অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২১ উপলক্ষ্যে ভাষাচিত্রের আয়োজন ভাষাচিত্র লেখক আলাপন লাইভ আড্ডা যা ভাষাচিত্র বুক ক্লাব ফেসবুক গ্রুপে প্রচারিত হয়। বিগত ৩১ মার্চ ২০২১ রাত দশটায় অনুষ্ঠিত হলো এরই একটি পর্ব। অনুষ্ঠানের নিয়মিত উপস্থাপক ‘রবি বাউলের শান্তিনিকেতন’ এবং ‘পথিক পরান’ গ্রন্থদ্বয়ের লেখক রয় অঞ্জনের মুখোমুখি হয়েছিলেন ‘নারীজনম’ এবং ‘স্বপ্নে পাওয়া হাত’ গ্রন্থদুটির লেখক সুমন কুমার, এ বছর ভাষাচিত্র প্রকাশ করতে যাচ্ছে সুমন কুমারের গল্পগ্রন্থ ‘শুভযাত্রা’। সেই আড্ডার সার সংক্ষেপই এই সাক্ষাতকার। লাইভে কমেন্টের মাধ্যমে দর্শকদের মধ্য থেকে অনেকেই প্রশ্ন ও মতামত রেখেছিলেন। সেসব আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের সাথে একত্রে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
রয় অঞ্জন : একটি চলচ্চিত্র দেখেছিলাম। একজন তুমুল জনপ্রিয় পৌঢ় লেখক, যার একটি ধারাবাহিক উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকায়। উপন্যাসের একটি চরিত্র, নাম অলকা- দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। একবার একজন লোক এসে লেখকের কাছে জানতে চাইছেন চরিত্রটির পরিণতি কী হবে। লেখক চরিত্রের পরিণতি প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক এতে পাঠকের আগ্রহ কমে যেতে পারে। লোকটা অনুরোধ করে যেন অলকার পরিণতি বিয়োগান্তক না হয়। কিছুদিন পর এক যুবক লেখকের সাথে দেখা করে, সেও একই বিষয়ে জানতে চায় এবং বলে অলকা যে রোগে আক্রান্ত তা এখন খুব জটিল কিছু নয়। চিকিৎসায় আরোগ্য হওয়া সম্ভব। ফলে অলকার বিয়োগান্তক পরিণতি যুক্তিসঙ্গত হবে না। গল্পের পরিণতি কী হবে সেটা লেখকের নিজের সিদ্ধান্ত, কিংবা এখনও তা ভাবা হয়নি বলে যুবকের ওপর বিরক্তি প্রকাশ করেন লেখক। একরাতে একজন চলচ্চিত্রাভিনেত্রী লেখকের সাথে দেখা করতে আসেন। তুমুল জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে পরিচয় দেন তিনি নিজেকে। লেখককে জানান ধারাবাহিক উপন্যাসটি নিয়মিত পড়ছেন এবং এটা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মান করতে চান। উপন্যাসের অলকা চরিত্রটি তার খুব পছন্দ, সেইসূত্রে জানতে চান অলকার পরিণতি। লেখক তা জানাতে চান না। নায়িকা লেখকের সাথে আর্থিক চুক্তির প্রসঙ্গ তোলেন এবং বলেন অলকার পরিণতি যেন বিয়োগান্তক না হয়। কারণ চলচ্চিত্রের দর্শক পয়সা দিয়ে সিনেমা দেখে এখন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরতে চায় না। এক পর্যায়ে সুন্দরী অভিনেত্রীর প্রস্তাবে রাজি না হয়ে লেখকের উপায় থাকে না। কিছুদিন পর লেখকের সাথে দেখা করা উল্লিখিত তিনজন সাথে এক যুবতীকে নিয়ে হাজির হয়। উপন্যাসের অলকা এবং ওই যুবতীর একই রোগ হয়েছিল এবং মেয়েটি ভাবতো গল্পের অলকার পরিণতি যা হবে তার পরিণতিও একই হবে। ডাক্তারগণের মতে যুবতী নিজেকে উপন্যাসের চরিত্রের সাথে নিজেকে মিলিয়ে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে, এই দুর্বলতা কাটাতে না পারলে তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম। লেখকের সাথে দেখা করা প্রথমজন ছিলেন ওই যুবতীর ভাসুর, দ্বিতীয়জন স্বামী এবং শেষোক্ত নায়িকা পরিচয় দেওয়া নারী তার জা। উপন্যাসের অলকা যেহেতু বেঁচে গেছে ফলে ওই যুবতীও মানসিক এবং শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে গেছে। তারা এসেছেন লেখককে ধন্যবাদ জানাতে। একজন লেখক মানুষের মনে কী পরিমাণ প্রভাব রাখতে পারে এটা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের সাথে আজও আছেন একজন লেখক, যাকে আমি বলি তেজি লেখক। ২০২০ গ্রন্থমেলায় ভাষাচিত্র প্রকাশ করেছিল তার উপন্যাস ‘নারীজনম’, উপন্যাসটি বেশ আলোচিতও হয়েছিল। আর ২০১৯ গ্রন্থমেলায় ভাষাচিত্র প্রকাশ করেছিল তার গল্পগ্রন্থ ‘স্বপ্নে পাওয়া হাত‘। আমাদের আজকের লেখক সুমন কুমার। সুমন কেমন আছ?
সুমন কুমার : জি দাদা ভালো, আপনি কেমন আছেন? আসলে আজকের কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ভালো আছি বলাটা কঠিন, তবে ভালো থাকার চেষ্টা আমাদের করতেই হবে।
রয় অঞ্জন : আমিও ভালো আছি। ঠিকই বলেছ ভালো থাকার চেষ্টা আমাদের করতেই হবে। সুমন কথা হচ্ছিল পাঠকের মনের ওপর লেখনীর প্রভাব নিয়ে। যেহেতু লেখক এই প্রভাব বিস্তার করতে পারে ফলে লেখালেখিতে একজন লেখক হিসেবে আমার উপলব্দি– লেখককে অবশ্যই পাঠকের প্রতি বিনয়ী হতে হবে, সমাজের জন্য কিছু মেসেজ থাকতে হবে, আবার রাখতে হবে সাহিত্যের রসদ এবং রস। এই যে এতগুলো ‘হবে’ কে হাইলাইট করলাম, তা নিয়ে তুমি কী ভাবো?
সুমন কুমার : অনুষ্ঠানের প্রস্তাবনা অংশে আপনি যে চলচ্চিত্রটির গল্প বলেছেন ওটা আমিও দেখেছি। খুবই চমৎকার ভাবনা। পাঠকের ভাবনায় আমার চিন্তাটা প্রতিস্থাপিত করতে চাই বলেই লিখি। যদি আমার বা কারও লেখা পাঠকমুখি না হতো তবে লিখে লিখে বস্তাবন্দী করে রাখাই যুক্তিযুক্ত হতো। প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগ থাকতো না। মানব ইতিহাসে সমাজ সৃষ্টির আগে লেখালেখির খোঁজ পাওয়া যায় না। ফলে পাঠক ও সমাজের জন্যই লেখকগণ লেখেন বলে আমি বিশ্বাস করি। একটি সাধারণ হিসাব হলো মার্কেটিয়ারকে ভোক্তার প্রতি বিনয়ী হতে হবে, এ জন্য তারা নানারকম প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, নিয়ত অনুশীলন করতেই থাকেন। লেখক তার চিন্তা ভাবনা মার্কেটিং করেন, ফলে পাঠকের প্রতি বিনয়ী না হয়ে উপায় নেই, পাঠকই তার চিন্তা ভাবনার ভোক্তা। যা মানুষের কোন কাজে আসে না, তা কোন উৎপাদন নয়। লেখক এবং প্রকাশক মিলে যা উৎপাদন করেন তা সমাজের জন্যই করেন। ফলে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা একটি পুস্তকের রয়েছে। একটি লেখায় সমাজের জন্য সরাসরি মেসেজ থাকতে পারে। এই ধরনের সরাসরি অ্যাপ্রোচকে থিয়েটারে বলা হয় রাফ থিয়েটার। আবার সরাসরি কোন মেসেজ নাও থাকতে পারে। লেখাগুলো পাঠকের মনন ও চিন্তনে আঘাত করতে পারে, যার ফলে পাঠের পর সে নিজেই কিছু মেসেজ আবিস্কার করতে পারে। উৎকৃষ্ট সাহিত্য হচ্ছে কবিতা, কবিতা আবিস্কার করারই বিষয়। সব কথা একটি লেখায় সরাসরি বলতে হবে তা মনে করি না, লেখক হিসেবে আমি কিছু বলব এবং পাঠক কিছু চিন্তা করে নেবে। একটি গ্রন্থের কাজই চিন্তার জানালা খোলা। এর মাধ্যমে পাঠকের সাথে লেখকের যোগাযোগ তৈরি হবে। রস সম্পর্কে আমি লেখাপড়া করেছি। মানুষের প্রাত্যহিক আচরণের মধ্যেই রস লুকিয়ে থাকে। সেগুলোকে যথাযথভাবে লেখার মধ্যে সন্নিবেশিত করাই লেখকের কাজ। এখানেই একটি দলিল, চুক্তি, নির্দেশনা, প্রজ্ঞাপন, বিচারের রায় কিংবা পরিপত্রের লেখকের থেকে সাহিত্যিক আলাদা হয়ে ওঠে। ফলে আপনি যে ‘হবে’ কে হাইলাইট করেছেন তার সাথে লেখক হিসেবে একমত আমাকে হতেই হবে।
রয় অঞ্জন : তাসমিনা, একটা বাচ্চা মেয়ে, গরীব হলেও তার নেশা ঘোড়া দৌড়। ঘোড়াকে খুব আদর করতো সে। তেমনই একটা চরিত্র ফজিলা, ২০১৯ সালে প্রকাশিত তোমার ‘স্বপ্নে পাওয়া হাত’ এ। প্রশ্ন হচ্ছে তুমি যখন ফজিলাকে সৃষ্টি করো, এই ফজিলা কি তোমার জীবনে পাওয়া কোন চরিত্র নাকি কল্পনা প্রসূত সৃষ্টি? ফজিলার এই জীবনবোধ এবং জীবের প্রতি বোধটা নিয়ে কিছু বলতে যদি।
সুমন কুমার : তাহমিনাকে আমরা সংবাদ মাধ্যমে জেনেছি। পশু বিক্রি করে পালকের কান্নারত ছবিও দেখেছি আমরা। যুগে যুগে সাহিত্যিকগণ সর্বপ্রাণবাদ চর্চা করেছেন। অনেক মহান সাহিত্যিক লিখেছেন নির্বোধ প্রাণিদের নিয়ে। বাংলা সাহিত্যেও এর উদাহরণ আছে। শরৎচন্দ্রের মহেশ, তারাশঙ্করের ছোটোগল্প ‘কালাপাহাড়’ কিংবা সেলিম আল দীনের আখ্যান ‘ধাবমান’ আমাকে ভাবিয়েছে। ‘স্বপ্নে পাওয়া হাত’ বইতে গ্রন্থিত ‘অসম্ভব শক্তিধর গাড়িটানা ঘোড়াটি’ গল্পের ফজিলা চরিত্রটি লেখক স্বয়ং একথা বিশ্বাস করতে পারেন। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে, মাঝে মাঝে শুকরের দল চরাতে আসতো কাহাররা। যারা শুকর চরায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ‘কাহার’ বলা হয় তাদের। তখন কম বয়সীরা লাঠি নিয়ে যেতাম সেগুলো পেটাতে। নিরাপদ মনে করলেই কোন একটাকে আঘাত করে সরে পড়তাম। পরে বড়ো হয়ে ভেবেছি, কেন ক্রিড়াচ্ছলে ওই রকম নিষ্ঠুর কাজটি করতাম? তখনকার আচরণ আমাকে ব্যথা দেয়, পাপবোধ জাগিয়ে তোলে। ফলে ধরে নিতে পারেন ফজিলা চরিত্রের মধ্য দিয়ে একটি প্রায়শ্চিত্ত রচনা করেছি। পৃথিবী ধ্বংসের জন্য আমরা মানুষরা বোমা বানাচ্ছি, বনে আগুন লাগিয়ে দাবানল বলে প্রচার করছি। অথচ পৃথিবী কেবল মানুষের নয়। কথা বলতে পারে না এমন অসংখ্য প্রাণের দাবি রয়েছে পৃথিবীর ওপর। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে পৃথিবীর অন্যান্য সকল প্রাণের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা রয়েছে। আমি নীতি নির্ধারক পর্যায়ের কোন বৈশ্বিক নেতা নই, প্রভাবশালী প্রাণি অধিকাররক্ষা কর্মী নই, ধনাঢ্য ব্যক্তি নই। ফলে অনেক কিছুই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও করতে পারি না। কিংবা ওগুলো করা গল্পকারের দায় নয়। আমি যা পারি তা হচ্ছে এ বিষয়ে কিছু লিখে ফেলতে পারি, সেই দায়বদ্ধতা থেকেই গল্পটি লেখা। আপনার প্রথম প্রশ্নে হাইলাইট করা যে ‘হবে’ তার একটি ‘হবে’ এখানে মিলে যেতে পারে।
রয় অঞ্জন : ইল্যুশন, একটা মনস্তাত্বিক বোধ। মনোবিজ্ঞানীদের চোখে এটা একটা রোগও। একটা শার্ট, সাদা শার্ট, হ্যাংগারে ঝুলানো, দেয়ালে অসংখ্য শার্ট, জানালা দিয়ে যে স্থলপদ্মগাছ দেখা যাচ্ছে তাতেও ফুলের বদলে ফুটে আছে অসংখ্য সাদা শার্ট। তোমার ‘স্বপ্নে পাওয়া হাত’ গল্পে একটা চমৎকার ইল্যুশন তৈরি করেছ এই শার্ট নিয়ে, ব্যাখ্যাটা প্লিজ।
সুমন কুমার : অনেকেই রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে পাগল বলেছিলেন। তার অন্যতম অনুসারী স্বামী বিবেকানন্দও তেমনটাই ভেবেছিলেন প্রথম দর্শনে। দেখার দলে কতজন তার ওপর নির্ভর করে কোনপক্ষ মানসিক রোগী। আবার ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সভ্য প্রবীর ঘোষ পরমহংসদেবের ঈশ্বরের দর্শনের ঘটনাটি স্বীকারও করেছেন। প্রবীর ঘোষ হচ্ছেন ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ সিরিজের লেখক, তাঁর একটি বহুল পঠিত গ্রন্থ ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাসী নই’। তিনি বলেছেন চোখটা ইনপুটের একটা যন্ত্রমাত্র। মূল ছবিটি মস্তিষ্কে প্রসেস হয়, এটা ক্যামেরার সিমোসের মতো, ক্যামেরার কাজ এই রকমই। কেউ প্রতিনিয়ত একটি বিষয় নিয়ে ভাবলে মস্তিষ্কে এই চিন্তার একটি ছবি প্রসেস হয়ে যেতে পারে। এভাবেই হয়ত পরমহংসদেবের ঈশ্বর দর্শনের ঘটনাটি ঘটেছিল। সাহিত্যে ম্যাজিক রিয়ালিজম, সুরিয়ালিজম, ফোরিয়ালিজম প্রভাবিত উৎকৃষ্ট কিছু রচনাও আমি পড়েছি। সেগুলো আমাকে প্রভাবিত করেছে। ‘একটি শার্ট’ গল্পে মজিদ জানালা দিয়ে বাইরের স্থলপদ্মগাছে ফুটে থাকা অসংখ্য সাদা শার্ট দেখতে পেয়েছিল। ঘরময় বিচিত্র শার্ট ঝুলছিল। এমনকি বাইরে দরজার শব্দকে সে ভাবছিল কোন শার্ট বুঝি নক করছে। গল্পে তার স্বপ্নের মধ্যে বলা হয়েছে শার্ট সম্পর্কে মজিদ কী কী ভাবতো। ছেলেটার জীবনের ভাবনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে কেবল একটি ভালো জামা। সে বিলবোর্ডে শার্ট গায়ে মডেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রেমিকা শার্ট প্রসঙ্গে কী বলেছিল তা নিয়ে ক্রমাগত ভাবে। ফলে সেই ছেলে স্বপ্নে শার্ট দেখবে এটাই স্বাভাবিক। এটা প্রবীর ঘোষের ব্যাখ্যায় পরমহংসদেবের ঈশ্বর দর্শনের মতই সম্ভব। নিঃসন্দেহে স্থলপদ্মগাছে ফুলের বদলে সাদা শার্ট ফুটে থাকা এবং বেলা বাড়ার সাথে সাথে তা গোলাপি রঙে পরিবর্তন হওয়ার বর্ণনা ইল্যুশন তৈরির চেষ্টা। যখন গল্পটি পাঠ করি তখন ওই অংশটা পড়ে সত্যি খুব ভালো বোধকরি।
রয় অঞ্জন : স্বপ্নে পাওয়া হাত- নামটা শুনে একটা অদৃশ্য হাতের কথা মনে আসতেই পারে, হতে পারে ঈশ্বরের হাত, যা উপকারের জন্য আসে, আবার হতে পারে কোন অদৃশ্য কালো হাত, অশুভ কিছু। এই স্বপ্নে পাওয়া হাত কিংবা এই নামকরনের যৌক্তিকতা বা আগ্রহের কথা যদি বলতে।
সুমন কুমার : ‘স্বপ্নে পাওয়া হাত’ একটি গল্পের নাম এবং একটি গল্প সংকলনের নাম। ২০১৯ গ্রন্থমেলায় ভাষাচিত্র প্রকাশ করেছিল। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম বলেছিলেন স্বপ্ন সেটা নয় যা মানুষ ঘুমিয়ে দেখে, স্বপ্ন হচ্ছে সেটা যা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না। আমি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিষয়ে লেখাপড়া করেছি। কিন্তু পেশাগত কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রকৃত নাট্যচর্চা করতে পারি না। শিল্পের কোন একটি মাধ্যমে সম্পৃক্ত থাকতেই হবে এই তাড়না সব সময় বোধ করতাম। লেখালেখিতে হাত ছিল বাল্যকাল থেকেই। ২০১৬ সাল থেকে তাগিদ বোধ করতাম ভাবনাগুলো বই আকারে প্রকাশ করার। বলতে পারেন ওই তাগিদ আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছিল না। সব সময় ভাবতাম কবে আমার হাতটি একজন সত্যিকার লেখকের হাত হয়ে উঠবে। ‘স্বপ্নে পাওয়া হাত’ গল্পটি একটি ধারাবাহিক স্বপ্নের বিবরণ দিয়ে শুরু। এমন স্বপ্ন আমি দেখেছি। নাটকের এপিসোডের মতো। এখনকার ভাবনা কিছু সময় পর যদি বাস্তবে পরিণত হয় তবে তাকে ফোরিয়ালিজম বলে। কিন্তু মানুষ স্বপ্নে যার ধারণা পেয়েছে সেটা যদি পরে বাস্তবে পরিণত হয় তবে বিষয়টিকে কী বলা যায় সে আমার জানা নেই। লেখক হয়ে ওঠার তাগিদ এবং গল্পটির বিবরণ ও পরিণতি এটাই সংকলনটির নাম হিসেবে ‘স্বপ্নে পাওয়া হাত’ পছন্দ করার প্রেরণা।
রয় অঞ্জন : মেলায় তোমার পাঠকগন যখন তোমাকে চাইবে, স্টলে চাইবে, কীভাবে থাকবে বা থাকছো পাঠকের কাছাকাছি?
সুমন কুমার : যেহেতু আমি ঢাকার বাইরে থাকি ফলে মেলায় নিয়মিত উপস্থিত থাকা সম্ভব হয় না। তবে বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে কারও কাছ থেকেই দূরে থাকার উপায় নেই। দূর মহাদেশের প্রতারক যেমন আমাকে খুঁজে পায় তেমন দূর দেশের সমসাময়িক সাহিত্যিকও আমার বন্ধু হয়ে ওঠে। তাছাড়া করোনা অতিমারী আমাদের শিখিয়েছে কীভাবে অনলাইন মাধ্যমে কাছাকাছি থাকতে হয়। প্রতিটি দুর্যোগ পৃথিবীকে অনেকটা পথ এগিয়ে নিয়ে যায়। ফলে স্টলে থাকি বা না থাকি আসলে পাঠকদের কাছেই আছি। এত কাছে যে চাইলেই তিনি আমাকে আঙুলে স্পর্শ করতে পারেন। ফেসবুকে বা মেসেনজারে কেউ যখন সুমন কুমার নামের ওপর মোবাইল স্ক্রিনে ট্যাপ করে তখন তো আমাকেই স্পর্শ করে। তবে মুখোমুখি সাক্ষাত সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ, সেই সাক্ষাতের জন্য আমিও উদগ্রীব হয়ে আছি। অবশ্যই পাঠকদের সাথে মিলিত হতে মেলায় উপস্থিত হবো।
রয় অঞ্জন : ‘নারীজনম’ গতবছরে প্রকাশিত হওয়া উপন্যাস, বলা যেতে পারে এক দুঃসাহসিক অথচ নান্দনিক বর্ণনা রয়েছে এর মধ্যে, নিজেকে ঢেলে লিখেছ। বিশেষ করে নারীর অগ্রযাত্রার একটা বড় অন্তরায় হিসেবে দেখিয়েছ নারী অঙ্গকে। কিন্তু নারীর এই অঙ্গ তো আমাদের সমস্ত মানব জাতির একটা বিশাল মহিমা। তোমার এই উপন্যাসে কিংবা না বলা কথায় কি আমরা এই মহিমাকে পাই?
সুমন কুমার : চমৎকার প্রসঙ্গ। নিঃসন্দেহে নারী অঙ্গ আমাদের সমস্ত মানব জাতির জন্য এক বিশাল মহিমা। ক্ষুদ্র প্রয়াস ‘নারীজনম’ দ্বারা নারীত্ববাচক অঙ্গকে মহিমান্বিত করার সামর্থ্য আমার নেই। কেবল চেষ্টা করেছি বিষয়টা মানুষকে পূণরায় স্মরণ করিয়ে দিতে। অতীতে দেশে দেশে কালে কালে নারীর জীবনে অন্তরায় ছিল, আবার কিছু সুযোগও ছিল। অতীতের অন্তরায়গুলোর কিছু এখন নেই। তবে যে সকল স্থলে সুযোগ ছিল তেমন কিছু জায়গায় নতুন করে অন্তরায় স্থাপিত হয়েছে। নারীর বিরুদ্ধে কথা বলা এবং শোনা এখন উপভোগ্য একটি ব্যাপার। কিন্তু কীভাবে ভুলে যেতে পারি আমরা যা বলছি বা শুনছি ওই সকল কথা আমার মা, বোন, স্ত্রী এবং কন্যারও বিরুদ্ধে।
রয় অঞ্জন : ‘নারীজনম’ নিয়ে একটু ডিটেইল যদি বলতে।
সুমন কুমার : আমি ঠিক তাই লিখেছি, যা দীর্ঘ পাঠে পেয়েছি। আমি দেখেছি পুরান, ইতিহাস এবং বর্তমান গণমাধ্যম ও শিল্পচর্চা নারীর অঙ্গের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সাক্ষ্য দেয়। নির্যাতন এবং সহিংসতার ধরন পালটেছে তবে পরিস্থিতি ঘুরে ফিরে একই রকম আছে। কিংবা বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে বলতে হবে আনুপাতিক হিসেবে কিছুটা পিছিয়ে গেছি। ফলে নারীর মহিমাময় অঙ্গ নিয়ে আমি লিখতে চেয়েছিলাম। বিশেষত নারীর যে অঙ্গটি মানবজাতিকে বাঁচিয়ে রাখে তার প্রতিই যেন পুরুষের ক্রোধ বেশি। আবার নারী ক্ষতিগ্রস্ত হয় কেবল পুরুষের লোলুপ দৃষ্টির জন্য নয়, ভালোবাসার জন্যও। বানরের দলের মধ্যে যারা কিশোরী তারা অন্যের শিশুকে কোলে নিয়ে আদর করে। ওই শিশুকে কেন্দ্র করে অন্য কিশোরীর সাথে কখনও কখনও লড়াই শুরু হয়ে যায়। তখন যার অধিকারে থাকে শিশুটিকে সে পেতে বসে মারামারি করে যেন অন্যরা ছিনিয়ে নিতে না পারে। এতে কখনও কখনও বানর শিশুর মৃত্যুও ঘটে। বিষয়টা ঠিক এই রকম। নারীবাচক অঙ্গকে পুরুষ অধিক ভালোবাসে একারণেও তা অনেকক্ষেত্রে নারীর জীবনহানির কারণ হয়ে ওঠে। বর্তমান সময়ের এক নারী কীভাবে তার নারীবাচক অঙ্গের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং পুরানে-ইতিহাসে নারীর এই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কী বিবরণ রয়েছে তা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি ‘নারীজনম’ উপন্যাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে নারীর প্রতি নিপীড়ন বিরোধী একটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। যার ফলে কর্মক্ষেত্রে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিপীড়ন বিরোধী একটি নীতিমালা মহামান্য হাইকোর্ট থেকে ২০০৯ সালে আমরা পেয়েছিলাম। ওই ঘটনা সমাজে নারীর প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে আমাকে ভাবিয়েছিল। ‘নারীজনম’ লিখতে গিয়ে আমাকে নারী শরীরের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে হয়েছে। বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমে নারীকে কীভাবে দেখানো হয়েছে সেসব আমাকে বিশ্লেষণ করতে হয়েছে। বিবরণ অশ্লীলতার দিকে ঝুঁকে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। আমার বন্ধুদের বারবার এটা পড়তে দিতাম। বিবরণগুলো সম্পর্কে তাদের মতামত এবং অনুভূতি জানতে চাইতাম। সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি ওটা কাটিয়ে উঠতে। বাকিটা পাঠক ভালো বলতে পারবে।
রয় অঞ্জন : নিউ ঊষা অপেরা। একটা যাত্রা দল। যাত্রাশিল্পটা আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে বিলুপ্ত প্রায়। যা একটু নাক উঁচু করে অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে, তাও ম্লান হয়ে যায় এই শিল্পে অনাচারের কথা মুখে মুখে থাকার কারণে। বিশেষ করে গ্রিনরুমের কথা যদি বলি। তোমার এবারের বই ‘শুভযাত্রা’ এখানে এমনই একটা প্রজাপতি প্রেমের কথা বলেছ, ভোমরা প্রেম বলতে উড়ে এসে পাপড়ি দখলের মত। জানতে চাই–পাপড়ি রাজিয়ার ওপর এসে বসেছিল ভ্রমর আলতাফ। সেই দৃশ্যপটে আমাদের পাঠকরা কী পাচ্ছেন?
সুমন কুমার : নিম্নবিত্তকে নিয়ে সমস্যার শেষ নেই। তারা প্রেম করে এটা সমাজের সমস্যা, মদ্যপান করে- সমস্যা, এমন কী তারা শিল্পচর্চা করলে সেটাও একটা সমস্যা। প্রকৃতপক্ষে এই সমস্যাগুলো তৈরি করেছে উচ্চবিত্ত। নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু যাত্রা করতে গেলে দরকার হয় প্রশাসনের বিশেষ অনুমতি। অর্থাৎ শাসকরা এটাকে নাটক হিসেবেই মানতে চায় না। কারণ তারা উচ্চবিত্তকেই প্রতিনিধিত্ব করে। এটা কলোনাইজড মানসিকতা। কলোনিয়াল প্রভুরা তো উচ্চবর্গই। যাত্রাদলের মালিক কিংবা শিল্পীরা মূল ব্যবসায়ী নয়। যারা ব্যাবসা করে তারা উচ্চবিত্ত এবং উচ্চবর্গ। তারাই ব্যবসায়িক স্বার্থে শিল্পটিকে ধ্বংস করেছে। মোটের ওপর শিল্পচর্চাকেই উচ্চবিত্ত ভালো চোখে দেখে না। দেশে যারা থিয়েটারের হর্তাকর্তা তারাও যাত্রাশিল্পের এই বিশেষ অনুমতি প্রসঙ্গে কিছু বলেছেন বলে জানা যায় না। যাত্রাদলের মানুষের চরিত্র, গ্রিনরুম সম্পর্কে মুখরোচক কথাবার্তা এইসব পেরিয়েও যে তারা আর দশটা মানুষেরই মত। তার মনেও প্রেম আসে, তারা সংসার করে, সন্তানাদি হয়- সেগুলোই এই গল্পে বলতে চেয়েছি। ব্যবচ্ছেদ করার চেষ্টা করেছি যে তারা এলিয়েন নয়, ঠিক কীভাবে যাত্রা দলে এসেছিল। আপনি আমি তাদের চরিত্র রসাতলে যাওয়া নিয়ে যে গল্প করে বেড়াই তা ঠিক কে কীভাবে ঘটিয়েছিল। এসব নিয়ে বিস্তর সাহিত্যচর্চা হয়েছে, উদাহরণ হিসেবে এই মুহূর্তে আমার শিক্ষক সেলিম আল দীনের ‘কিত্তনখোলা’ আখ্যানের নাম মনে পড়ছে। যাত্রাশিল্পীর জীবনের অজানা অনুচ্ছেদের উন্মোচনই ‘শুভযাত্রা’ গল্প সংকলনের ‘শুভযাত্রা’ গল্পটি।
রয় অঞ্জন : এবারে ভাষাচিত্র কর্তৃক প্রকাশিতব্য গল্প সংকলন হচ্ছে ‘শুভযাত্রা’। একটা গল্প নাম ‘মিষ্টিপান’ নিটোল প্রেম যেমন আছে নিকষ কালো অভিমানও আছে, একই ধরনের অভিমান ‘তরি’ গল্পে তরী, সুপ্রিয়, মুন্না আর শান্তদের মধ্যে। যখন প্রেমটা চলছিল মনে হচ্ছিল নামগুলো যথার্থ, কিন্তু অভিমানটা যখন তীব্র করে দেখিয়েছ, তখন কেন মনে হয় মিষ্টিপান নামটা এবং স্বাদটা ঝাঁজালো। ‘মিষ্টিপান’ এবং ‘তরি’ গল্প দুটি নিয়ে কিছু যদি বলতে যদি।
সুমন কুমার : ‘শুভযাত্রা’র গল্প চারটিকে আমি বলছি বড়ো আকারের গল্প কিংবা ছোটো আকারের উপন্যাস। বলার কারণ কেবল এগুলোর আকার নয়। বিস্তার এবং কাঠামো কৌশল উপন্যাসের মতই। এগুলো জীবনের টুকরো কোন বিবরণ নয়। একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের পরিপূর্ণ গল্প। আর গল্পগুলো একই সংকলনে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার কারণ এগুলোর প্রধান চরিত্র নারী এবং প্রত্যেকের মধ্যে সকল পরিস্থিতি থেকে ইতিবাচকভাবে অগ্রসর হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। ‘শুভযাত্রা’ গল্প সংকলনের দুটি গল্প হচ্ছে ‘তরি’ এবং ‘মিষ্টিপান’। কোন এক কুয়াশার সকালে একজন নারী, চারজন পুরুষ যাত্রী এবং এক মাঝির পদ্মানদীতে হারিয়ে যাওয়ার গল্প এটা। স্ব স্ব সময়ে প্রত্যেককে একই গভীরতায় ভালোবাসা যায়। এটাই স্বাভাবিক। তবে সংসার অন্য জিনিস। প্রেমের সুখ দুঃখ আর সংসারের সুখ দুঃখ আলাদা। সাংসারিক সুখ দুঃখের গল্প হলো ‘মিষ্টিপান’। পান একটি ঝাঁজালো চর্ব্য খাদ্যবস্তু। যা থেকে মানুষ বিনোদনমূলক তৃপ্তি আহরণ করে। স্বাদটা ঝাঁজালো হলেও অনুভূতি চমৎকার। এটা ঠোঁট লাল করে, মুখে সুগন্ধ আনে। সর্বোপরি এটা দ্বারা সম্মানজনকভাবে করা হয় অতিথি আপ্যায়নও। অর্থাৎ ঝাঁজালো বস্তু থেকে চমৎকার ফল লাভ হয়। পানের এই চমৎকার গুণ কেবল পাতা থেকেই আসে না। তার জন্য সহযোগী কিছু উপাদানও দরকার হয়। সেগুলোর যথাযথ মিশ্রণের ফলেই পাতাটি উপভোগ্য হয়ে ওঠে। কমবেশি হলে স্বাদ পাওয়া যাবে না, জিহ্বা পুড়ে যেতে পারে। এমনকি অনভ্যাস থাকলেও এটা উপভোগ্য হয় না। সংসারটাও ঠিক একই রকম, সব কিছুর মিশ্রণ সঠিক মাত্রায় হতে হয়ে। এমনকি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি সম্পর্কে ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। দুটি সংসারে সুখ সংক্রান্ত ধারণার তুলনামূলক বিবরণই হচ্ছে ‘মিষ্টিপান’ গল্প।
রয় অঞ্জন : ভাষাচিত্র এবং এর স্টেয়ারিং যার হাতে- খন্দকার সোহেল, এই নিয়ে কিছু বলতে যদি।
সুমন কুমার : প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাষাচিত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং পরিশীলিত। প্রকাশনার বিষয়টি এখানে ঘটে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে। সাথে নতুনদের উৎসাহিত করার সাহস রয়েছে ভাষাচিত্রের। সাহস বলছি এই জন্য যে প্রকাশনা কোন চ্যারিটি ওয়ার্ক নয়, এর সাথে লাভ-ক্ষতি এবং অনেক মানুষের কর্মসংস্থান জড়িয়ে রয়েছে। ফলে অপরিচিত কোন লেখকের লেখা প্রকাশ করার মধ্যে ঝুঁকি আছে। ভাষাচিত্র সেই ঝুঁকি অনায়াসে নেয়। হাজার হাজার মানুষ লেখালেখির বিস্তৃত আঙিনায় প্রবেশ না করলে কয়েকশ লেখক তৈরি হয় না। ফলে তরুনদের প্রকাশিত হতে না পারাটা জাতির জন্য বিশাল ক্ষতি। ব্যক্তি খন্দকার সোহেলকে নিয়ে বলার কিছুই নেই। তিনি কারও প্রিয়জন আবার কারও অপ্রিয়। শুধু এটাই বলতে চাই, একটি সত্যিকার সাহিত্যবান্ধব প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রত্যয়ে তার যে অভিযাত্রা, এর চেয়ে বড়ো কাজ আর কিছুই নয়। ভাষাচিত্রের অসংখ্য উদ্যোগের সাথে আমি পরিচিতি। সকল আইডিয়া সব সময় কাজ করে না। ধরা যাক দশটি আইডিয়া নিয়ে কাজ চলছে ভাষাচিত্রে। মধ্যে যদি একটি আইডিয়াও কাজ করে তবে এদেশের সাহিত্যপ্রেমি এবং পাঠকরা এগিয়ে যাবে অনেকটা পথ। খন্দকার সোহেলের আইডিয়াগুলো এতটা শক্তিশালী। কখনও কখনও ব্যক্তি আর প্রতিষ্ঠান মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। কুমিল্লা বার্ড এর নাম শুনলেই আখতার হামিদ খানের নামও স্মরণে আসে। যেমন স্যার ফজলে হাসান আবেদ নামটি শুনলেই মাথায় আসে ব্র্যাকের নাম। গ্রামীন ব্যাংক আর ড. ইউনূস যেন একই সত্ত্বা। একদিন সারাদেশে ভাষাচিত্র আর খন্দকার সোহেল তেমন বিপ্রতীপ হয়ে উঠবে সেই সম্ভাবনা প্রবল।
রয় অঞ্জন : আলাপে আলাপে জমে উঠেছিল আড্ডা। সময় হলো আজকের আয়োজন শেষ করার। সুমন পাঠকদের উদ্দেশে তোমার যদি কিছু বলার থাকে, এর পরই আমরা শেষ করব।
সুমন কুমার : বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সুপরিচিত শেফ গর্ডন র্যামসে। টেলিভিশনে তাঁর রান্না বিষয়ক নানান অনুষ্ঠান উপভোগ করি। এর মধ্যে একটা অনুষ্ঠান আমার খুব প্রিয়। সেই অনুষ্ঠানে অবস্থা ক্রমাগত খারাপের দিকে যেতে থাকা কোন রেস্টুরেন্টকে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পরিবর্তন করা হয়। এর মধ্যে থাকে রেনোভেশন, মেন্যু পরিবর্তন কিংবা সংশোধন, ম্যানেজারিয়াল ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যাটিটিউড ডেভেলপমেন্ট, কর্মীদের দক্ষতা ও ম্যানার উন্নয়ন। শেষে রেস্টুরেন্ট ভোক্তাদের উদ্দেশে খুলে দেওয়া ও খাবার পরিবেশন। নির্বাচিত বেশিরভাগ রেস্টুরেন্ট বেশ গর্জিয়াস কিন্তু সেগুলো এমন শহরে অবস্থিত যার লোকসংখ্যা ৫০০০-১৫০০০ হাজার, সেখানে ওই স্ট্যাটাসের একটি রেস্টুরেন্টে পর্যাপ্ত গ্রাহক পাওয়া কঠিন। গর্ডন র্যামসে যখন উদ্যোক্তার সাথে আলাপ করেন তখন অনেকক্ষেত্রেই তাঁরা স্বীকার করেন, রেস্টুরেন্টটির বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট অর্থ তাদের হাতে নেই। তখন গর্ডন র্যামসে শহরের সভ্যদের নিকট গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অবস্থা এবং কী করা দরকার তা খুলে বলেন। সভ্যরা অনেকেই অনুদান প্রদান করে। ডোনেট কেন করে তা সহজেই বোঝা যায়। আমার বর্তমান অফিসের আশেপাশে ভালো কোন রেস্টুরেন্ট এমনকি ন্যূনপক্ষে স্যান্ডউইচ বা কফি খাওয়ার মতো দোকানও নেই। আবার অফিসের চা একটি সুনির্দিষ্ট সময়ে দেওয়া হয়। ফলে রুটিন সময়ের বাইরে কোন গেস্ট এলে পড়তে হয় বিপদে। আমরা অনেককে এ ধরনের ব্যবসায় শুরু করতে উৎসাহিত করি এবং বলি দিনে অন্তত এতজন অমুক পণ্যটি ক্রয় করব, যাতে তিনি শুরুর পর জনপ্রিয় না হওয়া পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেন। তো কোভিড-১৯ এর কারণে আমাদের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো এমন একটি কঠিন সময় পার করছে। এখনই প্রকাশকদের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে। লক্ষাধিক মানুষ নানাভাবে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। কেউ প্রকাশনীতে চাকরি করে, কেউ ফ্রিল্যান্স প্রুভ দেখে। কাগজ, কালি, বাঁধাই ও প্রেসও প্রকাশনার সাথে জড়িত। ধারণা করতে পারি, এই পরিস্থিতির জন্য বাংলাদেশের অন্তত অর্ধেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ক্ষতির এমন জায়গায় পৌঁছে যাবে যেখান থেকে উঠে আসা দুরুহ, যদি আমরা সেগুলোর পাশে দাঁড়াতে না পারি। পৃথিবীর অনেক ভাষায় কোন মহাকাব্য নেই। এমনকি ডয়েচে ভাষায় একটিই মহাকাব্য- ফাউস্ত। আমরা গর্ব করে বলি, আমাদের ভাষায় কয়েকটি মহাকাব্য রচিত হয়েছে। আমাদের ভাষার সবচেয়ে বড়ো সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মানুষের জানা। কিন্তু বুকইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হয়ে গেলে উঁচুমাপের কোন সাহিত্যিক আর বের হবে না। দরকারী বিষয়ের বইটি আপনি কোথাও পাবেন না কারণ ওই বইটি কখনওই প্রকাশ হবে না। ফলে পাঠকের কাছে অনুরোধ আপনারা বই কিনুন। এখন বাড়ি বসেই বই ক্রয়ের নানান সুযোগ তৈরি হয়েছে। গ্রন্থমেলায় যেতে না পারলে সেগুলো ব্যবহার করুন। আপনার জায়গা থেকে যতটুকু করা সম্ভব ততটুকু করুন। এখন একটি বই ক্রয় মানে প্রকাশনা সংস্থার শরীরে এক ফোটা রক্ত সরবরাহ করা। প্রকাশনা সংস্থা তাতে আরও কিছু সময় লড়াই করার রসদ পাবে। দেশে পাঠকদের অসংখ্য গ্রুপ আছে। প্রকাশকগণও এ রকম গ্রুপ চালাচ্ছেন। ভাষাচিত্র গ্রুপের কথাই ধরা যাক। সেখানে তেরো হাজারের বেশি সদস্য। দশ শতাংশ সদস্যও যদি দুটি করে বই ক্রয় করে তাতে গ্রন্থমেলায় যে ক্ষতি হতে যাচ্ছে তা অনেকাংশে কমে আসতে পারে। আমি এটা বলছি না যে আমার বই কিংবা ভাষাচিত্রের বইই কিনতে হবে। আপনার দরকারী বইটিই কিনুন, প্রিয় লেখক ও প্রকাশনীর বইটিই কিনুন। তাতে বুকইন্ডাস্ট্রি বাঁচিয়ে রাখতে আপনারও কিছু অবদান তৈরি হবে।
রয় অঞ্জন : খুব ভালো বলেছ সুমন। বই এবং বুকইন্ডাস্ট্রির প্রতি ভালোবাসা না থাকলে এভাবে বলা যায় না।
সুমন কুমার : দাদা আপনার ‘পথিক পরান’ গ্রন্থের জন্য শুভ কামনা রইল। আজই ফেসবুকে একটি রিভিউ চোখে পড়েছে। যেই লিখে থাকুক চমৎকার লিখেছে। ভ্রমণসাহিত্য বলতে আমার কাছে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালমৌ’ হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড। ভ্রমণ করার জন্য বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন কোন জায়গার দরকার আমি বোধ করি না। নতুন প্রতিটি জায়গাই আমার কাছে বিশেষ জায়গা। ভ্রমণ বিষয়ে একটি সিরিজও লিখি। রিভিউটি পড়ে মনে হলো আমি ভ্রমণকাহিনিতে যা খুঁজি ‘পথিক পরান’ আসলে সে রকম বই। অচিরেই এটা সংগ্রহ করে পড়ব। ধন্যবাদ অঞ্জন দা, ধন্যবাদ সবাইকে এতক্ষণ সাথে থাকার জন্য। শুভরাত্রি।
রয় অঞ্জন : ধন্যবাদ সুমন। ধন্যবাদ সকলকে যারা এতক্ষণ সাথে ছিলেন। শুভরাত্রি।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD