॥ তুষার আবদুল্লাহ ॥
সেতু পার হলেই অন্য শহর। ট্রাক থেমে গেল সেতুতে ওঠার আগে। রাস্তা থেকে নিচের দিকে নামিয়ে রাখা হলো ট্রাকটি। রাশেদ লাফ দিয়ে নিচে নেমে পড়ে। উচুঁ রাস্তা থেকে দেখা যায় নিচে ট্রাক আর ট্রাক। কোনাে ট্রাকেই মালামাল নেই। অন্যসময় দেখতো খালি ট্রাকের পাশাপাশি পণ্য বোঝাই ট্রাকও থাকতো। এক শহর থেকে অন্য শহরে যাবার সময় বিশ্রাম নিয়ে নিতাে এখানে। নদীতে ভেসে থাকা কার্গোও খালি পড়ে আছে। চারদিকে মানুষজন নেই। মধ্যরাত হলে কি হবে, কখনও এই জায়গাটিকে ঝিঁমুতে দেখেনি রাশেদ। ও এখন চায়ের দোকান খুঁজছে। গাভীর দুধের চা এখানে ভালো পাওয়া যায়। এখানে চা না খেয়ে শহর ছাড়ার অভ্যেস নেই তার।
ট্রাক থেকে লাফ দেয়ার সময় পেছন থেকে বউ ডেকে বলছিল, ‘এই সময় কোন মরা তোমার জন্য চায়ের দোকান খুলে বসে আছে?’
চা, বিড়ি, সিগারেট এমন কি পরােটা-ডিমের খুপড়িও বন্ধ। একটা খুপড়ির সামনে চটের ছালা ঝুলে আছে, কিন্তু বেঞ্চিটা রয়ে গেছে আগের মতোই। রাশেদ বেঞ্চিটার ওপর বসে পড়ে। পকেট হাতড়ে একটা সিগারেট বের করে। কিন্তু ওর সঙ্গে তো লাইটার, দিয়াশলাই নেই! চায়ের দোকানই যখন নেই, দিয়াশলাই খোঁজ করে কী লাভ? বাসা থেকে বের হবার সময় চুলোর পাশে দিয়াশলাইর একটা বাকসো দেখেছিল। নিয়ে এলেই হতো। কিন্তু এদিকটা যে মরুভূমি হয়ে আছে কে জানতো।
বউতো ট্রাকে ছেঁড়া তেনা তুলতেও ভুল করেনি। কিছুই রেখে যাবে না এই শহরে সে। শহরের প্রতি বউ ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে। রাশেদ মালপত্র গোছাতে গোছাতে বলছিল, ‘আর গরম হলে বিপদ আছে। ঘরে আগুন ধরে যেতে পারে। শেষ বেলায় কেলেংকারী নিয়ে শহর ছাড়তে হবে।’
বউ আরও জ্বলে ওঠে, ‘কেলেংকারীর আর বাকি রইলো কী?’
‘হুম’।
রাশেদ কথা বাড়ায়নি। বাড়তে দিতেও চায়নি। সত্যি, কেলেংকারীর বাকিতো কিছু থাকছে না। লজ্জা, অপমানের ষোলাে আনা নিয়ে বাড়ি ছাড়তে হচ্ছে। এই বাড়িটায় যখন উঠেছিল ওরা, রাশেদের বউ এক দেখাতেই পছন্দ করে ফেলেছিল। শোবার রুমের জানলা দিয়ে সামনে একটা তালগাছ দেখা যায়। অনেক লম্বা তালগাছ। সেদিন তালগাছে পাকা তাল ঝুঁলেছিল। তাহলে ওরা কি ভাদ্র মাসে এই বাড়িতে এসে উঠেছিল? কী জানি। এখন তো আর পঞ্জিকা ধরে ফুল ফোটে না। আষাঢ়-শ্রাবনেও কাঁঠাল পাকে। জৈষ্ঠ্যে মাত্র মুচি আসে।
পাপন তখনও কথা বলতে শুরু করেনি। বউ-ছেলেকে ঐ তালগাছ দেখিয়ে ছড়া কেটে পেরুতো দিন-রাত। পাপনের মুখে যখন কথা ফুটতে থাকে, তখন ও নিজেও তালগাছ নিয়ে ছড়া শোনাতো বাবাকে। অফিস থেকে ফিরে তিনজনের সময় কেটে যেত তালেতালে। একদিন পাপন নিজেই একটা ছড়া বানিয়ে ফেলেছিল,
‘তালের পাতায় বৃষ্টি পড়ে,
বাপ তোমাকে মনে পড়ে।’
মোবাইলে সে বাবাকে এই ছড়া শোনানোর পর, অফিসের কাজে সেদিন আর রাশেদ মন বসাতে পারেনি।
ফোটা ফোটা বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ট্রাকে পাপনকে নিয়ে বউ একলা বসা। পলিথিন দিয়ে ট্রাক ঢেকে নিতে হবে। আকাশের দিকে তাকায় রাশেদ। মেঘ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। খুব তোরজোড় করে নামার মুরোদ নেই। রাশেদ ভাবে মেঘের অবস্থাও ওর মতোই। অভিমান, ক্ষোভে ওর মনটাও বিক্ষিপ্ত, কিন্তু তা প্রকাশের মুরোদ নেই। আসলে ও বুঝতেই পারছে না, কার প্রতি ওর ক্ষোভ, অভিমান। ও তো নিজের ছোটাে মফস্বল শহরেই থেকে যেতে পারতো। কবিতা, গান, রাজনীতির পাশাপাশি বাড়ির সামনেই বসে পড়তে পারতো ছোটোখাটো কোনাে দোকান দিয়ে। গ্রামে যতটুকু ফসলী জমি ছিল, সেখানে খামার করেও দিন চালিয়ে নেয়া যেত। ওর তো কখনও তালগাছের চূঁড়োতে উঠার স্বপ্ন ছিল না। তাহলে এমন স্বপ্ন ওর করোটিতে বুনে দিলো কে?
গ্রাম ছেড়ে শহরে চলো। এই গানতো কয়দিন আগেও ফুল ভলিয়মে চলেছে গ্রামে গ্রামে। কোনাে ভবিষ্যৎ নেই গ্রামে। অবিশ্বাস হারাচ্ছিল গ্রামের ছনের ঘর, টিউবওয়েল, পুকুরের মাছ, নকশা পিঠা, লালবিরুই চাল, ঝুঁটিওয়ালা মোরগ, কচু ঘেচু, ডেউয়া থেকে শুরু করে গ্রামে পাওয়া জ্বরের বড়ির ওপরও। শিক্ষা নেই, রোজগার নেই, চিকিৎসা নেই। সব গ্রামের নাম এক হয়ে গেছিল! নেই। সেই নেই থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে সবাই শহরের পথ ধরে। জমিতে ফসল সোনা রং ধরে থাকে, সেই ফলন তুলে আনার মানুষ শহরে মোটরসাইকেলে গতি তোলে কিংবা যন্ত্ররিকশা নিয়ে ছুটে বেড়ায় গলি থেকে গলিতে। শহরে গাড়ির জানালায় গিয়ে হাত পাতাও গৌরবের।
রাশেদ সেই গৌরবের সৌরভ মাখতে কখন যে রওনা হয়ে গেলো, কেন যে শহরে এলো, কোনাে অঙ্কই মেলাতে পারে না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শেখানো, অঙ্কের মাস্টার হওয়া, বায়িং হাউজের মার্চেন্টাইজারের চাকরি। মেরাদিয়া বস্তির মেস থেকে, দিলু রোডের ফ্ল্যাটে ব্যাচেলর মেস, সেখান থেকে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে একা ভাড়া থাকা। কত দ্রুত তালগাছ বেয়ে উঠে যাওয়া। এই উঠতি পথেই দেখা বউ চুমকির সঙ্গে। চুমকিও এই শহরের মেয়ে নয়।
চুয়াডাঙ্গার এক অজ পাড়াগাঁয়ের মেয়ে। কল সেন্টারের চাকরি নিয়ে শহরে এসেছিল। মেয়েদের হোস্টেলে শহর জীবনের শুরু। কল সেন্টার থেকে সুপার শপে। সেখানেই রাশেদের সঙ্গে পরিচয়। সুপার শপে বাজার করার অভ্যেস ছিল না। একদিন সময় কাটাতে এমনিতেই সুপার শপে ঘুরে বেড়াচ্ছিল রাশেদ। সেখানেই চুমকির চোখে চোখ আটকে যায়। তারপর নিয়মিত যাতায়াত, রেজার কেনার উছিলায়। চুমকিই ধীরে ধীরে ওকে ঝামেলা মুক্ত রান্নাবান্নার লোভ দেখিয়ে প্যাকেটে কুটে রাখা মাছ, সবজি কিনতে অভ্যস্ত করে। নাস্তাটাও দুধ আর কর্ণফ্ল্যাক্সে নিয়ে আসে।
রাশেদ উঠে পড়ে। শহরের শেষ চা খাওয়া আর হলো না। ওদিকে পাপনকে নিয়ে ট্রাকের মালপত্রের ওপর বৃষ্টিতে ভিজছে চুমকি। বৃষ্টির গতি বাড়ছে। রাশেদ মুখ হা করে কয়েক ফোটা বৃষ্টির জল খেয়ে নেয়। এমনটা সেই ছোটােবেলা থেকেই অভ্যেস। ওরা যেদিন নিজেরা কাজী অফিস থেকে বিয়ে করে ফিরছিল, তখন হঠাৎ আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। হুডখোলা রিকশায় সেদিন ওরা দুজনেই হা করে মেঘের সরবত পান করেছিল। ওমন মূহুর্ত খুব একটা আসেনি। দুজনে কাজ শেষ করে যখন ঘরে ফিরত, তখন ক্লান্তি নিয়েই পরের দিনের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিত তারা। পাপন আসার পর চুমকি আবদার করে, ‘আমি একটু বিরতি নেই, তোমার খুব কষ্ট হবে, না?’
কষ্ট হচ্ছিল কিনা রাশেদ বুঝতে পারেনি। একজনের রোজগারে বাড়িভাড়া, পাপনের স্কুল, খাওয়া-দাওয়া, মাঝে মধ্যে রেস্টুরেন্ট, কক্সবাজারে চলে যাওয়া, বেহিসেবি হয়েও চুমকি কেমন করে যেন সব সামলে নিয়েছে। কিন্তু এবারের আষাঢ়ে এসে মাথার ওপর ঠিক আকাশ ভেঙে পড়লোই। শহরটাই কেমন গ্রামের মতো নাম নিয়ে নিলো। বেতন না। চাকরি না। বাড়িভাড়া না। খাবার না। চিকিৎসা না। নতুন স্বপ্ন না। শহরের নাম এখন, ‘না’। এই যে গাভীর দুধের চা খেতে ইচ্ছে করলো সেখানেও না।
রাশেদ দূর থেকে দেখে ট্রাক ঘিরে কিছু মানুষের জটলা। চুমকি চিৎকার করে কী যেন বলছে। কাছে যেতেই ভিড়ের লোকগুলো ওর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ওরা রাশেদদের ট্রাক আটকে দিয়েছে। টাকা ছাড়া শহর ছাড়তে দেবে না। রাশেদ কিছু বলে না। হাসে। ওর হাসি দেখে চুমকি বিস্মিত হয়। রাগও হয় তার। ওর আর এক মূহুর্ত এ শহরে থাকতে ইচ্ছে করছে না। সেতু পেরোতে পারলেই বাঁচে। রাশেদের হাতের সিগারেট বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেছে। ও হাসতে হাসতে লোকগুলোকে বলে, ‘ভাই এক কাপ গাভীর দুধের চা খাওয়াতে পারবেন? না হলে একটা দিয়াশলাইর কাঠি। গরীবের শেষ ইচ্ছা ভাই।’
—
দেশের বই পোর্টালে লেখা পাঠাবার ঠিকানা : desherboi@gmail.com
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD