অর্থহীন ভালোবাসা
॥ মনোয়ার মোকাররম ॥
শরত বিদায় নিয়েছে কিছুদিন হলাে। কিন্তু শারদীয় আকাশটা এখনো রয়ে গেছে। পরিস্কার স্বচ্ছ ঝকঝকে নীল আকাশ। তার বুকে কাশফুলের মতাে সাদা ধবধবে মেঘের আনাগোনা, যে মেঘের মন খুব ভালো, কান্না হয়ে ঝরার কোনাে আলামত নেই। ওপরে স্বচ্ছ নীল আকাশের ঝকঝকে রূপ ফিকে হয়ে আসছে একটু একটু করে। দিনের আলো নিভু নিভু করছে। এমনি এক সময়ে ফিকে হয়ে আসা নীল আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আছে দুটি মানব শিশু।
দুই ভাই-বোন তারা, গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। বোনের এক হাতে মুঠো করে ধরা ভাইয়ের এক হাত। পিঠেপিঠি বড়াে হয়েছে দু’জন। ঠিক এই মূহুর্তে ওরা দাঁড়িয়ে আছে ওদের বাড়ির গেট পেরিয়ে কিছুটা দূরে। ভুল বলা হলো। ওদের বাড়ি নয় , ওরা এ বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকে। টিনশেডের একতলা বাড়ি। ইট, বালি, সিমেন্টের ক্ষয়ে যাওয়া শরীর আর ঘুনে ধরা কাঠের দরজা-জানালা নিয়ে তারই মতাে ক্ষয়ে যাওয়া আর ঘুনে ধরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো, ভাগ্যের সন্ধানে যারা লাল নীল বাতির এই শহরে পাড়ি জমায়, তাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। নিতান্ত অবহেলায়। অনেক দিন চুনকাম করা হয়নি। হয়তো আরো অনেক দিন হবে না। তার জন্যে সৌন্দর্য্যটা বাহুল্য, টিকে থাকাটাই উদ্দেশ্য, টিকে থাকাতেই স্বার্থকতা। রংচটা জরাজীর্ণ টিনের গেট। একটা সরু ছোটাে গলির ভেতর বাড়িটা। ওরা দাঁড়িয়ে আছে সেই গলির শেষ মাথায় যেটা এসে মিশেছে বড়াে রাস্তার সাথে।
বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা প্রহর। এই সময়টাকে গোধুলি বেলা বলা যাবে না। তারও বেশ কিছু আগেকার বেলা। সেই গোধুলি বেলার আগেকার সময়টাতেই দু’ভাই-বোন গায়ে গা ঘেঁষে আক্ষরিক অর্থেই গোধুলি দেখছে। গোধুলি অর্থাৎ গরুর পায়ের ধূলি। বড়াে রাস্তা ধরে একটু পরপর চার-পাঁচজন মানুষের একটি করে দল গরু হাকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বড়াে গরু, মাঝারি গরু, ছোটাে গরু। বড়াে শিংওয়ালা গরু, ছোটাে শিং ওয়ালা গরু, সাদা গরু, কালো গরু, সাদা-কালো মেশানো, লাল গরু, আরো কত কি! একটা মহিষও গেছে। ছাগলও দেখা যাচ্ছে। এই সব চারপেয়ে প্রাণীগুলো বড়াে রাস্তার ইট-পাথর আর ধুলো মেশানো পথে ধুলো উড়িয়ে গোধুলি বেলার অনেক আগেই এই যান্ত্রিক নগরে আক্ষরিক অর্থেই গোধুলির আবহ নিয়ে এসেছে।
আর কয়েকদিন পরেই কোরবানির ঈদ।
লোকজন পশুর হাট থেকে পশু কিনে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। ভাই-বোন মিলে রোজ এ সময়টাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব দেখে। বড়াে গরু, মাঝারি গরু, ছোটাে গরু। সাদা, কালো, লাল রংয়ের গরু, শিংওয়ালা গরু, মহিষ, ছাগল এইসব।
ভাই-বোন মিলে একটা সুন্দর খেলাও আবিষ্কার করে ফেলেছে। একটা গরু দেখামাত্রই দুজন গরুটির দাম অনুমান করছে। তারপর কৌতুহল ভরে তাকায় তারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার বাম দিকে অর্থাৎ তাদের ঠিক সামনেই গায়ে গা লাগানো দূরত্বের মুদি দোকানটির দিকে। সেখানে সারাক্ষণ ঘাড় উচিঁয়ে বসে থাকে দোকানদার মজিদ মিয়া। লোকটির বাড়ি বরিশাল, তাই সবাই তাকে ডাকে বরিশাইল্লা বলে। কাছাকাছি আরো একটি দোকান আছে, যার মালিক নোয়াখাইল্লা, হামিদ আলি। নিজের জন্মস্থানের সূত্রে প্রাপ্ত এই নামের জন্যে হামিদ আলি মাঝে মাঝে চরমভাবে রেগে গেলেও মজিদ মিয়া কিছু মনে করেন না। যখনই গরুর মালিক গরুটি নিয়ে মজিদ মিয়ার সামনে দিয়ে যাবেন, মজিদ মিয়া বলবেন, ভাইসাহেব, দাম কত পড়ল? গরুর গর্বিত মালিক যখন চোখে মুখে হাসির ঝিলিক এনে দামটি বলেন, তখন ভাই-বোনের একজনের চোখে মুখেও হাসির ঝিলিক উঠে, বিজয়ের হাসি। বিজয়ের হাসি সে বড়াে মধুর। আর বেশিরভাগ সময় এ হাসিটা হাসে মেয়েটি। তার অনুমান শক্তি অনেক প্রখর এতে কোনাে সন্দেহ নেই।
এই খেলা শেষ হয় যখন সন্ধ্যা নেমে আসে তখন। এই নগরে কখনো ঝুপ করে সন্ধ্যা নামে না। এখানে সন্ধ্যা নামে নিয়ম করে। সন্ধ্যা হলে এখানে পাখিরা নীড়ে ফেরে না, এই নগরজীবনে সন্ধ্যা হলে বাবারা অফিস শেষে বাসায় ফেরেন। ভাই-বোন দুটিও বাসায় ফেরে। সন্ধ্যার সাথে কেমন যেন একটা সমাপ্তি গন্ধ জড়িয়ে থাকে। সন্ধ্যা মানেই যেন অনেক কিছুর সমাপ্তি। আপাতত ভাই-বোন দুটির খেলা সমাপ্ত হলো। তারা ঘরে ফিরে এলো।
২.
বশির সাহেব রাতের খাবার খেতে বসেছেন। মেঝেতে একটি পুরনো বিছানার চাদর ভাঁজ করে বিছিয়ে খাবারের আয়োজন করা হয়। মাঝখানে তিনি বসেন, দুই পাশে থাকে তার দুই মানিক , আরিফ ও নীরু। বশির সাহেবের স্ত্রী মনোয়ারা কখনো তাদের সাথে খেতে বসেন না। তিনজন মানুষ তৃপ্তি করে খায়। মনোয়ারা দেখেন, না খেয়েও তিনি তৃপ্তি পান। সবার খাওয়া শেষ হলে, তিনি নীরবে, নিভৃতে, সবার অগোচরে নিতান্ত অগুরুত্বপূর্ণভাবে তার খাওয়া শেষ করেন। এভাবেই তিনি বিয়ের ১৪টি বছর পার করে দিয়েছেন। বাকি জীবনটাও হয়তো পার করে দিবেন। তাতে তার কোনাে আক্ষেপ, দুঃখ-কষ্ট, ক্ষোভ বা অভিযোগ নেই। তিনি ভালোই আছেন।
খাবার সাজানো হয়েছে। সাজানো বলতে যা বোঝায়, সামনে অনেক পদের তরকারি, সেরকম কিছু নয়। তিনটি পুরনো মেলামাইনের প্লেটে ভাত, একটি মাঝারি সাইজের প্লাস্টিকের বাটিতে ডাল আর একটি ছোটাে বাটিতে আলুভর্তা। আলুভর্তার সাথে ডাল খুব যায়। সাথে তেলে ভাজা শুকনো মরিচ। মাসের অনেকগুলো দিন এই পদগুলোই থাকে। কিন্তু স্বাদ যেন কমে না। কিংবা তারা কমতে দেন না।
সরকারি অফিসে ছোটাে একটা চাকুরি বশির সাহেবের। বেতন সর্বসাকূল্যে পনের হাজার টাকার মতো। পনের হাজার টাকা মানে পনের হাজার টাকাই। সরকারি অফিসে চাকুরি শুনলেই অনেকে বেতনটাকে আর আমলে নিতে চান না। কিন্তু বশির সাহেবের মতো অনেকেই আছেন যারা সেসব পথে হাঁটেন না, আর সে সংখ্যাও কম নয়। এ নিয়ে তার মনে কোনাে আক্ষেপ বা দুঃখবোধ নেই। টেনেটুনে সংসার চলে যায়। দুইকূলে বশির সাহেবের কেউ নেই। তাই কোনাে বাড়তি পিছুটান নেই। অনেক দোয়া-মানত করে, অনেক পীরের দরগায় শিরনী দিয়ে তার মা-বাবা তাকে এই পৃথিবীতে এনেছিলেন। তিনিই শুরু, তিনিই শেষ। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বংশ রক্ষা হয়েছে এই যা। মা-বাবা অনেক আগেই তাকে একা রেখে চলে গেছেন। কুমিল্লায় যা কিছু ভিটেমাটি, জায়গা-জিরেত আছে, তার এক চাচাত ভাই দেখা শোনা করে। লাভের লাভ, খোরাকির কিছু চাল জুটে যায়। তার সাথে ডাল, ভর্তা, মরিচ আর পীরের দরগায় তার মা-বাবা যে শিরনী দিয়েছিলেন তার রহমতে সংসার চলে যাচ্ছে কোনােমতে।
খাওয়ার সময় বশির সাহেব যতটা সম্ভব চুপ করে থাকেন। অতিরিক্ত কথা তিনি বলেন না, অতিরিক্ত কথা তিনি পছন্দও করেন না। খাওয়ার সময় তো আরও না। খাওয়া হচ্ছে ইবাদতের সমান। ইবাদতের সময় কথা বলা সমীচীন নয়।
হঠাৎ নীরবতা ভেঙ্গে নীরু বাবার গায়ের সাথে ঘেষে গলায় আহ্লাদের সুর এনে বলল,
– জানো বাবা, আজকে না ভাইয়া আমার কাছে খেলায় হারছে।
– খেলা? কী খেলা? বশির সাহেব জানতে চান।
তখন নীরু অত্যন্ত যত্নের সাথে বাবাকে বোঝায়। কীভাবে তারা গরু-ছাগলের দাম অনুমান করে সেই খেলার কথা। বশির সাহেব খুব আগ্রহ নিয়ে মেয়ের কথা শোনেন। বাচ্চাদের কথা আগ্রহ নিয়ে না শুনলে তারা মনে কষ্ট পায়। বশির সাহেব তার বাচ্চাদের মনে কোনাে কষ্ট দিতে চান না।
– ও আচ্ছা, এই কথা। সব শুনে বশির সাহেব মৃদু হাসলেন।
নীরু বলে, হুম।
বশির সাহেব আবারও হাসেন। তার মেয়েটি হয়েছে তার মায়ের মতােন। অনর্গল কথা বলতে পারে। আর মায়ের মতোই বুদ্ধিমতি। সেই তুলনায় ছেলেটি একদমই নিশ্চুপ ধরনের হয়েছে। একদমই তার মতাে। তবে বুদ্ধি অবশ্যই তার থেকে বেশি।
বশির সাহেব নিজে যদিও অত্যধিক কথা পছন্দ করেন না, কিন্তু মেয়ের কথায় কখনোই তিনি বিরক্ত হন না। যতক্ষণ মেয়ে কথা বলে মনে হয়, যেন কাচের চুড়ি হাতে আর নূপুর পায়ে সারাক্ষণ ঘরময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে কোনাে এক কিশোরী। আচ্ছা মেয়েটাকে কিছু কাচের চুড়ি কিনে দিলে কেমন হয়? বশির সাহেব ভাবেন। যদিও চুড়ি পরার মতাে বয়স নীরুর হয়নি। তবে নূপুর কিনে দেওয়া যেতে পারে। বশির সাহেব আবারও হাসেন। সে হাসি কারো দৃষ্টিগোচর হয় না।
– বাবা?
– হুম। নীরুর ডাকে বশির সাহেবের মগ্নভাব কাটে।
– আমরা কোরবানি দিব না?
বশির সাহেব থমকে যান। মেয়েকে কী বলবেন ভেবে পান না। উত্তরটা অবশ্য কঠিন কিছু নয়। তার যা আয় তাতে তাদের পক্ষে কোরবানি দেওয়া সম্ভব নয়। আর সামর্থ্যের কথা চিন্তা করলে, তার ওপর কোরবানি ফরজ- এ কথাও বলা যায় না। কিন্তু রবি ঠাকুর বলে গেছেন, সহজ কথাটি যায় না বলা সহজে। তাই বশির সাহেবও সহজ কথাটি সহজে বলতে পারলেন না। তার মেয়ের মন তিনি ছোটাে করতে পারবেন না। তবে তার নয় বছরের মেয়ে যে আর সেই ছোট্টটি নেই তা তিনি ভালােই বুঝতে পারছেন। কই, মেয়ে তো গতবার কিছু বলেনি। মেয়ের কথায় তিনি সম্বিৎ ফিরে পেলেন।
– কী হলো বাবা, কথা কও না কেন? আমরা কোরবানি দিব না?
বশির সাহেব অসহায় বোধ করলেন। মনোয়ারা ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি মেয়েকে কৃত্রিম ধমকের সুরে থামিয়ে দিলেন।
– কথা বন্ধ। খাওয়ার সময় এত কথা কীসের। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো, রাত অনেক হইছে। ঘুমাইতে হবে।
মেয়ে কিছুটা চুপ মেরে যায়।
বশির সাহেবের অসহায় ভাব কিছুটা দূর হলো। স্ত্রীকে যতটা বুদ্ধিমতি তিনি মনে করেন, মনে হয় সে তার চেয়েও বেশি। হঠাৎ করেই যেন স্ত্রীর প্রতি তার কিছুটা ভালোবাসা জন্ম নিল, কিছুটা শ্রদ্ধাও। মনে মনে এমন বুদ্ধিমতি এক মহিলাকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়ার জন্যে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন।
৩.
নীরুদের বাসা থেকে বড়াে রাস্তার মাঝে যে আরও দুটি বাড়ি সে বাড়ির একটি গেটে বিশাল ধুন্দুমার কাণ্ড। বিশাল বড়াে শিংওয়ালা এক কালো গরু বাধা। এ বাড়ির যিনি মালিক, গরুর মালিকও তিনি। গতকাল রাত্রে তিনি এ গরু কিনেছেন। সকালে ঘর থেকে বেরিয়েই নীরু দেখতে পেয়েছে। সারাক্ষণই ওখানে একটা জটলামতােন তৈরি হয়ে থাকছে। মিতুর বাবা, গরুর মালিক, গরুকে খাবার দিচ্ছেন। কখনও বা মিতু। মিতুদের বাড়ির অন্য ভাড়াটিয়ার ছেলেমেয়েরা মিলে গরুর আদর যত্নের কোনাে খামতি করছে না। মিতুর সাথে নীরুর ভালো খাতির। সেই সুবাদে গরুর সাথেও ভালো খাতির হয়ে গেল। মিতু-নীরু ক্ষণে ক্ষণে এক গাছি দু’গাছি খড় এগিয়ে ধরছে মুখের সামনে। নীরুর অনেক ভয় লাগছে আবার ভালোও লাগছে। কিন্তু একটু একটু লজ্জাও লাগছে। গরুটি তো আর তাদের নয়। শিশুরা বয়সে ছোটাে হতে পারে, কিন্তু তাদের লজ্জা, সে মোটেও ছোটাে নয়। এমনিতে শিশুদের কচি মনে লজ্জা নামক অনুভূতি সহজে আসে না। কিন্তু যখন আসে, তখন তা আর হেলাফেলার জিনিস থাকে না। নীরুর লজ্জাও হেলাফেলার জিনিস নয়।
৪.
রাতে খাবার সময় নীরু বাবাকে মিতুদের গরু কেনার কথা জানালো। খাবার সময় ছাড়া বশির সাহেবকে খুব একটা ঘরে পাওয়া যায় না। অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যার পর প্রায় পুরো সময়টা তিনি বাইরে ঘোরাঘুরি করে কাটান। মিতুদের গরু তিনিও দেখেছেন। সে এক দেখার মতাে গরু বটে। কিন্তু তবু তিনি মেয়ের কথায় গভীর উৎসাহ দেখালেন, যেন তিনি এইমাত্র জানলেন।
আরো কিছু কথা হলাে। হঠাৎই নীরুর প্রশ্ন,
– বাবা, আমরা কোরবানি দিব না? আমাদের গরু আনবা না?
বশির সাহেব খাবার চিবুতে থাকেন, চিবুতেই থাকেন। যেন অনন্তকাল ধরে এই খাবার চিবানোর কাজটা করতে পারলেই তিনি এই পৃথিবীর সবচে সুখী মানুষ হয়ে যেতেন। কিন্তু সম্ভবত তার কপালে এত সুখ নেই। তাই নীরু আবার মুখ খোলে,
– কিছু বলো না কেন বাবা?
মনোয়ারা আগের মতোই সক্রিয় হন ত্রাণকর্তার ভূমিকায়।
– কথা বন্ধ। খাওয়া শেষ করাে।
কিন্তু আজ আর নীরুর কথা বন্ধ হয় না। সে বলে চলে,
– মিতুর বাবা গরু কিনছে। কত্ত বড় কালো গরু। আমার ওদের গরুরে খড় খাওয়াইতে ভালাে লাগে না।
– ভালো লাগে না, তো যাও কেন? না গেলেই হয়। মনোয়ারা ধমক দেন।
– আমি আমাদের গরুরে খাওয়াব, আমাদের গরু কিনে আনাে। নীরু জেদ ধরে।
বশির সাহেব একের পর এক লোকমা গিলে চলেছেন। একটু আগে তার মন চেয়েছিল অনন্তকাল ধরে মুখ বন্ধ করে খেয়ে চলতে। কিন্তু এখন তিনি দ্রুত খাওয়া শেষ করে উঠতে চাচ্ছেন। একটু বাইরে বেরিয়ে আসবেন আবার। কিন্তু খাবার যেন ফুরোতে চাইছে না। তার মনে হলো, তিনি অনন্তকাল ধরে মেঝেতে বসে ডাল মাখা ভাত খেয়ে চলেছেন।
মনোয়ারা এবার কঠিন গলায় বললেন, কী এক গরু গরু করে পাড়া মাথায় তুলছাে। মাথার ভিতর কিছু একটা ঢুকলে আর বের হয় না। কথা না বলে ভাত খাও।
মেয়ে আরো জেদি হয়ে ওঠে।
– না, আমি খাব না। রোজ রোজ এই ডাল দিয়ে খাইতে ভালাে লাগে না। এই বলে সে সজোরে তার সামনে ভাতের প্লেট সরিয়ে দিল। তা গিয়ে ধাক্কা খেল ডালের বাটিতে। যেটুকু ডাল ছিল তা ছিটকে গিয়ে পড়ল বশির সাহেবের কোলের উপর, কিছুটা গিয়ে তার মুখেও পড়ল।
ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই কিছুটা হকচকিয়ে গেল। বশির সাহেব চিরদিন ঠান্ডা মাথার মানুষ। কিন্তু এ যেন জগতের এক আজব নিয়ম। ঠান্ডা মাথার মানুষেরা দরকারের সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন না, আবার গরম মাথার মানুষেরা যখন মাথা গরম করা দরকার ঠিক তখুনি কেন যেন জমে বরফ হয়ে যান। বশির সাহেবও মাথা ঠান্ডা রাখতে পারলেন না। তিনি মাথা গরম করলেন এবং সেই উত্তপ্ত মস্তিষ্কের ফলসরূপ তিনি মেয়ের গালে ডালমাখা হাতেই সশব্দ এক চড় বসিয়ে দিলেন। এই ঘটনার আকস্মিকতায় নীরুর ভাইটি ভয়ে জড়সড় হয়ে গুটিয়ে গেল। আর বশির সাহেব কী করলেন তা বুঝতে না পেরে কিংবা বুঝতে পেরেই পলকহীন দৃষ্টি মেলে বসে রইলেন। যথারীতি ত্রাণকর্তার ভূমিকায় মনোয়ারা। তিনি উঠে এসে মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন। মেয়ে কেঁদে মায়ের বুক ভাসিয়ে দিতে লাগল।
৫.
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বশির সাহেব উঠে বসেন। বাতি জ্বালিয়ে মেয়ের কাছে যান, বিড়বিড় করে কিছু বলেন। তিনি কাঁদছেন। এবং যথাসম্ভব চেষ্টা করছেন মনোয়ারা বা তার ছেলেটি যেন না জাগে। কিন্তু মনোয়ারা জাগলেন কিংবা হয়তো তিনি জেগেই ছিলেন। তিনি দেখলেন বশির সাহেব ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। তার কান্না এখন ফোপানো থেকে গোঙানিতে রূপ নিয়েছে। তিনি স্বামীর কাছে গেলেন এবং পরম ভালোবাসায় স্বামীকে আকড়ে ধরলেন। বশির সাহেব এখন শব্দ করে কাঁদছেন।
৬.
বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা নামি নামি করছে। ফিকে হয়ে আসা শারদীয় নীল আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আছে দুটি মানব শিশু। ওরা দাঁড়িয়ে আছে সেই গলির শেষ মাথায় যেটা এসে মিশেছে বড়াে রাস্তার সাথে। খেলছে তাদের সেই দাম অনুমান খেলা। প্রতিদিনের মতােই দূর থেকে একজনকে দেখা যাচ্ছে একটি ছাগল তাড়িয়ে নিয়ে আসছেন। ছাগলের মালিক নিকটবর্তী হতেই মজিদ মিয়া হাক দিলেন, ভাইজান, বকরি কত নিল?
বকরির মালিক বকরির দাম কত বললেন দুই শিশুর সেদিকে কোনাে ভ্রুক্ষেপ নেই। পৃথিবীর সমস্ত বিস্ময় চোখে নিয়ে তারা দেখল যে, বকরির যিনি মালিক তিনি আর কেউ নন, তাদের বাবা, বশির সাহেব। তিনি পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ তার চোখে নিয়ে ছাগলের দড়ি তার মেয়ের হাতে দিয়ে বললেন, দড়িটা শক্ত করে ধর, নইলে ছুটে পালাইবো কিন্তু।
৭.
ঈদের বাকি আরও সপ্তাহখানেক। কিন্তু বশির সাহেবের ঘরে তার আগেই ঈদ চলে এসেছে। তার পরিবারে যুক্ত হওয়া নতুন সদস্য টিঙ্কুকে নিয়েই এই আনন্দ। টিঙ্কু হচ্ছে কোরবানির জন্যে কিনে আনা ছাগলটির নাম। নামটি দিয়েছে নীরু। বশির সাহেব মাঝেমধ্যে মেয়েকে নিয়ে গল্প করতেন আর কাগজ দিয়ে বিচিত্র সব জন্তু জানোয়ার বানিয়ে দিতেন। কোনাে কারণ ছাড়াই, সেগুলোর তিনি নাম দিতেন টিঙ্কু। মেয়ে বাবার কাছ থেকে নাম ধার করে সর্বভূক এই প্রাণীটির নাম দিয়েছে টিঙ্কু। গরু গরু করে এই কয়দিন বশির সাহেবকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখলেও গরুর বদলে ছাগল পাওয়ায় মনক্ষুন্ন হওয়ার কোনাে লক্ষণ দেখা গেল না। বরং অনেকটাই খুশি মনে হলো। ছেলেমেয়ের খুশিতে বশির সাহেব খুশি। আর সবার খুশিতে মনোয়ারাও খুশি। এই খুশি কেনার জন্যে যে তাকে যক্ষের ধনের মতাে আগলে রাখা সোনার চেইনটি বিসর্জন দিতে হয়েছে তার জন্যে এখন তার আর কোনাে আক্ষেপই রইল না।
৮.
স্কুল ছুটি, ঈদের আবহ, পড়াশোনার অত চাপ নেই। নীরুর এখন সারাদিন কাটে টিঙ্কুকে নিয়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই একবার টিঙ্কুর সাথে দেখা। তারপর ভাই-বোন মিলে টিঙ্কুকে নিয়ে যাবে তাদের বাড়ির গেটে যেখানে সন্ধ্যা হওয়ার আগ পর্যন্ত কাটে টিঙ্কুর সারাবেলা। রাতে অবশ্য ঘরেই থাকে তাদের সাথে। একইঘরে তারা পাচঁটি প্রাণী- চারজন মানুষ আর একটি নির্বাক প্রাণী। আরিফ-নীরুর সারাবেলা কাটে তাকে ঘিরেই। সেই সারাবেলায় আরিফ নীরুর অনেক সহকারীও জুটে গেছে। মিতুও যোগ দিয়েছে তাদের সাথে। তাদের গরুর চাইতে নীরুদের টিঙ্কুকেই মিতুর মনে ধরেছে বেশি। নির্ভয়ে এর কাছে যাওয়া যায়। শিংয়ের গুতো খাবার ভয় নেই। চাইলেই গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দেয়া যায়। কান মলে দেয়া যায়, শিং ধরা যায়। দুর্বলের উপর মানুষ কেবল অত্যাচার করে এটা বোধ হয় পুরোপুরি ঠিক নয় , কখনো কখনো দুর্বলকে মানুষ ভালোও বাসে।
৯.
আজ ঈদ। মদীনার ঘরে ঘরে আনন্দ। এইরকম কথা নীরু বইতে পড়েছে। তবে বাস্তবে আজ নয়, কাল ঈদ। সব ঘরে ঘরে আনন্দ কি না, তা সে জানে না। তবে সে জানে কাল তার মনে আনন্দের সীমা থাকবে না। শুধু সে কেন, বাবা, মা, ভাইয়া সবাই অনেক খুশি থাকবে। যে উপলক্ষ নিয়ে এই খুশির দিনটি আসে, সেটি তারা এবার উদযাপন করতে পারবে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্যের কোরবানি দেখতে হবে না। অন্যদের বাড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চামড়া ছাড়ানো, মাংস কাটাকুটি দেখতে হবে না। এবার এসব কিছু তারা নিজেরাই করবে। কোরবানি দেওয়ার পর চামড়া ছাড়ানোর সময় বাবা হয়তো এক হাতে ছুড়ি আর আরেক হাতে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলবে, কীরে? হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? নে, তোরা দুইজনে দুইটা ঠ্যাং টান টান করে ধর। এসব চিন্তা করতেই নীরুর ছোট্ট মনে খুশির বড়াে একটা ঢেউ খেলে গেল।
১০.
আজ নীরু খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছে। আরিফকেও ডেকে তুলেছে। গোসল করে নতুন জামা পড়েছে। জামা অবশ্য নতুন নয়, গত রোজার আগের রোজার ঈদে কিনেছে। খুব যত্ন করে তুলে রাখা ছিল। যখনই এ জামা গায়ে চাপায় তখনই তা নীরুর কাছে নতুন বলে মনে হয়। কিংবা নতুন মনে করে নেয়। এ নিয়ে তার ছোট্টো মনে বিশেষ কোনাে দুঃখ বা আক্ষেপ নেই, আজ তো নয়ই। সে ভালোই আছে। তাদের বাড়ির গেটের কাছে তাদের বাবা, বশির সাহেব ছাগলের দেখ-ভাল করছেন। জবেহ করার আগে পশুকে গোসল করাতে হয়। তিনি ছোটাে একটা বালতি আর মগ নিয়ে বসেছেন। মগ দিয়ে ছাগলের গায়ে আস্তে আস্তে পানি ঢালছেন। নীরু এসে দাঁড়িয়েছে। বাবাকে মাঝে মাঝে উপদেশও দিচ্ছে। মাথায় যেন পানি না ঢালে, কানে যেন পানি না ঢুকে। নীরু শুনেছে ছাগলের কানে পানি গেলে ওদের অনেক কষ্ট হয়। বশির সাহেব টিঙ্কুর সামনে পানি, খৈল আর ভূষির মিশ্রণ রেখে উঠলেন, ঈদের জামাত ধরবেন বলে। তিনি প্রথম জামাতটাই ধরবেন। তিনি চেষ্টা করেন সবকিছুতেই সামনের দিকেই থাকতে, যদিও জীবনের দৌড়ে তিনি অনেকটাই পেছনে পড়ে আছেন, অনেক পেছনে! জীবনের রেসে সামনে থাকার উপায়টা তার জানা নেই, কিংবা তার জানার কোনাে ইচ্ছেই ছিল না অথবা সেই ইচ্ছেটা কোনাে এক সময় মরে গেছে হয়তো। এও পৃথিবীর এক আজব নিয়ম। যারা সবকিছুতেই সবসময় সামনে থাকার চেষ্টা করেন, আসল জায়গাতেই তারা সবার চেয়ে পিছিয়ে থাকেন। আগে গেলে বাঘে খায়। বশির সাহেব ভাবেন, তাকেও বোধ হয় কোনাে এক রয়েল বেঙ্গল টাইগার নীরবে খেয়ে চলেছে, খেয়েই চলেছে।
১১.
নীরুদের সরু গলির বাসার গেটের সামনে ছোটখাট একটা জটলা। লোক সমাগম তেমন আহামারি কিছু নয়। নীরুর খেলার সাথীরা, এতদিনকার সহকারীরা। জটলার উপলক্ষ আর কিছু নয়। ঈদের জামাত শেষ হয়ে গেছে। পশু কোরবানী দেয়া শুরু হয়ে গেছে। একটু আগে মিতুদের গরুটিকে জবেহ করা হয়েছে। নীরু দেখেছে। সে এক তুলকালাম কাণ্ড। সবাই মিলে মাটিতে ফেলে জাপটে ধরে আছে গরুটাকে। কেউ ধরেছে ঠ্যাং, কেউ ধরেছে লেজ। একজন মাথাটা চেপে ধরে আছে। আর গোটা চারেক লোক সারা শরীরটাকে চেপে ধরে আছে। কিন্তু তারপরেও গরুটা বারতিনেক প্রায় উঠেই গিয়েছিল। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার! নীরুদের সেই সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। নীরুর বাবা আর একজন মিলেই টিঙ্কুকে কাবু করে ফেলেছে। টিঙ্কু উঠতে পারছে না কিংবা উঠার চেষ্টা করছে না। সে হয়তো জানে বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই। মিতুদের গরুর মতাে ক্ষমতা তার নেই। কিংবা অহেতুক লাফঝাপ করে সে নীরুর মনে কোনাে কষ্ট দিতে চায়নি। নীরু তো এই দিনটির জন্যেই অধীর আগ্রহে দিন গুনেছে। শুধু নীরু কেন? তার মা, আরিফ, বাবা-সবাই। আজ যে তাদের বড়াে খুশির দিন। এই খুশিতে কোনাে বিঘ্ন ঘটুক টিঙ্কু হয়তো তা চায়নি। মনোয়ারা গেটের ভেতর থেকে বড়াে ঘোমটার ফাঁক গলে তাকিয়ে আছেন। তার চোখ-মুখে আনন্দ, কিছুটা আবার সহানুভুতিও আছে সে চোখের চাহনিতে। হুজুর তার রক্তমাখা পাঞ্জাবির হাতা গুটানো হাতে টিঙ্কুর গলার কাছে বড়াে ছুরিটা ধরে কুজো হয়ে ঝুলে দাঁড়িয়ে আছেন। অসহায় চোখের কালো কুচকুচে টিঙ্কু মাটিতে পড়ে আছে। সবকিছুই প্রস্তুত, শুধু সেই মাহেন্দ্রক্ষণটির অপেক্ষা। কিন্তু তার আগেই উপস্থিত সকলকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বিস্ময় উপহার দিয়ে নীরু দৌড়ে গিয়ে টিঙ্কুর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তাকে দু’হাতে আকড়ে ধরল।
– না, তোমরা টিঙ্কুরে ছাইড়া দাও। তোমরা আমার টিঙ্কুরে ছাইড়া দাও।
আর্তনাদ আর কান্নার একটা হৃদয়বিদারক সুর বেজে উঠল।
উপস্থিত সবাই হকচকিয়ে গেল। দুই একজন আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ল।
কেউ একজন নীরুকে টেনে ছাড়িয়ে আনলো। উদ্বিগ্ন মনোয়ারা মেয়েকে টেনে নিয়ে গেটের ভেতরে গেলেন। মেয়ে মায়ের শরীরে মুখ লুকালো। তার চোখ দুটি ঢাকা পড়ল বটে কিন্তু কান দুটি ঢাকা পড়ল না। উৎসুক জনতার শোরগোলের সাথে সে কিছু ধস্তাধস্তি, গরর গরর আওয়াজ আর গোঙানির শব্দ শুনতে পেল।
তারপর চারপাশ কেমন যেন শান্ত, নিশ্চুপ।
জনতার কোলাহল কমে এসেছে। নীরু চোখ খুলল।
টিঙ্কুর নিথর দেহ মাটিতে পড়ে আছে। তার গলা থেকে জমাট রক্তের একটা ধারা গড়িয়ে পড়েছে পাশের নালায়। পেটের দিকটা একটু করে কাঁপছে। বড়ো বড় চোখ দুটি খোলা। সে চোখের দৃষ্টির দিকে খেয়াল করলে বুঝা যেত তা চেয়ে আছে আর এক জোড়া চোখের দিকে, যে চোখ নীরু নামের একটা নয় বছর বয়সি মেয়ের চোখ। তার চোখ দুটি কালো কালো। ভাসা ভাসা চোখ। সে চোখে আনন্দ আছে, মায়া আছে, দুঃখ আছে – সবই আছে। এখন সেই চোখে আছে জল। টিঙ্কু কি কিছুক্ষণ আগে এই চোখই খুঁজছিল!
—
দেশের বই পোর্টালে লেখা পাঠাবার ঠিকানা : desherboi@gmail.com
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD