ঈদ সাময়িকী ॥ ছোটোগল্প

মনদীপ ঘরাই-এর ছোটোগল্প ‘পাঠক’

শনিবার, ০৮ আগস্ট ২০২০ | ১২:০৩ পূর্বাহ্ণ | 1403 বার

মনদীপ ঘরাই-এর ছোটোগল্প ‘পাঠক’

পাঠক
॥ মনদীপ ঘরাই ॥

একটা বই হাতে নিয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনের সামনে বসে আছে আরাফাত। আর একটু পরেই লাইভে যুক্ত হবে একটা টিভি চ্যানেলের সাথে। মহামারি আসার পর থেকে টিভি চ্যানেলে গিয়ে টক শো করাটা তো এক অর্থে বন্ধই হয়ে গেছে। এখন বাসায় বসেই টুকটাক টকশো করতে হয় তাকে। রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধূলা কিংবা বাণিজ্য নিয়ে তো অধিকাংশ মানুষই টক শো করে থাকে। আবার বইমেলার সময়টাতে ব্যস্ত সময় কাটায় লেখক-প্রকাশকেরা। অন্যদের চেয়ে আরাফাতের টকশো করার জায়গাটা একেবারে আলাদা। সে পাঠক। বই পড়া নিয়ে কথা বলতেই টিভি চ্যানেলগুলোতে ডাকা হয় তাকে।

 

 

যে কেউ এ কথা শুনলে প্রথম প্রশ্নটা করে, ‘কতগুলো বই পড়েছে সে? পাঠক হিসেবে ওই লোকটাকেই কেন ডাকতে হবে? দেশে কি শিক্ষাবিদের অভাব পড়েছে?’
এক বিবেচনায় কথাটা সত্যি। যারা প্রকৃত অর্থে প্রচুর বই পড়ে, তাদের তুলনায় আরাফাত কিছুই না। সব কাজ করে, পরিবার সামলে একটা অফিসের কেরানি ক’টা বই বা পড়তে পারে! এই মধ্যম গোছের পাঠককে নিয়মিত টিভিতে ডাকার ঘটনাটা তাহলে কী?
ফোনটা বেজে উঠল। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে লাইভে যুক্ত হতে আরও দশ মিনিটের মতো লাগবে। এই সময়টাতে ল্যাপটপের স্ক্রিনের সামনে থেকে ওঠাও যায় না, কিছু করাও যায় না। হঠাৎ অজান্তেই আরাফাত ডুবে গেল অতীত ভাবনায়।

আজ পাঠক হিসেবে তার যে এত নাম-ডাক, তার পেছনের কৃতিত্বটা বন্ধু রেজার। ভার্সিটি জীবনে বন্ধুদের মধ্যে বইপোকা হিসেবে আরাফাতের ‘দুর্নাম’ ছিল। সবাই যখন রাত ভ’রে তাস খেলত, সে তখন বইয়ের পৃষ্ঠায় মুখ ডুবিয়ে থাকত। শুধু তাই নয়, নাওয়া-খাওয়া শিকেয় তুলেও চলত বই পড়া। সব বদলে গেল পাশ করার পর। কেরানির চাকরিতে ঢুকে নিজেকে এক অর্থে হারিয়েই ফেলল আরাফাত। বই পড়া যে তার একসময় অভ্যাস ছিল, তা বাকি সবার সাথে সাথে সে নিজেও ভুলে গেল। এদিকে ভার্সিটির বন্ধু রেজা ওর অফিসেরই এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগদান করলো। বন্ধুর অধীনে চাকরি করার দুঃখটা আলাদাভাবে টের পেত আরাফাত।
এক দুপুরে রেজা তার রুমে আরাফাতকে ডেকে পাঠাল। আরাফাত স্বভাবসুলভ ইতস্তত ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে। রেজা একদম বন্ধুত্বের সেই দিনগুলোর মতো করেই বলল,
– দোস্ত, এসব অফিসিয়াল দূরত্ব আমার সাথে দেখাবি না তো। বসে যা!
আরাফাত শব্দ যাতে না হয়, এমন সাবধানে চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে বলল,
– অফিসে তো আপনি আমার বস্ই।
আরাফাত বেশ বিরক্ত হবার ভাব মুখে ফুটিয়ে বলল,
– ধুর, তোকে দিয়ে হবে না। এবার কাজের কথায় আসি। তুই না ভার্সিটিতে থাকতে অনেক বই পড়তি? এখনও পড়িস?
না সূচক মাথা নেড়ে আরাফাত বলল, এখন আর সুযোগ কোথায়!
কিছু একটা নিয়ে উৎসাহ ভরে রেজা বলল,
– শুধু বই পড়ে কি আর কাজ হয়? কৌশল করে বই পড়লে কত কিছু হয়। এই দ্যাখ!
কথাটা শেষ না করতেই মোবাইলে একটা আর্টিকেল আরাফাতকে রেজা দেখালো। তবে ঠিকঠাকমতো আর্টিকেলটি ওকে দেখানোর আগেই আবার কথা বলতে শুরু করলো রেজা,
– দীপক শর্মা বাজাগাইন। ব্যাটা করেছে কী দ্যাখ! ১১৩ ঘণ্টা টানা বই পড়েছে এক স্টেডিয়াম ভর্তি মানুষের সামনে। নেপালের ঘটনা। বিশ্ব রেকর্ড করেছে বই পড়ে। আর তুই? তাস খেলা বাদ দিয়ে বই পড়তি! এরকম কিছু করতে পারলে আজকে পাঠক হিসেবে কত নাম-ডাক থাকতো! লোককে গর্ব করে বলতাম, আমি আরাফাতের বন্ধু।
আরাফাত বিস্ময় লুকাতে না পেরে বলল, ১১৩ ঘণ্টা মানেটা আপনি বোঝেন, স্যার? প্রায় পাঁচদিন টানা বই পড়েছে লোকটা। আমার পক্ষে অসম্ভব। এমনিতেই আমার শ্বাসের সমস্যা।
রেজা একটুও না দমে বলল,
– ওসব বলে পার পাবি না। টানা পাঁচদিন না পারিস, পাঁচ ঘণ্টা তো পারবি। স্টেডিয়াম ভর্তি লোকের সামনে না পারিস, অডিটোরিয়াম ভর্তি লোকের সামনে তো পারবি! পারতে তোকে হবেই।
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল আরাফাত। রেজা থামিয়ে দিয়ে বলল,
– নো মোর টক। বস ইজ অলওয়েজ রাইট। এটাকে অফিসিয়াল অর্ডার হিসেবে ধরে নিন মি: আরাফাত হোসেন। আগামী একমাসের মধ্যে ইভেন্টটা হবে।
ডেস্কে ফিরে বাকি সময়টাতে কোনাে কাজেই আর মন বসাতে পারলো না আরাফাত। তবে, মনে সব ভয় আর সংশয়ের মধ্যেও নতুন একটা স্বপ্ন তৈরি হলো। শৈশবের কোনাে একটা জেদ তাকে তাড়া করছিল বহুদিন। বই নিয়ে এক কষ্টে মাখা জেদ। সেটা পূর্ণ করার সুযোগ এলাে বোধ হয়।

বাবা-মাকে কোন বয়সে হারিয়েছে, তা কখনোই জানা হয়নি আরাফাতের। যখন একটু একটু বুঝতে শিখেছে, তখন থেকেই নিজেকে আবিস্কার করেছিল এক দুঃসম্পর্কের এক মামার বাসায়। খুব ছোটাে বয়স থেকেই গৃহপরিচারকের মতো সব কাজ করতো আরাফাত। সারাদিন কাজ করতে করতে সন্ধ্যায় যখন শরীর ছেড়ে দিত, তখন আরাফাতের দায়িত্ব ছিল, দুঃসম্পর্কের সেই মামাকে অর্থাৎ বাড়ির কর্তাকে বাতাস দেয়া। বাসায় কোনাে পাখা ছিল না। একটা আদর্শলিপি বই দিয়ে বাতাস করতো। আরাফাতের ধারণাই ছিল, বই জিনিসটা তৈরিই হয়েছে একমাত্র বাতাস করার জন্য!
সময় বদলায়। আরাফাতের সময়ও বদলেছিল। এক এনজিওর নজরে পড়ে যায় আরাফাত। তাদের ওখানে বিদেশি আসবে। ছাত্র দেখাতে হবে। ছাত্র নেই। তাই খুঁজে টুজে আরাফাতসহ দশজনকে নিয়ে গিয়েছিল তারা। বিদেশিরা এসে সেখান থেকে আরাফাতসহ পাঁচজনকে শহরে একটা স্কুলে পড়তে পাঠায়। সেই থেকেই আজকের আরাফাত। তার আজীবনের একটাই জেদ, আর যাই হোক, তার মতো যেন আর কেউ বইকে বাতাস করার যন্ত্র মনে না করে, সেটা সে নিশ্চিত করেই ছাড়বে।
এবার সে সুযোগ হয়তো করে দিলো রেজা। সে পাঠক হিসেবে বিখ্যাত হবে, তারপর বিভিন্ন ফোরামে তার কষ্টের গল্প বলবে। তার মতো কাউকে আর বই দিয়ে বাতাস করতে দেবে না। সবাই বই পড়বে। মনের আনন্দে বই পড়বে।

অডিটোরিয়াম ভর্তি মানুষের সামনে জীবনে কোনােদিন দাঁড়ায়নি আরাফাত। মঞ্চে আরাফাতের পাশে টাইমপিস নিয়ে রেজা বসে আছে। বন্ধুকে সাহস জোগাচ্ছে। আরাফাতের হাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর ‘সেই সময়’।
কাঁপা কাঁপা গলায় বইটা পড়া শুরু করলো আরাফাত,
– শিশুটির জন্ম মাত্র সাত মাস দশ দিন গর্ভবাসের পর। মাতৃজঠরেই তার চাঞ্চল্য প্রকাশ পেয়েছিল। সেই অন্ধকার জলধিতে সে বেশিদিন থাকতে চায়নি…
এরপর পড়তেই থাকল। রেজার আশা অনুযায়ী পাঁচ ঘণ্টা নয়, বরং ৯ ঘণ্টা ১৭ মিনিট টানা বই পড়েছিল আরাফাত। মুহূর্তেই টিভি-প্রিন্ট-সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে আরাফাতের কীর্তি। ভাইরাল হয়ে যায় তার টানা বই পাঠের ঘটনা। দীপকের বিশ্ব রেকর্ড ভাঙ্গা হয়নি আরাফাতের। তবে, দেশে এমন অদ্ভুতুড়ে ঘটনা এটাই ছিল প্রথম। তাই পাঠক হিসেবে অদ্বিতীয় খ্যাতি পেয়ে গেল আরাফাত। বইমেলা এলেই লেখকেরা ডাক পাক বা না পাক, পাঠক আরাফাতকে ঠিকই খুঁজে নিত টিভি চ্যানেলগুলো। বই নিয়ে কিংবা বই পড়া নিয়ে অনেক ভালো ভালো জ্ঞানগর্ভ কথা বলতে লাগল আরাফাত। সবাই মুগ্ধ হতে লাগল তার জ্ঞানের গরিমায়।
কিন্তু, আরাফাত তার শৈশব থেকে লালন করা জেদের কথা বেমালুম ভুলে গেল। কোনাে টক শোতে ভুল করেও তার মুখে এলো না বই দিয়ে বাড়ির কর্তাকে বাতাস করার দুঃসহ স্মৃতি। কোনাে শিশুকে বই নিয়ে এমন কষ্ট সইতে হবে না, এসব নিশ্চিত করার প্রতিজ্ঞাও যেন কোথাও হারিয়ে গেল। সবচেয়ে বড়াে কথা, বন্ধু রেজার কথাও টক শোতে বলা বন্ধ করে দিলো আরাফাত। আর খ্যাতি পাবার পর বন্ধুর অধঃস্তন হিসেবে কাজ করার ইচ্ছেও আর থাকল না। পরিচিত একজনকে বলে কয়ে একটা ফার্মে বেশি বেতনে চাকরি করতে শুরু করল সে।
অতীতের ভাবনায় ছেদ পড়ল প্রেজেন্টারের ডাকে,
– ভাইয়া, আমাকে শুনতে পাচ্ছেন? আর দুই মিনিটের মধ্যে আমরা লাইভে যাব।
আরাফাত হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলল,
– লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার।
শুরু হলো টক শো। শিশুদের জীবনে বই পড়ার গুরুত্ব নিয়ে আলাপ হচ্ছে। তুমুল বক্তৃতা রাখছে আরাফাত। দেশ-বিদেশের পাঠকদের উদাহরণ উঠে এলো তার কথায়। সেই সাথে টানা সোয়া নয় ঘণ্টা বই পড়ার অভিজ্ঞতা।

হঠাৎ…দুম করে এক শব্দ হয়ে বিদ্যুৎ চলে গেল। জেনারেটরের লাইন আসার জন্য অন্তত দুই তিন মিনিট তো অপেক্ষা করতে হবেই। মেজাজটা ভীষণ পরিমান খারাপ হয়ে গেল আরাফাতের। ওয়াইফাই কানেকশনবিহীন ল্যাপটপের সামনে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় কী!
সে একা একাই বলে উঠল,
– অসহ্য গরম। এ জ্বালা সহ্য হয়? উফ্। এদিকে সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে।
জেনারেটরের লাইন তখনো আসেনি। হঠাৎ কে যেন পেছনে এসে দাঁড়ালো। মিষ্টি একটা ঠান্ডা বাতাস আরাফাতকে শীতল করে দিলো মুহূর্তে।
মাথাটা ঘুরিয়ে দেখলো একটা ছয়-সাত বছরের ছেলে। হাতে আদর্শলিপি নিয়ে বাতাস করছে।
আরাফাত আর্তনাদ করে উঠল,
– কে রে তুই?
ছেলেটা বলল,
– খালু, আমি আজিবর। আমনেগো বাসায় কাম করি। খালাম্মারে তো রোজ এমনে বাতাস করি। হ্যায় কইলো আইজ আমনেরে বাতাস করতে।
আরাফাত ওর হাত থেকে কী যেন এক অজানা ভয়ে আদর্শলিপিটা কেড়ে নিয়ে জড়িয়ে ধরল। ছেলেটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে।
বিদ্যুৎ এসে গেছে। শুরু হয়ে গেছে লাইভ। আজিবরকে দেখা যাচ্ছে স্ক্রিনে। উপস্থাপিকা উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে উঠল,
– প্রিয় দর্শক, জনাব আরাফাতকে আইকন বলা হয় এ জন্যই। তার হাতে আদর্শলিপি এবং পেছনে দাঁড়ানো ছেলেটাকে দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, বাসায় কাজ করা শিশুটির বই পড়ার ব্যাপারেও তিনি কতটা উদ্যোগী!
কোনাে কথা না বলে আস্তে করে ল্যাপটপের লিডটা বন্ধ করে ফেলল আরাফাত। পাঠক হিসেবে সে হেরে গেছে চিরদিনের জন্য।


দেশের বই পোর্টালে লেখা পাঠাবার ঠিকানা : desherboi@gmail.com

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD