পাঠ প্রতিক্রিয়া

ডাক্তারি বিজ্ঞান দর্শন সম্বলিত পরামর্শ নিয়ে ‘সুস্থতার সন্ধানে’

মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪ | ৯:১৬ অপরাহ্ণ | 135 বার

ডাক্তারি বিজ্ঞান দর্শন সম্বলিত পরামর্শ নিয়ে ‘সুস্থতার সন্ধানে’

বইয়ের নামকরণটি সরল সুস্থ জীবনের দিকটিকের ইঙ্গিত করে। আমাদের সকলেরই কাম্য একটি সুস্থ রোগমুক্ত কর্মক্ষম শরীর। সেই দারুণ সুস্থতার জন্য আমাদের মেনে চলতে হবে কিছু ডাক্তারি বিজ্ঞান দর্শন সম্বলিত পরামর্শ। লেখক ডা. শুভাগত চৌধুরী “সুস্থতার সন্ধানে” বইটিতে চেষ্টা করেছেন আমাদের স্বাস্থ্যকুশল, সুস্থতা সম্পর্কে জানাতে।

একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও তার লিখিত জীবন-দর্শনের দেখা পেয়েছি  বইয়ের প্রতিটি পাতায়।  বিন্যাসে আলো ছড়িয়েছেন স্বাস্থ্য কুশলের নানা বিচিত্র বিভাগে। আমাদের দৈনন্দিন জীবন সুস্থ সুন্দর করে তুলতে তার প্রতিদিনের অবদান সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখে পড়ার মতো।
তার লেখা আরও ৭০টি বই শরীর ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পদ।

সুস্বাস্থ্য নামের সম্পদের অধিকারী হতে চাইলে যত্নশীল হতে হবে নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি। মেনে চলতে হবে কিছু নিয়মকানুন!
সুস্বাস্থ্য আসলে কী?
সুস্বাস্থ্য কী? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রতি দশজনের আটজন বলবে, কোনো রোগ না হওয়াই সুস্বাস্থ্য। চারজন এখনও বলবে, সুস্বাস্থ্য মানে স্লিম বা মোটা  হওয়া। এর মূল কারণ হচ্ছে, এটি নিয়ে ঠিকঠাক সচেতনতা দূরে থাক, যথেষ্ট জানাশোনাও নেই আমাদের। সুস্বাস্থ্য কি শুধুই কি শারীরিক সুস্থতা?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুস্বাস্থ্যের সংজ্ঞায় শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক ও সামাজিক সুস্থতার কথাও বলা আছে। অর্থাৎ, সুস্বাস্থ্য হচ্ছে একজন মানুষের শারীরিক, মানসিক, ও সামাজিকভাবে সুস্থ থাকা। কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলার মাধ্যমে যা বজায় রাখা বেশ সহজ!

অধ্যাপক ডা.শুভাগত চৌধুরীর “সুস্থতার সন্ধানে” বইতে শারীরিক কুশল বর্ণনা করেছেন। দশটি অধ্যায়ে তুলে এনেছেন দৈনন্দিন কুশলের পাশাপাশি সামাজিক ও পরিবেশের বিভিন্ন বিষয়। এনালিসিস করেছেন সেগুলো বিভিন্ন ফর্মে। যা স্বাস্থ্যখাতে আলোড়ন আনতে পারে। ঔষধের ব্যবহার কমিয়ে নিজের প্রতি নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি  শ্রদ্ধাশীল হওয়ার ধাপগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে পড়তে হবে বইটি।

কুশল মানেই আমরা বুঝি সামাজিক একটি আচরণ। ডা. শুভাগত চৌধুরী কুশল বলতে সুস্থ থাকা আবেগিকভাবে, আধ্যাত্মিক  ও সামাজিকভাবে থাকাকে বুঝিয়েছেন।

অতিমারী করোনা বা দেশের ভেতরে কিছু নিত্য ব্যধি বিস্তার লাভ করেছে। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, নিউমোনিয়া, এই রোগের সময়ে এই কুশল কথাটির তাৎপর্য ছিল।
স্বাস্থ্য কুশলের কয়েকটি পর্যায় আছে : স্বাস্থ্য কুশলে দরদ ও মমতা, সেবার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য প্রাক সেবা, প্রোএকটিভ এবং সবার উপরে এই ব্যবস্থাটি হবে দরদমাখা। যেহেতু ক্রনিক রোগগুলোও নীরব মহামারীতে কিছু ভাবনা আসছে বিগত বছরগুলোতে।
Wellness shift form illness to wellness.
আরও বিস্তারিত বর্ণনা আছে বইটিতে। কুশলের মূলনীতির  প্রসঙ্গে লেখক প্রতিরোধ ও সামগ্রিক স্বাস্থ্য, কুশলের বহুমাত্রিকতা– দৈহিক, মানসিক, আবেগিক আধ্যাত্মিক, সামাজিক, পরিবেশগত অবস্থা ব্যাখ্যা করেছেন।

প্রকৃতিকে আলিঙ্গন– বিষয়ে পোজেন-এর পরামর্শ হলো, “ভালো থাকতে হলে অবলোকন করুন ঝরণা, সাগরতীরে বসে থেকে লক্ষ্য করুন ঢেউয়ের আসা যাওয়া, এমন পরিবেশ মনে কোমল ছন্দ আনে, উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়ে। পাওয়া যাবে আত্মিক কুশলের স্পর্শ।
স্বাস্থ্যকর বন্ধুত্বের শক্তি প্রসঙ্গে বলেছেন, যা পিতামহ মা-বাবারা আমাদের ভালো-মন্দ শিখিয়ে থাকেন শৈশবে, সামাজিক, নৈতিক, নীতিকথা পছন্দ  অপছন্দ বুঝতে শিখি। ভেতরের আমিকে ঋদ্ধ করে হিতকর বন্ধুত্ব।
এই বন্ধুত্বে কিশোরবেলা থেকে তরুণ বৃদ্ধ বয়সের চমৎকার সব আত্মিক বর্ণনা দিয়েছেন। পশুজাত বন্ধুত্ব গবেষণায় দেখা গেছে বানরের মতো বুদ্ধিমান প্রাণী বিভিন্ন আবাস ও আশ্রয়ের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয় আর মানুষের মতো তারা গোষ্ঠিতে মানিয়ে নিতে পারে।

মানুষের জীবনের নানা পর্যায়ের বন্ধুত্ব আমরা দেখি, সোশ্যাল মিডিয়ার কাছে আমরা নত এখন, সেই সঙ্গে সহকর্মী থেকে শুরু করে পরিবারের সঙ্গে, বন্ধুর চেয়ে বেশি সময় কাটে। ফেসবুকে তা হয়েছে ব্যাপক। বৃদ্ধজনের কুশলে শুভাগত চৌধুরী বলেছেন শ্বাসক্রিয়ার কথা, নাক দিয়ে শ্বাস–প্রশ্বাসের ভালো ফল পাবার কথা।

কর্মদিবসে উপদেশ দিয়েছেন হেঁটে কথা বলতে, ৩০ মিনিটের কল হলে হেডফোন কানে পায়চারী করে কথা বলতে। বলেছেন সবুজে হেঁটে স্বাস্থ্য ভালো করে বিভিন্ন কাজের উচ্চতর সম্ভাবনা গড়ে তুলতে। কিছু হালকা যোগ ব্যায়াম, যথেষ্ট জলপান প্রাত:কৃত সময়মতো করতে ইত্যাদি।
করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে আমরা অনেক রকম অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তাই শরীর এখন সংকেত দিলে সেটি শুনতে হবে কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে।

বইটিতে আরও কিছু প্রয়োজনীয় অধ্যায় রয়েছে। সেগুলো আলোচনা করছি।

কুশলের ৬টি মাত্রার কথা বলেছেন কর্মপন্থা ও জীবনযাপনকে গ্লোবাল ওয়েলনেস ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীরা। এর এলাকাগুলো হলো সার্বিক কুশলের বিভিন্ন মাত্রা, শারীরিক মানসিক আধ্যাত্মিক আবেগগত সামাজিক ও পরিবেশগত কুশল। সামগ্রিক ভাবে ভালো থাকার উপলব্ধি। সামাজিক সম্পর্ক ভালো রেখে শরীরচর্চা, সুষম খাবার, ভালো ঘুম, মগ্নতা চর্চা, এগুলো জীবনযাপনের বহুমাত্রিক স্বরূপ।
এই মাত্রাগুলো নিজেকে রক্ষার কুশল সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশে বাস, শারীরিক প্রভাব আছে। এতে স্বাস্থ্য রোগের ঝুঁকি ও স্বাস্থ্য পরিণতির ৮০-৯০ ভাগ শতাংশের পেছনে রয়েছে পরিবেশগত সামাজিক ও জীবন শৈলীর উপাদান।

বইটি পড়তে পড়তে হারিয়ে গেছি, কখনো দৈহিক  কুশলে, শরীরের পরিশ্রম খেলাধুলা শরীরচর্চা বিশেষ একটি পর্যাপ্ত এনার্জিপ্যাক নিয়ে ।  A wise man ought to realize that health is the most valuable possession.
এমন সব স্বাস্থ্য অভ্যাস ইতিবাচক ফল আনে, ভালো আছি কুশলে আছি- এসব চর্চায় রোগের ঝুঁকি কমে, আর শরীরে বল শক্তি বৃদ্ধি পায়।

ডা. শুভাগত চৌধুরী “সুস্থতার সন্ধানে” বইটিতে একটা পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানসম্মত স্বাস্থ্যরক্ষার জীবনসূচি দিয়েছেন। শরীরচর্চা সবাইকে সেই স্বাস্থ্যসূচিতে রাখতে বলেছেন, শিশু কিশোর বৃদ্ধ মধ্য বয়স সবাইকে।

শরীর চর্চা : শরীরে বাড়ায় শক্তি, পোড়ায় ক্যালোরি, হৃদস্বাস্থ্য করে উন্নত, মেজাজ করে চনমনে, মগজের স্বাস্থ্য করে উন্নত।
জার্নাল অব জেরোন্টলজিতে কম্যুনিটিভিত্তিক একটি কহোর্ট স্টাডিতে দেখানো  হয়েছে, সপ্তাহে  অন্তত পাঁচঘণ্টা শরীরচর্চা করলেও অংশগ্রহণকারীদের মানসিক ক্ষমতা বেশ  বেড়েছে, আর এতে ভবিষ্যতে ডিমেনশিয়া রোগ ঝুঁকি ও কমেছে। ইয়োগা শিক্ষক যাদব বলেন, শরীরচর্চা বিশেষজ্ঞ নির্দেশনায় করা উচিত।

মানসিক কুশল নিয়ে বইয়ের শেষ দিকে একটি অধ্যায় রয়েছে। লেখক অসাধারণ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন এই অধ্যায়ে। মানসিক কুশল হলো অন্তর্নিহিত শক্তি, যা আমাদের ভাবতে, অনুভব করতে, যুক্ত হতে, কর্মে নিয়োজিত হতে সাহায্য করে। এটি যার যার সম্পদ, গতিশীল, পুনঃনবায়নযোগ্য ও ইতিবাচক শক্তি। এমন একটি প্রক্রিয়া আমাদের কোনো কিছু ঘটার আগেই সক্রিয়  প্ররোচিত করে সতর্ক করে আর সঞ্চারনশীল করে।

মন আমার দেহঘড়ি। আমরা জানি মনই আসল সবকিছুর উর্ধে থাকে। মানসিক কুশলের কয়েকটি ধাপ রয়েছে : চিন্তা, মানসিক  আঙ্গিক, সংযোগ, সামাজিক দিক, ইমোশনাল দিক, কার্যকরী হওয়া মনোগত দিক।
মন ভালো না থাকলে সবকিছুই অচল হতে পারে। পৃথিবী বাসযোগ্য থাকে না, নিজেকে শেষ করার একটা প্রবণতা দাঁড় করায় মানসিক রোগী।
মানসিক কুশল হলো প্রতিরোধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে জীবনের বিপর্যয়ের মোকাবিলা করা। চাপের মুখে সামলে ঘুরে দাঁড়ানো, চাপে নুয়ে না পড়ে ঠেকানো, ক্রোধ একাকিত্ব দুশ্চিন্তা দুঃখ অনুভব করে সামলে দাঁড়ানো।
মানসিক শক্তি বড়ো শক্তি। তার মানে সুখী বোঝাতে নয়। জীবনে যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার শক্তিটা থাকে যেন।

মানসিক কুশল বাড়াতে আমরা যা করতে পারি : পরিবার  বন্ধুদের সময় দিন, টিভি বন্ধ করে কথা বলুন, হাসপাতালে  স্কুলে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করুন। দূরের পরিচিত বা কাছের মানুষদের সাথে অনলাইনে যুক্ত থাকুন। তবে সামাজিক মাধ্যমে বেশি সময় না দিতে পরামর্শ করেছেন।
নিজের আত্মমর্যাদা বাড়াতে হবে, শরীর সক্রিয় রাখতে। লক্ষ্য ও চ্যালেঞ্জ তৈরি  করে সেখানে পৌঁছাতে নিজেকে সাহায্য করতে হবে। আর কিছু  ব্যায়াম, মননশীলতা চর্চা, কাজ ও জীবনের ভারসাম্য বজায় রাখা, মগ্নতা, স্বাস্থ্যকর খাবার, আর অন্যদের দিতে হবে হাত ধরে।

আধ্যাত্মিক কুশল নিয়ে লিখেছেন। সেখানে ধর্ম গোত্রের কোনো বাধা নেই। আছে ধ্যান গম্ভীরতা পরমেশ্বর-এর প্রতি মানসিক শান্তি অর্জনের জন্য। আমাদের জীবনের গভীর অর্থ, উদ্দেশ্য, স্বস্তি আশা ও অন্তর্গত শান্তি সন্ধানের পথ হলো আধ্যাত্মিকতা।

সরল স্বিকারোক্তি জানিয়েছেন, শুভাগত চৌধুরী তখন তিনি যেন এক সরব দার্শনিক, “জীবনের অভিজ্ঞতা যখন বিহ্বলকারী প্রগাঢ় ও আনন্দময় হয়ে ওঠে তখন মনে প্রশ্ন জাগে, এর সৃষ্টিকর্তা কে? জীবনের উৎস বা প্রক্রিয়া জানতে চাইলে মানতে হবে  যে নিকটতম সৃষ্টির নজির নিজের শরীর। নিজের  মধ্যে সৃষ্টি উৎসের সন্ধান খুঁজে  পেলে তা হলো আধ্যাত্মিকতা। যতটা পড়েছি তাঁর লেখা মগ্নতায় বিভোর থেকেছি অনন্য এক দর্শন ছড়িয়ে আছে বই জুড়ে।

প্রতিটি  মানুষের আছে অনুভূতি– দৈহিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া।
কোনকিছুর প্রতি যে প্রতিক্রিয়া হয় তাকে প্রভাবিত করে অনুভূতি, আমাদের অন্তরের অনুভূতির প্রকাশ হলো আবেগ বা ইমোশন। নিজের অনুভূতি সম্পর্কে জানলে নিজেকে আরও জানা যাবে, রাগ হলে মুখ লাল হয়ে পেশি টানটান হয়ে যাবে, কোন বিন্দুতে আঘাত করতে ইচ্ছে করবে এগুলো দৈহিক প্রক্রিয়া।
অপর দিকটা হলো মানসিক। কেমন আবেগ হলো এতে বোঝা যাবে। আবেগজাত কুশলের কৌশল রয়েছে ঘুরে  দাঁড়ানোর শক্তি  অর্জন, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যাকে দেখা, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের চর্চা, রাতে চাই ভালো ঘুম, কমাতে হবে মনের চাপ, নিজেকে ভালো রাখা।

বইয়ের শেষ অধ্যায়টি গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ। মানুষের মনের না বলা অভিযোগগুলো পরীক্ষা গবেষণার মাধ্যমে লেখক শুভাগত চৌধুরী বর্ণনা করেছেন।

২০২২-এর একুশে পদকপ্রাপ্ত এই চিকিৎসাবিজ্ঞানী আমাদের গৌরব বয়ে এনেছেন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চিকিৎসা বিজ্ঞানের অঙ্গন থেকে। বহুকাল মেডিকেল কলেজগুলোতে  শিক্ষকতা করেছেন। প্রচুর মেডিকেল জার্নাল লিখেছেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চিকিৎসা সাময়িকী ও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠসূচিতে। গবেষণা করেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন চিকিৎসা বিদ্যাপিঠে ল্যাব-এ।


বই : সুস্থতার সন্ধানে
লেখক : ডা. শুভাগত চৌধুরী
প্রকাশক : মাতৃভাষা প্রকাশ
প্রচ্ছদ : ফরিদী নুমান

 

 

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD