একটি চন্দ্রযান ও তার কারিগর

সোমবার, ১৮ মে ২০২০ | ১২:০৯ পূর্বাহ্ণ | 916 বার

একটি চন্দ্রযান ও তার কারিগর

॥ সাধনা সাহা ॥

” চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙ্গেছে
উছলে পরে আলো…।”
সেদিন টাঙ্গুয়ার আকাশে এমনি এক উছলে পড়া আলোয় জোছনার ফুল ধরতে চেয়েছিলেন “জোছনা কুমারী ” নামক “ধবধবে সাদা বড়োসড়ো একটি পরিযায়ী সারস ” (লেখকের ভাষায়) জলযান যা এক ধরনের লঞ্চ বা জাহাজে ভ্রমণ পিপাসু কিছু চন্দ্রভূক মানুষেরা।
” অবাক জোছনা ঝরে পড়ছে… হাত বাড়িয়ে ডাকছে…। ঘোরলাগা আকাশের পানে চোখ তুলে দেখি, সেই নীল কস্তুরী আভার চাঁদ… হাওরের দিকে উবু হয়ে দেখি, হাওরের জলেও ভাসছে সেই এক চাঁদ। কী আশ্চর্য, হাওরের জলে জোনাকির মতো জ্বলছে থোকা থোকা জোছনার ফুল! হাত বাড়িয়ে সেই জোছনার ফুল ধরতে চাই…।”
আহারে! লেখকের জোছনা ধরার কি আকুতি! কথাগুলো মনের অবচেতন দূয়ারে এসে নাড়া দেয়। সৌন্দর্য পিপাসু মনের ভাবরস বোধ জাগিয়ে তোলে। চন্দ্রাহত মনের আকুতি আসে লেখকের ভাষায়
“অভিলাষী মন চন্দ্রে না পাক, জোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাই…।” সেই অবাক জোছনায় সিক্ত হওয়া চন্দ্রাহত মানুষের মনের কথাগুলো তুলে ধরলাম, যা তিনি লিখেছেন তারই সৃষ্টি ” চন্দ্রযান – দ্য লুনাটিক এক্সপ্রেস” নামক গ্রন্থে। লেখক – গিয়াস আহমেদ।

“চন্দ্রযান – দ্য লুনাটিক এক্সপ্রেস ” নামটা শুনে প্রথমে ভেবেছিলাম চাঁদে যাওয়ার কোন নতুন নভোযান নয়তো? বা কোনাে বৈজ্ঞানিক কল্পলোকের কল্পকাহিনি নয়তো? কিন্তু না, তা নয়! বইটিতে আছে কিছু সৌন্দর্যপিপাসু মনের সৌন্দর্য অবলোকন করার আকাঙ্ক্ষা আর আছে আমাদের অতীত ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য, ও তত্ত্বসম্ভারে পরিপূর্ণ এক ক্ষুদ্র বিশ্বকোষের অবতারণা। আছে মুক্তিযুদ্ধের কিছু হৃদয়বিদারক অথচ অনেকেরই অজানা তথ্য। সামগ্রিকভাবে বইটিকে শুধু ভ্রমণকাহিনি বলা যাবে না। এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটা অনেক জোড়ালো। আমার ক্ষুদ্র মনের প্রয়াসে যতটুকু অনুধাবন করেছি তাতে মনে হয়েছে একইসাথে ভ্রমণ আর তার সঙ্গে হাওরের অজানা ইতিহাসের চমৎকার সমন্বয় ঘটিয়ে তিনি পাঠক হৃদয়ে উপস্হাপন করেছেন। তার বলতে চাওয়া ” Docu Travelogue” বইটিতে যথার্থ সার্থকতা এনেছে।
একটি আনন্দযাত্রার পটভূমি দিয়ে বইটি শুরু করেন তিনি। তার অতি কাছের বন্ধু – স্বজনদের নিয়ে যাত্রার শুরু। বাস্তবিক ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ননা, বিশ্লেষণ, বাস্তব চরিত্রগুলোকে সাবলীল ভাষায় উপস্হাপন পাঠক হৃদয়কে আকর্ষণ করে। বইটির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এক ধরনের নেশায় পেয়ে বসে।
কাহিনির বর্ননা এতই সাবলীল যে, পরের পাতা পড়ার আকর্ষণ “হাছন রাজার ভাষায় প্রকাশ করতে হয়
” নিশা লাগিল রে, বাঁকা দুনয়নে নিশা লাগিল রে।”

সত্যিই এক অপূর্ব নেশা ধরা হাওরের গল্প। তার অসাধারণ সৃষ্টির মুগ্ধতায় পাঠকহৃদয় হয় বশীভূত। তার বর্ণনার ছটায় সুনামগঞ্জের জুবিলী স্কুলের নামের সাথে মহারানী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে বসার ৫০ বছর পূর্তির কাহিনি জড়িত, যা পাঠককে পুরনো ইতিহাসের দোড়গোড়ায় এনে হাজির করে।
সুরমা নদী নিয়ে উপকথা, “রিভার ভিউ” ঘাটের বর্ণনায় মেয়র জগলুলের পরিচিতি। সুরমার রূপ দেখা এক রূপক কারিগর হাছন রাজার প্রপৌত্র মউজউদ্দীন-এর সারা শহরের বাতি নিবিয়ে জনগনকে জোছনা দেখানোর প্রয়াস। অথচ, তার বড় অকালে চলে যাওয়া সত্যিই বেদনাদায়ক। কিন্তু লেখক মনে থাকবে তার দেওয়া ” চান্দের দাওয়াত…।” অকৃত্রিম ভালোবাসায় মোড়ানো এক স্বর্গীয় সুখ বহনকারী আহ্বান হয়ে।
সুনামগঞ্জের নামকরণের ইতিহাস, ঐতিহ্য সব কিছুই তিনি তুলে ধরেছেন অসীম ধৈর্য আর মমতায়।পাঠককুলের পরিপূর্ণতা এখানেই। ওখানকার মানুষের জীবন, জীবিকা, কর্মসংস্থান, সংস্কৃতি- কিছুই বাদ যায়নি তার লেখনি থেকে। গ্রাম্য বঁধুর লুকিয়ে ” জোছনা কুমারী ” অবলোকন, গলা পর্যন্ত নিমগ্ন তুলশী মঞ্চের পাশে কাঁসার থালা-বাটি হাতে বৌটির “জোছনা কুমারী” দেখার আকাঙ্ক্ষার সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে আমার মন ও মনন।
হাছন রাজা, রাধা রমণ রায়, শাহ আব্দুল করিম, শেখ ভানু শাহ, জালাল উদ্দিন খাঁ, বিজয় সরকার, মিরাশ উদ্দিন, গিয়াস উদ্দিন আহমদ, দূর্বিন শাহ এই সব ভাটির বাউলদের জীবন যাত্রা, গানের ধারা, সুখ, দুঃখের কাহিনি বইটি পড়েই জেনেছি। আর মনে মনে বলেছি, ‘সত্যি কি আশ্চর্য রত্ন ভান্ডারে পরিপূর্ণ আমাদের এই হাওর অঞ্চল।’ বইটি না পড়লে অজানাই থেকে যেত। হাওর অঞ্চলের জনপ্রিয় একটি গান হলো ঘেটু গান। এই গানের অন্তরালে ঘেটু পুত্রদের দ্বাসত্ব প্রথা মনকে নাড়া দেয়। তাদের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বেদনা-বিধুরতা আমাদেরকে বিষণ্ন করে তোলে। ভাটিয়ালির করুণ সুরও বাদ যায়নি তার লেখা থেকে। বিলুপ্তপ্রায় ধামাইল নৃত্যও উঠে এসেছে স্বমহিমায়।
বারেক টিলা বা বড়গোপ টিলা, লাউড়ের গড়, বড়োছড়া বাজার বর্ণনায় নিখুঁত। ‘যাদু কাটা’ নদীর গল্প হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ‘যাদু কাটা’ নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা হিন্দুদের ‘ বারুনি স্নান ‘ আর মুসলিমদের শাহ-আরেফিনের ‘ওরস ‘ যেন অসাম্প্রদায়িকতার এক মেলবন্ধন। লেখকের ভাষায়, ” এই যাদু কাটা নদীতে যদি কান পাতেন, একই ঢেউয়ে আপনি শুনবেন নাম কির্তন, সেই একই ঢেউয়ে শোনা যাবে জিকিরের ধ্বনি।”
সত্যিই এক অপূর্ব অনুধাবন তার লেখনির পরশে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ‘ যাদু কাটা ‘ কে কাশ্মীরের ‘ঝিলম’ এর সাথে তুলনা তিনি বলেই সম্ভব। সেই কাশ্মীরি ‘ঝিলম’ থেকে তার মোহময় মুগ্ধতায় পাঠককে এনে দাঁড় করিয়েছেন ৭১-এর পটভূমিতে।

টেকেরঘাটে ‘শহীদ সিরাজ লেক’-এর নীল জলে মুগ্ধ হয়ে কোন পর্যটকের ‘ নীলাদ্রি ‘ নামকরণ, লেকের বর্ণনা প্রাণবন্ত। শহীদ সিরাজুল ইসলামের আত্মত্যাগের কথা, মৃত্যুর সাতদিন আগে তার বাবাকে লেখা চিঠি, জগত জ্যোতি দাসের দাস পার্টির ইতিহাস, তার সহযোগী ইলিয়াসসহ তার যুদ্ধ কালীন মনোবল, তার মৃত্যুর মর্মান্তিক কাহিনি লেখকের সহযাত্রীদের সাথে পাঠককুলও বিষন্নতায় মগ্ন হয়ে যায়। হয়তো বা পাঠকের চোখ দিয়ে নেমে আসে নোনা জল। লেখকের বর্ণনায়, ” জগত জ্যোতিরা এমনই জ্যোতির্ময়, জীবন দিয়ে তাঁরা জগতে আলো জ্বেলে যান, বুকের তাজা রক্তে দেশকে স্বাধীন মানচিত্র দিয়ে যান।”

সুরের আলো ছড়িয়ে দিতে দিতে পাঠক মনে জাগিয়ে দেন নতুন ভাবনার ছন্দ। নিয়ে চলেন আগামীর পথচলায়। সেই সত্য সুন্দরের অপেক্ষার অবকাশ হয় টাঙ্গুয়ার আকাশে, দুধ ধবল জোছনার এক অলীক স্বপ্নরাজ্যে। স্নিগ্ধ আলো, নরম-কোমল জোছনার ফুলের এক অতৃপ্ত হাতছানি যা পাঠক হৃদয়কেও পরিপূর্ণতায় ভরিয়ে দেয়।
লেখক গিয়াস আহমেদ যে লেখক হুমায়ুন আহমেদ এর স্নেহভাজন ছিলেন তা ওনার লেখা পড়লেই বোঝা যায়। হুমায়ুন আহমেদের মতো সহজ, সরল, সাবলীল ভাষায় বর্ননা, আবেগী মন, সাধারণ তুচ্ছ জিনিসকে অসাধারণ করে দেখার মতো চোখ, সবকিছু মিলিয়ে অসাধারণ! সত্যি অসাধারণ এই “চন্দ্রযান – দ্য লুনাটিক এক্সপ্রেস। ” লেখক তার সমস্ত আবেগ, অনুভূতি, ভালোলাগা, ভালোবাসা সব উজাড় করে দিতে পেরেছেন বলেই আমাদের মতো সাধারণ পাঠকদের মন ছুঁয়ে গেছে।
তবে, হ্যাঁ জিনিস নামক শব্দটি ছাড়া তার লেখনি অনবদ্য। তবে তার এই শব্দ চয়ণটাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ভাবনা মনে করছি না। তিনি যথেষ্ট উচ্চমনের মানুষ। হয়তো ঘুরতে যাওয়ার আনন্দে কোনাে এক বেভুল, অসতর্ক মুহূর্তের বিন্যাস বলেই মনে করছি। তার এই শব্দটিকে বিখ্যাত একটি গানের কলির “কপোলের কালো তিল ” মনে করেই না হয় পাঠক হৃদয়ের ভাবনা হবে। যে তিলের উপমায় মাঝে মাঝে কোনাে পাঠক খুঁজে পাবে ভালোবাসার অনুরণন, আর কেউ বা দীর্ঘনিঃশ্বাসের মাত্রাটা করবে আরও একটু দীর্ঘায়িত।

আমি একজন সাধারণ পাঠক। আমার বিশ্লেষণে যদি কোথাও কোনাে ভুলভ্রান্তি থাকে, যদি লেখকের অযাচিত মনে হয় তাহলে লেখককে সুন্দর, সহজভাবে নেওয়ার জন্য অনুরোধ রইলো। লেখকের ভাষায় বলছি, “অক্ষমতা বোঝার ক্ষমতাও চন্দ্রাহত মানুষের থাকে না।” অতএব…!
পরবর্তী বইয়ের গভীর অপেক্ষায় পাঠককুল অপেক্ষমান। বর্তমান আতংক, উৎকণ্ঠা, বন্দিদশা, সর্বোপরি করোনার করাল গ্রাস দ্রুত মুক্ত হোক।
সাবলীল, সহজ, সরল, মনোমুগ্ধকর আর একটি নতুন বইয়ের সাথে একটি সুন্দর নতুন সকালের আবেদন কি পাঠক হিসেবে অনেক বেশি হয়ে যাবে! ধন্যবাদ।

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD