খন্দকার সোহেল
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে পৃথিবী। বদলে যাচ্ছে আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, জীবন ও যাপন। সকলের হাতে ডিজিটাল ডিভাইস। মুহূর্তেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আমাদের বিচরণ। তথ্য-প্রযুক্তির নিত্যনতুন উৎকর্ষে পরিবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর শিল্প ও অর্থনীতি। ডিজিটাল বিশ্বের সঙ্গে তুলনায় কোথায় আমাদের অবস্থান? প্রশ্নটা যদি বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্প নিয়ে করা হয়, উত্তর হিসেবে আমরা কী পাবো?
একটি নতুন ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়েছে কয়েক বছর আগেই। অন্যান্য অনেক সেক্টরের মতো আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনাশিল্প নিয়ে উন্নয়নের তেমন কোনো রোল মডেল আমাদের সামনে নেই। বিভিন্ন সভা-সেমিনার, সাক্ষাতকারে আমরা ‘বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্প’ নিয়ে কথা বলি। এই ‘শিল্প’ আসলে কোন অর্থে ‘শিল্প’? ‘অৎঃ’ অর্থে শিল্প নাকি ‘ওহফঁংঃৎু’ অর্থে? আমরা সবাই জানি, প্রকাশনাকে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে সরকারিভাবে এখনও ঘোষণা করা হয়নি। অথচ দেশে ‘চলচ্চিত্র’ জগতকেও ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে!
আমাদের প্রকাশনায় পেশাদারিত্ব গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে দৃশ্যমান কোনো বইয়ের মার্কেট নেই। কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের মতো কোনো বুক জোনও নেই আমাদের। প্রকাশনা সেক্টরে দক্ষ, প্রশিক্ষিত কোনো কর্মিবাহিনীও নেই। সৃজনশীল প্রকাশনা জগত অমর একুশে গ্রন্থমেলাকেন্দ্রিক অর্থাৎ মাসব্যাপী আয়োজনের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। পুরো বছর জুড়ে বই প্রকাশের কোনো তাগিদও দেখা যায় না— এরকম অসংখ্য হতাশার ফিরিস্তি তুলে ধরা যাবে এই লেখায়, যা আমাদের কেবলই হতাশ করে তুলবে।
পেশাজীবি হিসেবে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রকাশনা জগতের সঙ্গে জড়িত। ‘বাংলাদেশে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’ নামের একটি বাণিজ্যিক সংগঠন আছে বাংলাদেশের পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতাদের। এই সমিতির সদস্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৬ হাজারেরও বেশি! বাণিজ্যিক মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর মধ্যে এই সমিতির সদস্য সংখ্যাই বাংলাদেশে সর্বাধিক। অথচ করোনা মহামারিসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংগঠনের সদস্যদের জন্য সরকারিভাবে প্রণোদনাসহ বিচিত্র সুযোগ-সুবিধা প্রদানের নজির থাকলেও বঞ্চিত হয়েছেন প্রকাশনা জগতের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীগণ। সমিতির পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হলেও, সরকারের পক্ষ থেকে সুদৃষ্টি মেলেনি এই সেক্টরের লক্ষ লক্ষ পরিবারের প্রতি।
বিশ্বজুড়ে হঠাৎ শুরু হওয়া করোনা মহামারীর সময় থেকে বাংলাদেশের প্রকাশনা ব্যবসায় মূলত স্থবির হয়ে পড়েছে। অসংখ্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে প্রকাশনা জগতের সঙ্গে জড়িত অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন। আমরা জানি, একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ হলো ‘বই’। অথচ বইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সংশ্লিষ্ট মানুষগুলো ভালো নেই।
সম্প্রতি বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। এই পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের হাত ধরে। তাই দেশে এখন পরিবর্তিত নতুন সরকার। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে শুরু করে সমাজের সকল ক্ষেত্রেই তারুণ্যের নতুন জোয়ার পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমরা চাই, বাংলাদেশের সৃজনশীল প্রকাশনা জগতেও এই জোয়ার উঠুক। আমরা বিশ্বাস করি, তারুণ্যের হাত ধরেই নতুন করে বিনির্মিত হবে আগামী দিনের প্রকাশনাশিল্প।
বইমনষ্ক সমাজ তৈরি, আলোকিত ও মেধাবী প্রজন্ম গঠনের অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ হলো ‘বই’। একাডেমিক পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে পৃথিবীর ইতিহাস, সংস্কৃতি, সভ্যতা, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, দর্শনসহ বিচিত্র বিষয় নিয়ে নতুন প্রজন্মকে আগ্রহী করে তুলতে হলে প্রয়োজন সৃজনশীল বই। তাই আমাদের প্রকাশনাজগত নিয়ে নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। নতুন প্রজন্মের জন্য প্রয়োজন আধুনিক, যুগোপযোগী, বিজ্ঞানধর্মী ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বিকশিত প্রকাশনা। করোনাপরবর্তী বিশ্বে অন্য অনেক সেক্টরের মতো প্রকাশনা জগতও নতুনভাবে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। নতুন পথে হাঁটছে। তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রকাশনাকে আরও গতিশীল করে পাঠকের সামনে নতুনভাবে প্রকাশ করছে। মুদ্রিত বইয়ের পাশাপাশি ই-বুক, ই-পাব, অডিও বুকসহ বিভিন্ন ডিজিটাল পাবলিশিং শুরু হয়েছে সেখানে। তাই আমাদের প্রকাশনা জগতকেও নতুন পথে হাঁটতে হবে। বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পের অগ্রগতি, উন্নয়নকল্পে আমাদের কিছু পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করি।
১। বাংলাদেশে প্রকাশনা জগতের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বাংলা একাডেমি, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক, পরিচালক পদে নির্দলীয়, নীতিবান, কর্মনিষ্ঠ, তারুণ্যদীপ্ত, অন্যায়ের সঙ্গে আপোষহীন, আধুনিকমনষ্ক, তথ্যপ্রযুক্তিতে অভ্যস্ত এবং বিশ্বপ্রকাশনা জগত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কাউকে নিয়োগ দেয়া হোক।
২। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রকে নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজাতে হবে। গ্রন্থকেন্দ্রের কর্মপ্রক্রিয়া বইবান্ধব ও প্রকাশনাবান্ধব হিসেবে তৈরি করতে হবে। ‘বই’ পত্রিকাটি আধুনিক ও মানসম্মত হিসেবে প্রকাশ করার লক্ষ্যে যোগ্যতাসম্পন্ন সম্পাদক নিয়োগ করতে হবে।
৩। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের আয়োজনে বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের বইমেলা পরিচালনায় একটি বিশেষজ্ঞ জাতীয় কমিটি প্রণয়ন করতে হবে।
৪। সরকারি পর্যায়ে বই ক্রয়ের জন্য ‘বই ক্রয় নীতিমালা’ প্রণয়ন করতে হবে। বই ক্রয় কমিটিতে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি রাখতে হবে।
৫। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরে প্রতি বছর বই ক্রয়ের জন্য নির্ধারিত ‘মন্ত্রী ও সচিব কোটা’ পুরোপুরি বাতিল করতে হবে।
৬। অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজনে বাংলা একাডেমি প্রণীত বইমেলা আয়োজন কমিটিতে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি রাখতে হবে।
৭। বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক বইমেলার আয়োজন করতে হবে।
৮। প্রকাশনা জগতে পেশাদারিত্ব সৃষ্টি, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির জন্য একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৯। প্রকাশকদের জন্য স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
১০। নতুন লেখক সৃষ্টি ও মানসম্মত বই প্রকাশের জন্য ‘পাবলিশিং ফেলোশিপ’ বা ‘পাবলিশিং গ্র্যান্ট’-এর ব্যবস্থা করতে হবে।
১১। নতুন প্রজন্মের পাঠককে বই পাঠে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ডিজিটাল প্রকাশনায় প্রকাশকদের উৎসাহিত করতে হবে। এক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রকাশনার জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।
১২। ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে একটি ‘বুক মার্কেট’ স্থাপন করতে হবে এবং বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে ছোটো আকারে ‘বুক মার্কেট’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
১৩। ঢাকায় একটি ‘বুক কমপ্লেক্স’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
১৪। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে অনুবাদের ব্যবস্থা করতে হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে একটি অনুবাদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
১৫। রিডিং সোসাইটি তৈরির লক্ষ্যে নতুন লাইব্রেরি/পাঠাগার স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। পুরনো লাইব্রেরি/পাঠাগারকে মানসম্মত বই অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৬। ‘সৃজনশীল প্রকাশনা পুরস্কার’ প্রবর্তন করতে হবে। একইসঙ্গে প্রতিবছর সরকারিভাবে ‘লেখক সম্মাননা’ ও ‘প্রকাশক সম্মাননা’ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৭। অমর একুশে গ্রন্থমেলা আয়োজনকে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী হিসেবে আয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৮। নতুন ও তরুণ প্রজন্মকে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রকাশনা জগতকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সেমিনার-ট্রেনিং-ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৯। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এইসব লাইব্রেরি পরিচালনার জন্য লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ দিতে হবে।
২০। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়-মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছোটো ছোটো বইমেলা ও সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করতে হবে।
আমরা মনে করি, প্রকাশনা জগত নিয়ে আমাদের দেশে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে, একটি বিজ্ঞানমনষ্ক আধুনিক জাতি গঠনে সৃজনশীল বই পাঠ নিয়ে নতুনভাবে কাজ করতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তিতে অভ্যস্ত নতুন প্রজন্মকে ডিজিটাল মাধ্যম দিয়েই তাদের পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন প্রজন্মের জন্য প্রকাশনাশিল্পকে আধুনিক হিসেবে গড়ে তোলাটা এখন সময়োপযোগী দাবি ও প্রয়োজন। প্রকাশনা জগতে একটি তারুণদীপ্ত নেতৃত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমেই কেবল একটি আধুনিক প্রকাশনাশিল্প গড়ে উঠতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে নানান পৃষ্ঠপোষকতা ও সুদৃষ্টি। একইসঙ্গে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন।
খন্দকার সোহেল
গবেষক, সম্পাদক ও প্রকাশক
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD