॥ আদনান সহিদ ॥
‘দ্য অ্যাপল’ (১৯৯৮) ইরানি ফিচার ফিল্মটির মাধ্যমে সামিরা মাখমালবাফ মাত্র ১৭ বছর বয়সে চিত্রপরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এই ডেব্যু সিনেমাটিতে তিনি তাঁর কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। ‘দ্য অ্যাপল’ সিনেমাটি ১৯৯৮ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবের অফিসিয়াল বিভাগে প্রদর্শিত হয় এবং একই সাথে সামিরা কান চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণকারী ‘বিশ্বের কনিষ্ঠতম পরিচালক’ হিসেবে বিবেচিত হন। এমনকি কানে প্রদর্শিত হবার দুই বছর পরেও ‘দ্য অ্যাপল’ বিশ্বের ৩০টিরও অধিক দেশে একশ’রও বেশি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শনের জন্য আমন্ত্রিত হয়।
সামিরা মাখমালবাফের জন্ম ইরানের তেহরানে, ১৯৮৩ সালে। তাঁর পিতা বিখ্যাত ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতা মোহসেন মাখমালবাফের ‘গাব্বেহ’,’সালাম সিনেমা’ ও ‘দ্য সাইক্লিস্ট’সহ অসংখ্য প্রশংসিত সিনেমার সফল কারিগর। ১৯৯৮ সালে সিনেমা পরিচালনায় হাতেখড়ি হলেও সিনেমা জগতে প্রথম পা রাখেন তার পিতা মোহসেন মাখমালবাফের ‘দ্য সাইক্লিস্ট’ (১৯৮৯) সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে।
‘দ্য অ্যাপল’ সিনেমাটি বাস্তব ঘটনার প্রেক্ষিতে সামিরা মাখমালবাফের দৃষ্টিনন্দন ক্যামেরার কাজে নির্মিত। সিনেমাটিতে দেখা যায় ৬৫ বছর বয়স্ক এক পিতা ও দৃষ্টিশক্তিহীন মাতা তাদের ত্রয়োদশবর্ষী দুই জমজ কন্যাকে (জারাহ ও মাসুমেহ) জন্মের পর থেকে প্রায় বার বছর ধরে গৃহবন্দি করে রেখেছেন। ইরানের তেহরানে সমাজকল্যাণ সংস্থার কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেশীদের রিপোর্টিংয়ের পর কিছুটা মানসিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন কন্যা দুটিকে বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়। এরপর এই শর্তে পিতা-মাতার কাছে ফেরত দেওয়া হয় যে তাদেরকে বাড়ির বাইরে বের হতে দিতে হবে এবং বাইরের পৃথিবী প্রদক্ষিণের সুযোগ দেওয়া হবে। এই সত্য ঘটনাটি জানতে পেরে চলচ্চিত্র পরিচালক সামিরা মাখমালবাফ মাত্র চার দিনের মাথায় সিনেমার চিত্রগ্রহণ শুরু করেন। সিনেমায় তিনি কল্যাণ সংস্থার কাছ থেকে মেয়ে দুটির গৃহে প্রত্যাবর্তন এবং মেয়েদের পক্ষে দেয়া ইরানি সমাজকল্যাণ সংস্থার রায়ের বিরুদ্ধে তার পিতার অসন্তোষ প্রকাশের কাহিনি তুলে ধরেন। সিনেমাটিতে অভিনয় করেন সমাজকল্যাণ সংস্থার প্রতিনিধিত্বকারী এক ব্যক্তি এবং মেয়ে দুটিকে ঘর থেকে বাইরে বের করার পর তাদের ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে থাকা সমবয়সী ছোটাে মেয়েরা।
পরিপূর্ণ বাস্তবতার নিরিখে তৈরি এই সিনেমাটিকে সামিরা মাখমালবাফের ভাষায় ‘সেমি ডকুমেন্টারি’ বলা যেতে পারে। চিত্রনাট্যের কারণে এটি ফিকশন হতে পারত আবার এর অভিনেতা-অভিনেত্রী বাস্তব হওয়ায় এটি ডকুমেন্টারির সংজ্ঞায় পড়ে যায়। বস্তুত ‘ইটালিয়ান নিওরিয়ালিজম’ দ্বারা প্রভাবিত সামিরা মাখমালবাফ এ সিনেমায় পেশাদার কোনাে অভিনেতা-অভিনেত্রীকে কাজে নেননি। নেই কোনাে ঘটনার অতিরঞ্জনও। বরং ছবিটিতে প্রকৃতভাবে ফুটে উঠেছে ইরানের সমাজ বাস্তবতা, বিশেষ করে দরিদ্র বা নিম্নবিত্তের সমাজ বাস্তবতা। সাধারণত ইরানি সিনেমায় শিশুদের নিষ্পাপ, নির্মোহ সুন্দর শৈশব তুলে ধরা হলেও ‘দ্যা অ্যাপল’ সিনেমায় বিশেষত নারী ও কন্যা শিশুর মর্মস্পর্শী এক অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে। বাস্তব ঘটনাকে পুঁজি করে সামিরা মাখমালবাফ সিনেমাটিতে ইরানের অতি রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা ও প্রচলিত কঠোর আইনের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। কোনাে আইন বা ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত মানুষের কল্যাণ সাধন করা। কিন্তু যদি তা হিতে বিপরীত হয় তাহলে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
‘দ্য অ্যাপল’ সিনেমায় দীর্ঘ বারাে বছর পর বাসার বাইরে বের হতে গিয়ে তেরাে বছর বয়সী দুই জমজ বোনকে পশুর ন্যায় আচার-আচরণ ও শব্দ করতে দেখা যায়। সুন্দর পৃথিবীর রূপ থেকে তারা বঞ্চিত, বঞ্চিত শিক্ষা থেকে, শারীরিক কর্মকাণ্ড থেকে। তারা ঠিকমতো কথা বলতে জানে না। মানুষের সাথে মিশতে পারে না ,এমনকি জানে না যে একটি আইসক্রিম কিনলে তার মূল্য পরিশোধ করতে হয়! মূলত এটি মানবতার একটি চরম লংঘন। জমজ এই দুই বোনের জীবন ভিন্ন হতে পারত, যদি তারা দারিদ্র্যের মাঝে বসবাস না করত, যদি তাদের মা শুধু তুর্কি ভাষায় কথা না বলতেন অথবা অন্ধ ও বোবা না হতেন অথবা শিক্ষিত হতেন। তাদের জীবন প্রকৃত মুক্তির স্বপ্ন ও বাস্তবতা উপভোগ করতে পারত যদি তাদের দারিদ্র, ধার্মিক কিন্তু অশিক্ষিত পিতা চার দেয়ালের বাইরে প্রকৃত পৃথিবীতে তাদের পদচারণা করতে দিতেন। তাদের পিতার ধর্মবিশ্বাস ও জ্ঞান তার কন্যাদের বাইরে বের হতে রোধ করেছে। এমনকি রাস্তায় খেলারত কোনো বালক যদি তার উঠোনে এসে পড়া বল কুড়াতে দেয়ালের বাইরে থেকে উঁকি দেয়, অথবা তার মেয়েদের গায়ে হাত লেগে যায় তবে তা মেয়ে দুটির জন্য, তার সমাজ ও পরিবারের জন্য অসম্মান বয়ে আনবে বলেও তাঁর বিশ্বাস ছিল। তাদের পিতার ভাষ্যমতে, ‘আমার মেয়ে দুটি হচ্ছে ফুল। আর মানুষের ছোঁয়া হচ্ছে সূর্য। সূর্যের ছোঁয়ায় আমার মেয়ে দুটি গলে ম্লান হয়ে যেতে পারে।’
‘দ্যা আপল’ সিনেমাটি মুক্তির দীর্ঘ ২২ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজও নারী ও কন্যা শিশুদের সাথে ‘ফুলের মতাে’ আচরণের নামে এক অপার ‘বন্দিত্বের দ্বার’ উন্মোচন করা হচ্ছে না তো? জবাব খুঁজে পেতে কষ্ট হবার কথা নয়।
‘দ্য অ্যাপল’ প্রসঙ্গে সামিরা মাখমালবাফ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘দ্য অ্যাপল’ পরিচালনার পর ইরান সম্পর্কে অনেকের কাছ থেকেই নানা প্রশ্ন এসেছে। তারা সবিস্ময়ে মন্তব্য করেছেন, ‘একদিকে দেখছি ইরানে তেরাে বছরের দুটি মেয়ে বার বছর ধরে গৃহবন্দি আছে। আবার অন্যদিকে, সতের বছরের একটি মেয়ে তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র নিয়ে কান চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রিত! আমার মনে হয়, ইরানের মেয়েরা যেন জলপ্রপাত! তাদেরকে যতই চাপ দেয়া হবে, ততই তারা মুক্তির পথে একেবেঁকে এগিয়ে চলবে।’
আজ সমগ্র বিশ্বে করোনার কারণে গৃহবন্দী পৃথিবীর হাজার শিশু ও নারীরা মানসিক ও শারীরিক বিকাশে যে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে নিঃসন্দেহে এই সিনেমার কাহিনিতে কিছুটা হলেও তা প্রতিফলিত হয়েছে। শুধু পার্থক্য এই যে, করোনাকালীন লকডাউনে নারী ও শিশুরা অনিচ্ছায় ‘পরিস্থিতির’ শিকার হলেও, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে নারী ও কন্যা শিশুদের দেশ-কাল-পাত্র ভেদে দৈহিক ও মানসিক ‘শিকারে’ পরিণত করে এক নেতিবাচক পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়া হয়। ‘দ্য অ্যাপল’ সিনেমাটিকে তাই তৎকালীন ইরান তথা সাম্প্রতিক বিশ্বের নারী ও কন্যা শিশুদের প্রতি দমন ও নিপীড়নমূলক আচরণের বিরুদ্ধে যুগপতভাবে এক প্রতিবাদ ও মুক্তির প্রতীক হিসেবে দেখা যেতেই পারে।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD