ঈদ সাময়িকী ॥ ছোটোগল্প

তামান্না স্মৃতির ছোটোগল্প ‘আঁধারে আলো’

শনিবার, ০৮ আগস্ট ২০২০ | ১১:২৯ অপরাহ্ণ | 957 বার

তামান্না স্মৃতির ছোটোগল্প ‘আঁধারে আলো’

আঁধারে আলো
॥ তামান্না স্মৃতি ॥

তিথির একটু মেজাজ খারাপ। মেজাজ খারাপ হবার অবশ্য একটা কারণ আছে। তিথিরা আজ রাতে কক্সবাজার যাছে। ঢাকা থেকে কক্সবাজারের বেশ লম্বা একটা জার্নি, তিথির সাথে আছে ওর স্বামী রফিক আর ওদের একমাত্র মেয়ে তিতলি।

 

 

 

তিথি আর তিতলি পাশাপাশি দুইটা সিট নিয়ে বসেছে। আর ওদের ঠিক পাশের সারির একটা সিটে বসেছে তিথির স্বামী রফিক আর আর অপর সিটে কিম্ভুতকিমাকার দেখতে একটা লোক। তিথি খুব মনোযোগ দিয়ে লোকটাকে খেয়াল করলো। লোকটার মুখের একপাশে খুব গভীরভাবে পুড়ে যাবার একটা বড়াে দাগ আছে। লোকটার একটা চোখও বোধহয় পাথরের তৈরি আর গায়ের রংটাও ভীষণ কালো। তিথি একবার আড়চোখে ওর মেয়ের দিকে তাকালো। তিতলিও লোকটাকে দেখে কেমন যেন একটু চুপসে গেছে। মায়ের কোলের সাথে একেবারে সিটিয়ে আছে। তিথি তিতলিকে স্বাভাবিক করার জন্য ওর সাথে একটু গল্প করার চেষ্টা করলো। একটা পটেটো চিপসের প্যাকেট খুলে মেয়ের হাতে দিলো। অন্য সময় হলে মেয়ে চিপসের প্যাকেট দেখে একেবারে ঝাপিয়ে পরতো। কিন্তু আজ চিপসের প্যাকেট হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। চিপস খাওয়ার প্রতি তিতলির কোনোরকম আগ্রহ দেখা গেল না। এতটুকুন মেয়েকেই বা কী বলবে! লোকটাকে দেখার পর থেকে তিথি নিজেকেই কোনোভাবে শান্ত রাখতে পারছে না। ও বার বার সন্দেহের চোখে লোকটাকে দেখছে। লোকটাকে দেখে তিথির অবশ্য সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক। কেননা যে কোনো জার্নির ক্ষেত্রেই ওর পাশে বসা সহযাত্রীকে নিয়ে ওর সাথে কোনো না কোনো একটা ঘাপলা ঘটবেই। এই যেমন, তিথি যখন মাসছয়েক আগে ওর স্বামী আর মেয়েকে ছাড়া হুট করে একদিনের নোটিশে মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে একা একা ট্রেনে করে খুলনা গেল। সে সময়েই তো ওর পাশে বসা যাত্রীটিকে নিয়ে ভয়ংকর একটা কাণ্ড ঘটেছিল। সেবার তিথির পাশে বসেছিল বয়স্ক একজন মহিলা। তিথি শুরুতে ওর সহযাত্রিটিকে দেখে মনে মনে খুব খুশি হয়েছিল। কেননা তিথির টিকিট ছিল এসি চেয়ারের। তাই শুরুতেই ওর পাশের সিটে কে বসবে এটা নিয়ে ওর মনে একটু খুঁতখুঁতে ভাব থাকলেও পরে ওই ভদ্রমহিলাকে দেখে তিথি মনে মনে একটু নিশ্চিন্ত হয়েছিল। প্রথম ঘণ্টাদুয়েক বেশ ভালই কাটল। কিন্তু বিপত্তি ঘটল একটু পরে যখন দেখা গেল ওদের ঠিক পেছনের সিটের এক মহিলার দামি মডেলের মোবাইল ফোনটি পাওয়া যাচ্ছে না। মহিলাটি বার বার বলছিলেন, উনি উনার সাত বছরের ছেলের হাতে মোবাইলটা দিয়ে একটু ওয়াশরুমের দিকে গিয়েছিল। একটু পর উনার ছেলেটিও নাকি ওর মায়ের পেছন পেছন ওয়াশ রুমের দিকে যায়। ছেলেটা বারবার তিথির পাশে বসা মহিলাটিকে দেখিয়ে বলছিল, ও নাকি যাবার সময় ফোনটা উনার হাতে দিয়েছে। এসময় অনেকেই তখন তিথিকে স্বাক্ষী মানা শুরু করলো। তিথি খুব বিব্রতকর একটা পরিস্থিতির মধ্যে পরে গেল। কেননা তিথি এইসবের কিছুই জানে না। ও জার্নির পুরোটা সময় ঘুমিয়ে ছিল। যাই হোক অনেক বাকবিতণ্ডার পর ঠিক হলো মহিলার ব্যাগ চেক করা হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। মহিলার শত আপত্তি থাকার পরেও উনার ব্যাগ চেক করা হলো এবং ব্যাগ থেকে হারিয়ে যাওয়া মোবাইলটা উদ্ধার হলো। তিথি সেবার মহিলার এমন কাণ্ড দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। এছাড়াও তিথির সাথে আরও একবার এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। ও যখন ভার্সিটিতে পড়ে সেইসময় একবার বাসে করে বাসায় ফেরার পথে তিথির পাশে বসা সহযাত্রীটি ওর হাতের ব্যাগটা নিয়ে বাস থেকে নেমে পরেছিল। ওর মনে হচ্ছে আজকেও নির্ঘাত এমন কিছু একটা ঘটবে। তিথি রফিকের দিকে তাকিয়ে চোখ ইশারা করে ওকে নিজেদের কাছে ডাকলো।

রফিক এসে তিতলিকে কোলে নিয়ে ওর সিটে বসতে বসতে বলল, কী ব্যাপার? কোনো সমস্যা?
– একটু আস্তে কথা বলো, এত চিৎকার করে কথা বলছ কেন?
– কী হয়েছে বলবে তো?
– তিথি ফিসফিস করে বলল, তোমার পাশে যে লোকটা বসেছে তাকে ভালোমতো খেয়াল করেছ?
– রফিক একটু চিন্তিত মুখে বলল, হুম করেছি। কেমন যেন ডাকাত ডাকাত চেহারা।
– তিথি এবার একটু নড়ে চড়ে বসলাে। বাসের সুপারভাইজারের সাথে একটু কথা বলবে নাকি?
– আরে নাহ্। বাসের সুপারভাইজারের সাথে কথা বলে কী হবে? রফিক মাথা ঘুরিয়ে বাসের অন্য যাত্রিদের একটু দেখে নিয়ে বলল, বাসের অন্য সবাইকে তো বেশ ভদ্রলোক মনে হচ্ছে।
– হুম তা ঠিক, কিন্তু তুমি খেয়াল করেছ পুরো বাসে আমি ছাড়া আর একজন মাত্র মেয়ে রয়েছে? আর বাচ্চা কেউ বলতে তিতলি একা?
রফিক এবার একটু বিরক্ত হয়েই বলল,
– তুমি একটু বেশি চিন্তা করছ। দুইজন মেয়ে হয়েছ তো কি হয়েছে, শুনি? এইসব উলটাপালটা চিন্তা না করে মেয়েকে নিয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো, তা না হলে কালকে সারাদিন আবার শরীর খারাপ করবে। কালকে কত জায়গায় ঘোরার প্ল্যান আছে, তোমার মনে আছে?

তিথি মাথা হেলিয়ে রফিকের কথায় সায় দিল। রফিক এবার উঠে গিয়ে নিজের সিটে বসলো। তিথি দেখলো লোকটা পাথরের চোখটা দিয়ে ওদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লোকটার সাথে চোখাচোখি হওয়া মাত্রই তিথি খুব দ্রুত ওর চোখ নামিয়ে নিলো। নিজের গায়ের বড়াে ওড়নাটা দিয়ে সারা শরীর খুব ভালো মতাে ঢেকে ও মেয়েকে ঘুম পাড়ানো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তিতলিকে ঘুম পাড়িয়ে তিথির চোখ সবেমাত্র একটু লেগে এসেছে, ঠিক এমন সময় হঠাৎ করেই বাসটি প্রচন্ড ঝাকুনি দিয়ে মাঝরাস্তায় থেমে গেল। শুরুতে বাসের অন্যান্য যাত্রীদের মতো তিথিও ভেবেছিল বাসের সামনে বোধহয় কুকুর কিংবা শেয়াল টাইপের কোনো প্রাণী পরেছে। তাই ড্রাইভার এত শক্তভাবে ব্রেক করেছে। কিন্তু পরমূহুর্তেই দেখা গেল ঘটনা ভিন্ন। ওদের বাসে ডাকাত পরেছে। যাত্রার শুরুতেই প্রায় পাঁচজন ডাকাত ঢাকা থেকে যাত্রী বেশে ওদের বাসে ওঠে। ওরা যখন দেখেছে বাসের প্রায় সকল যাত্রী গভীর ঘুমে তখন ওদের মধ্যে একজন সিট থেকে উঠে গিয়ে ড্রাইভারের গলায় একটা ধারালো ছুরি ধরে। ড্রাইভার তখন কি করবে বুঝতে না পেরে হঠাৎ করে শক্ত একটা ব্রেক করেছে। তিথিরা দেখলো একটু পরেই বাস আবার চলতে শুরু করলো। তিথি তিতলিকে শক্ত করে বুকের ভেতর চেপে ধরে আছে আর এক মনে দোয়া ইউনুস পড়ছে। তিথি তাকিয়ে দেখলো, রফিক ওর সিটে একদম শক্ত হয়ে বসে আছে। ডাকাতরা খুব স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে কেউ যেন নিজেদের সিট থেকে ওঠার চেষ্টা না করে। ওরা একে একে বাসের সবার কাছ থেকে টাকা-পয়সা, সোনা গহনা, মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে। যারা একটু আপত্তি জানাচ্ছে তাদেরকে বেশ মারধরও করছে। তিথির কাছে আসতেই ও বিনা বাক্যবায়ে ওর কাছে যা ছিল তার সব কিছু দিয়ে দিলো। পুরো বাসের সবাইকে যখন একেবারে কপর্দকশূন্য করে ডাকাতের ছোট্ট দলটা বাস থেকে নেমে যাবার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, ঠিক তখনই যাকে বাসের সবচেয়ে সুন্দর চেহারার ভদ্রলোক বলে মনে হয়েছিল, যে কিনা ডাকাত দলেরই একজন সদস্য, সেই লোকটা উঠে এসে সরাসরি তিথির হাত ধরে বলল, তারা তিথিকে নিয়ে বাস থেকে নামবে। তারপর ওদের দলের সবাই মিলে তিথির সাথে একটু মজা করে কালকে সকালে তিথিকে এই জায়গাতেই রেখে যাবে। লোকটার কথা শুনে তিথি হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তিতলিও ওর মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছে। রফিক প্রচন্ড বাধা দেবার চেষ্টা করছিল বলে এর মধ্যেই ওদের একজন রফিকের হাত-পা শক্ত করে নাইলনের দড়ি দিয়ে বেঁধে দিয়েছে। ওরা তিথিকে টানতে টানতে বাসের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। তিথি অবাক হয়ে দেখলো বাসের প্রায় পঞ্চাশ জন যাত্রী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিথিদের অসহায়ত্ব দেখছে কিন্তু কেউ ওদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না। সবাই যেন একসাথে বোবা, কালা, অন্ধ হয়ে গেছে। ডাকাতদের মধ্যে একজন যে পুরো সময়টুকু ড্রাইভারের গলায় ছুরি ধরেছিল, সে যখন ওদের বাস থেকে নির্বিঘ্নে নামিয়ে দেয়ার জন্য বাসটা থামানোর নির্দেশ দিলো, ঠিক তখনই যাত্রীদের ভেতর থেকে একজন লোকের চিৎকার শোনা গেল। তিথি তাকিয়ে দেখলো, চিৎকার দিয়েছে সেই কিম্ভুতকিমাকার লোকটা, যার খারাপ চেহারা দেখে তিথি যাত্রার শুরু থেকেই লোকটাকে মনে মনে খারাপ লোক ভেবে নিয়েছিল। লোকটা চিৎকার করে বলল,

– ওই তোরা উনারে ছাইড়া দে। সোনা-গহনা, টাকা-পয়সা নিয়া যাবি ভালো কথা, কিন্তু আমি মুন্সি গাজী বাঁইচা থাকতে কোনো মেয়ে মানুষের ইজ্জত আমি নিয়ে যাইতে দিমু না।
এরপর মূহুর্তের মধ্যেই অনেক কিছু ঘটে গেল। ওদের দলের মধ্যে থেকে একজন যখন মুন্সি গাজীকে একটা বড় রামদা দিয়ে হামলা করতে গেল। তখন মুন্সি গাজী প্রায় চোখের নিমিষেই শক্ত একটা লাথি কষিয়ে লোকটার হাতের রামদাটা ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলো। এমনিতেই বাসটা প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে থেমে আছে, যে কেউ যে কোনো মুহুর্তে চলে আসতে পারে, তাছাড়া ওদের সবচেয়ে বড়াে রামদাটাও এখন মুন্সি গাজীর দখলে, তাই ডাকাতরা তিথিকে নিয়ে আর বেশি টানাটানি করবার সাহস পেল না। ওরা একটু তাড়াহুড়ো করেই বাস থেকে নেমে অন্ধকারের ভেতর হারিয়ে গেল। তিথির হতভম্ব ভাবটা কাটতে বেশ কিছুটা সময় লাগল। একটু স্বাভাবিক হতেই ও দৌড়ে গিয়ে তিতলিকে কোলে নিয়ে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরলো। বাস আবার চলতে শুরু করেছে। মুন্সি গাজী রফিকের বাধনগুলো খুলে দিতেই রফিক উনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। রফিক হাউমাউ করে কাঁদছে। আজকে ফেরেশতার মতো এই লোকটা না থাকলে তিথির কি হতো ভাবতেই রফিকের দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাসের সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। দু-একজন শান্ত্বনার কিছু বাণী দিয়ে যে যার নিজের জায়গায় বসে পড়লো। তিথি তখন থেকে কক্সবাজার পৌঁছানোর পুরো সময়টুকু একইভাবে তিতলিকে বুকের ভেতর চেপে নিয়ে বসে রইলো।
বাস একদম সময়মত কক্সবাজার পৌঁছে গেছে। বাস চলাকালীন সময়েই বাসের যাত্রীরা সবাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করেছে যে, আজকে সন্ধায় সবাই মিলে একসাথে লোকাল থানায় গিয়ে একটা জিডি করে আসবে। বাস থেকে নেমে সবাই যে যার মতো বিদায় নিয়ে নিজ নিজ হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। মুন্সি গাজী যখন তিথিদের কাছে বিদায় নিতে এলো। তিথি তখনো তিতলিকে কোল নিয়ে চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। মুন্সি গাজীকে ওদের দিকে আসতে দেখে তিথি তিতলিকে কোল থেকে নামিয়ে লোকটার পা ছুঁয়ে সালাম করলো।
মুন্সি গাজী একটু হকচকিয়ে গেল। উনি একটু অবাক হয়েই বললেন,
– এডা আপনি কি করতাছেন? আমি তো এমন কিছু করি নাই। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের বিপদে আগাইয়া আসবো এটাই তো নিয়ম।
তিথি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– আমাদের মতো মানুষ নামক সভ্য জাতির অনেকেই হয়তো এই নিয়মটা ভুলে গেছি। শুধু আপনার মতো কিছু মানুষ মনে রেখেছে বলেই দুনিয়াটা এখনো টিকে আছে।
মুন্সি গাজী তিথির কথার কোনো জবাব দিলেন না। উনি তিতলিকে একটু আদর করে নিজের কোলে তুলে নিলেন। তিতলিও হাসিমুখে উনার কোলে উঠল। ওইটুকুন বাচ্চাও এখন খুব ভালোমতো বুঝে গেছে যে, এই আঙ্কেলটা না থাকলে আজ ও আর হয়তো ওর মাকে ফিরে পেত না।
তিতলি মুন্সি গাজীর গালের পোড়া দাগটার উপর হাত বুলিয়ে বলল,
– তোমার এখানে কী হয়েছে আঙ্কেল?
– ও কিছু না, মামনি। অনেক আগে আমাদের গ্রামে তোমার মতােই একটা ছোট্ট পরী থাকতো। একদিন ওই পরীর বাসায় আগুন লাইগ্যা গেছিল। বাসা থেকে সকলেই বাইর হতে পারলেও পরীটা বাইর হইতে পারে নাই।
– ওর বাবা মা ছিল না?
– ছিল তো। ওর বাবা মারে হকলে মিলা আটকাইয়া রাখছিল। যদি মাইয়ারে বাঁচাতে যাইয়া হকলে একলগে পুইড়া মরে হেই ডরে। তখন আমি ওইখানেই দাঁড়ায় ছিলাম। মনে মনে কয়লাম, একটা বাচ্চা মাইয়া পুইড়া মরবো আর আমি মুন্সি গাজী হেডা দাঁড়ায় দাঁড়ায় দেখুম তা হয় নাকি? মাইয়াডারে বাঁচানোর লাইগ্যা তাই আগুনের ভেতরেই ঝাঁপ দিলাম।
এবার তিথি বলল,
– মেয়েটাকে বাঁচাতে পেরেছিলেন?

– জি হ্যাঁ। আল্লাহ তায়ালার অশেষ কৃপায় আর আপনাদের দোয়ায় মাইয়াডার গাঁয়ে একফোঁটাও আগুনের আঁচ লাগে নাই।
– মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়ে আপনার মুখ আর চোখটা পুড়ে গিয়েছিল, তাই না?
– জি হ্যাঁ। কিন্তু সেই বিষয় লইয়া আমার মনে কোনো দুঃখ নাই। দুঃখ শুধু এক জায়গায়। ছোটাে ছোটাে পোলাপাইন আমার এই চেহারা দেইখা এখন ডরায়, আর যে কোনো লোক আমারে দেখবার মাত্রই আমার দিকে কেমন যেমন সন্দেহের চোখে তাকায়। ভাবে, আমি বুঝি খুব খারাপ লোক, হয় চোর না হয় ডাকাত। এইডা আমারে খুব কষ্ট দেয়। আপনারাই বলেন, এই যে আমার এমন পোড়া কালা চেহারাডা দেইখা মানুষ আমারে নিয়া এমুন ভাবে, এইডা কি ঠিক?
তিথিরা কেউই লোকটার এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারলো না। ওদের সবারই চোখটা লজ্জায় নিচু হয়ে গেছে। ওদের চোখ তুলে মুন্সি গাজীর দিকে তাকানোর আর সাহস নেই। যেন চোখ তুলে তাকালেই মুন্সি গাজী হয়তো কালকে রাতে উনার প্রতি তিথিদের যে ভয় এবং সন্দেহে মিশ্রিত চোখের দৃষ্টি ছিল তা খুব সহজেই পড়ে ফেলতে পারবেন। ধরা পরে যাবার ভয়েই কি না, ওরা খুব তাড়াতাড়ি মুন্সি গাজীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজেদের হোটেলের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
মুন্সি গাজী ঐখানে দাঁড়িয়েই আল্লাহ তাআলার দরবারে হাত তুলে অনেকক্ষণ তিতলিদের জন্য দোআ করলেন। উনার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। মুন্সি গাজীর এই চেহারা দেখে কেউ উনার সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হয়নি। তাই ওর কোনোদিন সংসার করাও হয়নি, কোনো ছেলেপুলেও হয়নি। অথচ অনেক ছোটবেলা থেকেই ও ছোটাে ছোটাে ছেলেমেয়েদের খুব পছন্দ করে। রাস্তাঘাটে কত ফুটফুটে পরীর মতাে বাচ্চা দেখে! কত বার মনে হয় ওদের কাছে যেয়ে বাচ্চাগুলোর বাবা মাকে বলে, বাচ্চাগুলোকে কোলে নিয়ে একটু আদর করবে! পুতুল, কিংবা চকলেট অথবা খেলনা, এইসব কিনে দিবে! কিন্তু নিজের চেহারার কথা ভেবে কাছে যাবার কখনো সাহস হয়নি। কিন্তু আজ ও অনেক খুশি। আজকে ওর মনের বাসনা পূরণ হয়েছে। অন্তত দুনিয়ার একটা বাচ্চা ওকে ভয় পায়নি। ওর কোলে উঠেছে। অনেক মায়া নিয়ে ওর গালের পোড়া দাগটাই হাত বুলিয়েছে। ওকে এক মুহূর্তের জন্য হলেও ভালোবেসেছে। এই ছোট্ট জীবনে ওর মতো অভাগার আর কিছুই চাইবার নেই। আজ মুন্সি গাজী অনেক খুশি। অনেক।

 


দেশের বই পোর্টালে লেখা পাঠাবার ঠিকানা : desherboi@gmail.com

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD