বইয়ের নাম : নারীজনম
লেখক : সুমন কুমার
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান: ভাষাচিত্র
মুদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা
——————————————————–
নারী-নদীর বুকে দাঁড়িয়ে পুরুষ মাঝির জবানিতে “নারী জীবন’ নামক তরণীর দোদুল্যমান ছুটে চলার গল্প, ‘নারীজনম’ । যে জীবনের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকে নানা সম্ভাবনা ও অনিশ্চয়তা। অপর দিকে, নারী জীবনের নিশ্চয়তা হিসেবে আছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর দেহের চাহিদা, দেহসৌষ্ঠবের সৌন্দর্য ও তার যথেচ্ছ ব্যবহার, প্রতারণা ও প্রতারিত হবার গল্প, স্বার্থত্যাগ সমেত আত্মত্যাগ, সমঅপরাধে নারী অপরাধীর প্রতি সমাজের কটুক্তি এবং তারচে অত্যুক্তি ! এমনকি লেখক ও শিল্পীদের কাজে ‘নারী’ চরিত্র নির্মাণে নিষ্ঠুর ও নির্দয়তার স্পষ্ট ছাপও লক্ষনীয়। যেমনটি উপন্যাসিক নিজেই বলেছেন তাঁর সৃষ্টকর্মে-
‘নির্দয় না হওয়া পর্যন্ত শিল্পী উৎকর্ষের চূড়ান্তে পৌঁছে না। যে কাঁদছে শিল্পী তাকে আরো কাঁদায়। যে বেঁচে যেতে পারতো তাকে প্ররোচিত করে আত্মহত্যায়। লজ্জা অপমানে জর্জরিত যে মানুষ আত্মহত্যা করে মুক্তি পেতে পারতো তাকে বাঁচতে বাধ্য করে। যে কেঁদে হালকা হতে পারতো তাকে হাসায়। শোকগ্রস্ত মানুষকে হাসানো কি কম নির্দয়তা!’ (নারীজনম )
#প্রেক্ষাপট ও #গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সংক্ষেপ
উপন্যাসের মূল কাহিনী আবর্তিত হয়েছে ‘ডেভেলপমেন্ট থিয়েটার এক্টিভিস্ট’ একদল থিয়েটারকর্মীর পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনকে ঘিরে যারা স্তন ক্যান্সার সচেতনতা নিয়ে বেসরকারী একটি সংস্থার সাথে কাজ করছে। রাজা শরীফ-এ দলের প্রধান,আরো আছে তাঁর সহধর্মিনী জেরিন এবং তানশা, মাসুম, শম্পা ,নবনীতা, জাকির, রবিউল ও সংশ্লিষ্ট অন্যরা। একসাথে কাজ করতে গিয়ে আনন্দ ,বেদনা,হাসি, গান, প্রেম, প্রতারণা সব কিছুই স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে চলছিল তাদের । তবে একটু অন্যভাবেই ঔপন্যাসিক তুলে ধরেছেন এখানকার নারীদের জীবন।
স্তন ক্যান্সার সচেতনতায় কাজ করলেও উদ্দাম প্রেমে নিমজ্জিত মাসুম-শম্পা যুগল জানেই না দীর্ঘদিন ধরে স্তন ক্যান্সারে ভুগতে ভুগতে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাদেরই পরিবারের অতি আপন এক বয়স্কা নারী,যিনি যথাসময়ে চিকিৎসা গ্রহণকে অস্বীকার করেছেন ‘তাঁর নিজ পুরুষকে’ দীর্ঘদিন যাবৎ শারীরবৃত্তীয় সুখ প্রদানের উদ্দেশ্যে।
থিয়েটার দলনেতা রাজা শরীফ নিজ সহধর্মিনীর সমান্তরালে বহুগামিতায় মগ্ন নিজ দলের তরুনী সহকর্মীর সাথে। শরীফের সহধর্মিণী এ বিষয়ে জ্ঞাত হলেও ‘তার বুক ফেটেছে কিন্তু মুখ ফোটে নি’।
প্রেমিক মাসুমকে অপরিসীম বিশ্বাসে সবসময় নিজ দেহ প্রাণ বিসর্জন দিয়ে আসলেও অকস্মাৎ ধেয়ে আসা এক দুর্যোগকালে প্রেমিকা শম্পা পরিত্যক্ত হয়েছে প্রেমিক দ্বারা।যে দুর্যোগের জন্য দায়ী নির্মম,নিকৃষ্ট একদল পুরুষ।অথচ সেই দুর্যোগ থেকে প্রেমিকাকে বাঁচাবার সুযোগ হারানোর দায় কিছুটা হলেও অস্বীকার করতে পারবে না প্রেমিক মাসুম।
অন্যদিকে, ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই’ দর্শনে ব্রত সুপ্ত প্রেমিক রবিউল তার প্রেমিকাকে ‘ঠিক ভাবে’ মনেপ্রাণে চাইলেও, তার প্রেমিকা ততক্ষণে ‘ভুল নৌকায়’ উঠে পড়েছে! এই ‘ভুল নৌকায়’ উঠে পড়াটা ‘নারীজনমের’ একটা স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য মনে হয়েছে। যদিও নৌকা ‘ভুল’ ছিল নাকি ওঠার পর নৌকায় ‘ত্রুটি’ ধরা পড়েছে এ বিষয় তর্কসাপেক্ষ।
‘প্রেমের ক্ষেত্রে সবকিছু শুদ্ধ’ কিংবা ‘প্রেম অন্ধ’ এই তথাকথিত বিশ্বাসের বলিদান আরেক নারী, নবনীতা তারই সহকর্মী অপর নারীর কারণে বঞ্চিত হয়েছে নিজ মেধা ও শ্রমের অবমূল্যায়ন দ্বারা। ফলাফল আবার ওই চিরায়ত ‘মুখ ফোটে নি’ তাঁর!
ধর্মবিশ্বাস কে উপেক্ষা করে গৃহপরিচারিকা নমিতার পরকীয়ায় আসক্ত হওয়া এবং সন্তান সন্তানাদির কথা চিন্তা করে পুনরায় স্বামীর কাছে প্রত্যাবর্তনের গল্পও ‘নারীজনমের’ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যেখানে নমিতার প্রত্যাবর্তন ‘লজ্জা’ হিসেবে বাঁধ সেধেছে এক সংকীর্ণ ও গোড়া সমাজের প্রতিনিধিদের কাছে।
#বর্ণনাকৌশল
‘নারীজনম’ এরনারীর কাহিনীগুলো ‘নিরপেক্ষ অথচ বাস্তবানুগ’ হিসেবে সুমন কুমারের কলমে উঠে এসেছে । গতবছর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ, ‘স্বপ্নে পাওয়া হাত’ থেকে তাঁর কাহিনী নির্মাণের সামর্থ্য সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলাম। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নারীজনম’ সেই ধারণাকে আরো পোক্ত করলো। ‘নারীজনম’ এর বর্ণনাশৈলীতে ঔপন্যাসিক কাহিনীর প্রয়োজনে খুঁটিনাটিসহ কখনো বলেছেন বিস্তারিত,আশ্রয় নিয়েছেন গান-কবিতার, প্রশ্রয় দিয়েছেন স্বাভাবিক যৌনতাকে।পুরাণের আশ্রয় নিতেও দেখেছি তাঁকে নারী-জীবনের তুলনামূলক বিশ্লেষণে। পুরাণে বর্ণিত ‘ধরাসতী’ নামক আত্মত্যাগী নারীকে দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত অবস্থায়ও দেখি দোকানিকে নিজ স্তন বন্ধক রেখে ছদ্মবেশী অতিথি দেবতা নারায়ণ ও দেবর্ষি নারদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে।ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে তামিলনাড়ুর ত্রিবান্দাম রাজ্যে নিম্ন শ্রেণীর নারীরা জনসম্মক্ষে বের হতে চাইলে বাধ্যতামূলক যে মুলাক্কারাম (ব্রেস্ট ট্যাক্স) প্রদানের সম্মুখীন হতো সেই ইতিহাসও উঠে এসেছে ‘নারীজনম’-এ।
#ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণঃ
উপরোক্ত দীর্ঘকথনে ‘নারীজনম’ কেবলি ‘নারীরই ব্যাপার’ মনে হলেও এটি নারী ও পুরুষের সহযোগী হিসেবে পথচলারই এক আমন্ত্রণ। যে গল্পে কিছু ভুল হয়তো আছে নারী ও পুরুষ দুই বিপরীত লিঙ্গেরই। তবু ‘নারীজনম’ আহ্বান করে, অনুপ্রাণিত করে, আত্মউপলব্ধি করায় সেই ভুলগুলো শুধরে নেবার ‘একসাথে’, যার সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি :
‘তারাও জানুক হাতে হাতুড়ি
জেগে তুমি আর আমি
গায়ের চাদরে এক্ষণ পোস্টার,
পতাকা উড়াবো হাতে’। (নারীজনম, পৃষ্ঠা ১৫ )
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD