‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’- রবি ঠাকুরের এই চরণকে জীবনের পাথেয় করেছেন নেত্রকোণা সুসং দূর্গাপুরের বইপ্রেমী নাজমুল হুদা সারোয়ার। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির কার্যক্রম দেখে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার স্বপ্ন থেকে পথ পাঠাগারের উদ্যোগ নেন তিনি। ব্যক্তিগত উদ্যোগে শুরু করেন পথ পাঠাগার। পারিবারিক ব্যবসা থেকে আসা লভ্যাংশ ব্যয় করে ২০২০ সালের ২ জুন প্রতিষ্ঠা করেন স্বপ্নের পথ পাঠাগার। পরিবারের রোষাণলে পড়তে হয় এতে। গ্রামের মানুষের পাগল, আকাইম্মা তিরষ্কারে পিছিয়ে আসেননি নিজের স্বপ্নের পথ থেকে।
৪০টি বই দিয়ে চায়ের দোকানে শুরু করেন শুভ উদ্যোগ। এ পর্যন্ত ১১টি শাখা গড়ে উঠেছে দূর্গাপুরের বিভিন্ন পথে। তারমধ্যে-দুর্গাপুর পৌর শহরে এম কে সি এম মোড়ে সুমন সাহার টি স্টলে, বইয়ের সংখ্যা পয়ত্রিশটি। চন্ডিগড় ইউনিয়নের সাতাশি বাজার এলাকার আজিজুল ইসলামের ফার্মেসি শাখা, বইয়ের সংখ্যা বত্রিশটি। উপজেলা প্রেসক্লাব মোড় এলাকায় খোকন মিয়ার হোটেল শাখায় পঁচিশটির বেশি বই রয়েছে। নাজিরপুর মোড় এলাকায় তোতা মিয়ার অলম্যান সেলুন শাখায় বই রয়েছে ত্রিশটি। রিক্সাচালক তারা মিয়ার ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সায় ভ্রাম্যমাণ শাখায় বিশটির বেশি বই রয়েছে। কুল্লাগড়া ইউনিয়নের ভেন্নাকান্দা চৌরাস্তা গ্রামের আশরাফুল ইসলাম এর ফার্মেসিতে একটি শাখা রয়েছে, সেখানে বইয়ের সংখ্যা পঁচিশ। বহেরাতলী গ্রামে মোবারক হোসেন মিলনের সেলুন শাখা, বই রয়েছে প্রায় পয়ত্রিশটি। দুবাউড়া উপজেলার চারুয়াপাড়া গ্রামে শামসুল হক মৃধার ফার্মেসিতে শাখা রয়েছে, বইয়ের সংখ্যা পঞ্চাশ। ধোবাউড়া তিলক সরকার এর গার্মেন্টস শাখায় বই রয়েছে চল্লিশ। ধর্মপাশা ভাসমান শাখা ধনা মিয়ার নৌকায়, বইয়ের সংখ্যা বিশ। পাঁচগাঁও বকুল মাস্টার ফার্মেসি শাখা, বইয়ের সংখ্যা ত্রিশ। পূর্বধলা জারিয়া-ঝানঞ্জাইল রেলস্টেশনে মোঃ আলাউদ্দিন মিয়ার টি স্টল শাখা, বইয়ের সংখ্যা একচল্লিশটি।
পথ পাঠাগার পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্বে রয়েছেন মাসুদ রানা, সাংবাদিক রাজেশ গৌড়, তন্ময় সাহা, পলাশ সাহা, জিয়াউল হক শুভ প্রমুখ। পথ পাঠাগারগুলোতে শিশুতোষ, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনিসহ নানাবিধ সৃজনশীল সাহিত্যের বই রয়েছে। পাঠাগারগুলোর গঠন কাঠামো দোকানভিত্তিক। যেন সবরকম দোকানে এক কর্ণারে একটি সেলফে ৪০-৫০টি বইয়ের একটি ছোট্ট পাঠাগার। চাইলেই যে কোনো পাঠক দোকানে বসে বই পড়তে পারবেন। পাঠাগারগুলো বর্তমান ও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিদিন অনেক মানুষ বই লেনদেন করে। অনেকে দোকানে বসে বই পড়ছে। মেঘালয় পাহাড় ঘেরা গারো অধ্যুষিত জনপদে পথপাঠাগার আলোর মশাল জ্বালিয়েছে বলে স্থানীয় সুধী সমাজের অনেকে মন্তব্য করেছে।
পাঠাগারের অতীত ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রতিষ্ঠাতা নাজমুল হুদা সারোয়ার জানান, ‘শুরুতে আমার কাজের প্রতি আমার পরিবারের সদস্যদের বিরূপ মনোভাব ছিল। কিন্তু বর্তমানে এর বিপরীতটা লক্ষ করা যাচ্ছে এবং পরিবারের সাপোর্ট পাচ্ছি। শুরুর দিকে আমার পরিবারও বিষয়টাকে আমার পাগলামি মনে করতো। এর ফলাফল শূন্য বলে এ কাজের প্রতি অবহেলা করতো। কিন্তু বর্তমানে এর আলোড়ন দেখে আমার পরিবার আমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে। এর মাধ্যমে আমি অনেক সামনে এগিয়ে যেতে পারব বলে তাদের ধারণা। বর্তমানে তারা এ বিষয়টাকে আমার কাজের একটি অংশ বলেই মনে করেন। পথ পাঠাগার নিয়ে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে আমি এর একটি নিজস্ব প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বই পাঠে সম্পৃক্ত করার স্বপ্ন দেখি।’
প্রবীণ লেখক ও আদিবাসী গবেষক মতিলাল হাজং বলেন, পথ পাঠাগার মানুষকে আলোকিত করার যে স্বপ্ন দেখাচ্ছে, সেটি থেকে সবার আদর্শ হওয়া উচিত। তাঁর স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখতে হলে উদার ও মননশীল ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা উচিত বলেও মনে করেন তিনি। একটি তথ্যনির্ভর ও আধুনিক সমাজ বির্নিমাণে নতুন প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে নাজমুল হুদা সারোয়ারের মতো এমন পাগল আরও প্রয়োজন যারা আলো জ্বালবে আগামীর পথে।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD