সুস্মিতা জাফর। তরুণ লেখক ও সম্পাদক। প্রকাশিত হয়েছে একাধিক বই। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে একটি সম্পাদনাগ্রন্থ। বাংলাদেশে লেখালেখি, সম্পাদনা, পাঠক ও বাংলা প্রকাশনার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দেশের বইয়ের পক্ষ থেকে সম্প্রতি কথা হয় এই তরুণ লেখকের সঙ্গে। সাক্ষাতকার বিভাগে আজ প্রকাশিত হলো এই তরুণ লেখকের সঙ্গে কথোপকথন।
একজন তরুণ লেখক হিসেবে মৌলিক লেখা আর সম্পাদনা- কোন কাজটিকে বেশি উপভোগ্য মনে করেন?
অবশ্যই মৌলিক লেখা লিখতে আমি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। নিজের সৃষ্টি অনেকটা মাটির তালের মতো। একে নিজে হাতে গড়ে-পিটে নেওয়া নিজের জন্য সহজ।
কিন্তু সম্পাদনা অনেক কঠিন একটি কাজ। সম্পাদক আর সংকলক কিন্তু আলাদা দু’টো শব্দ। একজন সংকলক কেবল গল্প সংগ্রহ করেন। কিন্তু সম্পাদককে সেই গল্প নির্বাচন করার পর তাতে ছুরি-কাঁচির পোঁচ দিয়ে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংশোধনসহ আরও অনেক কাজ করতে হয়। কাজটি যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ এবং পরিশ্রমেরও বটে। একটি লেখা একজন লেখকের কাছে সন্তানতুল্য।
নিজের লেখায় যত সহজে ইরেজার বোলানো যায়, অন্যের লেখায় সেটা করা ততটাই দুঃসাহসিকতার কাজ বলে মনে হয় আমার। সম্পাদনার চেয়ে মৌলিক লেখা লিখতেই তাই আমি উপভোগ করি অনেক অনেক বেশি।
আপনি কি মনে করেন সম্পাদনার কাজ একজন লেখকের মৌলিক লেখার পথকে বাধাগ্রস্ত করে?সম্পাদনা তখনই করা উচিত যখন একজন লেখক জানেন, মৌলিক লেখা লেখার পর তার হাতে যথেষ্ট সময় বিদ্যমান। তা না হলে সম্পাদনার ভিড়ে নিজের মৌলিক লেখা বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য।
আপনার সাম্প্রতিক সম্পাদনাগ্রন্থ নকশীকাঁথা সম্পর্কে জানতে চাই। এই নামকরণের কোনো বিশেষ কারণ আছে কি?
‘নকশীকাঁথা’ আমার সম্পাদিত প্রথম গল্প সংকলন, যা প্রকাশিত হয়েছে অক্টোবর ২০২১ সালে, পরিবার পাবলিকেশন্স থেকে। এখানে আছে সামসময়িক পঁয়ত্রিশজন গল্পকারের বিভিন্ন জনরার পঁয়ত্রিশটি ছোটগল্প।
প্রকাশনী থেকে যখন আমার কাছে সংকলনের নাম জানতে চাওয়া হলো, তখন এই পঁয়ত্রিশজন লেখকের, একত্রে এত যত্নসহকারে গল্প বুননের কৌশল আর আগ্রহ দেখে ঐ মুহূর্তে আমার যে নামটি মনে এলো, তা হলো ‘নকশীকাঁথা’। গ্রাম-বাংলায় আমাদের মা-খালা, দাদি-নানি এবং পরিবারের সকল নারী একত্রে আয়েশ করে বসে কাঁথার ভাঁজে ভাঁজে সুঁই-সুতোর সূক্ষ ফোঁড়ে যেভাবে জীবনের গল্পগুলো দক্ষতার সাথে গেঁথে রাখেন ঠিক তেমনি ‘নকশীকাঁথা’ গল্প সংকলনের প্রত্যেক গল্পকার নিজ নিজ যোগ্যতায়; সংকলনের প্রতিটি পাতার ভাঁজে ভাঁজে আয়োজন করে বুনেছেন আবেগ, স্বপ্ন আর ধৈর্যের সুনিপুণ প্রতিচ্ছবি।
শুধু নারী লেখকদের লেখা নিয়ে সংকলন করার পরিকল্পনা কেন? আর ৩৫ জন লেখকই বা কেন?
সংসার সামলে ঘরের বাইরে কাজ করার পাশাপাশি লেখালেখিতেও নারীদের অবদান যে কোনো অংশে কম নয়, মূলত এ বিষয়টা তুলে আনার জন্যই নারী সংকলনের পরিকল্পনা।
প্রায় শ’খানেক লেখা থেকে আমার কাছে পঁয়ত্রিশটি গল্প ‘নকশীকাঁথা’ সংকলনে স্থান পাওয়ার মতো উপযুক্ত মনে হয়েছে বলেই এখানে পঁয়ত্রিশ জন লেখকের লেখা বিদ্যমান।
সম্পাদক হিসেবে সম্পাদনার কাজটি করতে গিয়ে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন?
না, হইনি। যখন যে গল্পের কোনো অংশের পরিবর্ধন, পরিমার্জন বা সংশোধন করতে চেয়েছি; তখনই সে লেখক নির্দ্বিধায় তার গল্পে প্রয়োজনীয় সম্পাদনাটুকু আমাকে করতে দিতে রাজী হয়েছেন। অনুমতি দিয়েছেন। আমার পরামর্শ গ্রহণ করা, চাহিদানুযায়ী গল্পের পরিমার্জন করা এবং আমার প্রতি সম্মানিত গল্পকারদের এরূপ বিশ্বাস- তাদের প্রতি আমাকে কৃতজ্ঞ করেছে।
সম্পাদনার প্রয়োজনে নিশ্চয়ই সংকলনের সব গল্প পড়া হয়েছে। সমসাময়িক লেখকদের লেখার প্লট বা ভাবনা কোনদিকে প্রবাহিত হচ্ছে বলে মনে করেন?
নকশীকাঁথার পঁয়ত্রিশটি গল্পের প্রত্যেকটি কম করে হলেও দশের অধিকবার পড়া হয়েছে আমার। সমসাময়িক লেখকরা সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে লিখতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন বলেই মনে হয়েছে। সেই সাথে যুক্ত হচ্ছে থ্রিলার। বিভিন্ন জনরার থ্রিলার গল্প লেখার প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি।
বইয়ের গল্পগুলো কোন ঘরানার?
নকশীকাঁথায় সামাজিক, রোমান্টিক, ফ্যান্টাসি, কল্পবিজ্ঞান, হরর, রম্য, সাইকোলজিকাল থ্রিলার, মিস্ট্রি, ক্রাইম থ্রিলারসহ বিভিন্ন জনরার গল্প স্থান পেয়েছে।
কেউ কেউ বলে থাকেন ইদানিং সম্পাদনাগ্রন্থ শুধুই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থেকে করা হয়ে থাকে। বই বিক্রি ছাড়া সম্পাদক বা প্রকাশকের আর কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য থাকে না। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
নকশীকাঁথার দিক থেকে যদি চিন্তা করি, তবে এক্ষেত্রে আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সমসাময়িক নতুন এবং পুরনো গল্পকারদের একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা।
আপনার মৌলিক বইয়ের কথা বলুন। কী কী বই প্রকাশিত হয়েছে?
আমার লেখালেখির শুরুটা হয় মাত্র ছয় বছর বয়সে। ১৯৯৮ সালে ক্লাস ফোর-এ স্কুল ম্যাগাজিন ‘নূন প্রবাহ’তে প্রথমবারের মতো ছাপার অক্ষরে দেখতে পাই নিজের লেখা গল্প ও ছড়া। জাতীয় দৈনিকের ক্ষেত্রে ১৯৯৯ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের ‘কচিকাঁচার আসর’-এ প্রথম ছড়া এবং একই বছর দৈনিক প্রথম আলোর ‘গোল্লাছুট’-এ প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়।
জাতীয় দৈনিক, লিটল ম্যাগাজিন, রহস্য পত্রিকা এবং পত্র-পত্রিকায় লিখছি প্রায় তেইশ বছর ধরে। গত দুই বছরে প্রায় পনেরটির অধিক সংকলনে গল্প লিখেছি।
‘সোয়েটার’ এবং ‘টেবিল নম্বর ১৭’ আমার দুইটি একক গল্পগ্রন্থ, প্রকাশিত হয়েছে পরিবার পাবলিকেশন্স থেকে। ‘সোয়েটার’-এর পঁচিশটি গল্পই ২০১০-১২ সালে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ‘টেবিল নম্বর ১৭’-এর সতেরটি গল্পের মধ্যে তিনটি গল্প জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছিল ২০১৯-২০ সালে।
তবে ‘সম্পাদক’ হিসেবে এই প্রথমবারের মতো কাজ করার সুযোগ মিলেছে।
বর্তমান সময়ে বাংলা বইয়ের পাঠক সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
এ যুগের পাঠক সাহিত্যমানের চেয়ে আবেগীয় গল্প অধিক পছন্দ করে। যে লেখার ভাষা যত বেশি সহজ, সাবলীল, জটিলতাবিবর্জিত, সাম্প্রতিক বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত; মূলত সে লেখাগুলোই পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।
অনেকে বলেন, বর্তমানে পাঠক বই পড়েন না, লেখক পড়েন। লেখকরাও তাই সাধারণ পাঠকের পরিবর্তে ফ্যান-ফলোয়ার তৈরিতে মনোযোগী। আপনার অভিমত?
লেখক নিশ্চয়ই তার লেখা দিয়ে মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখেন বলেই, পাঠক লেখার সাথে লেখক পড়েন। নিজে একজন সিরিয়াস পাঠক হিসেবে বলছি, যে লেখকের লেখা পড়ে আমার ভালো লাগবে, আমি অবশ্যই তার লেখাই বারবার পড়ব।
সাধারণ পাঠকদের মধ্য থেকেই ফ্যান-ফলোয়ার তৈরি হয়। আর ফ্যান-ফলোয়ার তারাই তৈরি করতে পারেন, যারা পাঠকের চাহিদানুযায়ী কোনো লেখা সৃষ্টি করতে পারে। শুধু সাহিত্যমান ঠিক রেখে লিখে গেলেই তো হলো না, একজন সাহিত্যিককে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে লেখার ধরন এবং বিষয়বস্তুতেও পরিবর্তন আনতে হয়, তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হয়।
বর্তমানে অধিকাংশ তরুণ লেখক মানসম্মত পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতের পরিবর্তে বইয়ের প্রচারণায় বেশি মনোযোগী- এই বিষয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই।
কতিপয় প্রকাশকের ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কিছু লেখক এখন লেখার দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরিবর্তে কত বেশি বই বিক্রি হলো সেদিকে অধিক নজর দিচ্ছে। সে কারণে প্রচারণাতেও সময় দিতে হচ্ছে অনেক। অথচ সে সময়টুকু লেখার ক্ষেত্রে ব্যয় করলে মানসম্পন্ন পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত সম্ভব ছিল।
প্রকাশনা জগতে বলা হয়, প্রকাশক হলো লেখকের অভিভাবক। একজন ভালো প্রকাশক লেখক তৈরির পেছনে, লেখকের বেড়ে ওঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
‘একজন ভালো প্রকাশক লেখক তৈরির পেছনে, লেখকের বেড়ে ওঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন’- আমিও এটাই বলতে চাই।
বাংলা প্রকাশনা ও বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু বলুন।
লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক, প্রুফ রিডার, প্রেস মালিক, বুক বাইন্ডার এবং সর্বোপরি পাঠক- সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রকাশনা শিল্প টিকে থাকে এবং বিস্তার লাভ করে। এর যেকোনো একটির দুর্বলতা বা অসহযোগিতা- ভবিষ্যতে বাংলা প্রকাশনা শিল্প স্থায়ী থাকার সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে তোলে।
লেখালেখি ও সম্পাদনা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই।
সম্পাদনা নিয়ে আমার তেমন কোনো নির্দিষ্ট স্বপ্ন নেই। হয়তো আর কখনো সম্পাদনায় নাও থাকতে পারি। সেটা সময় বলে দেবে।
তবে আমি লিখতে চাই, প্রচুর লিখতে চাই। প্রয়োজনে যথাযথ পড়াশোনা করে, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে এক একটি লেখা সৃষ্টির আনন্দ উপভোগ করতে চাই। এমনিতেও আমি কোনো গল্প লেখার আগে সেই জনরা বা বিষয়ের উপর প্রচুর বই পড়ে তবেই কাজে হাত দিই। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যদি বলি, তবে সাহিত্যমান সম্পন্ন সাহিত্য চর্চা করে যাওয়ার ইচ্ছে আছে।
[ বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের যে কোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য সংশ্লিষ্ট ছবিসহ আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : desherboi@gmail.com ]
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD