ধানচাষি কৃষক : সংকটের নতুন ধারা-গবেষণায় নতুন চিন্তা

শনিবার, ৩০ জানুয়ারি ২০২১ | ২:২৭ অপরাহ্ণ | 954 বার

ধানচাষি কৃষক : সংকটের নতুন ধারা-গবেষণায় নতুন চিন্তা

কৃষকের উৎপাদিত ধানের দামের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত সমস্যাগুলোর আলোকপাত করে বইটি লেখা। বইটি লিখতে লেখকদ্বয় সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন।

 

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা বিশেষকরে বগুড়া, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও লালমনিরহাটসহ টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ এলাকায় মাঠ পর্যায়ের তথ্যসমূহ সংগ্রহ করেছেন। লেখকদ্বয় তত্ত্ব ও তথ্যের ভিত্তিতে তুলে ধরেছেন ধানের দামের ন্যায্য মূল্য না থাকায় কৃষকের ধান চাষে অনীহা, দীর্ঘ অভ্যস্ত কৃষি জীবন ব্যবস্থা ও উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন ও সৃষ্ট খাদ্য নিরাপত্তার শঙ্কা।

কোনো সৃষ্টকর্ম সীমাবদ্ধতার উর্দ্ধে নয়। এ ক্ষেত্রে শুরুতেই লেখকদ্বয় মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। তারা যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছেন গবেষণামূলক বইটির সীমাবদ্ধতা। প্রথমত, তাদের আলোচনা ক্ষুদ্র ও দৈনন্দিন চর্চার আলোকে (মাইক্রো)। এখানে উৎপাদন, পরিমাণ, চাহিদা, জোগান, দাম ও আমদানি-রপ্তানি নিয়ে প্রথাগত পরিসংখ্যানবিদ কিংবা অর্থনীতিবিদদের বড় পরিসরের (ম্যাক্রো) কোনো আলোচনা নেই। পাশাপাশি, বইটিতে জাতীয় পরিসরের আলোচনার পরিবর্তে স্থানীয় ধান চাষি কৃষকের অভিজ্ঞতা ও মতামত অগ্রাধিকার পেয়েছে। গবেষণামূলক লেখা হলেও বইটির সহজ সরল ও প্রাঞ্জল ভাষা সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীসহ কৃষক, কৃষি, ধান চাষ ও গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থা নিয়ে আগ্রহী সকল পাঠকের কাছেই সহজবোধ্য ও সুপাঠ্য করে তুলবে।

ভূমিকা অধ্যায়সহ মোট পাঁচটি অধ্যায়ের সন্নিবেশন বইটিতে ‘ধানচাষি কৃষকের সংকটের বহুমাত্রিকতা’ শীর্ষক ভূমিকা অধ্যায় সাহিত্যপ্রেমী যে কোনো পাঠককে বিমোহিত করবে। সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানের গবেষণামূলক বই হওয়া সত্ত্বেও শুরুটা রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণীর ‘চাষি’ নামক কবিতা দিয়ে। কৃষক ও ধান চাষ আমাদের শিল্প, সাহিত্য, চিত্রকর্ম, গল্প, সৌন্দর্যবর্ধক বক্তব্য ও বিবৃতিতে তথা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই অবিচ্ছেদ্য অংশের সংকট কীভাবে জনপরিসরের আলোচনায় আসলো তা এখানে যথার্থ ব্যাখ্যা করা হয়েছে টাঙ্গাইলের আব্দুল মালেক শিকদার নামক কৃষকের গল্পের মধ্যে দিয়ে। একইভাবে খাদ্য নিরাপত্তা বয়ান ও বাস্তবতা এবং এর মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকির মূল বক্তব্য তুলে ধরেছেন। এখানে ধান চাষের সাথে রয়েছে কৃষকের আত্মিক বন্ধন। অথচ উৎপাদিত ফসলের বিক্রয়মূল্য উৎপাদন খরচের চেয়ে কম হওয়ার কারণে ধানচাষি জমির ভবিষ্যৎ শঙ্কাময়। এ বিষয়ে লেখকদ্বয় ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন করেছেন। সমালোচনার সাথে আলোকপাত করেছেন কীভাবে কৃষির উৎপাদন কৃষকের হাত থেকে পুঁজিপতি ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।

‘ধানের দাম নেই, কৃষক সংকটে : উত্তরণের পথ সন্ধানে’ নামক দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখকদ্বয় আলোচনা করেছেন ধানের দাম না পাওয়া কৃষক-বঞ্চনার প্রেক্ষাপট। এখানে আলোচনার খাতিরে সংযুক্ত করেছেন তেভাগা আন্দোলনের কথা। এই অধ্যায়ে আরো বিশ্লেষণ করেছেন কৃষক বঞ্চনার সূত্রপাত ও কারণ, কৃষকের হতাশা ও দুর্ভোগের স্মৃতি রোমন্থন, চাল আমদানি ও রপ্তানি পলিসি, চাল রপ্তানি নিয়ে আড়তদার, চালকল মালিক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত। উপর্যুক্ত বিষয়কে সমর্থন দিতে লেখকদ্বয় অন্যান্য প্রমাণপত্রের সাথে ধানের দামে চরম হতাশা কৃষকের গুরুত্বপূর্ণ ৩টি কেস স্টাডি সংযুক্ত করেছেন।

তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে ‘লোকসানের ফাঁদে আটকা কৃষক’। এই অধ্যায়ে লেখকদ্বয় ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে কৃষক বোরো ধানের লোকসানের পর আবার আমন ধান চাষের লোকসানের ফাঁদে পরে গেলেন। একইভাবে বর্ণনা করেছেন বিগত বছরের আমন ও বোরো ধান সংক্রান্ত তথ্য, উত্তরাঞ্চলের ধান উৎপাদনের চিত্র, সরকারি ধান ক্রয়ে শুভঙ্করের ফাঁকি, আমন ধানের মজুতদারের অবস্থা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন বাংলাদেশ বিতর্কের বিশেষজ্ঞের মতামত, এবং ধানে আনন্দ, ধানে বিষাদের পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা। এই আলোচনাগুলোর জন্য তারা ব্যবহার করেছেন সরকারি কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য এবং মাঠ পর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন অফিসসহ মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন স্তরের কৃষক (বড়, মাঝারি ও ছোট কৃষক) থেকে পাওয়া তথ্য। কৃষক সংকটের বাস্তবতা বুঝাতে তারা এখানেও সংযুক্ত করেছেন ৪টি কেস স্টাডি।

‘ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে কৃষক’ শীর্ষক চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে কেন কৃষক ধান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। লেখকদ্বয় মাঠ গবেষণা থেকে তুলে ধরেছেন- তুলনামূলকভাবে অন্য ফসলের দাম বৃদ্ধি পেলেও ধানের ন্যায্য মূল্য (কৃষকের হিসেবে) না থাকায় কীভাবে ধানের পরিবর্তে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক অন্যান্য ফসল যেমন তামাক, গম, ভুট্টা উৎপাদিত হচ্ছে; এমনকি ধানের জমিতে ইটভাটা স্থাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যসহ গবেষণার আওতাভুক্ত জেলাসমূহে সরেজমিনে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলেছেন। কেন ধান চাষ কৃষককে টানছে না-এই বয়ানের ব্যাখা করতে ৮টি কেস স্টাডি ও সংশ্লিষ্টদের যৌক্তিক মতামতা এই অধ্যায়ে যুক্ত করেছেন।

পঞ্চম ও শেষ অধ্যায় ‘গবেষণা পদ্ধতি : উদ্ভাবন, ব্যবহার ও বিতর্ক’ শিরোনামে। এই অধ্যায়ে লেখকদ্বয় তাদের গাবেষণার পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। পরিমাণগত উপাত্তকে উপেক্ষা না করে গুনগত গবেষণা পদ্ধতিকে প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে নিয়ে সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞানের ধ্রুপদি পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রথাগত দলগত আলোচনা, অনানুষ্ঠানিক আলোচনা ও অংশগ্রহণমূলক পর্যবেক্ষণ ছিল অন্যতম। লেখকদ্বয় খুব চমৎকারভাবে লিখেছেন কীভাবে তাদের দুইজনের মধ্যে (আবুল হোসেন ও আহসান হাবীব) উপর্যুক্ত বিষয়ে গবেষণার আগ্রহ জন্য পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া, গবেষণার বিষয়বস্তু নিয়ে তাদের পূর্ব-অভিজ্ঞতা, গবেষণার সময়কাল, কর্মরত প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা, তথ্যের উৎস ও মাঠ, প্রাইমারি বনাম সেকেন্ডারি উৎস, গুনগত ও পরিমাণগত পদ্ধতির মিশ্রণ এবং এথনোগ্রাফিক পদ্ধতির ব্যবহার। পরিশেষে, গবেষণার বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে তারা পাঁচটি অত্যাবশ্যক প্রশ্নের অবতারণা করেছেন যা নিয়ে আরো অধিকতর গবেষণা প্রয়োজন। প্রশ্নগুলো আলোচ্য বিষয়ে আগ্রহী ও গবেষণারত অন্য গবেষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা হতে পারে।

বইটির ভূমিকাতে ইউএসএ-এর ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সেলিম রশিদ যথার্থই বলেছেন ‘মাঠ গবেষণার আলোকে লিখিত এ বইটি সমসাময়িক কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক স্থানিক বাস্তবতার একটি চমৎকার চিত্রায়ণ।’


বই : ধানচাষি কৃষক : সংকটের নতুন ধারা
লেখক : আবুল হোসেন ও আহসান হাবীব
প্রকাশকাল : ২০২০
প্রকাশক : টাঙ্গন
মূল্য : ২০০ টাকা


দেশের বই পোর্টালে লেখা ও খবর পাঠাবার ঠিকানা : desherboi@gmail.com

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD