এক দুঃসাহসী স্পাইয়ের আশ্চর্য মায়াবী জগতের হাতছানি কিংবা কাউবয় হ্যাট পরা বুনোফুলের সুবাসিনী সুন্দরীর জন্য হাহাকার। আছে ঘরে বসেই বেরিয়ে আসা আমাজানের জঙ্গলের নরমুণ্ডু শিকারীদের গ্রাম। রহস্য, রোমাঞ্চ আর পুরো বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নেওয়ার বাঙালি পাঠকের অনন্য এক যাদুকাঠিরই অপর নাম ‘সেবা প্রকাশনী’।
১৯৬৪-তে যাত্রা। তারও আগে ১৯৬৩-এর মে মাসে বাবা কাজী মোতাহার হোসেনের দেওয়া ১০ হাজার টাকায় সেগুনবাগিচায় প্রেস বসানো। সেগুনের ‘সে’ আর বাগিচার ‘বা’ নিয়ে যে ‘সেবা’ গঠিত হলো তাতেই যাত্রা শুরু হলো এই ব-দ্বীপে থ্রিলার সাহিত্যের এক অনুপম জগত।
আট হাজার টাকায় একটা ট্রেডল মেশিন। বাকি দুই হাজারে টাইপরাইটার। তারও এক বছর পর ১৯৬৪’র জুনে আত্মপ্রকাশ করলো সেবা প্রকাশনী, কুয়াশা সিরিজের প্রথম বইয়ের মধ্য দিয়ে। প্রকাশিত হলেন একজন থ্রিলার লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন।
পার্থ সনজয়-এর সঙ্গে আলাপে সেই স্মৃতিচারণ। সাথে আরও কিছু…
পার্থ সনজয় : আপনি কি কখনও ভেবেছেন, ‘মাসুদ রানা’ সিনেমার চরিত্র হবে?
কাজী আনোয়ার হোসেন : এমন চাহিদা ছিল না আমার। তবে হলে মন্দ কী? যখন শুরু করি, তখন এসব ভাবনার সময় ছিল না। কাজের মধ্যে ব্যস্ত ছিলাম। প্রথম থেকে প্রচণ্ড কাজ। মাত্র পাশ করার পর আমি গান-বাজনা করতাম। বিয়ে-শাদি যখন করলাম, তখন গান-বাজনাও আস্তে আস্তে ছুটে গেল। আমি কাজে নামলাম। রোজগার করতেই জান বেরিয়ে যাচ্ছিল। আমি প্রফেসরের ছেলে। যাদের বিশাল এক সংসার। ৭০০-৮০০ টাকা বেতন পেতেন বাবা। উনি ‘হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট অব স্ট্যাটিসটিকস’ ছিলেন। এটা দিয়ে মা সংসার চালাতেন। খুব যে ভালো ছিলাম, তা না। আবার খারাপ ছিলাম তাও বলব না। ওই সময় পাশ করার পর চাকরির ইচ্ছে ছিল না। আমি ‘এই’ কাজ করতে চাই বাবাকে বললাম। তিনি বললেন, ঠিক আছে। তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় থেকে আমাকে দশ হাজার টাকা দিলেন। আম্মা খুব আপত্তি করলেন। বললেন, ‘টাকাগুলো নষ্ট করবে ও। জীবনে এই বংশে কেউ ব্যবসা করে নাই’…ইত্যাদি।
সেসময় প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হয়েছে। সকাল আটটার সময় যেতাম প্রেসে। রাত ১১টা পর্যন্ত কাজ করতাম। প্রুফ দেখা থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা কাজ নিজে করতাম।
তখন কল্পনাও করিনি, আমার বই এত কিছু হবে। এত দূর যাবে। কখনোই চিন্তা করিনি। যখন যেভাবে এসেছে, সেভাবে চেষ্টা করে গেছি। আমি কোনো কিছুতে সহজে হারতে চাইতাম না। আর চেষ্টা করেছি, সাধ্যমতো ভালো করার। এই তো?
সনজয় : কোনো রিগ্রেট আছে?
হোসেন : না। যা করেছি, ঠিকই করেছি। যে কাজটা করেছি, এর বেশি আমি করতে পারতাম বলে মনে করি না। মনে করি, আমার সাধ্যমতো যা করার, করেছি। এখন ৮৫ বছর বয়স। খুব বেশি কিছু করার নেই। আমার ছেলেরা লিখছে। ইসমাইল আরমান লিখছে, সায়েম সোলায়মানও লিখছে। অনেকেই লিখছে। আমি দেখছি। আমার চেয়ে খারাপ কিছু যে লিখছে কেউ, তা মনে করি না। বরং বেশ ভালোই লিখছে।
সনজয় : সেবার জনপ্রিয়তা ভাটার দিকে- কী বলবেন?
হোসেন : এটা এখন বুঝি না। কারণ, সরাসরি ব্যবসাটার সাথে আমি নেই। আমার বড় ছেলে এখন ব্যবসাটা দেখছে। সে বলেছে, সেল কমেছে। তো, সেল কমার অনেক কারণ আছে। নতুন প্রযুক্তি এসেছে। ফেসবুক এসেছে। ইন্টারনেট এসেছে। সেটির প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। বইয়ের প্রতি আগ্রহ কমেছে।
সনজয় : ‘ই-বুক’ করার পরিকল্পনা আছে কী?
হোসেন : ‘ই-বুক’ করার ভাবনা আছে। যুগের চাহিদা মেটাতে একসময় আমরা ‘প্রজাপতি’ করেছিলাম। এখন অনলাইন করব। ‘ই-কমার্সে’ সেবা প্রকাশিত হবে।
সনজয় : সিনেমার জন্য কয়টি মাসুদ রানার কপিরাইট দেওয়া হয়েছে?
হোসেন : এ পর্যন্ত ৪৬৪টি মাসুদ রানা প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে সিনেমার জন্য প্রথমেই বিক্রি করেছি ‘বিস্মরণ’। এটি মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা) নিয়েছে। সম্প্রতি জাজ মাল্টিমিডিয়া তিনটি নিয়েছে। সব মিলিয়ে সিনেমার জন্য চারটি মাসুদ রানা দেওয়া হয়েছে।
মাসুদ পারভেজ যেটি তৈরি করেছেন, সেটির চিত্রনাট্য আমার। কাহিনিও আমার। যার জন্য ‘বাচসাস’ থেকে চিত্রনাট্যের জন্য আমাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি না, তা পাওয়ার উপযুক্ত ছিলাম আমি। তবে আমার সাধ্যমতো আমি করেছি। মাসুদ পারভেজও তার সাধ্যমতো করেছেন। যিনি নির্দেশনা দিয়েছেন আড়ালে থেকে, সম্ভবত এসএম শফি, তিনিও তার সাধ্যমতো করেছেন। কবরী ও অলিভিয়া অভিনয় করেছেন। তারাও সাধ্যমতো করেছেন। তবে হলিউডের মতো যদি নাও হয়, তবু ঢালিউডের সেরাটাই করেছেন। আমার তো দেখতে বেশ ভালোই লেগেছে।
গল্প আর সিনেমা তো আলাদা হবেই। সে জন্য আমার কোনো ক্ষোভ নেই। জাজ মাল্টিমিডিয়ার ওপরও আমার ভরসা আছে। তাদের কাজের মধ্যে খুব ‘নিটনেস’ দেখতে পাচ্ছি। আর যিনি এবারের চিত্রনাট্য লিখেছেন, অত্যন্ত পাকা হাতে লিখেছেন।
[ সাক্ষাতকারটি কোভিড সময়কালে ২০২০-এর সেপ্টেম্বর নেয়া ]
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD