॥ স্বপন পাল ॥
এক
রুদ্ধ নজরুল!
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, ‘কারাগারে আমরা অনেকে যাই, কিন্তু সাহিত্যের মধ্যে সেই জেল জীবনের প্রভাব কমই দেখতে পাই, কিন্তু নজরুল যে জেলে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণ তাঁর লেখার মধ্যেই অনেক স্থানে পাওয়া যায়। এতে বোঝা যায় যে তিনি একটি জ্যান্ত মানুষ।’
হ্যাঁ, জীবনের একটা সময় পর্যন্ত নজরুল প্রচণ্ড রকমের জ্যান্ত মানুষ ছিলেন। এটা তাঁর লেখা পড়লেই যে কোনাে পাঠক সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন। এরপর তো ৩৪ বছর কাটিয়েছেন নির্বাক হয়ে। লেখালেখির জন্য আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনে জেল পর্যন্তও খাটতে হয়েছে। এর আগে যদিও বাংলা সাহিত্যে অনেকেই সরকারের রোষাণলে পড়েছেন, দণ্ডিতও হয়েছেন। এক্ষেত্রে মুকুন্দ দাসের নাম উল্লেখ করা যায়। তবে নজরুলের মতো আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেননি কেউ। নজরুলকে কারারুদ্ধ করা হলে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল সারা দেশ।
সবমিলিয়ে নজরুল পঁচিশ বছরের মতো লেখালেখি করতে পেরেছিলেন। যদিও জীবিত ছিলেন সাতাত্তর বছর। কিন্তু মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সেই থেমে গিয়েছিলেন, হয়ে গিয়েছিলেন নির্বাক, নিস্পন্দ। কিন্তু এই অল্প সময়েই বাংলা সাহিত্যে তো বটেই, বিশ্ব সাহিত্যেও একটা স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন তিনি।
কবিকে জেলে যেতে হয়েছিল তাঁর সম্পাদিত ‘ধুমকেতু’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা এবং ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ত’ প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য। প্রথমটি নিজের লেখা, অন্যটি এগারো বছর বয়সী এক বালিকার। তাঁর নাম লীলা মিত্র। নজরুলের খুব ঘনিষ্ঠজন অধ্যাপক সাতকড়ি মিত্রের ছোটাে বোন। লেখা দু’টি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরের নজরুল সম্পাদিত ‘ধুমকেতু’ পত্রিকায়। তখন নজরুলের বয়স মাত্র তেইশ বছর। রাজদ্রোহের অভিযোগে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪/এ ধারামতে কবিকে এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। পুলিশ তাঁকে ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করেছিল।
কবির বিরুদ্ধে কবি!
কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর এক বিখ্যাত কবিতায় লিখেছিলেন, “তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ, কবির বিরুদ্ধে কবি”। নজরুলের কারাদণ্ডের ব্যাপারে সত্যি সত্যিই কবির বিরুদ্ধে কবি দাঁড়িয়েছিলেন। কলকাতার তৎকালীন চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ‘সুইন হো’র আদালতে কবির বিচার হয়। বিচারক ‘সুইন হো’ও ছিলেন একজন কবি। জানা যায়, তাঁর নামে কলকাতায় একটি সড়কও আছে। বিচারক কবি রাজদ্রোহের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে বিদ্রোহী কবি নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন।
রাজবন্দির জবানবন্দি
আদালতে নজরুল যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তা ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ নামে বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। হয়ে উঠেছে ন্যায়ের পক্ষে চিরকালের অমৃত বাণী। নজরুল বলেছিলেন, ‘‘একজন রাজা, হাতে রাজদণ্ড, আরেকজন সত্য, হাতে ন্যায়দণ্ড…, রাজার পেছনে ক্ষুদ্র, আমার পেছনে রুদ্র। রাজার পক্ষে যিনি, তার লক্ষ্য স্বার্থ, আমার পক্ষে যিনি, তার লক্ষ্য সত্য, লাভ পরমানন্দ…, রাজার বাণী বুদ্বুদ, আমার বাণী সীমাহারা সমুদ্র”।
আজ কবির কথাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তাঁর বাণী সীমাহারা সমুদ্র হয়ে আছে-যার আলোড়নে আমরা আন্দোলিত হই প্রতি মুহূর্তে।
কবি যখন জানতে পারলেন তাঁর বিচারকও একজন কবি, হয়তো কিছুটা আশাবাদী হয়েছিলেন ন্যাবিচারে, কিন্তু সংশয়ও ছিল অনেক বেশি। তাইতো তিনি বলেছিলেন, ‘‘শুনেছি আমার বিচারক একজন কবি। শুনে আনন্দিত হয়েছি। বিদ্রোহী কবির বিচার বিচারক কবির নিকটে। কিন্তু বেলা শেষের শেষ খেয়া এ প্রবীণ বিচারককে হাতছানি দিচ্ছে, আর রক্ত-ঊষার, নব-শঙ্খ আমার অনাগত বিপুলতাকে অভ্যর্থনা করছে, তাকে ডাকছে মরণ, আমায় ডাকছে জীবন, তাই আমাদের উভয়ের অস্ত তারা আর উদয় তারার মিলন হবে কি না, বলতে পারি না।…।’’
শেষ পর্যন্ত কবির শংকাই সত্যে পরিণত হয়েছিল। তাঁকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেছিলেন বিচারক কবি।
বিচারাধীন থাকার সময় কবিকে প্রেসিডেন্সি জেলে রাখা হয়েছিল। দণ্ডিত হওয়ার পর তাঁকে প্রথমে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়।
‘ইয়েস আওয়ার গ্রেটেস্ট পয়েট নেক্সট টু ট্যাগোর’
রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। নজরুল যখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁর ‘বসন্ত’ নাটকটি নজরুলকে উৎসর্গ করে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমে তাঁর কাছে পাঠিয়েছিলেন। উৎসর্গপত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন. ‘শ্রীমান কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু’। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় এ ঘটনার এক অনুপম বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর স্মৃতিচারণমূলক লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘আমি প্যাকেট খুলে গুরুদেবের উৎসর্গপত্র দেখাতেই নজরুল লাফ দিয়ে পড়ল লোহার গারদগুলোর ওপর। বন্দির প্রবল উত্তেজনা লক্ষ্য করে ইউরোপীয় ওয়ার্ডার কারণ জানতে চাইলে আমি বললাম, ‘পোয়েট ট্যাগোর ওকে একখানা বই ডেডিকেট করেছেন।’ সাহেব আমার ইংরেজির ভুল ধরে বললেন, ‘ইউ মিন প্রেজেনটেড?’ আমি জোর দিয়ে বললাম, ‘নো, ডেডিকেটেড’। সাহেবের মুখ বিস্ময়াভিভূত— ‘ইউ মিন দি কনভিক্ট ইজ সাচ অ্যান ইম্পরট্যান্ট পারসন?’ আমি বললাম, ‘ইয়েস আওয়ার গ্রেটেস্ট পয়েট নেক্সট টু ট্যাগোর।’ বয়সে নজরুল ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ৩৮ বছরের ছোটাে। ১৯১৩ সালে বিশ্বকবি যখন নোবেল পুরস্কার পান তখন নজরুল মাত্র ১৪ বছরের কিশোর। ১৯২২ সালে বিশ্বকবি কারাবন্দি নজরুলকে যখন ‘বসন্ত’ নাটিকাটি উৎসর্গ করেন তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৩। আমাদের এ যুগেও কোনো প্রবীণ কবি ওই বয়সের একজন নবীন কবিকে তার বই উৎসর্গ করতেন কি না সন্দেহ। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের অসামান্য প্রতিভা স্বীকার করার ক্ষেত্রে সে ঔদার্য দেখান তার কোনো তুলনা নেই। বন্দি নজরুলকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বই উৎসর্গ করেছেন এ ঘটনা বিদ্রোহী কবিকে উদ্বেলিত করেছিল দারুণভাবে। এটি ছিল তার কাছে মহান কিছু অর্জন। তবে নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের বাৎসল্য প্রদর্শনের শুরু আরও আগে থেকেই। ১৯২২ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ধূমকেতু পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু’ সম্বোধন করে আট লাইনের একটি কবিতা লিখে পাঠান। কবিতাটি হলো, ‘আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।/অলক্ষণের তিলক রেখা/রাতের ভালে হোক না লেখা,/ জাগিয়ে দেরে চমক মেরে/আছে যারা অর্ধচেতন।’
কারাগারে নজরুলের অনশন
কিছুদিন পর নজরুলকে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে হুগলি জেলে নেওয়া হয়। হুগলি জেলে থাকাকালীন জেলের বিভিন্ন বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা ও নিপীড়নের প্রতিবাদে কবি অনশন শুরু করেন।
নজরুলের দাবি মেনে নেওয়ার জন্য সভা করলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ।
নজরুলের দাবি মেনে নেওয়ার জন্যে ১৯২৩ সালের ২১ মে কলকাতা কলেজ স্কোয়ারে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় হেমন্ত সরকার, অতুল সেন, মৃণালকান্তি বসু, কবি যতীন্দ্র লাল বাগচী প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সভা থেকে বলা হলো, ‘নজরুলকে বাঁচানো বাংলাদেশ ও সাহিত্যের পক্ষে প্রয়োজন। কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে হবে নজরুল যাতে অনশন ভঙ্গ করে।’
‘গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক, আওয়ার লিটারেচার ক্লেমস ইউ’
রবীন্দ্রনাথ তখন শিলঙে। সেখান থেকে শুনলেন নজরুল জেলখানায় বিভিন্ন দাবিতে অনশন করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ৷ তিনি ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হলেন অত্যন্ত স্নেহের নজরুলের জন্যে। সেখান থেকেই টেলিগ্রাম পাঠালেন জেলখানায় ‘গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক, আওয়ার লিটারেচার ক্লেমস ইউ (অনশন ত্যাগ কর। আমাদের সাহিত্য তোমায় দাবী করে।)’
নজরুলের অনশনের খবর সারাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। চিন্তিত হওয়ার পাশাপাশি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে মানুষ। নানা সভা-সমিতি ও পত্রপত্রিকায় এসব প্রকাশ হতে থাকে। ১৯২৩ সালের ১৬ মে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ বিশেষ সম্পাদকীয় লিখে এ বিষয়ে।
অবশেষে নজরুলের অনশন ভাঙালেন বিরজাসুন্দরী দেবী
অনশনে নজরুল দুর্বল হয়ে পড়েন। তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে যায় এবং শরীর দ্রুত খারাপ হতে থাকে। কিন্তু নজরুল তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। কারো অনুরোধ উপরোধে ভ্রুক্ষেপ করেন না তিনি। শেষে মাতৃসমা বিরজাসুন্দরী (প্রমীলা’র কাকীমা)-নজরুল যাকে ‘মা’ বলে ডাকতেন, তিনি ছুটে এলেন কুমিল্লা থেকে। ছেলের এমন অবস্থায় কোনও মা-ই স্থির থাকতে পারেন না।
ছেলে অভুক্ত থাকলে মায়ের মুখে খাবার রোচে কী করে? তাই নজরুলের অনশনের খবর শোনার পর থেকে তিনিও অনশন শুরু করেছিলেন। তেরোদিন অনশনের পর একজন ছেলেকে রাজী করিয়ে ছুটে এলেন হুগলি। জেলে সাক্ষাৎকারের অনুমতি পেতে দেরী হলো না। তাঁকে দেখে সবিস্ময়ে নজরুল বলে উঠলেন ‘এ কী! মা তুমি?’ দেখা হতেই অনশন ভাঙার আদেশ করলেন তিনি। কিন্তু নজরুল রাজী হলেন না। বিরজাসুন্দরী দেবী তখন বললেন, ‘তোমার জন্য আমি তেরো দিন উপোস করে আছি। সারাটা পথ নুনজল ছাড়া কিছুই খাইনি। অনাহারে আমি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছি যে, ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকার সামর্থ্যও আমার নেই। তুমি যদি মর, তার আগেই আমি মরব। আত্মঘাতী হবার আগে তুমি মাতৃহন্তা হবে।’ নজরুল আর অনড় থাকতে পারলেন না।
অবশেষে ১৯২৩ সালের ২২ মে বিরজাসুন্দরী দেবীর হাত থেকে এক গ্লাস লেবুর জল খেয়ে ঊনচল্লিশ দিনের অনশন ভাঙলেন নজরুল।
১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
এর আগের একবার নজরুলের ছয়মাসের কারাদন্ড হয়েছিল ‘প্রলয় শিখা’ কাব্যগ্রন্থ নিষিদ্ধ হওয়ার সময়। হাইকোর্ট থেকে জামিন পাওয়ায় সেইবার আর জেল খাটতে হয়নি কবিকে।
দুই
নিষিদ্ধ নজরুল!
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বাংলা সাহিত্য জগতে ঝড়ো হাওয়ার মতো উপস্থিত হয়েছিলেন নজরুল। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতবর্ষে তখন শুরু হয়েছে অসহযোগ আন্দোলন। এই সময়েই নজরুল এলেন বিদ্রোহের বাণী নিয়ে। ব্রিটিশ শাসক-শোসকের বিরুদ্ধে নজরুলের লেখা হয়ে উঠল ক্ষুরধার তরবারির মতো। তাই তাঁর কণ্ঠকে বারবার থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার। তাঁর পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছে, তাঁকে কারাগারে নিয়েছে, বাজেয়াপ্ত করেছে তাঁর লেখা। কিন্তু তবুও থামাতে পারেনি তাঁকে। অসুস্থ হবার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর মতো করেই ‘রণতূর্য’ চালিয়ে গিয়েছেন তিনি।
নজরুলের নিষিদ্ধ হওয়া বইসমূহ
১. যুগবাণী
কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম নিষিদ্ধ বই যুগবাণী। ১৯২২ সালে তৎকালীন সরকার ফৌজদারি বিধির ৯৯/এ ধারা অনুযায়ী বইটি বাজেয়াপ্ত করে। সেন্ট্রাল প্রভিন্স ও বার্মা সরকারও যুগপৎ গ্যাজেটের মাধ্যমে যুগবাণী নিষিদ্ধ করে। বাংলা সরকারের নিষিদ্ধ করার গ্যাজেট বিজ্ঞপ্তির তারিখ ও নম্বর যথাক্রমে ২২ নভেম্বর, ১৯২২ এবং ১৬৬৬১পি। নবযুগ পত্রিকায় লেখা নজরুলের কয়েকটি নিবন্ধের সংকলন হলো ‘যুগবাণী’।
২. বিষের বাঁশি ও ভাঙার গান
যুগবাণীর পর নজরুলের দুটি কাব্যগ্রন্থ নিষিদ্ধ হয়েছিল ১৯২৪ সালে- বিষের বাঁশি ও ভাঙার গান। এ দুটি বইও ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৯/এ ধারা অনুসারে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বইটি সম্পর্কে তৎকালীন নামী পত্রিকা ‘প্রবাসী’ লিখেছিল ‘কবিতাগুলি যেন আগ্নেয়গিরি, প্লাবন ও ঝড়ের প্রচন্ড রুদ্ররূপ ধরিয়া বিদ্রোহী কবির মর্মজ্বালা প্রকটিত করিয়াছে। জাতির এই দুর্দিনে মুমূর্ষু নিপীড়িত দেশবাসীকে মৃত্যুঞ্জয়ী নবীন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করিবে।’ বিষের বাঁশি বাজেয়াপ্ত আদেশ পরাধীনকালেই উঠে যায়। ১৯৪৫ সালে বাংলা সরকার বিজ্ঞপ্তির মধ্য দিয়ে ‘বিষের বাঁশি’র বাজেয়াপ্ত আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়। তবে ‘ভাঙার গান’র ক্ষেত্রে তা হয়নি।
৩. প্রলয় শিখা
‘প্রলয় শিখা’ বাজেয়াপ্ত হয় ১৯৩১ সালে। যদিও এ সংশ্লিষ্ট সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় ১৯৩০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। ভারতীয় ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১২৪/এ এবং ১৫৩/এ ধারা অনুযায়ী বইটি নিষিদ্ধ হয়েছিল। এটির বাজেয়াপ্ত আদেশ প্রত্যাহার হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পর, ১৯৪৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি। উল্লেখ্য. এই বইটি নিয়ে মামলায় চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট নজরুলকে ৬ মাসের কারাদন্ড প্রদান করেছিল। উচ্চ আদালতে আপিল করার জন্য এ সময় কবিকে আর কারাগারে যেতে হয়নি। তবে কবির মুক্তির ব্যাপারে গান্ধী-আরউইন চুক্তিরও একটা প্রভাব ছিল। ‘প্রলয় শিখা’ নজরুলের একটি কাব্যগ্রন্থ।
৪. চন্দ্রবিন্দু
‘প্রলয় শিখা’র পরপরই ১৯৩১ সালের ১৪ অক্টোবর বাজেয়াপ্ত করা হয় নজরুলের ‘চন্দ্রবিন্দু’ কাব্যগ্রন্থ। এটির বেশিরভাগ লেখা ছিল মূলত তৎকালীন সমাজ ও রাজনীতির অসংগতির প্রতি বিদ্রুপাত্মক। এই বইয়ের কবিতাগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি এটিও বলেছেন যে, ইংরেজের সাথে আপোষ করে হিন্দু-মুসলমানের মিলন কিংবা ভারতের স্বাধীনতা, কোনোটাই সম্ভব নয়। ‘চন্দ্রবিন্দু’র বাজেয়াপ্ত আদেশ ১৯৪৫ সালের ৩০ নভেম্বর প্রত্যারিত হয়।
অগ্নিবীণা, সঞ্চিতা, ফণীমনসা, সর্বহারা, রুদ্রমঙ্গল–এই পাঁচটি গ্রন্থ সুপারিশ সত্বেও নিষিদ্ধ হয়নি। উল্লেখ্য পাঁচটি গ্রন্থ ছাড়াও নজরুলের অসংখ্য লেখা ও বই ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়েছিল, কিন্তু সেগুলো নিষিদ্ধ হয়নি। যদিও নজরুল গবেষক ড. সুশীল কুমার গুপ্ত তাঁর ‘নজরুল চরিত মানস’ গ্রন্থে দাবি করেছেন, ‘অগ্নিবীণা’ বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। কিন্তু নজরুলের নিষিদ্ধ বই নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন, শিশির কর। তিনি এমন কোনো প্রমাণ খুঁজে পাননি। তবে অগ্নিবীণা নিষিদ্ধ না হলেও পুলিশ যখনই এ বই পেয়েছে, তখনই তা জব্দ করেছে। বংশীধর বন্দোপাধ্যায় নামে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী জানিয়েছেন, একবার তিনি ‘অগ্নিবীণা’ বই সাথে নিয়ে আসছিলেন। পুলিশ তখন তাঁকে ধরে থানায় নিয়ে যায় এবং বইটি কেড়ে রেখে দেয়।
নজরুলের নিষিদ্ধ বই নিয়ে আইনসভায় আলোচনা এবং তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকারের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া
নজরুলের বইগুলোর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য সভা-সমিতির পাশাপাশি বঙ্গীয় আইনসভাতেও এ ব্যাপারে জোর দাবি উঠেছিল। এ নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এর মতামতও জানা যায়।
আইনসভার কার্য বিবরণী থেকে জানা যায় যে ১৯৩০ সালের ১১ আগস্ট, বিষের বাঁশির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আবেদন জানান মৌলবী মো. ফজলুল্লাহ। এর কয়েক বছর পর, নজরুলের বইয়ের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জোর দাবি তোলেন হুমায়ুন কবির। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রাজনৈতিক বিভাগের ফাইলে দেখা যায় আইনসভার অধিবেশনের উত্থাপনের জন্য হুমায়ুন কবির নিম্নে উল্লেখিত কয়েকটি প্রশ্নের নোটিশ দেন।
ক) কাজী নজরুল ইসলামের বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, প্রলয় শিখা, চন্দ্রবিন্দু ও যুগবাণী বইগুলি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়েছে কি না স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মাননীয় মন্ত্রী অনুগ্রহ করে কি জানাবেন?
উত্তর : হ্যাঁ, বইগুলি দেশদ্রোহাত্মক বলে সরকার বিবেচনা করে।
খ) দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে সরকার কি ওই বাজেয়াপ্ত আদেশ প্রত্যাহারের কথা ভাবছেন?
উত্তর : না। কারণ শক্তিশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠী দেশে গণবিদ্রোহ ও সামাজিক বিপ্লব সংগঠনের ইচ্ছা এবং সাংবিধানিক উপায়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিকাশের পথ পরিহারের কথা ঘোষণা করেছেন।
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন বেঙ্গল কাউন্সিলে ১৯৩৯ সালের ১০ মার্চ হুমায়ুন কবিরকে জবাব দেন যে, নজরুলের বইগুলো থেকে বাজেয়াপ্ত আদেশ প্রত্যাহার করা হবে না। যদিও বেঙ্গল কাউন্সিলের প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেছিলেন হুমায়ুন কবির, কিন্তু প্রশ্নোত্তরের দিন তাঁর হয়ে প্রশ্নগুলো করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র দত্ত। নজরুলের বাজেয়াপ্ত বইগুলো সম্পর্কে তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হকের একটি নোট বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি তিনি একটি নোটে লিখেন, “Muslim’s complain and very naturally that worse books by ‘Hindu’ authors have in many places been released from proscription and they resent these orders in the case of Muslim authors.”
ওই বছরেরই ১৭ আগস্টের নোটে লিখা হয়, “এই বইগুলি এখনো আপত্তিকর বলে বিবেচনা করা হয় এবং বর্তমানের এই জরুরি অবস্থায় ওইসব বই থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে কিনা তা ভেবে দেখতে হবে।”
যদিও কবির জীবিত অবস্থায়ই তাঁর সবকটি বই থেকে বাজেয়াপ্ত আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছিল, কিন্তু কবি তা জানতে পারেননি। কারণ ১৯৪১ সালের পর থেকেই কবি ক্রমশ অসুস্থ হতে থাকেন এবং ১৯৪২ সালে এসে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর আর সম্বিত ফিরে পাননি তিনি। তাই তাঁর প্রিয় কাব্যগ্রন্থ ও নিবন্ধের বইটি থেকে বাজেয়াপ্ত আদেশ প্রত্যারিত হলেও তাঁর কোনো প্রতিক্রিয়া আর কখনোই আমরা জানতে পারিনি।
উল্লেখ্য যে, ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনে প্রদেশগুলোকে সীমিত স্বায়ত্তশাসন দিয়ে সংসদীয় ধারার শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। প্রদেশে গঠন করা হয় ব্যবস্থাপক সভা। এই আইনে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন হয় ১৯৩৭ সালে এবং ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ মিলে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার গঠন করে। প্রধানমন্ত্রী হন এ কে ফজলুল হক এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন।
সহায়ক গ্রন্থসমূহ
১. কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা- মুজফফর আহমদ
২. নিষিদ্ধ নজরুল- শিশির কর
৩. কাজী নজরুল ইসলাম ও আমার মামাবাড়ি- সুজাতা সেনগুপ্ত
৪. নজরুল-জীবনী- অরুণকুমার বসু
—
দেশের বই পোর্টালে লেখা পাঠাবার ঠিকানা : desherboi@gmail.com
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD