সুমন কুমারের ছোটোগল্প ‘তরি’
॥ সুমন কুমার ॥
সকাল সাতটা বাজে, আটটার মধ্যে ওপারে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে সময়মত কাজে যোগ দেয়া যাবে না। সাধারণত পদ্মায় এ রকম ঘন কুয়াশা পড়ে না ফ্রেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। ফেরি-লঞ্চ সবই অচল, কেউ বলতেও পারছে না কখন পারাপার শুরু হতে পারে। অথচ উথলি বাজারে ছিল মিষ্টি রোদ। কাটরাসিন মোড়ের ডানে দিগন্ত বিস্তৃত সুবর্ণ সর্ষে ক্ষেতে ঝকমক করছিল শিশির। সেখান থেকে পাটুরিয়া পর্যন্ত সাতকিলো রাস্তা। কুয়াশা ঘন হতে হতে এখানে দৃষ্টিসীমা পাঁচ মিটারে নামিয়ে এনেছে।
পার হওয়ার ভিন্ন উপায় আছে কি না এখানে-ওখানে খোঁজ নিতেই এক চায়ের দোকানি জানালেন, ‘ওই ঘাটে টলার আছে, যাত্রী হলি যাতিউ পারে।’
পার হওয়া জরুরি। বস একদিন আগে পৌঁছাতে বলেছিলেন। কিন্তু বাচ্চাদের নিঃসঙ্গ করে রওনা হয়নি তরী। ট্রলার পার করলেও সেটা ঝুঁকি হতে পারে, তবু উপায় নেই। চা-ওয়ালার নির্দেশিত দিকে পাওয়া গেল এক বৃদ্ধ ট্রলার চালককে। পঞ্চান্ন-ষাট বছর বয়স। মুখে কাঁচাপাকা দাঁড়ি। তরী তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘চাচা রওনা হবেন কখন?’
‘খালা রওনা হওয়ার টাইম নেই। যাত্রী হলিই যাবো।’
‘কয়জন হলে যাবেন?’
‘লোকের ঠিক নেই। আপনি একাও যাতি পারবেন, খরচ পড়বে দুই হাজার।’
‘ও।’ লোকটার ব্যবহার ভালো। তবে নদী এলাকার মানুষ, নদীর মধ্যে ভয়ংকর। কুমিরের মতো। তরীর পার হওয়া জরুরি, দুই হাজার খরচ হলেও যেতেই হবে। তবে জীবন বা অন্য কিছুর ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। সে ভাবতে থাকে।
‘খালা, আপনি বসেন। লোক হলি ভাড়া কুমে যাবে।’
ভিআইপি কোনাে কর্মকর্তা এলে ছোটো ফেরি ছাড়তেও পারে সেই সম্ভাবনায় তরী আবার খোঁজ নিতে যায়। সেখানে একজন এডিশনাল এসপির গাড়িও অপেক্ষমান। কুয়াশা কমে না এলে পার হওয়া অসম্ভব। আর কোনাে সম্ভাবনা নেই, ফলে আবার সেই ট্রলারঘাটের দিকে যাত্রা।
ট্রলারওয়ালা এগিয়ে আসে, ‘খালা যাওয়ার তাড়া থাকলি আসেন। দুইজন ভদ্রলোক পাইছি। এখন পড়বে আটশো।’
পারের উপায় হয়েছে ভাবতেই ঝলমল করে তরীর মুখ। ট্রলারওয়ালা তাকে ডেকে ঘাটের দিকে হাঁটা শুরু করে। রওনা দিতে গিয়ে তরীর ঝলমলে মুখ হঠাৎ কালো হয়ে যায়। সে ভাবে এই সকালে কারা পার হবে ট্রলারে। হতেও পারে তারা এই লোকটির সহচর। ভদ্রলোক সেজে বসে আছে। ঘন কুয়াশায় অন্ধ নদীর মাঝে গিয়ে তারাই চড়াও হবে।
‘খালা, কী হলো? আসেন। যাবেন না?’ ট্রলারওয়ালা পেছনে ফিরে আসে।
‘উ, হু, যাব।’
‘তাগের অত তাড়া নেই। আরও দুই চাইরজন খুঁজতি কয়চে। আপনার তাড়া আছে আমি বুজিচি, আপনি উঠলিই ছাড়বো।’
মাঝির আগ্রহ তরীকে ভাবিয়ে তোলে। প্রয়োজনে বসকে ফোনে সমস্যা খুলে বলা যেতে পারে, কিন্তু এই ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। গতকালও নদীতে কুয়াশার কোনাে খবর ছিল না। বস নিশ্চয়ই বুঝবেন।
‘খালা, ভয় নেই। এইডে সিরিয়ালের টলার।’
তরী মনে মনে হাসে, জীবন না থাকলে সিরিয়ালের ট্রলার হলেই লাভ কী! হরহামেশাই খবর আসে-নদীতে ডাকাতি হয়েছে। ওসবের সাথে কী আর মাঝিদের যোগসাজস থাকে না! বরং ফেরিঘাটে অপেক্ষা করাই শ্রেয়-মনে করে সে। এডিশনাল এসপি তো পার হবেনই, ‘চাচা যান, আমারও তাড়া নাই।’
ট্রলারওয়ালা নিরাশ হয়ে সারিবদ্ধ অপেক্ষমান বাসের দিকে চলে যায় যাত্রী খুঁজতে। তরী পাশের চায়ের টংয়ে গিয়ে বসে। নারী বলেই সে এই ট্রলারে যেতে পারল না। পুরুষ হলে পার হয়ে যেত। জীবনের ভয়ে মানুষ ভীত নয়, ভয় পায় সম্মানহানি। তরী এখন সেই ভয়ে ভীত। চিন্তিত অন্য কারণেও। বস আগের দিন চলে আসতে বলেছিলেন, এখন দেরি হলে তিনি সহজে ছাড়বেন না। দুই একজন নারী যাত্রী থাকলেও পার হওয়া যেত।
মিনিট দশেক পর মাঝিকে নদীর দিকে যেতে দেখা যায়। নারী যাত্রী আছে কি না বোঝার চেষ্টা করে তরী। নারী নেই, একজন পুরুষ মাঝির সামনে সামনে হাঁটছে। তার বাম হাতে সিগারেট। তরী মাঝিকে ডাকে, ‘ও মামা, শুনুন। আর যাত্রী পেলেন?’
‘হ একজন, ওই যে যাচ্চে।’
‘আমি যাব।’
‘যাবেন? চলেন। সাতশ পড়বে এখন।’
তরী ব্যাগ হাতে ঘাটের দিকে হাঁটা শুরু করে।
ট্রলারে উঠে বাম হাতে সিগারেট টানা লোকের চোখে চোখ পড়ে। লোকটা চোখ ঘুরিয়ে নেয়। ট্রলারের মাঝামাঝি দুজন বসে আছে পূর্ব থেকেই। একজনের কোঁকড়া চুল, অন্যজনের ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ি। তারা একযোগে তাকায় তরীর দিকে, দুজনের কপালই কুঁচকে যায়। তরী চোখ ফিরিয়ে নেয়। নৌকার গলুইয়ের কাছে বসে। সশব্দে চালু হয় পিছনের স্যালো ইঞ্জিন। ট্রলার তরতরিয়ে এগিয়ে চলে গভীর গাঙের দিকে। মাঝি ছাড়া নৌকায় আর সকলের বয়স চল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশের মধ্যে।
পিছনের দুজন ফিসফাস কথা বলছেন। সামনে বাম হাতে সিগারেটওয়ালা চুপচাপ বসে একের পর এক সিগারেট টানছেন। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিই টানছেন।
তরী সামনের তাকিয়ে বসে আছে। কুয়াশা ভেদ করে ট্রলার চলছে খুব ধীরে। সম্মুখে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মাঝি কীভাবে চালাচ্ছেন কেবল তিনিই জানেন। মাঝে মাঝেই অতি ঘন কুয়াশার মেঘের মধ্যে গিয়ে পড়ছে নৌকাটা। তখন গতি আরও কমাচ্ছেন মাঝি।
পিছনের ফ্রেঞ্চকাট বাম হাতে সিগারেটওয়ালার কাছে এসে আগুন চায়। সে লাইটার এগিয়ে দেয়। ফ্রেঞ্চকাট বলে, ‘ঢাকা থেকে আরিচার মোড় পর্যন্ত কোনাে কুয়াশা দেখলাম না।’
‘হুম, বিগত চার বছর ধরে রেগুলার যাতায়াত করি। আজকেই এমন অনাকাঙ্খিত কুয়াশার মুখোমুখি হলাম।’ জবাব দেয় বাম হাতে সিগারেট।
‘প্রতিদিন সপ্তাহে যাতায়াত করেন?’
‘হ্যাঁ, শীত আর বর্ষা ছাড়া সপ্তাহে এক দুইবার যাওয়া হয়।’
‘বসুন না, উনি আপনার পরিচিত?’ কোঁকড়া চুলকে চোখের ইশারায় দেখায় বাম হাতে সিগারেট।
‘না, টলারেই দেখা। এখনও ঠিকমত পরিচয়ই হয়নি।’
‘ওনাকেও ডাকুন না, গল্প করি।’
তাকে ডাকে ফ্রেঞ্চকাট, তিনজন একসাথে বসে গল্প করে। ট্রলারের সামনের দিকে একজন বসে আছে, সে দিকে তাদের কোনাে আগ্রহ নেই। তিনজন বেশি কাছাকাছি হয়ে গেছে, তরী পিছনে মাঝির নিকট চলে যায়। ইতোমধ্যে দশ মিনিট চলে গেছে। তরী চাদর আঁটসাঁট করে জড়িয়ে বসে, ‘মামা, শীত নেই, কিন্তু এত কুয়াশা!’
‘খালা নদীতি এইরম হয়। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে কুয়াশা পড়ে একদিন।’
‘ওপারে যেতে কতক্ষণ লাগে?’
‘এমনিতে আধাঘণ্টা লাগে। এখন ঘণ্টাখানিক লাগবি।’
‘আর একটু জোরে যাওয়া যায় না?’
মাঝি হাসেন, ‘খালা ওইপারে নিয়মিত যাতায়াত করেন না, তাই না?’
‘হ্যাঁ, কেন?’
‘আপনারে দেকেই বুজিছিলাম। যারা নিয়মিত অফিস করে তারা জানে। একন শীতকাল, গাঙে পানি কম। আমরা যেকেন দিয়ে যাচ্চি তার দুই পাশে বালুচর। একটু ভুল হলিই নৌকা চরে উটে যাবে। আর জোরে চালালি বালুর এত উপরে ওটপে যে অন্য নৌকা, নয় লঞ্চ না আলি উদ্ধার পাওয়া যাবে না। তার মানে কুয়াশা কাটা লাগবে।’
‘ও, তাহলে আস্তে যান। আচ্ছা দুইপাশে বালুর চর বললেন, আমি তো কিছুই দেখি না।’
মাঝি হাসে, ‘খালা, এইডে অভ্যাস। পদ্মা তো আমাগের হাতের তালুর মতোন।’
‘আপনাদের ভুল হয় না?
‘যেই কাজে ঠিক আচে, ওই কাজে ভুলও আচে। নৌকার মাথা ইট্টু বেঁকে গিলিই চলে যাতি পারি রাজবাড়ি। পাবনার সুজানগর, ফরিদপুরির চরভদ্রাসন বা ঢাকার দোহারের দিকিউ চলে যাতি পারে নৌকা। তা আজ পর্যন্ত আমার এইরম ঘটনা ঘটিনি।’
‘আপনি কত দিন টলার চালান?’
‘আমার আব্বা ছিল মাঝি, ধরেন সাঁতার শেকার আগেই নদীর সাথে পরিচয়। তখন পদ্মা ছিল বিশাল গাঙ। ওই ডানপাশে আরিচা, আমরা তো এখন যাবো দৌলতদিয়া, তখন ঘাট ছিল গোয়ালন্দ। ফেরিতি গিলি তিন ঘণ্টা লাইগতো।’
‘গোয়ালন্দ ছিল ঘাট!’
‘হ, দৌলতদিয়া তখন চর।’
সামনের ফ্রেঞ্চকাট চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘চাচা আর কতক্ষণ লাগবে।’
‘ধরেন আর কুড়ি মিনিট।’
সামনের তিনজন আবার গল্পে মনােযোগ দেয়। কোঁকড়া চুলের লোকটি বলে, ‘এত গল্প হলাে এখনও কেউ কারো নাম জানি না।’
বাম হাতে সিগারেটওয়ালা অন্য দুজনের দিকে হাত বাড়িয়ে নাম বলেন, ‘আমি শাহেদ জামান শান্ত।’
কোঁকড়া চুল বলে, ‘সাজেদুর রহমান সুপ্রিয়।’
‘আমি মনোতোষ সরকার মুন্না, শুধু মুন্না বলতে পারেন।’ বোঝা যায় নাম ছাড়া সবার পেশাগত পরিচয় ইত্যাদি আগেই আলাপ হয়ে গেছে।
তরী ফোন করে বাসায়। নেটওয়ার্ক নেই বললেই চলে। কথা ভেঙে যাচ্ছে। ছেলেমেয়েদের জরুরি নির্দেশনা দিয়ে কেটে দেয়।
মুন্না চিৎকার করে, ‘চাচা, একঘণ্টা বিশ মিনিট হয়ে গেল। আর কতক্ষণ লাগবে?’
‘কতক্ষণ হয়চে?’ মাঝি জিজ্ঞাসা করে।
তরী নীচু স্বরে বলে, ‘একঘণ্টা কুড়ি মিনিট।’
মাঝিকে চিন্তিত দেখায়, সে ট্রলারের স্টার্ট বন্ধ করে।
‘মামা, স্টার্ট বন্ধ করলেন যে?’ তরী জিজ্ঞাসা করে।
‘খালা মেশিনি ইট্টু সমস্যা হয়চে। চিন্তার কিচু নেই, তেলের লাইন ঢিলা হয়ে গেচে। আমরা ঘাটের কাচেই আচি।’ মাঝি ইঞ্জিন নাড়াচাড়া করে একটু তারপর বড়ো লগিটা নিয়ে নদীর পানি মাপে।
সুপ্রিয় বলে, ‘মামা কী হইছে, কোনাে সমস্যা? নৌকা থামাইলেন কেন?’
‘না না, সমস্যা না, ঘাটের ঠিক সামনেই বালুর চর আচে তো। এই পথটুক বুজে শুনে যাতি হবে। আমি একা তো, হাল ধরার কেউ নেই তাই বন্ধ করে দিচি।’ মাঝি আবার মেশিন স্টার্ট দিয়ে বাম দিকে ট্রলারের মাথা ঘুরায়। নৌকা আরো কুড়ি মিনিট চলে।
গল্প থেকে মাঝির দিকে তাকায় শান্ত, ‘চাচা, কী ব্যাপার, বললেন ঘাটের সামনে, আরও বিশ মিনিট চলে গেল। কী সমস্যা?’
‘একটা চরের অন্য পারে চলে গিচলাম তো, এই তো এখনই পৌঁছায়ে যাব।’
তরীকে উদ্গ্রীব দেখায়। পৌনে নয়টা বাজে, মিনিট দশেকের মধ্যে ওপারে যেতে পারলেও অফিস ম্যানেজ করা যেত, ‘মামা, আমার তাড়া আছে বলেই টলারে উঠলাম।’
‘খালা, কুয়াশার সুমায়, এত তাড়াহুড়ো করে তো নৌকা চলবে না।’
শান্ত-মুন্না-সুপ্রিয়দের গল্পও থেমে গেছে, তারাও চিন্তিত। আশেপাশে দেখছে, সামনে ঘাটের খোঁজ করছে তাদের চোখ। কিন্তু দৃষ্টিসীমা বড়োজোর পাঁচ মিটার, কোথাও কিছু দেখা যাচ্ছে না।
মাঝি নৌকা ইউটার্ন নেয়। ক্ষেপে ওঠে শান্ত, ‘চাচা আবার ইউটার্ন নিলেন যে।’
‘আপনি এত চিল্লান ক্যা? আমারে নিজির মতো চালাতি দেন।’
‘চিল্লাই মানে? পয়সা খরচ করে টলারে উঠছি তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর জন্য।’
সুপ্রিয় তাকে থামায়, ফিসফিস করে কিছু বলে। তাদের আরো চিন্তিত দেখায়। তরী ঘড়ি দেখে, সোয়া নয়টা বাজে। মুন্না অধৈর্য হয়ে ওঠে, ‘চাচা, সমস্যাটা কী?’
‘কোনাে সমস্যা নেই তো। কুয়াশার সময়, ঘাট ছাইড়ে অন্য জাগায় গিযে পড়িছিলাম। এখন ঠিক দিকি যাচ্চি।’
সুপ্রিয় বলে, ‘মানে? পথ হারায়া ফেলছেন?’
‘না পথ হারাবো ক্যা? এখনি পৌঁছায়ে যাব।’
তরী বুঝতে পারে সঠিক সময়ে পৌঁছানো অসম্ভব। এখনি বসকে ফোন করা উচিত। ফোন বের করে কল দেয়, কল ঢোকে না। চোখের সামনে যন্ত্রটা ধরে অবাক হয় সে। দুইটি সিমের কোনােটাতেই নেটওয়ার্ক নেই।
‘খালা মনে হচ্চে ফোন দিয়ে কোনাে লাব হবে না।’
‘মানে?’
‘এমন জাগায় আইসে পড়িচি যেকেনে নেট থাকে না।’
‘বলেন কী? কতবার এই নদী পার হয়েছি, ফেরিতে কথা বলতে বলতে গেছি। ঠিক করে বলেন তো, আমরা সঠিক পথে আছি?’
মাঝি কোনাে কথা বলে না, আরও দশ মিনিট এদিক-ওদিক চালিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়। সবাই মাঝির দিকে তাকায়, প্রত্যেকের চোখে আতংক। মাঝি বালতিতে নদীর জল তোলে, অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে বালতির জলের দিকে।
এবার ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায় সুপ্রিয়র, ‘মামা কী শুরু করছেন আপনি। উদ্দেশ্য কী আপনার। শোনেন আমাদের সাথে সুবিধা করতে পারবেন না। দশ মিনিটের মধ্যে ঘাটে পৌঁছে দেবেন। নইলে অসুবিধায় পড়বেন।’
‘আপনারা থামেন। পৌঁছায়ে দিউয়ার জন্যিই উঠাইচি, পৌঁছায়ে দেবো।
‘ধারে পাশে সঙ্গী সাথীরা আছে তাই না? পিটায়া নদীতে ফালায়া দিমু বদমাস কোথাকার।’ শান্ত রাগত স্বরে বলে।
‘চিল্লাফাল্লা কইরেন না, বিপদ হবে।’
‘সাহস কত বড়ো।’ শান্ত ছুটে গিয়ে মাঝির সোয়েটার চেপে ধরে, ‘তোর মতো একটা দুইটা ডাকাত হাত-পা বাইন্দা নদীতে ফালায়া যামু, খোঁজও পাওয়া যাবে না।’
ডাকাত শব্দটা শুনেই তরী ভয়ে পিছিয়ে যায়। মাঝিও ক্ষেপে ওঠে, ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় শান্তকে, ‘সরেন একেন তে, খরবদার চিল্লাফাল্লা করবেন না।’
মুন্না এসে দাঁড়ায় শান্ত আর মাঝির মাঝখানে, ‘দেখেন রেগুলার যাতায়াত করি এভাবে, বেশি কিছু পাবেন না, উলটো পরে বিপদে পড়বেন। নৌকায় ওঠার আগেই আপনার ছবি তুলে এক পুলিশ বন্ধুকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। এতক্ষণ যা করেছেন মেনে নিলাম, ওপারে পৌঁছে দিন, কাউকে কিছু বলব না আমরা।’
মাঝি রেগে আছে, ইঞ্জিনের তলা থেকে মাঝারি সাইজের রামদা বের করে। মুন্না, শান্ত এবং সুপ্রিয় তিনজনই পিছিয়ে যায়। তরী প্রায় দৌড়ে মাঝির সামনে এসে দাঁড়ায়, ‘মামা আমি আপনার মেয়ের মতো, ওদের কিছু বলবেন না। আমাদের কাছে যা আছে দিয়ে দিচ্ছি।’ নিজের ব্যাগে থাকা কয়েক হাজার টাকা আর মোবাইল এগিয়ে দেয়।
মাঝি এদিক-ওদিক দেখে, হয়তো তাঁর সঙ্গী-সাথীদের খুঁজছে। অন্য রকম ভীতি দেখা দেয় তরীর মনে। টাকা আর মোবাইল ধরা হাতটি আরও কিছুটা বাড়িয়ে ধরে। মাঝির সেদিকে খেয়াল নেই। সে নদীতে কিছু খুঁজছে। তরী তিনজনের দিকে কাতর দৃষ্টিতে তাকায়।
মুন্না বলে, ‘অসম্ভব।’
তরী অন্যদিকে তাকায়, কয়েকটা জলপায়রা নৌকার খুব কাছ দিয়ে সাঁতার কাটছে, উড়ে মাঝে মাঝেই কুয়াশায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। চাদর আরও আঁটসাঁট করে গায়ে জড়ায় তরী, শীতে নয়। শরীর ঘামছে, কিন্তু নারী হিসেবে তার ভয় অন্যত্র। কাউকে সরাসরি উদ্দেশ না করে বলে, ‘এখানে মারা গেলে লোকটা ধরা পড়বে কিন্তু বন্ধুকে পাঠানো ছবিটা জীবন ফেরত দিতে পারবে না। আর আমি মেয়ে মানুষ…।’
শান্ত চিৎকার করে, ‘রামদা হাতে একটা লোক দেখে ভয় পাবার মানুষ আমি নই। আপনারা ভয় পাবেন না। প্রয়োজনে এইটারে মাইরা নদীতে ফালায়া যামু।’
মাঝি রামদা হাতে কাছে এগিয়ে আসে, তরী তাকে আটকানোর চেষ্টা করে। মাঝি নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ থাকতে ইশারা করে। একটু নীচু স্বরে পুরুষ তিনজনের উদ্দেশে বলে, ‘আপনারা কী শুরু করিচেন, চুপ করেন। এখনও বুঝতি পারতিছেন না কি হয়চে?’
কেউ কোনাে কথা বলে না, তরী টাকা-মোবাইল এগিয়ে ধরে। মুন্নাও মানিব্যাগে হাত দেয়। রাগে ফোঁসে শান্ত।
‘আরে টাকা বের করতিচেন ক্যান? আপনারা আমারই ডাকাইত ভাবতিচেন? আমরা হারায়ে গিচি। নদীর ঠিক কোন জাগায় আচি বুঝতি পারতিচিনে।’
তিনজন পুরুষ প্রায় সমস্বরে চিৎকার করে, ‘কী, হারিয়ে গেছি?’
ঠোঁটে আঙুলের ইশারায় চুপ করতে বলে মাঝি। খাড়া কানে কিছু শোনার চেষ্টা করে।
‘হারায়া গেছি এতক্ষণ বলেন নাই ক্যান? হাতে রামদা ওঠাইছেন ক্যান?’ নীচু রাগত স্বরে জিজ্ঞাসা করে শান্ত।
মাঝি কাছে এগিয়ে আসে, ‘কথা কইয়েন না, আমাগের পিছন দিয়ে এট্টা টলার আসতিচে, ওইডে ডাকাতগেরও হতি পারে। এই জন্যি রামদা তুলিচি। শব্দ শুনলি উরা এই দিকিই আসপে।’
‘আমি তো কিছু শুনছি না।’ সুপ্রিয় বলে।
‘আপনেরা অন্য কিছু ভাবতিছিলেন, তাই শুনতি পাচ্চেন না, ভালো করে শোনেন।’
তরী পিছনে তাকিয়ে থাকে, যেন ধ্যান করছে, ‘হ্যাঁ, খুব ক্ষীণ শব্দ।’
‘খালা ওইডে হাফকিলো দূরিও না। যদি সত্যিই ডাকাতগের টলার হয় তালি শব্দ শুনতি পালিই চলে আসপে।’
‘যদি ডাকাতের নৌকা না হয়?’ মুন্না বলে।
‘না হলি তো বাঁচলাম। কুয়াশার সুমায় উরা এইরম হারায়ে যাওয়া টলার খোঁজে। চুপ করে থাকেন। তালি ওরা কাচে দিয়ে চলে গিলিউ বুঝতি পারবে না। আর যদি কাছে আসেই পড়ে তালি আর কী! আল্লা আল্লা করেন।’
ট্রলারের শব্দ ক্রমাগত কাছে আসে। মাঝি বিভিন্ন সাইজের লাঠি বের করে ইঞ্জিনের নীচ থেকে। রামদা শান্তর হাতে দেয়। অন্যদের দেয় লাঠি। সবাইকে ইশারায় কাছে ডাকে, ফিসফিসিয়ে বলে, ‘ওরা খুব কাছে আইসে গিলি টলারে স্টার্ট দেব। আপনি লম্বা চওড়া আছেন, উরা জানি টলারে উঠতি না পারে সেইডে আপনি দেকপেন। গলায় কোপ দেবেন দরকার হলি। আপনারাও লাঠি চালাবেন। আল্লা ভরসা, চরায় না ঠেকলি উরা আমগের ধত্তি পারবে না। খালা আপনিও এট্টা লাঠি নেন। অবশ্য ওগের কাছে বন্দুক থাকে। ঘাড়ের উপর আইসে পড়লি লাঠি-রামদা দিয়ে বেশিক্ষণ ঠেকানো যাবে না। তয় ধরা পড়ার ভয় না থাকলি উরাও গুলি করে না।’
একটা এন্টিকাটার বের করে তরী। সবাই বাগিয়ে ধরে যার যার অস্ত্র। শব্দটা ক্রমাগত নিকটবর্তী হয়। মাঝি হ্যান্ডেল নিয়ে মেশিনের কাছে দাঁড়ায়। সবার দম বন্ধ, কান খাড়া।
দূরের ট্রলার থেকে কথা শোনা যায়, ‘ডান দিকে পানি কম। বালু চরা থাকতে পারে।’ তরী শিউরে ওঠে, ডাকাতদের নৌকা এত কাছে! তবু কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছে না।
শব্দটা এখন দূরে সরে যাচ্ছে। একসময় একেবারেই মিলিয়ে যায়। মাঝি ট্যাঁক থেকে বিড়ি নিয়ে ধরায়, ‘এখন লাঠিসোটা নৌকার খোলে রাখেন। ওরা চলে গেচে।’
‘ওটা ডাকাতদের নৌকা ছিল?’ তরী জিজ্ঞাসা করে।
‘আল্লা জানে। হতিউ পারে, নাও পারে।’
শান্ত সিগারেট ধরায়, প্যাকেট বাড়িয়ে দেয় অন্যদের দিকে।
‘খালি পেটে আসলে সিগারেট খাই না, আপনার টানা দেখে তখন ধরিয়েছিলাম।’ মুন্না বলে।
‘চাচা, নৌকায় পানি আছে? দশটা পার হয়ে গেছে, ক্ষুধা পেয়েছে।’ জানতে চায় সুপ্রিয়।
‘নৌকার খোলে সিলভারের ঘড়া আছে দেখেন।’
ছয়টা রুটি আছে ব্যাগে-মনে পড়ে তরীর। আলুভাজি-ডিমভাজিও আছে। একজন সহকর্মী আলুভাজি আর আটার রুটি পছন্দ করে, তাই বেশি করে বক্সে ভরেছিল। তাছাড়া ব্যাগে বিস্কুটের প্যাকেটও আছে। আলুভাজি আর ডিমভাজির টুকরো দিয়ে রুটির রোল তৈরি করে। ফেসিয়াল টিস্যুতে জড়িয়ে প্রথমে দেয় মাঝিকে। সে হাত বাড়িয়ে নেয়। লোকটা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে শুধু, কিছু একটা ভাবছে। অন্যদের হাতেও রুটির রোল ধরিয়ে দেয় তরী।
কেউ কথা বলে না, খায়ও না।
মাঝি কয়েক গ্রাসে শেষ করে রোলটা, ‘মাথা ঠাণ্ডা হবে পেটে কিচু পড়লি, তখন এট্টা উপায় করা যাবে।’
সুপ্রিয় খাওয়া শুরু করে। মুন্না রোল খুলে আলু আর ডিমভাজির নাড়াচাড়া করে, মুখে দেয় একটা দুইটা আলুর টুকরো। শান্ত হাতে নিয়েই বসে থাকে, অন্যমনষ্ক। সুপ্রিয় তাগাদা দেয়, ‘শান্তভাই খান, আলুভাজিটা খুব ভালো হয়েছে।’
‘উম্, হুম খাবো। জি, আলুভাজিটা ভালোই হয়।’ শান্তর চোখ জলজল করে।
তরী মাথা নীচু করে খাচ্ছে, ‘আমি একটার বেশি রুটি সকালে খেতে পারি না, আর একটা বাড়তি আছে, যদি কারো লাগে…।’
মুন্না খাওয়ার সমান পরিমান নদীতে ফেলে। রুটি, আলুভাজি ডিমের টুকরো-সবই। সেটা দেখে আচমকা ক্ষেপে ওঠে শান্ত, ‘আপনার অপছন্দ হলে খাওয়ার দরকার নেই। ফেলছেন কেন?’
‘আরে আপনি ক্ষেপে যাচ্ছেন কেন? খাব নাকি ফেলে দেব সেটা আমি বুঝব।’
‘না, এভাবে ফেলে দিতে পারেন না। প্রয়োজনে ফেরত দিন।’
‘অদ্ভুত তো, আপনার রুটি আপনি খান। মন চাইলে আমি সবটাই ফেলে দেব।’
‘আর একটা টুকরো ফেললে ভালো হবে না বলছি।’ বলতে বলতে চোখ মোছে শান্ত।
সুপ্রিয় এগিয়ে আসে, ‘শান্ত ভাই খাবার নষ্ট করা ঠিক না, কিন্তু এভাবে কথা বলাও আপনার ঠিক হচ্ছে না। শান্ত হোন, খেয়ে নিন। কী হয়েছে আপনার? বেশ শক্ত মানুষ মনে হচ্ছিল, হঠাৎ এভাবে…!’
তরী তিনজনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সুপ্রিয় শান্তর পাশে গিয়ে বসে। মুন্না আগের মতোই আলুভাজি আর রুটির টুকরো নদীর জলে ফেলছে আর খাচ্ছে।
‘একটা মানুষ আলুভাজি আর রুটি পছন্দ করতো। পাশে বসে খেতে চাইতো। এটা বিশেষ কোনাে চাওয়া ছিল না তার। আমি স্বেচ্ছাকৃতভাবে জেলি দিয়ে ব্রেড খেতাম কিংবা বাইরে গিয়ে নাস্তা করতাম। সেই হাতের আলুভাজি খেতে খুব ইচ্ছে করে, তবে সে উপায় আর নেই। হঠাৎ মনে পড়ে গেল। সরি মুন্না ভাই। আপনার রুটি আপনি যা ইচ্ছে করুন।’ শান্ত রুটির রোলে কামড় বসায়। তার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা নামে।
তরী জলের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা জলপায়রা এসে বসে নৌকার গলুইতে, জোড়ার অন্যটা নৌকার চারপাশে ঘুরে ঘুরে উড়ছে। মুন্না পাখিটার দিকে আলুভাজি আর রুটির টুকরো ছুড়ে দেয়। পাখিটা তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকে। ওর উড়ন্ত সাথীও নেমে আসে, দুটিতে একসাথে খায়।
মাঝি বলে, ‘এখন কী করবো?’
জবাব দেয় সুপ্রিয়, ‘কী করবেন তার আমরা কী জানি।’
‘আমি মুখ্য সুখ্যু মানুষ, কোনাে বুদ্ধি তো খুঁইজে পাচ্চিনে। কুয়াশা কাটে রোইদ বেরোনো ছাড়া উপায় দেকতিচিনে। কিন্তু আপনাগের তো দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
‘আর দেরি! এখন পার হইলেও জায়গায় পৌঁছাতে একটা, এগারোটা বাজে অলরেডি।’
‘মামা, কোন জাগায় যে আচি সেইডেই বুঝতি পারতিচিনে। না জাইনে যেদিক যাবো সেইডেই ভুল হবে। তেল যা আছে তাতে ঘণ্টাদেড়েক চলবে। তখনও যদি কূল না পাই?’
‘আপনার তেল থাকবে কী ফুরাবে আমরা তার কী জানি? আপনি ঘাটে পৌঁছে দিবেন টাকা নিবেন।’ মুন্না জবাব দেয়।
‘মামা, এইডে পদ্মা নদী, একেনে পদে পদে বিপদ। চরায় আটকায় যাতি পারি, ডাকাতির কবলে পড়তি পারি। আবার সুজানগর, আরিচা, পাংশা, চরভদ্রাস নয় দোহার গিয়েও পড়তি পারি, ভাইগ্য ভালো হলি পাটুরিয়া বা দৌলতদিয়া। অপেক্ষা করা ছাড়া কোনাে উপায় দেখতিছিনে।’
‘আমরা কি সারাদিন নদীতে থাকবো? কোন একদিক চলতে থাকেন, কূলে তো উঠবই। অফিস না হয় বাদ দিলাম, নদীতে ডাকাতের কবলে পড়লে তো বিপদ।’ তাগাদা দেয় সুপ্রিয়।
‘অবুঝের মতো কথা বললে তো হবে না। ওনার তেল আছে দেড় ঘণ্টার, মাঝ নদীতে ঘুরতে ঘুরতে যদি তেল ফুরিয়ে যায়।’ অনেকক্ষণ পর কথা বলে তরী।
‘আচ্ছা মামা, ম্যাপে যদি দেখাই ঠিক কোথায় আছি আপনি যেতে পারবেন?’ মুন্না বলে।
‘একশোবার।’ মাঝিকে উৎফুল্ল দেখায়।
মুন্না মোবাইল ডেটা চালু করে। কিন্তু নেটে ঢুকতে পারে না। পরে খেয়াল করে নেটওয়ার্ক নেই, ‘আমার অফলাইন ম্যাপ নেই। মোবাইলে নেটও পাচ্ছে না, আপনারা একটু চেষ্টা করবেন?’
সুপ্রিয় চেষ্টা করতে থাকে। শান্ত তখনও মাঝে মাঝে চোখ মুছছেন। তরীর মনে পড়ে বসকে ফোন করা হয়নি। সেও ফোন বের করে। নেটওয়ার্ক নেই।
সুপ্রিয় বলে, ‘শান্ত ভাই আমারও নেটওয়ার্ক নেই, আপনি একটু দেখুন না।’
শান্তর রুটি খাওয়া শেষ। তার মোবাইলেও নেট নাই, কারো অফলাইন ম্যাপও নাই।
সুপ্রিয় বলে, ‘মামা ম্যাপ তো নেই। আপনি নদীর মানুষ দেখেন কী করা যায়।’
মুন্না শান্তর পাশে গিয়ে বসে, ‘একটা সিগারেট দেবেন?’
শান্ত প্যাকেট বের করে। তরী বাকি রুটিটা মাঝির দিকে এগিয়ে দেয়। মুন্না সিগারেট ধরায়। আয়েশ করে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে, ধোঁয়া মিশে যায় কুয়াশায়, ‘আশ্চর্য, সাড়ে এগারোটা বাজে অথচ কুয়াশা কাটার নাম নেই। আজ বিশেষ কোনাে কারণেই কুয়াশা কাটছে না। জানেন একজন নারীর সাথে সব ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম, এমনকি রুটি আলুভাজিও। কোনাে বিপদ থেকে উদ্ধার হলেই তাকে মনে পড়ে। আজ তাকে মনে পড়ল আমারও। একটু আগেই তো ভাবছিলাম আজ ডাকাতের কবলে মৃত্যুও হতে পারে। মনে মনে তাকে রুটি আলুভাজি খাইয়ে দিচ্ছিলাম। আমাদের হিন্দু কমিউনিটিতে শাস্ত্র অনুযায়ী এভাবে মৃত মানুষকেও খাবার খাওয়ানো যায়। বিশ্বাস করা হয় প্রাণীর বেশ ধরে এসে মৃত স্বজন খেয়ে যায়। দেখেছেন দুটো জলপায়রা এসে খেয়ে গেল। ঠিক ওই রকম।’
‘তিনি মারা গেছেন?’ সুপ্রিয় জিজ্ঞাসা করে।
‘না, বেঁচেই আছেন। তবে মৃত্যু আর স্থায়ী বিচ্ছেদের মধ্যে পার্থক্য কী! মৃত ধরে নিয়েই তার উদ্দেশে জলে খাবার দিচ্ছিলাম। ভাবছিলাম তাকে হাতে তুলে খাইয়ে দিচ্ছি। রুটি আলুভাজি খুব পছন্দের খাবার ছিল তার।’
‘রুটি আলুভাজি নিয়ে আপনাদের তো অনেক স্মৃতি দেখছি। আমারও স্মৃতি আছে। ছাত্রকালে এক প্রিয়মানুষ প্রায়ই খাওয়াতো রান্না করে। মাঝে মাঝে রুটি আলুভাজিও খাইয়েছে। আমি ঠিক এভাবেই খেতাম, যেমন আজ খেলাম।’ সুপ্রিয় হাহা করে হাসে।
তরী পাটাতনের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘোমটা বানিয়েছে চাদর পেঁচিয়ে। মুখ দেখা যাচ্ছে না।
মাঝি যাত্রীদের উদ্দেশে বলে, ‘কী করা যায়? কুয়াশা কাটা ছাড়া কোনাে দিশে তো পাচ্চিনে।’
‘চাচা, কোনাে একদিকে চলুন। কূল তো পাওয়া যাবেই।’ মুন্না জবাব দেয়।
‘না মামা। এইডে উচিত হবে না।’
‘আরে, আড়াআড়ি গেলে একটা কূল পাওয়া যাবে না?’
তরী জিজ্ঞাসা করে, ‘মামা আমরা কোন জায়গায় তা বুঝতে পারছেন?’
‘খালা আমার মাথায় প্যাঁচ লাইগে আচে। কোন দিক কোন জায়গা তা তো দূরির কথা, আমরা পদ্মায় না যমুনায় সেইডেও বুঝতি পারছিনে। তখন বালতিতি জল তুলে জলের রং বুজার চেষ্টা করলাম। কিচুই বুজলাম না। একন শীতকাল, নদীতি জল কম। বেশি জল থাকলি দুই নদীর জল দুই রঙের থাকে। এট্টা অন্যডার সাথে মেশে না।’
‘ঝুঁকি তো নিতেই হবে।’ সরাসরি সম্বোধন না করে মুন্না বলে তরীর উদ্দেশে।
‘ঝুঁকি নেয়া যেতে পারে তবে ভুল হলে তার দায় নেবে কে? দায় এড়িয়ে যাওয়ার মানুষের অভাব নেই।’
‘আমি কোনাে ফালতু কথা সহ্য করার জন্য এখানে বসে নেই। পয়সা দিয়ে টলারে উঠেছি। মামা চলেন কোনাে একদিকে। ডাকাতের আতংক নিয়ে বসে থাকার কোনাে মানে নেই।’ মুন্না উত্তেজিত স্বরে বলে।
‘আমিও বিনেপয়সায় উঠিনি। ছাড়ার পর যদি ডাকাতের কবলে পড়ি তার দায় কে নেবে?’
‘আপনারা ঝগড়া শুরু করলেন নাকি?’ সুপ্রিয় বলে দুজনের উদ্দেশে। মাঝি ও শান্ত নির্বিকার এসব আলাপ শুনতে থাকে।
‘সে বিষয়ে আর কারো মাথা ঘামানোর দরকার আছে বলে মনে হচ্ছে না।’ তরী সুপ্রিয়কে জবাব দেয়।
‘এটা কী ধরনের কথা হলো?’ সুপ্রিয় এই অভাবিত জবাবে বিব্রত হয়।
‘কেন, বাংলা বোঝেন না? আপনাকে কে কথা বলতে ডেকেছে?’ মুন্না সুপ্রিয়র উদ্দেশে বেশ উত্তেজিত স্বরে বলে।
‘ভদ্রভাবে কথা বলুন।’ সুপ্রিয় বলে মুন্নাকে।
‘আপনার কাছ থেকে ভদ্রতা শিখতে হবে? চুপ করে বসে থাকুন।’ রাগত স্বরে বলে মুন্না।
‘যে যেটা জানে না, তাকে তো সেটা শিখতেই হবে।’ সুপ্রিয় জবাব দেয় কটাক্ষ করে।
মুন্না রেগে উঠে দাঁড়ায়। নৌকা দুলে ওঠে। তরী বোঝে ঘটনাটা হাতাহাতির দিকে যেতে পারে। সে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নেয়। দৃঢ় গলায় সুপ্রিয়র উদ্দেশে বলে, ‘দেখুন, আপনার কাছ থেকে আমাদের কিছুই শিখতে হবে না।’
‘আরে বাহ্। যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর! কেউ চোখ রাঙিয়ে উঠে দাঁড়ালো তাতেই আমাকে পালিয়ে যেতে হবে। চুপচাপ বসে থাকতে হবে?’
‘সেটাই ঘটে, অনেকেই পালায়। সে রকম মানুষ আমি অন্তত একজনকে চিনি।’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলে তরী।
‘ও, বুঝেছি। দুঃখিত মিস্টার মুন্না। আমার এ বিষয়ে কথা বলা উচিত হয়নি।’ আহত কিন্তু রাগান্বিত কণ্ঠে জবাব দেয় সুপ্রিয়।
মাঝি আবার বিড়ি ধরিয়েছে, দুই পুরুষ সহযাত্রীর উদ্দেশে শান্ত বলে, ‘আপনারা একজন নারীর সাথে এভাবে কথা বলছেন কেন? আমরা সবাই মিলেই সিদ্ধান্ত নেব নৌকা চলবে নাকি অপেক্ষা করবে।’ নিজের পাশে জায়গা দেখিয়ে তরীর উদ্দেশে বলে, ‘এখানে বসলেই হয়।’
‘অনেকেই ডেকে কাছে বসায় তারপর দরকার মতো দূরে সরে যায়। আমি এখানেই ঠিক আছি।’
মুন্না ক্ষেপে ওঠে, ‘আরে আপনি তো দেখছি ভারি লোক। মেয়ে মানুষ দেখলেই পাশে বসাতে ইচ্ছে করে?’
‘শাট আপ। আপনারা দুজনই অভদ্রর মতো কথা বলছিলেন।’
‘দুজনের কথা আসছে কেন? সুযোগ নিয়ে পাশে বসানোর ধান্দা, তার আবার ভদ্রতা বোধ।’ রেগে বলে সুপ্রিয়।
‘আপনাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়ে যাবে। উনি মাঝখানে, লেগে যেতে পারে। তাই এখানে বসতে বলেছি। এর মধ্যে ধান্দা আসছে কোথা থেকে?’ শান্তর গলাও চড়ে যায়।
‘ঠিক কথা, এদের হাতাহাতি হলে লেগে যেতে পারে দুর্ঘটনাবশত। কিন্তু ওখানে গিয়ে বসলে ঘটনাবশত কোনাে আঘাত আসবে না তো?’ তরী চিবিয়ে চিবিয়ে বলে।
‘এই কথার অর্থ কী?’ জিজ্ঞাসা করে শান্ত।
‘না বোঝার কথা তো নয়।’
‘পুরুষের প্রতি পোষা রাখা রাগ আছে বোঝা যাচ্ছে। ঝগড়া লাগছে সবার সাথেই।’ সুপ্রিয় বলে।
‘না তা তো নয়। আমার বাবা আছে, ভাই আছে, বন্ধু আছে। তাদের উপর রাগ নেই তো। রাগ সবার থাকে কম বেশি। কিছু পুরুষের উপরও রাগ আছে আমার। যে পুরুষ একটা সম্পর্কে থাকা অবস্থায় অন্য জনের সাথে বিয়ে করে নেয় সে রকম পুরুষকে আমি ঘৃণা করি।’
সুপ্রিয় কী বলবে কথা খুঁজে পায় না। মুন্না কথা বলে, ‘আর যে নারী অপেক্ষা না করে চলে যায়। তার ব্যাপারে মূল্যায়ন কী?’
হঠাৎ অন্যদিক থেকে বাক্যবাণ ছুটে আসবে তরী তা ভাবেনি। যেন আগুন ঠিকরে বের হয় তার চোখ থেকে, ‘অপেক্ষা না করে চলে যাওয়াটা নিশ্চয়ই খারাপ। তবে অনিশ্চিত কোনাে ভবিষ্যতের আশায় অনন্তকাল অপেক্ষাও বোকামি। বিশেষত সেইসব পুরুষদের জন্য যারা শুরু থেকেই জানতো তাদের সামনে বাধা কী। ভীতদের ছেড়ে যাওয়াটাই সাহসিদের কাজ।’
ঝগড়ার উপক্রম দেখে মাঝি আলাপে প্রবেশ করে, ‘আপনারা একজন আর একজনের অচিনা। মাঝ গাঙে আমরা হারায়ে গিচি, আর আপনারা করতিচেন ঝগড়া। কখন কুয়াশা কাটবে তার তো ঠিক নেই। এট্টা উপায় ঠিক করেন।’
কেউ কোনাে কথা বলে না। মাঝি পুণরায় বলে, ‘আমি নৌকা ছাড়তিচি।’
ট্রলার চলতে থাকে, ঘন কুয়াশা মধ্য দিয়ে। একেবারে নিরুদ্দেশ যাত্রা। যন্ত্রের ভটভট ছাড়া কোনাে শব্দ নেই। মুন্না কথা বলে, ‘আচ্ছা অকারণে আমরা তিনজন কেন ঝগড়ায় লিপ্ত হলাম?’
সুপ্রিয় হাসে, ‘তাই তো, একজনের জন্য আমরা অনর্থক ঝগড়া করছি।’
‘দুঃখিত। এই বিপদে বিশেষ কোনাে কারণ ছাড়াই এভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি।’ বলে শান্ত।
‘নিশ্চয়ই ঠিক হয়েছে। আর অকারণে কোনাে ঝগড়া হয়নি। চরিত্রগতভাবে আপনারা একই রকম, সে কারণে ঝগড়া হয়েছে।’ শান্তকে উদ্দেশ করে বলে তরী।
‘কী বলতে চাও?’ কণ্ঠস্বরে বোঝা যাচ্ছে রাগ সামলাতে পারছে না শান্ত।
‘নিজের ফেলে আসা সময় বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে।’ উত্তর দেয় তরী।
ক্ষেপে ওঠে শান্ত, ‘কুয়াশায় অন্ধকার পদ্মায় হারানো টলারে আমি অপরিচিত কোনাে ব্যক্তির সামনে ঝগড়া করতে উঠিনি।’
‘আমি সুনন্দা বাশার তরীও কারো সাথে ঝগড়া করতে টলারে উঠিনি। তাছাড়া আপনার যা অপরিচিত তা আমার পরিচিতও হতে পারে।’
‘অদ্ভুত! মামা কোনাে এক চরে আমারে নামায় দিতে পারেন?’ শান্ত মাঝির উদ্দেশে বলে। ইঞ্জিনের শব্দে মাঝি কিছুই শুনতেই পায় না।
‘নিশ্চয়ই, নেমে যাওয়াটাই সেরা সমাধান। পথ খুঁজে বের করার মতো সাহস ছিল কোনাে কালে?’ তরী উঁচু স্বরেই বলে।
‘একটা থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব।’ হাত উঁচিয়ে চড়ের ভঙ্গি করে শান্ত।
সুপ্রিয় ছুটে আসে, ‘কী ভেবেছেন আপনি, আপনাকে ছেড়ে দেব? একা একজন নারীর সাথে যা খুশি ব্যবহার করে পার পাবেন ভেবেছেন?’
‘এর মধ্যে কথা বলার আপনি কে? যান এখান থেকে।’ শান্ত বলে তার উদ্দেশে।
‘মিস্টার শান্ত কোথায় যাবে লোকটা। আপনারা একই নৌকার যাত্রী। মিস্টার সুপ্রিয়, আপনাকে কোথাও যেতে হবে না, আপনি বসুন ওখানে। তাছাড়া একজন পালিয়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে এত মানবিক গুণাবলি বড়ো মেকি লাগে।’
‘তুমি ওনাকে চেনো?’ শান্ত জিজ্ঞাসা করে তরীকে।।
‘চিনতাম। ও হ্যাঁ মিস্টার শান্ত, আমাকে চড় দিয়ে দাঁত হয়তো ফেলতে পারবেন তবে কোনাে কূলে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তার জবাব আমি দিয়ে দেব।’
‘সরি, কথাটা রাগে বলে ফেলেছি। কে উনি?’
‘উনি একজনকে ভালবেসে অন্য আর একজনকে বিয়ে করা মানুষ।’
সুপ্রিয় কঁকিয়ে ওঠে, ‘কী হচ্ছে এসব?’
‘মিথ্যে কিছু তো হচ্ছে না।’
‘পুরোনো কথার দরকার কী এখানে? সবকিছু তুমি জানো না।’
শান্ত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মুন্না কাছে এগিয়ে আসে, স্পষ্ট করে শোনার জন্য। নৌকা মৃদু ঝাঁকুনি খায়।
‘ঠিক তাই, সবকিছু আমি জানি না। তবে যেটুকু জেনেছি তাতেই আমার কাজ চলে যায়।’
‘ওটা ছিল একটা দুর্ঘটনা। আমি নিরুপায় ছিলাম।’ সুপ্রিয় বলে।
‘ওটা একটা অন্যায় ছিল। যার সাথে বর্তমান তার প্রতি সৎ থাকাটাই কি যৌক্তিক নয়।’ তরী সুপ্রিয়র চোখে চোখে রেখে বলে।
‘আগে একটা সম্পর্ক ছিল ওর সাথে, বলেছিলাম সেটা। আমার পরিবারের সাথে ওদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিছু সময় থাকে যা এভয়েড করা যায় না।’
‘ফলে অন্য কারো সাথে প্রতারণা করে হলেও অপরাধে প্রলেপ দিতে হয়।’ তরী জবাব দেয়।
‘কী করতাম আমি, একটা ভ্রুণ হ্ত্যা করা উচিত ছিল? এক গ্রাম্য কিশোরীর জীবন শেষ করা উচিত ছিল আমার?’ সুপ্রিয় কাঁতর কণ্ঠে বলে।
‘না সেটা হতো পাপ। অন্যায়-অপরাধের চেয়ে পাপ আরও কঠিন। ওটা ঠিক কাজ ছিল, নিজের অপরাধ আর কিশোরী ও ভ্রুণের জীবনের সাপেক্ষে। কিন্তু যে মানুষ বাড়িতে গিয়ে আর ফেরেনি, পরের বছর অন্যত্র পড়াশোনা শুরু করেছে, তার জন্য অপেক্ষা করা মানুষের সাপেক্ষে ওটা ভালো কাজ ছিল কি?’
‘সে সময় আমার বয়স কম ছিল।’
‘তখন বয়স কম ছিল অপেক্ষা করা মানুষেরও।’
‘সে জন্য আমি অনুতপ্ত। আমার যেকোনভাবে হয়তো জানানো উচিত ছিল।’
‘তাতে কারো ব্যথা কিংবা কারো অপরাধ মোটেই কমতো না। তবে পলাতক সিল লাগতো না কারো মাথায়।’
‘এক মিনিট, এই ভদ্রলোক তোমার প্রথম প্রেমিক?’ শান্ত জিজ্ঞাসা করে।
‘প্রথম প্রেমিক, ভদ্রলোক কি না জানি না।’ বহু বছর পর দেখা হলো আজ।
সুপ্রিয় জিজ্ঞাসা করে, ‘ইনি তোমার পরিচিত?’
‘হ্যাঁ, এই সেই লোক যার সাথে আমার জীবনের কয়েকটি বছর কেটেছিল একই ঘরে?’
‘মানে কী, এখন তোমাদের…?’
‘হুম ঠিক ধরেছ। সে বিদেশ গিয়ে আর ফেরেনি। সেখান থেকেই জানিয়েছিল আমার সাথে থাকবে না। তারপর যা হয় তাই।’
শান্ত বলে, ‘এসব কথা এখানে বলার দরকার কী? যা গেছে তা গেছে। তুমি এখন ভালো আছো, আমিও ভালো আছি।’
‘তোমার স্ত্রী তো শুনেছি আমার মতোই একটা চাকরি করে। তুমিও এখন ড্রিংক করো না, জুয়াটাও বাদ দিয়েছ।’
‘কে বলেছে তোমাকে?’
‘কীভাবে কীভাবে যেন খবরটা আসে।’
‘ঠিকই শুনেছ। সংসার করতে গেলে কিছু বিষয় তো মানিয়ে চলতেই হয়।’
‘আমি তো ঠিক এগুলোই চেয়েছিলাম, কেবল আমার সাথে সেগুলো মানিয়ে নেয়া যায়নি।’
‘তুমি জানো আমার মাথাটা একটু গরম, নেশার ঘোরে অনেক সময়…। সে জন্য এখন খারাপ লাগে। তাছাড়া তুমি আমাদের বাড়িতেও চলে যেতে পারতে।’
তা পারতাম, হয়তো করতামও তাই। তবে গোপনে পাসপোর্ট ভিসা করে একা বাসায় ফেলে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলে নিশ্চয়ই তোমাদের বাড়িতে চলে যাব সেই আশা করে নয়।’
অনেকক্ষণ কেউ কোনাে কথা বলে না। শান্ত সিগারেট জ্বালায় একটা। নীরবতা ভাঙার জন্যই সৃপ্রিয়র উদ্দেশে বলে শান্ত, ‘ও আপনার কথা আমাকে বলেছিল।’
কারণ দর্শানোর মতো করে বলে সুপ্রিয়। ঠিক শান্তকে নয়, তরীকে শুনিয়ে, ‘আসলে প্রথম বর্ষে থাকতেই আমাকে বিয়ে করতে হয়েছিল। ফলে ওর সামনে এসে দাঁড়ানোর সাহস হয়নি। তাই পরের বছর অন্যত্র পড়াশোনা শুরু করেছিলাম। তাছাড়া বিষয়টা কতদিন গোপন রাখতাম, আমার স্ত্রী যদি জানতো ওর সাথে…সেটাও ভালো হতো না। ওর খবরও পেতাম। শুনেছিলাম আমি যাবার দুই আড়াই বছর পর আপনার সাথে সম্পর্ক হয়েছিল ওর। আমি খুব অল্পদিন ছিলাম তো বিশ্ববিদ্যালয়ে, সব বিভাগের সবার সাথে পরিচয় হয়নি।’
‘না আমি সেই ব্যক্তি নই। আমার সাথে পরিচয় আরও পরে। তখন ও চাকরি করতো। আপনার পরে ওর জীবনে কেউ এসেছিল, খোলাখুলি কখনও বলেনি তবে সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। অনেক বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝামেলা হলেও ওসব নিয়ে কখনও হয়নি।’
‘আর আশ্চর্যজনকভাবে এই তরীতে তিনিও আছেন।’ তরী বলে।
শান্ত, সুপ্রিয় দুজনই অবাক চোখে তাকায় মুন্নার দিকে। মুন্না একটু ঘাবড়ে যায়, ‘এখানে আমার কথা আসছে কেন?’
‘কারণ সুনন্দা বাশার তরীতে যারা ভ্রমণ করেছে তুমিও তাদের একজন।’
‘কিন্তু আমি তো তোমাকে ছেড়ে চলে যাইনি, তুমি গেছ। আর এসব কথা এখানে বলার প্রাসঙ্গিকতা কী?’ বিরক্ত হয়ে বলে মুন্না।
‘প্রাসঙ্গিকতা ছিল না, এইমাত্র তৈরি হলো।’ তরী জবাব দেয়, তার গলা চড়ে ওঠে, ‘আমি ছেড়ে গেছি বলে যে দোষ দিলে সে কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজনেই এটা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।’
‘আমার কী ত্রুটি ছিল, আমি কি বলেছিলাম বিয়ে করব না? পরিবারের কথাও আমাকে ভাবতে হতো।’
‘এটাও তো বলোনি যে বিয়ে করবে। দুজনই জেনে-বুঝে সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম যে আমাদের ধর্ম ভিন্ন। তুমি বারবার বলতে এভাবেই চলুক। আমি সম্পর্কের দায় বহনের জন্য সবসময় তৈরি ছিলাম। তুমি সাহস পাওনি। উপরন্তু…। আর তোমার যেমন পরিবার ছিল আমারও ছিল। বাধাগুলোকে আমি অগ্রাহ্য করতে চেয়েছিলাম তুমি চাওনি।’
‘ঠিক বলছো না। ওটা তোমার পরের ঘটনা, তাছাড়া নিশ্চয়ই জানো আমি বিয়ে করিনি, হয়তো করবোও না।’
‘সে মেয়েটাও তোমার ধর্মের ছিল না। তখন আমি চাকরিতে জয়েন করে ফেলেছিলাম। মানুষের গতিবিধি বোঝার বয়স আমার হয়েছিল। কয়েকবার ওকে নিয়ে তোমার সাথে মতবিরোধও হয়েছিল। আর শেষে তার সাথেই…! বিয়ে করোনি এ কথা উল্লেখ করে কি আমাকে দায়ী করতে চাও? তুমি তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে, ওই মেয়েটাই তোমাকে বিয়ে করেনি। কেবল একটা প্রশ্নের উত্তর মেলে না, যদি পুণর্বার একজন ভিন্ন ধর্মের মানুষের কাছে যেতেই হয় তবে আমার সমস্যা কী ছিল!’
মাথা হেঁট করে বসে থাকে মুন্না। শান্ত আবার সিগারেট ধরিয়েছে। সুপ্রিয় গুনগুন করে রবীন্দ্রসংগীত গাইছে, ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম প্রেম মেলে না’।
সাড়ে বারোটা বাজে। কুয়াশা এখনও সকালে মতই ঘন। মাঝি নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে। চারপাশে লগি মেরে জল মাপে, সামনে গিয়ে হাহা করে হাসে। যাত্রীরা তার দিকে তাকায়। মাঝি লগি রাখে যথাস্থানে, ‘বুঝলেন নৌকার সামনে বালুচরা, একবার ঝাঁকুনি খালো আধাঘণ্টা মতাে আগে, তখন আপনারা ঝগড়া করতিছিলেন। মনে হয় সেই সুমাত্তে আটকায়ে আছি। এক চুল আগোতি পারিনি।’
মাঝি লাফিয়ে নামে। সামনে সত্যি নীচু বালুচরা, নৌকার নাক সেখানেই ঠেকে আছে। কেউ সেটা খেয়াল করেনি। ঠেলে নাক ঘুরিয়ে নৌকায় ওঠে মাঝি, ‘এখন কী করি কন? যা তেল আছে তাতে মিনিট চল্লিশেক চলবে।’
কেউ কোনাে কথা বলছে না। নীরবতা ভাঙে তরী, ‘চল্লিশ মিনিট অনেক সময়।’
মাঝি হাসে, ইঞ্জিন চালু করে। সুপ্রিয় আবার গান ধরে, ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না’। গলা মেলায় মুন্না ও শান্ত।
কিছুক্ষণ পর মাঝি ইঞ্জিন বন্ধ করে, ইশারায় থামতে বলে সবাইকে। তারা গান থামায়। মাঝি বলে, ‘সামনেই জালেগের ডিঙি নৌকা, কথা বার্তা শুনতে পাচ্ছি, জাল ফেলার শব্দ পালাম। ওরা সহজে হারায় না। অন্তত একটা কূলির হদিস দিতি পারবে।’
যাত্রীরা এই কথা শুনতে পেয়েছে বলেই মনে হয় না। তরীর ফোনে কল আসে। দেখেই সাইলেন্ট করে একটা টেক্স পাঠায় কাউকে। সবাই মোবাইল বের করে, নেটওয়ার্ক এসেছে। কারো জবাব না পেয়ে মাঝি হাকে, ‘মাঝিভাই এইডে যাত্রী টলার। পাটুরিয়ারত্তে দৌলতদিয়া যাচ্চিলাম। আমরা হারায়ে গিচি।’
সামনে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশা ভেদ করে চিৎকার ধেয়ে আসে, ‘চইলে আসেন।’
মাঝি যাত্রীদের অনুমতি প্রার্থনা করে, ‘বদ লোক হওয়ার সম্ভাবনা কম। ওগো কাছে যাই, তাই না?’
জবাব দেয় না কেউ, তরী গান ধরে, ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না’।
অন্য তিনজন গলা মেলায়। চারজনের চোখেই জল। মাঝি কিছুক্ষণ গান শুনে ইঞ্জিন চালু করে। শব্দের ওপর দিয়ে চারজন গাইতে থাকে কেবল স্থায়ীর তিনটি লাইন-
‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না
শুধু সুখ চলে যায়, এমনই মায়ার ছলনা
এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না’
আবারও কুয়াশার ঘন মেঘের মধ্যে প্রবেশ করে ট্রলার। জলপায়রা দুটি এসে বসেছে গলুইতে। ইঞ্জিন বন্ধ করে দিয়েছে মাঝি। গতিজড়তার গতিতেই এখন নিঃশব্দে চলছে নৌকাটি। মাঝি রামদা বের করে বাগিয়ে ধরে রেখেছে যে কোনাে বিপদ মোকাবিলার জন্য। সামনের জেলেনৌকা থেকে জাল ফেলার খুপ খুপ শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। আরও একটি যাত্রা সমাপ্ত করতে কুয়াশা ভেদ করে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে তরিটি।
—
দেশের বই পোর্টালে লেখা পাঠাবার ঠিকানা : desherboi@gmail.com
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD