” যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে-
তবে একলা চলোরে,
একলা চলো, একলা চলো
একলা চলো রে…।”
বইয়ের নামঃ- “একা ”
লেখকের নামঃ- মৌলী আখন্দ
প্রচ্ছদঃ- আবুল ফাতাহ মুন্না
প্রকাশকঃ- ভূমি প্রকাশনা
মূল্যঃ- ৩০০ টাকা
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের এই বানীটি ঘিরেই যেন আবর্তিত হয়েছে “একা” উপন্যাসের কাহিনী। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো সামগ্রিক ভাবে সব কিছুতে যুক্ত থাকলেও লড়াই করেছে একাকীত্বের সাথে। একাকীত্ব একেক সময়ে একেক ভাবে চরিত্রগুলোকে ভেঙে চুড়ে চুরমার
করে জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে শেষ করতে চাইলেও চরিত্রগুলো সেই একাকীত্বকেই ঘুরে দাঁড়াবার হাতিয়ার বানিয়ে একলা চলো মনোভাবের শক্তি পেয়েছে; পেয়েছে মনোবল আর সাহসিকতা।
“একা” একটি সামাজিক জীবন ধর্মী উপন্যাস। সেই ১৯৭১ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত এই সময়ের তিন নারী প্রজন্মের জীবন যুদ্ধ, জীবনের অস্তিত্ব, ভালো থাকা, মন্দ থাকা, ভিন্ন ভিন্ন চেতনা, পরিবেশ,পরিস্থিতি সব কিছুকেই সাবলীল ও সমান্তরাল ভাবে এগিয়ে নিয়েছেন লেখক। তিন প্রজন্মের নারীর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলিতে এগিয়েছে উপন্যাসটির কাহিনী। উপন্যাসটির নারীরা সকলেই এক একটি প্রতিবাদী সৈনিক। তাদের সাহসিকতা, তাদের আত্মনির্ভরশীলতা, তাদের সুখ-দুঃখ গুলো, তাদের কষ্টগুলো,তাদের আনন্দ অনুভূতি গুলো একই সুতেোয় “বিনি সুতোর মালার” মত গেঁথেছেন তিনি।
কাহিনী সংক্ষেপঃ-
উপন্যাসটা গতানুগতিক ধারার নয়। তিন প্রজন্মের নারীর জীবনের নানা ঘটনায় এগিয়েছে এর কাহিনী। মূল চরিত্র রওশন। তিনি হলেন মুক্তি যুদ্ধের সময়কার গল্পের প্রথম জেনারেশন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়। সাংসারিক অপরিপক্কতার কারনে হোক, বা সংসারের যাতাকলে পৃষ্ঠ হয়ে হোক ; পরপর পাঁচটি মেয়ের জন্ম দেন শুধুমাত্র একটি ছেলে সন্তানের আশায়। তৎকালীন সমাজের চিন্তাধারাই ছিল একটি ছেলে সন্তানই পারে বংশবৃদ্ধি করতে। রওশনের পরিবার বিশেষ করে ওর শাশুড়ীর মানসিকতা ছিল সেই আদলেই গড়া। তবে ঐ চিন্তধারা থেকে কিছুটা হলেও বেড়িয়ে আসতে পেরেছেন রওশনের স্বামী। তিনি
ঐ গতানুগতিক চিন্তা ধারার ছিলেন না তবে পরিকল্পনা মাফিক পরিবারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ছিলেন কিছুটা উদাসীন। তবুও পরপর পাঁচটি মেয়ের বাবা হওয়া সত্বেও তিনি মুখ কালো করেননি বরং মহানন্দে মেয়েদের নাম রেখেছেন মুক্তি, তৃপ্তি, দীপ্তি, সুপ্তি আর জরী। তবে রওশন পরবর্তীতে একটা পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়ে সমাজের বিশেষ মানসিকতা থেকে উৎরে গিয়েছিল। স্বামী সন্তান নিয়ে বেশ চলছিল রওশনের দিনগুলো।
এই সুখ রওশনের ভাগ্যে সইল না।ছেলে হওয়ার এক বছরের মাথায় স্বামীহারা হলো। তবে তার স্বামীর পুত্র সন্তানের চাহিদা থাকলেও মানসিকতা ছিল একটু অন্য ধাচের, যার কারণে তিনি তার বাড়িটা স্ত্রীর নামে করে দিয়েছিলেন। হয়তো তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন কন্যা সন্তানের পিতা হওয়ার সুবাদে ওনার মৃত্যুর পর সম্পত্তি সন্তানদের বদলে আত্মীয় স্বজনের কবলে চলে যাবে। রওশন বাড়িটাকে আঁকড়ে ধরেই ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে লাগলেন।
স্বামী মারা যাবার পরই শুরু হয় তার জীবন যুদ্ধ। রওশনকে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। আনাড়ি দাইয়ের অপটুতা, ঘন ঘন সন্তান জন্মদানের পর নারীর জরায়ু নিচে নেমে আসা,গৃহকর্মীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক ইত্যাদি সব মিলিয়ে রওশনের নারী জীবনকে প্রতিমুহূর্তে ভয়াবহ বাঁক পরিবর্তন করে যুদ্ধে টিকে থাকতে হয়েছে। লেখক তার লেখনীতে ঐ সময়কার একজন অসহায় নারীকে পরিপূর্ণ শক্তভাবে উপস্থাপন করেছেন তার উপন্যাসে। তার পাঁচটি মেয়ে, প্রত্যেকেরই জীবন পথে ঝড়-ঝঞ্ঝার শিকার হতে হয়েছে। অল্প বয়সে ভুল করা তাদের চলার পথকে কঠিন করেছে ঠিকই কিন্তু থামাতে পারেনি তাদের পথ চলা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে নারী জীবন দায়িত্বের দায় বহন করে
চলেছে। জীবনের সব প্রতিকূলতাকে চ্যালেঞ্জ করে এগিয়ে গেছে তারা। রওশনের জীবনে আহা মরি কিছু না ঘটলেও যতটুকু ঘটেছে তা অস্বীকার করি কি করে।
এবার আসি দ্বিতীয় প্রজন্ম অর্থাৎ রওশনের মেয়েদের জীবনধারা, চলার গতিপথ, সামাজিক টানাপোড়েন এবং আত্মনির্ভরশীলতার যুদ্ধের কাহিনীতে। মুক্তি, তৃপ্তি, দীপ্তি, সুপ্তি জরী আর বাবুকে নিয়ে অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে কেটেছে রওশনের জীবন। স্বামী হারানোর অসহায়ত্বের এবং পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে সন্তানদের দিকে পুরোপুরি খেয়াল দিতে পারেনি। তাইতো বড় মেয়ের জীবনে নেমে এল কালো মেঘের ছায়া। অবশ্য কিছুটা মুক্তির বোকামিতেই, বাঁধ ভাঙা চঞ্চল মনটাকে আটকে রাখা সম্ভব হয়নি। জীবনটা তার উলোট পালোট হয়ে গেল। মেঝ মেয়ে তৃপ্তিও গা ভাসিয়ে দিল। বড় বোনের করুণ পরিণতি দেখেও তার শিক্ষা হলো না। এদিকে মুক্তি তার ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে আলোর দিকে মেলে ধরতে চেষ্টা করলো, কিন্তু বোনকে আটকে রাখতে পারলো না। এই উপন্যাসের একটা আকর্ষণীয় দিক হলো তৎকালীন সমাজে মেয়েরা একবার ভুল করলে, সেখানে মুখ থুবড়ে পড়ে যেত, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস পেত না। কিন্তু রওশনের মেয়েরা তা করেনি। তাদের দুঃসাহসিকতা, নীরেট মনোবল, আর আত্মনির্ভরশীলতা তাদেরকে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেয়নি; তারা আবার মাথা উঁচিয়ে চলতে পেরেছিল, এই সমাজে নিজেদের কে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। অবশ্য রওশনের অবদান ছিল অনেক। রওশনের চরিত্রটাকে লেখক সাহসিকতায় ভরিয়ে তুলেছেন, একজন বিধবা মায়ের মনোভাবটা খুব জোড়ালো ভাবেই উপস্থাপন করেছেন। মাটিতে হোচট খেয়ে পড়ে গেলে তার উপর ভর দিয়েই আবার তাকে উঠে দাঁড়াতে হয়, মুক্তি, তৃপ্তির জীবনে এমনই একটা দৃঢ় সত্যের বাঁধনে বেঁধেছেন লেখক।
দীপ্তি, সুপ্তির কথা সেভাবে আসেনি বইটিতে। তবে আমরা অনুমান করতে পারি, তাদের জীবন স্বাভাবিক ছন্দেই আবর্তিত হয়েছে। মায়ের আদর্শ, আপোষহীন মনোভাব, বোনদের জীবন যুদ্ধে জয়ী হবার মনোবল তাদের জীবনকে এগিয়ে নিয়ে গেছে সাফল্যের পথে। জীবনের সব প্রতিকূলতাকে চ্যালেঞ্জ করে এগিয়ে গেছে তারা।
এরপর আসা যাক তৃতীয় প্রজন্ম অর্থাৎ রওশনের পঞ্চম মেয়ে জরীর দুই মেয়ে রূপকথা আর অর্পিতা। মেয়েদের সাথে সাথে মা জরীর জীবন গাঁথা ও বিস্তর ভাবে উঠে এসেছে এই উপন্যাসে।
মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত স্বামী নিরুদ্দেশ হবার পর জরীর জীবনে নতুন করে ভালোবাসা আসে। তাই নিয়ে শুরু হয় জরীর নিজের সাথে দ্বন্দ্ব। তার জীবনেও বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার আগমন ঘটে স্বাভাবিক নিয়মেই। সন্তান রূপকথার প্রসব পরবর্তী ডিপ্রেশন, মানসিক সমস্যা, ছোট মেয়ে অর্পিতার বলাৎকার ও আইনের আশ্রয় চাওয়ায় সমাজের কাছে হেয় হওয়া, আমাদের চিরচেনা সমাজটাকে নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছেন লেখিকা তার উপন্যাসে।
রওশন বা তার মেয়ে মুক্তি, তৃপ্তি এদের মতো মনোবল ছিল না রূপকথার। ছিল না তার মায়ের মতো মানসিক শক্তি, তাইতো সে চুপিচুপি হারিয়ে গেছে রূপকথার রাজ্যে। অন্যদিকে তার বোন অর্পিতা নিজেকে দ্বিধা দ্বন্দ্বের বেড়াজাল ভেঙে জয়ী করে তুলেছে, নিজেকে হারিয়ে যেতে দেয়নি অন্ধকারে।
এই উপন্যাসের একটা চরিত্রকেও মনে হবেনা কাল্পনিক। গল্পগুলোকে শুধু রওশনের, তৃপ্তির, মুক্তির বা রূপকথা, অর্পিতার মনে হবে না। মনে হবে যেন গল্পগুলো আমার, তোমার কিংবা তার। আমাদের সমাজের প্রত্যেকটা মেয়ের। তবে এই গল্পের বিরাট পটভূমিতে এসেছে একাকীত্ব। একাকীত্ব এমনই একটা বিষয় যা শুধু চোখে দেখে বা বইয়ে পড়ে বোধগম্য হয়না, এযে হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে হয়।
পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ-
উপন্যাসটি সচেতনতা মূলক। অল্প বয়সে ভুল করা ভুলের জন্য কেউ নিজের জীবন বিপন্ন না করে। কেউ যেন ভেঙে না পরে। বরঞ্চ জীবনের সমস্যা, যন্ত্রণা, বিপদ এইগুলোকে শক্ত হাতে মোকাবেলা করে জীবনকে সুন্দর ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় খুঁজে পাওয়া যাবে এই চরিত্রগুলোর কাছ থেকে।
এই উপন্যাসের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে পোষ্টপারটাম ডিপ্রেশন নিয়ে আলোচনা।
” প্রেগন্যান্সির সময়ে মেয়েদের শরীরে প্রজেস্টোরন অনেক বেশি থাকে। ডেলিভারির পরে সেটা হঠাৎ করে কমে যায়। সেই জন্য কিছু সমস্যা হয়।কেউ কেউ অকারণ উগ্র আচরণ করে।নিজের বাচ্চাকেও সহ্য করতে পারে না কেউ কেউ।” সন্তান সম্ভবা মার এই ডিপ্রেশন মাঝে মাঝে কতটা যে ভয়াবহ হয়ে ওঠে তা ভুক্তভোগী পরিবারগুলোই উপলব্ধি করতে পারে। এই সত্যের উপলব্ধিতায় জীবনও চলে যায় অনেক বাচ্চার।
” না এমন মা আর দেখিনি কোনদিন! বাচ্চার জন্য একটু মায়া লাগে না! কেন পেটে ধরেছিলি?” লেখকের এই বক্তব্যের মধ্যেই ফুটে ওঠে এর সত্যতা। লেখক নিজে ব্যাক্তিগত জীবনে একজন ডাক্তার।তাই তিনি এ বিষয়টাকে সমাজের চোখে তুলে ধরেছেন নিখুঁত ভাবে। ভ্রান্ত ধারণার হাত থেকে প্রসূতি মাকে নিরাপদে রাখার সেই বার্তা দিয়েছেন তার লেখার মাধ্যমে।
এই উপন্যাসে একাকীত্বের মধ্যে থেকেই জয়ী হবার শিক্ষা দিয়েছে নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে। প্রত্যেকটা চরিত্রই যেন বাস্তব। যেন আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিদিনের দিনপঞ্জি। লেখাগুলো এতই সাবলীল যে পড়তে গিয়ে কখনো ভয়ে শিউরে উঠেছি, কখনো কান্নায় ভেঙে পড়েছি, কখনোবা দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়েছি, গড়ে তুলেছি যুদ্ধে জয়ী হবার মনোবল। কখনো মনে হয়নি কাগজে বন্দী কোন ঘটনা, মনে হয়েছে আমাদের চারপাশে ঘটা নিরন্তর ঘটনা।
পরিশেষে বলবো বইটা সবার পড়ার মতো। বইটিতে আছে আমাদের চারপাশে যাপিত জীবন বা সমাজের জন্য আশা জাগানিয়া বার্তা। আছে নতুন বোধ, নতুন আশা, জীবন তৈরী করার নতুন ভাষা। আশা করি পাঠকদেরও ভালো লাগবে। তৃপ্তি পাবে তারা। বাস্তবতার নিরিখে পরিবারের সবাইকে ভালো রাখতে, আগলে রাখতে, ছোট ছোট সমস্যাকে এড়িয়ে জীবনকে সুন্দর ভাবে সাজাতে “একা” উপন্যাসটি পড়া খুব প্রয়োজন।
[ বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের যে কোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য সংশ্লিষ্ট ছবিসহ আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : desherboi@gmail.com ]
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD