একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছেলে হারানোর শোক অথবা মরণ ব্যাধি ক্যানসার শহীদ জননী জাহানারা ইমামের দেশ প্রেমের কাছে হার মেনেছে। নিজের মেধাবী সন্তান শহীদ রুমিকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলে তিনি। এমনকি নিজেও যুদ্ধ করেছেন কলম হাতে। ১৯৮৬ সালে তিনি রচনা করেন একাত্তরের স্মৃতি-বিস্মৃতি বিজড়িত গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে একইসঙ্গে স্বামী ও সন্তানকে হারিয়েছিলেন তিনি। এই শহীদ জননী জাহানারার পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল মুক্তিযুদ্ধে। তখন তার ১৯ বছর বয়সী বড় সন্তান শাফী ইমাম রুমি যুক্তরাষ্ট্রে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সুযোগ ত্যাগ করে মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে দেশের ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।
এ সময় প্রিয়জনকে হারানোর সেই বেদনা তাঁর অন্তরে জ্বেলে দিয়েছিল তীব্র দ্রোহের আগুন। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ তার নেতৃত্বেই গঠন করা গণআদালতের মাধ্যমে একাত্তরের শীর্ষ নরঘাতক গোলাম আযমের প্রতীকী ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।
যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের বিচারের আওতায় আনার জন্য তার প্রচেষ্টা ছিল অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। মূলত এরপর আমৃত্যু সেই সংগ্রামী নারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে নানা সময়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। এর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময় তিনি নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নিজেকে নিবেদিত করেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে তার রচিত ডায়রি ‘একাত্তরের দিনগুলি’ হচ্ছে এক অনন্য সৃষ্টি।
এদিকে ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী দল তাদের দলের আমির ঘোষণা করলে দেশ ব্যাপী সকল জনগণ এর বিরুদ্ধে তাদের বিক্ষোভে প্রদর্শন করেন। ১৯৯২ সালের ২১ জানুয়ারি জামায়াতের এই ধৃষ্টতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রায় ৭০টি রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন একজোট হয়ে গঠন করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নামে একটি সংগঠন।
জাহানারা ইমাম ছোটবেলাতেই পিতা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল আলীর তত্ত্বাবধানে রক্ষণশীলতার বাইরে এসে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। স্বামী প্রকৌশলী শরীফ ইমামও তাকে লেখাপড়ায় বেশ অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।
১৯৪৫ সালে কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে বাংলায় এমএ পাস করেন। এ সময় শিক্ষকতার মাধ্যমে শুরু হয় তার কর্মজীবন। ১৯৫২ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন। এর পর তিনি ফুল ব্রাইট স্কলার হিসেবে আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ১৯৬৬ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
এদিকে ১৯৭১ সালে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। যেখানে তিনি তার ছেলে রুমী ও স্বামীকে হারান। তিনি এই দুঃসময়ে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানাভাবে সাহায্য করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
স্বাধীনতার পর জাহানারা ইমাম নিজের লেখালেখি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করেন। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারের কাছে পরাজয় বরণ করতে হয় তাকে। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেটের ডেট্রয়েট শহরের একটি হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
দেশের সনাম ধন্য একজন সু-সাহিত্যিক হিসেবে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন এই জাহানারা ইমাম। তার রচনা করা ‘একাত্তরের দিনগুলি‘ মুক্তিযুদ্ধের একটি অন্যতম দলিল। তার রচিত অন্য সব গ্রন্থগুলো হলো ‘জীবন মৃত্যু, অন্য জীবন, বীরশ্রেষ্ঠ, চিরায়ত সাহিত্য, নাটকের অবসান, বুকের ভিতরে আগুন, দুই মেরু, নিঃসঙ্গ পাইন, নয় এ মধুর খেলা, ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস এবং প্রবাসের দিনলিপি উল্লেখ যোগ্য।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ১৯২৯ সালের আজকের দিনে (৩ মে) পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD