ঈদ সাময়িকী ॥ অনুবাদ গল্প

মিশরীয় গল্প ‘গুপ্তধন’

সোমবার, ০৩ আগস্ট ২০২০ | ১০:৫৩ অপরাহ্ণ | 1079 বার

মিশরীয় গল্প ‘গুপ্তধন’

গুপ্তধন [মিশরের গল্প]

‘গুপ্তধন’ গল্পটি ‘দ্য ট্রেজার’ শিরোনামে আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ন্যান্সি রবার্টস। ‘দেশের বই’ সাময়িকীর পাঠকদের জন্য গল্পটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আদনান সহিদ

 

 

সাদা পোশাক পরিহিত পুলিশ, আব্দুল আলের দৈহিক গড়ন লম্বা, ত্বক গাঢ় বর্ণের। তার ডান হাতের উলটো পিঠে মুখ হাঁ করা ও মাঝখান দিয়ে দু’ভাগে বিভক্ত লেজওয়ালা একটি মাছের উল্কি আঁকা, যে মাছের চোখে আবার একটা দাগ স্পষ্ট!

আব্দুল আল পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করত। পুলিশ হওয়া সত্ত্বেও তার স্ত্রী সন্তানেরা কিছুটা সময় তাকে শান্তি দিলেও বেশিরভাগ সময়ই বেশ উত্ত্যক্ত করত। বিরক্ত হয়ে সে যে তার স্ত্রীকে কয়েকবার বিবাহ-বিচ্ছেদের হুমকি দেয়নি এমন নয়, কিন্তু সেই হুমকি সে কোনোদিনই বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

আব্দুল আল মাসিক দশ মিশরীয় পাউন্ড বেতন পেত। এর মধ্যে তার পাওনা এবং বকেয়া সবধরনের বোনাসই অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে বেতন যা-ই হোক, গোয়েন্দা পুলিশে চাকরি করে বেশ সন্তুষ্ট ছিল আব্দুল আল। বাস থেকে নামার সময় সে পরিস্কার শুনত, কত কন্ডাকটর তাকে বলছে, ‘পুলিশ’। এই ‘পুলিশ’ শব্দটি শুনে আশেপাশের লোকজন যখন তার দিকে সম্মানের দৃষ্টিতে তাকাত, তখন তার মধ্যে একটা অহংকার বিরাজ করত।

অন্য দশজনের মতোই আব্দুল আলের চোখে নানা ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ভাসত।তবে তার স্বপ্নগুলো ‘নিতান্তই সাধারণ ছিল’ না। কারণ, সে পুলিশ অফিসার অথবা পুলিশ কমিশনার হবার স্বপ্ন দেখত না কখনও। বরং তার একমাত্র স্বপ্ন ছিল ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর’ পদ লাভ করা। হ্যাঁ ! ঠিকই শুনেছেন। হয়তো ভাবছেন, একজন মানুষ সকালে উঠে দেখবে সে সরকারি মন্ত্রী হয়ে গেছে। তাঁর একটা গাড়ি থাকবে, দেহরক্ষী থাকবে এবং কমপক্ষে একজন মিলিটারি অফিসার কাঁধে দুটো ব্যাজসহ অফিসের সামনের প্রবেশপথে তাঁকে পাহারা দেবে! এও কি সম্ভব?

 

আপাত অসম্ভব মনে হলেও বিষয়টি সহজেই ঘটতে পারে বলে আব্দুল আলের বিশ্বাস ছিল। সৃষ্টিকর্তার পক্ষে তো কোনাে কিছুই অসম্ভব নয়। সৃষ্টিকর্তা যদি শূন্য থেকেই সবকিছু সৃষ্টি করতে পারেন, পুলিশ থেকে তাকে মন্ত্রী বানানো কি তাঁর পক্ষে আদৌ কঠিন কাজ? তাছাড়া অন্যান্য বন্ধুদের মাঝে সে-ই ছিল একমাত্র শিক্ষিত যে যথাযথভাবে লিখতে ও পড়তে জানত। মাঝে মাঝে নিজের কাছেই দুর্বোধ্য ঠেকা কিছু ইংরেজি শব্দও বলে ফেলত সে। সংবাদপত্র গোগ্রাসে গিলত আব্দুল আল। কোরিয়া সম্পর্কেও তার সম্যক জ্ঞান ছিল, এমনকি সে ‘হামারসকজল্ড’ এর মতাে কঠিন নামও অনায়াসেই উচ্চারণ করতে পারত। এমন যোগ্য ব্যক্তি কি স্রষ্টার চোখের আড়ালেই থেকে যাবে? আব্দুল আলের নিত্য ভাবনা জুড়ে এসবই থাকত।

একবার আব্দুল আল এক পুলিশি রেইডের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয় এবং রেইড দিয়ে অবৈধ দ্রব্যাদি বাজেয়াপ্ত করে। গোয়েন্দা বিভাগ যখন বাজেয়াপ্ত দ্রব্যগুলো নিয়ে হিসাব মেলাচ্ছিল তখন তালিকা মাফিক কিছু দ্রব্য পাওয়া যায়নি। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে রেইডে অংশগ্রহণকারী আব্দুল আলকে গোয়েন্দা বিভাগের তত্ত্বাবধানে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। তার প্রতি ছুঁড়ে দেওয়া সব প্রশ্নের উত্তর আবদুল আল অস্বীকার করে। খোয়া যাওয়া দ্রব্যের ব্যাপারে সে কিছুই জানে না- এমন দাবি করে বসে সে। গোয়েন্দা বিভাগ তার প্রতি বেশ নির্দয় আচরণ করে এবং কথা বের করার জন্য ক্রমাগত মানসিক ও দৈহিক চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। আব্দুল আল একপর্যায়ে তোতলানো শুরু করে। প্রশ্নকর্তা অফিসারের সন্দেহ হয় এবং সে আব্দুল আলের দেহতল্লাশি করতে উদ্যত হয়। আব্দুল আল অন্তর্দৃষ্টি থেকে দেখতে পায় প্রকৃতপক্ষে পুলিশ অফিসারটি তাকে তল্লাশি করার চেয়ে ভয় দেখাতেই বেশি আগ্রহী। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ সে পকেট থেকে ‘খোয়া যাওয়া’ বস্তুটি বের করে আনে। সেই বস্তুটি ছিল খুব সুক্ষ্মভাবে জাল করা মিশরীয় এক লাখ পাউন্ডের একটি চেক! চরম বিস্মিত হওয়া অফিসারটি তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করে এবং তাকে নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন করে।

‘এই জাল চেকটি তোমার কাছে কেন আব্দুল আল?’

আব্দুল আল এর কোন সদুত্তর দিতে পারে না। সে বিড়বিড় করে আবোল তাবোল বকতে থাকে। তদন্তকারী পুলিশ অফিসারটি তার উত্তরে সন্তুষ্ট হয় না। অবশেষে, সারাদিন পর ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহে আব্দুল আল তার বিভাগ থেকে বের হয়ে আসতে পারে। তার অর্ধেক বেতন কেটে নেওয়া হয়। গোয়েন্দা পুলিশের ‘তদন্ত বিভাগ’ থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং তাকে চাকরিচ্যুত করা হবে বলেও সতর্ক করা হয়।

যথেষ্ট বিরক্তি ও বিষণ্নতা নিয়ে আব্দুল আল বাড়ি ফিরে আসে। একইসাথে তার মনে প্রবল সন্তুষ্টি ও সুখবোধ হতে থাকে। সে যে জাল চেকটির আরেকটি হুবহু কপি তৈরি করে ফেলেছে এটা কেউই ধরতে পারেনি। এজন্য অবশ্য তার পকেট থেকে পনেরো পিয়েসটার গুনতে হয়েছে।

পরবর্তী দিনগুলোতে, আব্দুল আল এর বিষণ্নতা এবং বিরক্তিভাব ক্রমান্বয়ে উধাও হয়ে গেল আর তার সাথে ‘সুখানুভূতির মতাে’ রয়ে গেল কেবল জাল চেকটির ‘হুবহু’ কপিটা।

একদিন আব্দুল আল জনসম্মুখ থেকে দূরে পালিয়ে গেল। এই পালিয়ে যাওয়াটা তার জন্য একটি প্রচন্ড সুখকর অভিজ্ঞতা। কেউ তার উপর নজর রাখছে না নিশ্চিত হবার পর খুব সাবধানে সে তার মানিব্যাগের ‘গোপন পকেট’ থেকে জাল চেকটির ফটোকপি টেনে বের করল। চেকের গায়ে ব্যাংকের লোগো সম্বলিত প্রিন্ট করা চিঠিটি দেখে অতি আগ্রহে তার কান খাড়া হয়ে গেল, সারা শরীর কাঁপতে লাগল। তারপর সে চেকের গায়ে আদর করে হাত বুলাতে বুলাতে বিশেষ বাক্যটি পড়ল, ‘এই চেকের বাহককে এক লক্ষ মিশরীয় পাউন্ড প্রদান করা হোক।’

এরপর প্রচন্ড উত্তেজনায় সৃষ্ট তার পেটের ভেতরকার কম্পন না থামা পর্যন্ত সে চেকটায় অনবরত চোখ বোলাতেই থাকল। একসময় খুব কায়দা করে অনেকটা স্বীকারোক্তিমূলক প্রার্থনা শেষ করার মতাে, চেকটি মানিব্যাগের গোপন পকেটে ঢুকিয়ে রাখল সে। তারপর আস্তে আস্তে আবার জনসম্মুখে উপস্থিত হলো। আর সন্দেহাতীতভাবে উপস্থিত সেই ব্যক্তিটি ছিল সাদা পোশাক পরিহিত পুলিশ, আব্দুল আল, যার দৈহিক গড়ন লম্বা, ত্বক গাঢ় বর্ণের। তার ডান হাতের উলটো পিঠে মুখ হাঁ করা ও মাঝখান দিয়ে দু’ভাগে বিভক্ত লেজওয়ালা এক মাছের উল্কি আঁকা, যে মাছের চোখে আবার একটা দাগ স্পষ্ট!

 

[গল্পকার পরিচিতি]

ইউসুফ ইদ্রিস
১৯২৭ সালে মিশরে জন্মগ্রহণকারী ইউসুফ ইদ্রিস একজন প্রথিতযশা নাট্যকার, ছোটােগল্পকার এবং ঔপন্যাসিক। চিকিৎসাশাস্ত্রে অধ্যয়ন ও পেশাগত দায়িত্ব শুরু করলেও সাংবাদিক হিসেবে প্রবন্ধ লিখে তিনি তাঁর সাহিত্যজীবন শুরু করেন। তাঁর ছোটগল্পগুলো বাস্তবানুগ, প্রাত্যহিক জীবনের নানা উপাদান স্বতঃস্ফূর্তভাবে চিত্রিত হয় সেখানে। গল্পে স্বদেশি ভাষা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে ইউসুফ ইদ্রিস বেশ যত্নশীল। এজন্য তাঁকে মিশরীয় ‘ছোটােগল্পের গুরু’ আখ্যায়িত করা হয়। লেখক জীবনের প্রথমদিকে তিনি মিশরের জনপ্রিয় ঐতিহ্য ও লোককথানির্ভর আধুনিক থিয়েটারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁর রচিত নাটকের সংখ্যা নয়টি। এছাড়া তাঁর এগারােটি গল্প সংকলন রয়েছে যা বিশ্বের ২৪টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্প সংকলনের মধ্যে ‘চিপেস্ট নাইটস’ এবং ‘আল-হারাম’ (দ্য ফরবিডেন) উপন্যাসটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি বেশ কয়েকবার নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। ইউসুফ ইদ্রিস ১৯৯১ সালে লন্ডনে মারা যান।


দেশের বই পোর্টালে লেখা পাঠাবার ঠিকানা : desherboi@gmail.com

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD