ফেসবুক থেকে

মিলন ভাইকে নিজের মহল্লার বলেই চালিয়ে দিতাম

বুধবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১:১৫ পূর্বাহ্ণ | 472 বার

মিলন ভাইকে নিজের মহল্লার বলেই চালিয়ে দিতাম

হুমায়ূন কবীর ঢালী


আমাদের কাছে তিনি মিলন ভাই। মহল্লার মিলন ভাই। মহল্লা ঠিক নয়, পাশের মহল্লা। ফরিদাবাদ-মিলব্যারাক। মিলন ভাই গেন্ডারিয়ার। কিন্তু আমরা গর্ব করে মিলন ভাইকে নিজের মহল্লার বলেই চালিয়ে দিতাম। চালিয়ে দেওয়ার কারণ দূরের বন্ধুদের কাছে একটা সমীহ আদায় করে নেওয়া। মিলন ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক আছে, এই সুবিধা নিয়ে বন্ধুদের কাছ থেকে চা-পানিসহ নানারকম সুবিধা আদায় করেছি। এটা উনিশ’শ ছিয়াশি কি সাতাশি সালের কথা। আমি তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। পাঠকমহলে কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন একটি জনপ্রিয় ও ঈর্ষণীয় নাম। মিলন ভাই কোন ব্যান্ডের প্যান্ট-শার্ট পরেন, পারফিউম কোনটা ব্যবহার করেন, আমরা তাঁকে অনুসরণ করার চেষ্টা করি। খুব মনে আছে, কী করে জানলাম মিলন ভাই ‘কোবরা’ পারফিউম ব্যবহার করেন, জলদি গিয়ে ‘কোবরা’ কিনে নিয়ে এলাম। এরপর বন্ধুদের মাঝে সুযোগ পেলেই জানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি, মিলন ভাই যে পারফিউম ব্যবহার করেন, আমিও তাই করছি। তিনি সাহিত্যের মহাতারকা। শিল্প-সাহিত্যের লোকজনের কাছে আলোচিত। প্রকাশকরা তাঁর পান্ডুলিপি পাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ইমদাদুল হক মিলনের বই মানে বিজনেস। প্রকাশনা জাতে ওঠা।

 

দুই.
দিগন্ত মজলিস ও তরুণ ঐক্যজোট নামে দুটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল মিলব্যারাক, আলমগঞ্জে। দিগন্ত মজলিস পুরনো সংগঠন। তরুণ ঐক্যজোট নতুন। দুই সংগঠনেই ছিল আমার যাতায়াত। আমি একটু-আধটু লেখার চেষ্টা করছি। বিশেষ দিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করছি। অনুষ্ঠানের কর্মী হয়ে কাজ করছি। সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনো ম্যাগাজিন প্রকাশের কথা ভাবলেই প্রথম লেখকের নামে আসত মিলন ভাইয়ের নাম। প্রথমত আমাদের মহল্লার লেখক। দ্বিতীয়ত, ম্যাগাজিনের ওজন বাড়ানো। লেখা চাইতে কে কে যাবে? কথা শেষ হওয়ার আগেই হাত তুলতাম। লেখা চাওয়ার উছিলায় জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলনের দর্শন পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।

 

তিন.
বিরানব্বই সালের কথা। লেখালেখির পাশাপাশি আমি প্রকাশনার সাথেও যুক্ত হয়ে গেলাম। লেখালেখি নেশা। প্রকাশনা পেশা। পেশার কারণে ‘চারদিক’ নামক একটা প্রকাশনার প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব নিলাম। দায়িত্ব নেওয়ার পর জানতে পারলাম, একদা ‘চারদিক’ প্রকাশনা সংস্থাটির সাথে মিলন ভাই জড়িত ছিলেন। এই কথা শুনে কাজের স্পিড বেড়ে গেল। এখন চারদিকের প্রকাশক মেসবাহউদ্দিন আহমেদ।

চারদিকের দায়িত্ব নিয়ে শুরুতেই সিদ্ধান্ত নিলাম, ইমদাদুল হক মিলনের পান্ডুলিপি নেব। প্রেমের উপন্যাস। কারণ, প্রেমের উপন্যাসে তখন ইমদাদুল হক মিলন অদ্বিতীয়। এখনও। ভাবনা অনুযায়ী যথারীতি মিলন ভাইয়ের বাসায় গিয়ে প্রস্তাব দিলাম। সাথে দিলাম অগ্রিম বাবদ পঞ্চাশ হাজার টাকা। অনেকে আরও বেশি অগ্রিম দিয়ে ইমদাদুল হক মিলনের পান্ডুলিপির জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করছেন। আমিও ওয়েটিং লিস্টে আছি। মিলন ভাই বইয়ের নাম দিলেন। সুচরিতাসু। সমর মজুমদার প্রচ্ছদ করলেন। প্রায় প্রতিদিন বাসায় ঢুঁ মারি। প্রয়োজন ছাড়াও যাই। পান্ডুলিপির ছুতায় মিলন ভাইয়ের সঙ্গ পেতে চলে যেতাম। মাঝে-মাঝে ধরাও পড়েছি। তবুও চার তলার সিঁড়ি ভেঙে কলিংবেল চাপ দেই। যথারীতি দরজা খুলেই মিলন ভাই চেনা ভঙিতে প্রশ্ন করেন, কি মিয়া ঢালী, আইছ? তোমার কি আইজ আসার কথা?
মিথ্যা বলি মিলন ভাইকে। জি ভাই।
মিলন ভাই প্রমাণে যেতেন না, বলতেন ভেতরে আসো।
বাসায় গিয়ে বসি। সাথে সাথে গৃহকর্মীকে মিলন ভাইয়ের নির্দেশ, এই কুসুম, ঢালীরে নাস্তা দে।
এরপর মিলন ভাই বসে সাহিত্যের নানা গল্প বলতেন। আমার লেখালেখি নিয়ে বুদ্ধি-পরামর্শ দিতেন।
এই মিয়া তুমি নামের শেষে ঢালীটা রাখছ ক্যান? শুধু হুমায়ূন কবীরই তো যথেষ্ট। তোমার লেখা আমি পড়ছি। তুমি ত মিয়া ভালোই লেখো।
একজন ইমদাদুল হক মিলনের মুখে এই কথা শুনে আপ্লুত হই। মনে মনে ভাবি, আমার লেখালেখি সার্থক।
আমাদের কথার মাঝে মিষ্টি ও চা নিয়ে হাজির কুসুম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মিলন ভাইয়ের বাসায় গিয়ে কেউ মিষ্টি না খেয়ে ফিরে এসেছেন এমন কাউকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
যাহোক, চামচ দিয়ে মিষ্টি কেটে কেটে খাচ্ছি আর মিলন ভাইয়ের মিষ্টি কথা হজম করছি। এটাও সত্য, মিলন ভাইয়ের কথা শুনতে শুনতে ঘোরে বন্দি না হয়ে উপায় নেই। প্রসঙ্গটা যখন এলো বলেই ফেলি। মিলন ভাই লেখক হিসেবেই শুধু জনপ্রিয় নন, একজন ভালো বক্তা ও উপস্থাপকও। শুধু মিলন ভাইয়ের বক্তৃতা শুনতে অনেক অনুষ্ঠানে গিয়েছি। উপন্যাসের কাহিনির মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি বক্তৃতা দিলেও দর্শককে দেখেছি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে।
নাস্তা শেষ করে বিদায় নেবার পালা। আন্তরিকতার সাথে বিদায় দেন মিলন ভাই।
ঢালী, আবার আইসো।
কবে আসুম ভাই?
যখন খুশি আইসো। লেখা শেষ হয়ে যাবে দুএকদিনের মধ্যেই।
আইচ্ছা।
মনে মনে বলি, আপনার লেখা শেষ না হলেও আপত্তি নেই। আমি তো আসি আপনাকে দেখতে। আপনার কাছাকাছি কিছু সময় বসে থাকতে।

 

চার.
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের ৬৬ বছর পূরণ হবে আজ। তাতে কী! তিনি আমাদের কাছে ‘মিলন ভাই’ই আছেন।


[ লেখাটি হুমায়ূন কবীর ঢালীর ফেসবুক প্রোফাইল থেকে সংগৃহিত ]

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD