লাস্ট নাম্বার
॥ গিয়াস আহমেদ ॥
গলিটা সরু। ভেতরে আবছা অন্ধকার। তাতে গলিপথটাকে রহস্যময় এক গুহা বলে মনে হয়। শেষ মাথায় একটি ল্যাম্প পোস্ট। নিঃসঙ্গ। একাকী। সে আলো ছড়িয়ে চলেছে। আলোকধারা যেন জ্যামিতির সূত্র মেনে ঝরছে। শীর্ষ বিন্দু থেকে ঝরনার মতো নেমে এসে বিছিয়ে পড়ছে অনুভূমিক তলে। নরম কোমল আলো। পুরো গলিটার মধ্যে অদ্ভুত আবছায়া।
ল্যাম্প পোস্টটার নিচে ঝাপসা একটা স্পট লাইটের মতো তৈরি হয়েছে। সেই আলোর মাঝে বসে আছেন বেদানা বানু। তার পাশে একটি ফ্লাস্ক। সিলভার কালারের, বেশ বড়ো-সড়ো। ফ্লাস্ক ভর্তি চা, রুটি। তার নিজের হাতে বানানো। আর তার বাঁ হাতের মুঠোয় ছোট্ট একটি কাপড়ের ব্যাগ। তাতে কয়েক প্যাকেট সিগারেট।
হুড়মুড় করে হাওয়া বইছে। ঢাকা শহরের কতক তাজ্জব কাণ্ড-কারখানা আছে! এই শহরে আকাশছোঁয়া সব দালান। তাতে বাধা পেয়ে কোনো কোনো গলির ভেতরে পাগলের মতো দাপাদাপি করে বাতাস। এই গলিটা সে রকম এক ‘বাতাস কারখানা’। গ্রীষ্মকাল। ভালোই গরম পড়েছে। তবে এখানে, এই ল্যাম্পপোস্টের নিচে, বড়ো শান্তি। বোশেখের বাতাসে বানুর শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি তাকিয়ে আছেন ক্লান্ত চোখে, শূন্য চোখ। এমন চোখে মানুষ যখন তাকায়, আসলে সে কিছু দেখে না…!
যে রিকশাওয়ালাটা তার কাছ থেকে ‘রুটি চা’ খেয়েছে আর নেভি সিগারেট, সেও চলে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। এরপর আর কোনো কাস্টমার নেই। রাস্তা-ঘাটে মানুষজনই নেই। হুটহাট যাও দু-একজন আসে, তাদের সবার মাঝেই ভিতুভাব! মুহূর্তে আসে, মুহূর্তেই উধাও! যেন টুকপলান্তি খেলা! কে যে আসে কেইবা যে যায়- বোঝা দায়। সবার মুখে মাস্ক। মুখোশপরা মানুষদের চেনার উপায় আছে! দুনিয়াভরা মুখোশ-মানুষ। তার ওপর এখন মুখে মুখে মাস্কের আড়াল। শুধু চেনা যায় পুলিশদের। তারাও মাস্ক পরে আসে, তবে ড্রেস দেখে যায় চেনা।
কয়েকবারই পুলিশের গাড়ির সামনে পড়েছেন বেদানা বানু। তারা গালাগাল দিয়েছে। মাস্কের কারণে মুখ দেখা যায়নি, তবে খ্যাঁকখ্যাঁকটা ঠিকই বোঝা গেছে। একবার তো লাঠি নিয়ে তেড়েই এসেছিল, শেষমুহূর্তে থেমে গেছে, বাড়ি দেয় দেয় করেও আর দেয়নি। বেদানা বানুর মুখেও মাস্ক। মনে হয়, ভারি বয়স্ক শরীর আর শাড়িটার কারণে মার খাওয়া থেকে বেঁচে গেছেন তিনি। তার পরনের শাড়িটার রং এখনো তাজা…।
কোথাও হাসনুহেনা ফুল ফুটেছে। বাতাসে মিষ্টি একটা গন্ধ। বোশেখ মাস তো ফুলেরই মাস। চারপাশ আলো করে আছে রঙিন সব ফুল। অধিকাংশ রংবাহারি ফুলই গন্ধহীন। রূপে রসে হোক কী ধনে মানে, পরিপূর্ণতা দিতে প্রকৃতির কিছু কিপটেমি আছে। হাসনুহেনা সেদিক দিয়ে ভালো। তার প্রিয় ফুল। কী কোমল ঘ্রাণ! দেখতে ঢ্যাংঢ্যাঙা চেহারার, কেমন মায়া মায়া লাগে!
সামনের বাড়িটার গেটে ঝাকড়া মতো একটি গাছ। মনে হয় জারুল। বেগুনি রংটা আঁধারে মিলেমিশে গেছে। তবে পাশের গাছটিতে যে হলুদ ফুল ফুটেছে, তা কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। মনে হয় রাধাচূড়া। সোনালুও হতে পারে। এত ফুলসজ্জার একেকটি বাড়ি, অথচ ঘরবাড়িগুলোকে লাগছে ভূতের বাড়ির মতো! প্রায় বাড়িই অন্ধকার। কেউ এসে বারান্দায় দাঁড়ায় না। কেমন গা ছমছম করে…!
বেদানার বাবা দিদারুল আলম ছিলেন স্কুল মাস্টার। ফল-ফুল তাঁর বড়ো প্রিয় ছিল। বাড়ির চারপাশটা ঘিরে তিনি বাগান করেছিলেন। বিচিত্র সব গাছগাছালি জোগাড় করে লাগিয়েছিলেন। তিনি ছেলের নাম রেখেছিলেন আঙুর, মেয়ের নাম বেদানা। দিদারুল আলম বলতেন, মহান আল্লাহপাক সুরা আবাসায় আঙুর ফলকে বলেছেন ‘আল-ইনাবু’ আর সুরা রহমান-এ আনারকে বলেছেন ‘আর-রুম্মান’। তোমরা তো তাঁর দেওয়া ফসল, আমাদের জন্য তাঁর দেওয়া সবচেয়ে বড়ো নিয়ামত গো, আম্মা…।
বেদানা বানুর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। তিনি হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল খুলে হাতে ঢাললেন। স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে তিনি সচেতন। বাঁচতে হলে মানতে হবে। সচেতন হলেও কী আর বাঁচা যায়! হ্যান্ড স্যানিটাইজারের গন্ধে চাপা পড়ে গেছে হাসনুহেনার ঘ্রাণ। এই ঝাঁঝালো গন্ধটাকে তার কাছে মনে হয় কর্পুরের গন্ধ! এই একটি গন্ধে বদলে গেছে পৃথিবী, বদলে গেছে পৃথিবীর মানুষ, চেনা মানুষ। চেনা মানুষ কী আসলেই চেনা? নাকি মানুষের মুখটাই কেবল চেনা হয়!
আজগর আলীও তার চেনা ছিলেন না। কিশোরী বেদানার রোমান্টিক ভাবনা ছিল, ফলের নামে যার নাম, তার স্বামীর নাম হবে ফুলের নামে, অন্তত কোনো বৃক্ষের তো নামে। টগর, কদম, অন্তত লেবু মিয়া। অথচ তার বিয়ে হয়ে গেল আজগর আলী কেরানির সাথে! তিনি দুষ্টুমি করে বলতেন, ‘অজগর আলী’।
আজগর আলীও বৃক্ষপ্রেমিক মানুষ। স্বামীর মাঝে বাবার ছায়া পাওয়া বিরাট ভাগ্য। বেদানা নিজেকে বড়ো সুখী আর ভাগ্যবতী মানতেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে তারা ছেলে-মেয়েদের নাম রাখলেন ফুলের নামে নামে।
খরবটা শোনা যাচ্ছিল টিভিতে, পত্রিকায়। দুনিয়া কাঁপিয়ে আসছে এক রোগ! করোনা। মার্চের ৮ তারিখে সত্যি সত্যিই করোনা ঢুকে পড়ল দেশে। তারপর মহামারি…। করোনায় প্রতিদিন মৃত্যুর খবর! প্রথমে অমুক-তমুকের কথা শোনা গেল, তারপর আত্মীয়-স্বজনদের মৃত্যুর খবর আসতে লাগল! নিজের যে হাত, সে-ই সবচেয়ে অবিশ্বাসী! এমন গজব মানুষ দেখেনি কোনো দিন, এই জীবনে দেখতে হবে- কে ভেবেছে! ঈদের জামাত হলো না। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হলো না। ৩১ বছরে এসে ছেদ পড়ল মঙ্গল শোভাযাত্রার…।
মানুষ ঘর থেকে বের হয় না। কেউ কারো কাছে যায় না, কারো কাছে কারো আসা নিষেধ, যেন পাশের মানুষটিই ঘাতক! অফিস-আদালত বন্ধ হয়ে গেল। মানুষের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ। একের পর চাকরি হারাতে লাগল মানুষ!
এমনই যখন দিন-রাত্রি, তখন এক ভোরে নামাজ পড়তে উঠে আজগর আলী দেখলেন- গায়ে জ্বর। খুশখুশে কাশি। গলাব্যথাও আছে…! আজগর আলীর টনসিল বড়ো নাজুক, অল্পতেই ফুলে যায়, নতুন কিছু না! দুদিন দুবেলা গার্গল করলেই হলো।
হলো না! সময় বদলে গেছে! ছেলে-মেয়েরা বুড়ো বাবাকে ঘরে বন্দি করে ফেলল। বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেওয়া হলো। ছোঁয়াছুঁয়ি হলেই করোনা, আর করোনা মানেই মরণ। মরতে যাবে কে! আপনি বাঁচলে বাপের নাম! বেদানা বেগম কোনো রকমে স্বামীর ঘরে ঢুকে পড়লেন। মানুষটা এভাবে মরবে নাকি! তার যদি করোনা হয় তো হোক। স্বামীর সাথে তালাবন্দি হলেন বেদানা বেগম!
যে সন্তানদের তারা বুকে আগলে বড়ো করেছেন, তারা বাবা-মায়ের ধারেকাছেও আর এলাে না। আজগর আলীর অবস্থা আরো খারাপের দিকে গেল, শ্বাসকষ্ট! বেদানা বেগম চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন, ‘তোরা তোর বাপটাকে বাঁচা, মানুষটা কি বিনাচিকিৎসায় মারা যাবে…! তোরা এত পাষাণ…!’ সন্তানরা কেউ সাড়া-শব্দ করল না।
বেদানা কাঁদতে কাঁদতে মিনতি করতে লাগলেন, ‘কে আছো, মানুষটারে বাঁচাও… একটু হাসপাতালে নিয়ে যাও…।’ যাদের সঙ্গে সুখে-দুঃখে প্রায় একটা জীবন কাটিয়েছেন, সেই পড়শিরা কেউ সাড়া-শব্দ করল না। এলাে, এলাকার কেউ রাতের অন্ধকারে এসে বাসার গেটে এক টুকরো লালসালু টাঙিয়ে দিয়ে গেল। মানে জানান দেওয়া, এ বাসায় কোভিড-১৯ ভাইরাস আক্রান্ত রোগী আছে।
আজগর আলী সারাক্ষণ আকাশের দিকে হাত তুলে প্রার্থনা করতেন, ‘হে আল্লাহ, যে মৃত্যুতে নামাজ নাই, গোসল নাই, সেই মৃত্যু তুমি আমারে দিও না, দয়াময় গো…।’
আজগর আলী মারা গেলেন। দুদিন পড়ে রইল তার মৃতদেহ। ছেলে-মেয়ে-পড়শি কেউ দাফন করতে এগিয়ে এলাে না। এরপর হয়তো কারো টেলিফোনে পুলিশ এলাে। আগাগোড়া সাদা কাপড়ের অদ্ভুত পোশাকে মোড়া কয়েকজন মানুষ নিয়ে গেল আজগর আলীর দেহ। শত অনুরোধেও তারা সঙ্গে নিল না বেদানাকে। তিনি শুকনো চোখে দেখলেন, জীবনসঙ্গীর শেষযাত্রা…।
কদিন পরে বেদানা বেগমের মোবাইল ফোনে একটি ম্যাসেজ এলাে- গ্রেভইয়ার্ড…, গ্রেভ নং-১৫২৭…।
বাতাস থেমে গেছে! বৈশাখের বড়ো রকমের পাগলামি আছে, মতিগতি বোঝা ভার! কখনো দুরন্ত তো কখনো স্তব্ধ। বেদানা বেগম উঠে দাঁড়ালেন। বাড়ি তিনি নিজেই ছেড়েছেন। যে ছেলে-মেয়েরা বাবাকে মরার সময় দেখেনি, মরার পরেও না। বাবার কবর কোথায়, সে খবরও তারা নেয়নি! তাদের সাথে তিনি আর থাকেননি। একটাই তো জীবন, আর জীবনের কটাইবা দিন! কেটে যাবে। এই ভূতুড়ে পৃথিবীতে তিনি এক বেদনার ফেরিওয়ালা।
আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি হতে পারে। বেদানা বেগম উঠে দাঁড়ালেন। গলির মুখের দিকে হাঁটতে হাঁটতে তিনি আবার মোবাইল ফোনটা বের করলেন, ল্যাম্প পোস্টের আলোয় বোতাম টিপলেন, তার চোখের সামনে কেবলই একটি নম্বর…।
—
দেশের বই পোর্টালে লেখা পাঠাবার ঠিকানা : desherboi@gmail.com
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD