যোদয়ে
রঙিন জীবন! মানুষে মানুষে ঠিক মেলাবেই বুক!
সেরে যাবে সকল অসুখ, যন্ত্রণা হবে তো সাবাড়
জনপদে উড়বে নিশান, লজ্জা পাবে মৃত্যুরা আবার!
রংধনু মুছে গেলে
রংধনু মুছে গেলে আকাশেই পড়ে থাকে ছায়া!
কী মায়ার কথা! সোনালি রোদ্দুরে ভাসে কার মুখ?
সবুজ পাতার মতো গাঢ় সেই প্রেম! প্যাঁচিয়ে হৃদয়
কথা বলে শেকড়ে শেকড়ে! এই তো বৃক্ষজনম!
গাছের খোড়লে যদি লেপ্টে থাকে পাখিজন্ম, তবে
ভূগোলের বই খুলে দেখো : কতদূর গেলে দেখা মেলে
পরিযায়ী পাখিদের ডানা? শিল্পের নিমগ্ন পাঠ নিতে
পারো বাবুইয়ের কাছে! রক্ততোলা ডাকে ডাহুকও
দীক্ষা দিতে পারে মহামিলনের। মিলনেই আছে
সভ্যতার গতি আর যত স্বর্গসুখ! নদীদের কাছে
যদি খোলা বুকে বসো, উড়ে যাবে মন গহিন সুদূরে…
ঢেউ ঢেউ জলে পাখা নেড়ে ঠিক স্বাগত জানাবে
জলকবুতর। তুমিও রোদ্দুর কিংবা জ্যোৎস্নার ফলা;
সভ্যতাকে গড়ে নিতে পারো পরম মমতা আর
শক্তি-বাহুবলে! এ জগৎ মোহময় জাদুকরি মায়া!
রংধনু মুছে গেলে আকাশেই পড়ে থাকে ছায়া!
প্রথম যৌবনের গান
বিশ্বাসের ভিত নড়ে গেলে ঘরে ঢোকে সুতানালি সাপ
দানা বাঁধে গোপন সন্দেহ, হিংসা আর যাবতীয় রিরি!
রিরংসার ঘূণপোকা কুটিকুটি করে সুরভিত অন্তর্বাস;
গৃহকোণে জ্বলে চিতা দাউ দাউ! শ্মশানের ধুলো জলে
ঢেকে যায় ঘরবাড়ি, সবুজ আঙিনা; কথায় কথায়
অগ্নি ঝরে শ্রাবণের জল থইথই মাঠে! বেনোজলে
ভেসে যায় তোরঙ্গ সিন্দুকে তুলে রাখা রাশি রাশি
প্রণয়লিপি! অভিমানের খেয়া যেন ডুবে মরে রোজ
তুমুল ঢেউয়ে! গগনবিদারী বজ্রডাকে মনের গহিন
কোণে ভর করে শঙ্কা-শিহরন! কী বাতাস বয়ে যায়
কদমের বনে! পুরুষ্টু চালতা যেন স্মৃতি উসকে নিয়ে
যায় প্রথম যৌবনে; বকুলের গাঁথা মালা গাঁয়ের
সুঘ্রাণ বিলি করে অমানিশি-অন্ধকারে! এ শহর
বড়ো বেশি ভেকধারী! তবু সুখের লাগিয়া কাঁদে
এ পরান…সুখ কি সহজে মেলে? মেলে শুধু অভিশাপ!
বিশ্বাসের ভিত নড়ে গেলে ঘরে ঢোকে সুতানালি সাপ!
তবু স্বপ্ন দেখি
এমন অসুখ আর কখনো দেখিনি পৃথিবীর পথে…
কী বিষণ্ন আর মায়া মায়া মুখগুলি জীবনের কাছে
আকুতি জানায় : যদি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকি
সবুজ বাতাসে… তবে ভাঁটফুলে লিখে যাবো নাম
আমিও ছিলাম! এই মাটি ঘাসফুল কচুরিপানারা
পায়ে পায়ে বাজে; জলেস্থলে লিখে রাখি শৈশবের
রোদভাঙা ছায়ারাশি যত; ঢেউ ঢেউ স্বপ্নের কুহক!
আমাদের মধ্যবিত্ত দিন সিঁটিয়ে রয়েছে ভয়ে! কারা
যায় কাঁধে নিয়ে যমকালো অন্ধকার? চন্দ্রার রোদ্দুরে
হরিণ শাবক এক পান করে স্বচ্ছতোয়া জল; পৃথিবী
কি পিপাসার্ত খুব? কেড়ে নিতে চায় ডানাঅলা
নদীগুলো! গভীর শঙ্কায় স্তব্ধ হয়ে আছে চরাচর!
তবু স্বপ্ন দেখি, কেটে যাবে অন্ধকার বিজুলির রথে
এমন অসুখ আর কখনো দেখিনি পৃথিবীর পথে!
অলংকরণ : সমর মজুমদার
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD