॥ ইলিয়াস বাবর ॥
গল্পকারেরা মনুষ্য-হৃদয়ের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী হয়ে বিরাজ করে দূরতম স্থানে! এই দূরত্ব একজন সৃজনকারের সাথে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর; একজন বেদনাঘন মানুষের সাথে একজন সহৃদয় শব্দশিল্পীর। দুটোর ভেতর বসবাস করা অনির্ণেয় ব্যবধান ঘুছে আনে কেবল শব্দের বাহাদুরি, বাক্যের সার্বভৌমত্ব। লোকে যা উচ্ছিষ্ট ভেবে ফেলে দেয়ে ডাস্টবিনে, গল্পকার তা কুড়িয়ে আনে সাধনার ল্যাবরেটরিতে। বোঝাপড়া আর জীবনকে দেখা ও দেখানোর বিবিধ আলোয় সেসব গল্প পড়ে জীবনভাষ্য আবিস্কারের যে সুখ বা বেদনায় পাঠক বিহ্বল হয় তার পশ্চাতে রয়েছে হরেক চোরাস্রোত। গল্পকারের এই বোধের বিচার চেহারা-পেশা-জাত দিয়ে কেউ করতে চাইলেও তা প্রকৃতভাবে করতে হয় গল্পভাষ্যের আলোকে। “লাল সাদা নীল” গল্পকিতাবের বুক চিরে আমরা সময়ের প্রতিবিম্ভকে দেখতে পাবো হয়তো, পরিপার্শ্বকে প্রত্যক্ষ করার নাম করে আমরা দেখে আসবো মানুষ আর বাস্তবতার নানা ছবি। ফারজানা রহমান শিমু তার শিল্পযাত্রায় শিশুসাহিত্য, কবিতা ও অনুবাদের সাথে গল্পকেও রাখেন সযতনে। তার গল্পসাহিত্যে বসবাস করে সমাজের নিন্মশ্রেণীর মানুষ, তাতে সঙ্গ দেয় নাগরিক ফ্ল্যাটসংস্কৃতি। গ্রাম আর শহরকে মেলানোর জন্যে গল্পকার সচেতনভাবে চরিত্র নির্মাণে প্রয়াস নেন, নানা প্রেক্ষিতে তিনি দেখানোর চেষ্টা করেন আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির বহুরৈখিক আঞ্জামগুলো।
“লাল নীল সাদা” গল্পকিতাব পরিভ্রমণ শেষে আমাদের পড়ার চোখ থামে, দেখা ও ভাবনার প্রখর দৃষ্টিসত্ত্বাটি আরো বিস্তৃত হয় নানাভাবে। চলতিপথে জিজ্ঞাসার চিহ্নগুলো, বেদনার মোড় আর আহ্লাদের স্বরগুলো বিম্বিত করতে গিয়ে গল্পকার বেচে নেন পরিচিত ভূগোলকেই। কথাসাহিত্যিকেরা অচেনা জীবন আঁকতে পারেন না; এই সত্য ফারজানা রহমান শিমুর জানা আছে বলেই, তিনি তার যাপিত জীবনকে, প্রতিবেশ আর পরিপার্শ্বকেই লেখেন গল্পে। গ্রন্থভুক্ত পনেরটি গল্পই আকারে ছোট, বিস্তারে বৃহৎ। এসব গল্পকে অণুগল্পের কাতারে মাপা যায় না ঠিক তবে তাতে মানুষের হাহাকার-রোদন-আনন্দ-উৎসব মিলে সাক্ষাৎ হয় মানবজীবনের! তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনার ভেতর বড়র অস্তিত্বকে মেনে নিয়ে বা আধারকে শব্দজাত করে ফারজানা রহমান শিমুর গল্পসাধনাকে অভিনন্দিত করতে হয় তার অকৃত্রিমতার জন্যই! গল্প যেহেতু জীবন থেকে উৎসারিত বাস্তবতা ও সৃজনের মিশেল তাই এখানে আরোপিত ছেলেমানুষি যায় না– এই বোধ প্রাগুক্ত গল্পকারের আছে বলে প্রতীয়মান হয়, অন্তত “লাল সাদা নীল” গল্পকিতাবের আলোকে।
গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলোর ভাষা কেমন? গল্পকার কোন আঙ্গিকে গল্পগুলো নির্মাণ করেছেন? গল্পস্থ চরিত্রসমূহে কিসের ছায়া কিলবিল করে? গল্পকারের দর্শনগত অভিমত কী? এসব সূত্র ধরে আলোচনা এগুনোর যথেষ্ট সুযোগ থাকে বটে আমরা কেবল পাঠক হিসেবে তৃপ্তি-অতৃপ্তি, শোকর-ওজর নিয়ে কথা বলতেই পছন্দ করবো। এখানে, এটাও বলার ব্যাপার, প্রত্যেক পাঠকের রুচি এক নয়, যেমনি ব্যবধান থাকে লেখক-লেখকে। “লোপাট” গল্পের সৌমিত্র বাবুর সাথে আমাদের দেখা হয়ে থাকে, চেরাগি থেকে বৌদ্ধমন্দির হেঁটে যাবার পথে তাকে সর্বস্থ হারাতেও দেখি আমরা, এভাবে সারাদেশেই এই নৈরাজ্যজনক লাল নীল সাদা: ১
“অর্জন”, “ধাঁধা”, “মর্যাদা” ও “প্রতিদান” গল্পগুলোকে একই স্বরের বিভিন্ন ভাষ্য ও প্রেক্ষিত বলেই আমাদের মনে হয়। গল্পগুলোর সমবায়সূত্রের বড় ঐক্য এই, এখানে শ্রেণিবিভাজন ও শ্রেণি-ফারাকের বাস্তবিক চিত্র প্রকাশ্য হয়েছে, পূঁজির দলগত কিংবা ব্যক্তিক চারিত্রের কতিপয় কমন বৈশিষ্ট্যও দৃশ্যমান আছে গল্পগুলোয়। “অর্জন” গল্পের মির্জা হাসান জাগতিক অর্জনের ভারে আপাতনিপতিত এক প্রতিভূর চরিত্র হয়ে পাঠকের মনোবিশ্বে ঘুরে আসে। তার সন্তানেরা দেশের বাইরে পড়াশোনা করা; বৈদেশেই স্থিত তাদের পেশা– এই চিত্র হাজারো বাঙালি পরিবারের, যারা কিনা উচ্চ মধ্যবিত্তের লেভেলকে আরো উপরের দিকে নিতে গিয়ে শেষকালে হারিয়ে খোঁজে পারিবারিক শান্তি। এমনটা তো হওয়ার কথা! যে পূঁজির পেছনে আপনার দিনাতিপাত, তার অতিরিক্ত আসক্তি আপনাকে কলরোলের ভেতরে রেখেও একা করে দেবে, এটা একজন সমাজসচেতন কথাশিল্পী স্মরণে রাখেন, রেখেছেন শিমুও। “ধাঁধা” গল্পের চাকুরিপ্রার্থী অনীকের সাথে “অর্জন” গল্পের মির্জা হাসানের গৃহাসহযোগী জসিমের কোন তফাৎ কি দৃশ্যমান হয়? একজন হুকুমে তটস্থ, আরেকজন হুকুমে নিজেকে জারিত করতে উদগ্রিব। অনীকের চাকরিজনিত বেদনা মূলত আজকের তৃতীয়বিশ্বে এবং বাংলাদেশ-প্রেক্ষিতে সবচে আলোচিত বিষয়। এখানে চাকরির জন্য হাহাকার আছে, চাকরি নিয়ে পস্তানো আছে অথচ পূঁজির এই বিশালাকার চাপ আর তাপের কাছেই নিতান্তই অসহায় আমরা, যেমনি বসের হুকুমে তটস্থ জসিম; সবাই পারে না মুখের উপর ঝেড়ে ফেলতে, অনীকেরা করে দেখায় তাও পরিপার্শ্বে পরাজিত হয়ে। “মর্যাদা” গল্পে নীলা মেমের চাকরি ছেড়ে দেওয়া, “ধাঁধা” গল্পে অনীকের চাকুরি না হওয়ার সাযুজ্য আমাদের সমাজবাস্তবতাকে ইঙ্গিত করে। এই ইঙ্গিতের ভেতর বিরাজ করে সময় আর স্বকালের বিষবাষ্প। মানুষ ক্রমাগত পূঁজির দাসে পরিণত হবার চিত্র গল্পগুলোর ভেতর দিয়ে পাঠক ধরতে পারেন এবং এই ধরাটি একেবারেই একরৈখিক, গল্পকারের এখানে সুযোগ ছিল কায়ার সাথে ছায়ার সংযোগ ঘটানোর। “প্রতিদান” গল্পের নীরাকে আমরা হামেশাই দেখে উঠি, নগরযাপনে, যে কিনা গৃহপরিচারিকা থেকে হয়ে ওঠে ঘরের মেয়ে। এর ভেতরেও হয়তো গৃহকত্রীর সূক্ষ্ম ইচ্ছা থাকে, নিজেদের সন্তানের অভাবটি নীরাকে দিয়ে পূরণ করতে চায়। মুনিরাকে নীরা করে তোলা হয় ফার্স্টফুড খাইয়ে, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, গ্রামের মেয়েটিকে এতবেশি শহুরে করার দরকার যখন পড়ে আমাদেরই নগুরেপনাকে বড় করতে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, পূঁজির স্তরবিনাসে নিজেকে দেখতে কতোটা অভ্যস্থ আমরা। ঠিক এ জায়গাতেই লেখকের ফোকাসড। লেখককে সমাজের চোরাস্রোতের দিকে নজর রাখতে হয় এবং এক্ষেত্রে ফারজানা রহমান শিমুর অভিপ্সাকে অভিনন্দন জানাতে হয়।
“জনক” গল্পটি পড়লে হয়তো আমাদের বদলে যাওয়া জেনারেশনের একটা ছবি পাওয়া যাবে; যেখানে ফেসবুক থেকে বন্ধুতা প্রায় সবটাই চলে আসে অনায়াসে। বাবাদের প্রকৃত অর্থেই বন্ধু হয়ে ওঠার বোধ আমাদের থাকা দরকার হলেও কলহাস্য পেরিয়ে তা হয়ে ওঠে না, ইতিবাচক হবার সৌন্দর্যই মূলত এ গল্পের সবক। “কোন এক রিদিমা” গল্পকে গ্রন্থের প্রথম গল্পের সমান্তরালে পাঠের সুযোগ আছে অনেকাংশে। পয়লা গল্পে সৌমিত্র বাবুকে যেখানে কতিপয় বিপদগামী যুবক সর্বসান্ত করে দেয়, সেখানে প্রাগুক্ত গল্পে রিদিমার সরলতার সুযোগ নেয় এক বাচ্চা, যে কি না এই সমাজের কতিপয় কীট দ্বারা পরিচালিত। রিদমারা পরাজিত হয় রাতের আঁধারে, ওদিকে নারীবাদীরা সংবাদসম্মেলনে মুখ দেখায় পরম তৃপ্তিতে। “ফাঁদ” গল্পেও নারীরে এভাবে ছোট আর নিঃশেষ হতে দেখা যায় ট্রেনে, পুরুষের পৈচাষিকতায়! অথচ “নষ্টনীড়” গল্পের ঝুমু ক্রমশ একা হতে থাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে গিয়ে। ঘোড়া পছন্দ করলেও গাধাকে ভালোবাসার এই নিয়মে রাষ্ট্রযন্ত্র নারীকে ক্ষমতা দেয়ার নাম করে পুরুষের করতলে রাখার ফন্দি আঁটে সবসময়ই। এখানে সবাই কুশলীব, সুযোগসন্ধানী। সমাজের ভেতর থেকেই সমাজের অতিচর্চিত, দূষণ ও সুবাস নিয়ে গল্পকার ফারজানা রহমান শিমুর অভিপ্রায় আনন্দের। তিনি তথাকথিত পুতুপুতু প্রেমের গল্প ফাঁদেন না, অতিরিক্ত মেদ আর ঘটনাকলহে গল্পের শরীর বড় করার দুর্বার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হন না বলে গল্পগুলো এক নিমিষে পড়া যায়। সময়হীন এই সময়ে পাঠক ধরে রাখার জন্যেই যদি এ আয়োজন তবে ভারি অন্যায় হয় বৈকি।কাজকারবারের সাথে পরিচয় হয় পাঠকের। অথচ কী এক ভয়ানক জুজুর তাড়নায় আমরা চুপ থাকি, কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার আহাজারিতে কার কী আসে তবে! বরং “আমাদের একজনকে জামাই করে নিন না” বাক্যের ভেতর দিয়ে তালাশ হয়ে যায় এই সময়ের। লেখকের দেখার চোখের এই ভাষ্য অতি সাধারণ হয়েও সময়ঘন, তুমুল মানবিক হাহাকারের আস্ত চিৎকার এতে লেপ্টে আছে। অথচ বিশ্রীভাবে একটা কর্পোরেট হাউসের বিজ্ঞাপনও আছে, এটা ঠিক যায় না, অন্তত গল্পের শরীরে। ছোট আকারে ঘটনা ধরা যায়, রবীবাবুর আদলে ছোটগল্পত্বও তাতে থাকে কিন্তু সবিনয়ে বলা দরকার, একজন গল্পকারের চিন্তাবিশ্ব আরো বিস্তৃত। লাল নীল
ফারজানা রহমান শিমুর গল্পভাষা স্বাদু; কমিউনিকেট করার মতো– হতে পারে তার কবিসত্ত্বাটি আলগোছে ছায়া ফেলে গল্পের বারান্দায়। “লাল সাদা নীল” গ্রন্থের এমন নাম নির্বাচন করে গল্পকার হয়তো রঙের ভেতরেই জীবনের নির্মম সত্যকে তুলে আনার প্রয়াস পেয়েছেন কিন্তু এই সময়ে গল্পগ্রন্থের নাম হিসেবে এটা খুব বেশি ফিট না। আমাদের উল্লেখ করতে হয়, ফারজানা রহমান শিমুর গল্পে সম্ভাবনা যা দুর্বলতাও তা! আরেকটু খোলাসা করলে, গল্পের আয়তন। প্রশ্ন আসতে পারে, আয়তনই কি সব? বিন্দুর ভেতর কি সিন্দুর অস্তিত্ব থাকে না? সবটাই মানা যায়, তবে এই সত্যকে কবুল করতে হয়– মানবজীবন মোটেই একরৈখিক নয়, একটি ঘটনা দ্বারাই মানবিক বৈকল্য আর শুদ্ধতা বোঝার সুযোগ নেই। হতে পারে ছোটগল্পের ঐতিহাসিক ভিত্তি; নিক্তিরও তো রকমফের থাকে! একটা ঘটনা, কয়েকটা চরিত্র সেঁটে দিলেই মহাসত্যকে ধরা যায় না বলেই গল্প আলাদা। এখানে লুকিয়ে থাকে বহুধাবিভক্ত কাতারের পূর্ণবিভা। সমকালীন গল্পপাঠে নিজেকে বিরত রেখে অথবা আলাদা জগতের বাসিন্দা ভেবে অথবা পাঠককে বোকা ভেবে অনেকেই সিনেমাটিক, কল্পনাহীন গালগল্পে কাহিনি বানিয়ে গল্পের নামে চালিয়ে দেয়ার যে চালাকি তা শিমুর আয়ত্বে নেই বলে আমাদের বিশ্বাস রাখতে সুবিধে হয়, তার গল্প অণুগল্পের ছায়া মাড়িয়ে প্রকৃত অর্থেই গল্প হয়ে ওঠবে পূর্ণছবির মগ্নতা নিয়ে; এটা হতে পারে সামনের কোন গল্পে বা গ্রন্থে– অপেক্ষা যদি ভালো কিছুর জন্যই করা লাগে তবে খারাপ না!
লাল সাদা নীল
ফারজানা রহমান শিমু
আবির প্রকাশন
বইমেলা ২০১৮
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD