‘ভালো বই পড়া মানে গত শতাব্দীর মহৎ লোকের সাথে আলাপ করা’
– দেকার্ত
একমাত্র বইয়ের পক্ষেই সম্ভব মনের ভেতর আলো এনে যাবতীয় অন্ধকার দূর করা। বইয়ের আলো নিকট থেকে দূরে, অতীত থেকে ভবিষ্যত, প্রান্ত থেকে অন্ত, যুগ থেকে যুগান্তরে পৌঁছে যেতে পারে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সেতু হিসেবে কাজ করে বই। বইমেলা থেকে শুরু করে সারা বছরই ছাপা হয় বই, পৌঁছে যায় পাঠকের ঘরে। কিন্তু সেই বই সকল পাঠক পড়ে কি না, কিংবা পড়লে আদৌও সে পাঠের মর্ম উদ্ধার করতে পারে কি না এ খোঁজ রাখার মানুষ বিরল।
কিছু লেখক বই প্রকাশ করেই তুষ্ট, কিছু প্রকাশক পাঠকের হাতে বই তুলে দিতে পেরে তুষ্ট। কিন্তু বই প্রকাশের সঠিক উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবছে না কেউ-ই। বই লেখা ও প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবতে শুরু করে একটি বইয়ের গ্রুপ। ভাষাচিত্র বুক ক্লাব। গ্রুপটি মূলত সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ভাষাচিত্র’র উদ্যোগে শুরু হওয়া। শুরু থেকেই সৃজনশীল বই-পাঠক-লেখক নিয়ে অভিনব সব আয়োজন করে আসছে এই বুকক্লাব। বইয়ের ছবি, কাভার ফটো প্রতিযোগিতা, রিভিউ প্রতিযোগিতা, মৌলিক লেখাসহ নানাবিধ আয়োজন চলে বছরব্যাপী।
করোনাকালের স্থবির সময়ে গত জুলাই মাসে পাঠকদের মাঝে সাড়া ফেলেছে বুকক্লাবের একটি আয়োজন। আয়োজনটির নাম, ভাষাচিত্র বইপড়া প্রতিযোগিতা। তিন পর্বের এই আয়োজনে পুরষ্কার হিসেবে ঘোষণা করা হয় এক লক্ষ টাকা মূল্যমানের বই। সেই সাথে প্রথম পর্বে অংশগ্রহণকারী সকল প্রতিযোগীর জন্য রয়েছে সম্মাননা সনদ ও একটি বই।
দুইটি গ্রুপে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতার প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে গত ২০ আগস্ট। উৎসবের আমেজে শেষ হওয়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে মোট ১৯৭ জন পাঠক। ক-গ্রুপটি শিশু-কিশোরদের জন্য নির্ধারিত। স্কুল পড়ুয়া যে কোনো শিশু-কিশোর এই শাখায় অংশ নিতে পারবে। ৬৯ জন ক্ষুদে পাঠক অংশ নিয়েছে এতে। খ-শাখা উন্মুক্ত, সব বয়সী পাঠক এ শাখায় অংশ নেয়। প্রতিযোগিতার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আয়োজকদের অবাক করে এ গ্রুপে অংশ নেয় ১২৮ জন পাঠক। অবশেষে পাঠকের আন্তরিক উপস্থিতি ও অংশগ্রহণে আয়োজনটি পরিণত হয়েছে উৎসবে।
ক্যামেরার সামনে বসে পছন্দের বইটি পড়তে হবে, সময়সীমা সর্বনিম্ন পাঁচ মিনিট। আরও কিছু নিয়মের সাথে মুখ্য একটি নিয়ম ছিল বই পড়ার সেই ভিডিয়োটি ভাষাচিত্র বুকক্লাবে পোস্ট করতে হবে কমপক্ষে ৫-১০জন বইপ্রেমী বন্ধুকে ট্যাগ করে। অতি সাধারণ এইসব নিয়মের পেছনে ছিল সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য। সব বয়সী পাঠকের মাঝে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করতে মূলত এই আয়োজন করেছে ভাষাচিত্র বুকক্লাব এবং প্রথম পর্বেই আয়োজকবৃন্দ পাঠকের আগ্রহ ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ।
এই গ্রুপের এডমিন প্যানেল জানায়, বই পড়ার আয়োজনটি মূলত নীরব আন্দোলন। সেই সাথে এটি একটি গবেষণা। বর্তমানে পাঠক কেমন বই পড়ে, কোন সময়ে পড়ে, কোন পরিবেশে পড়ে ইত্যাদি বিষয় উঠে এসেছে প্রতিযোগিতার প্রথম পর্ব থেকে। প্রতিযোগিতার পোস্টগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কিছু পাঠক রাতে বই পড়ে, কেউ বই পড়াকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে মোমবাতির আলোয় পড়ে, কেউ পুকুর পাড়ে, কেউ শেলফের সামনে বসে, কেউ ছাদে বসে, কেউ চা পান করতে করতে পড়ে। কিছু পাঠকের ভিডিয়োর ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখা সংগ্রহ বেশ লোভনীয়। পাঠকের রুচি, পছন্দও উঠে এসেছে এই আয়োজনের মাধ্যমে। আগামী প্রজন্ম কী পড়ছে, তাদের পড়া বইগুলো শিশুতোষ কি না এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নজরে এসেছে এই প্রতিযোগিতার ফলে।
পোস্ট যাচাই-বাছাই শেষে এডমিন প্যানেলের পক্ষ থেকে গত ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ প্রথম পর্বের ক- গ্রুপের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। মোট ৫৪ জন শিশু-কিশোর বইপড়ুয়া পাঠক প্রথম পর্ব থেকে দ্বিতীয় পর্বে প্রতিযোগিতা করার সুযোগ পাচ্ছে। ফলাফলে বেশ উৎফুল্ল প্রতিযোগীরা। বাচ্চাদের পড়ায় আগ্রহী করতে পেরে আনন্দিত অভিভাবকবৃন্দ। তাঁদের কাছে এই আয়োজন শুধু প্রতিযোগিতা নয় আগামীর আহ্বান। ইতোমধ্যে আয়োজনটি বিভিন্ন লেখক-প্রকাশকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে এবং প্রকাশনা ও সাহিত্য সংশ্লিষ্ট একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান আয়োজনে সম্পৃক্ত হবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন এটিই মূলত আয়োজনটিতে এনে দিয়েছে যুদ্ধ জয়ের সাফল্য। অবশেষে ইলেকট্রনিক ডিভাইসে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকার যুগে এসেও মানুষ বই পড়ছে, বই পড়ার আনন্দ ছড়িয়ে দিচ্ছে আগামী প্রজন্ম ও নিজেদের মধ্যে।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD