অন্যরকম সুন্দরবন ভ্রমণ
॥ মেসবাহ য়াযাদ ॥
আমরা কতিপয় বন্ধু আছি, যাদের কাজ সময় আর সুযোগ পেলেই দেশ-বিদেশ ঘুরতে যাওয়া। এক একটা ট্যুর আমাদের মধ্যে এক একজন অর্গানাইজ করে। আমাদের ঘুরতে যাবার কোনো তাল-লয় নেই। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম, ঘুরতে যাব। ব্যস, জামা-কাপড় নিয়ে সেদিন রাতের গাড়িতে চড়ে বসি। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কুমিল্লা, শ্রীমঙ্গল জাতীয় ট্যুরগুলো সচরাচর দুই দিনের হয়। রাতে যাত্রা শুরু করে পরদিন থাকি। তার পরদিন ফিরে আসি। সেন্টমার্টিনের ট্যুর হয় তিন-চার দিনের।
তবে বছরে একবার সেন্টমার্টিন এবং একবার দেশের বাইরে যাওয়াটা আমাদের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইরে বলতে ভারতের কোলকাতা, দিল্লি, আগ্রা, আজমির, জয়পুর, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং বা শিলং। কখনো-কখনো নেপাল, মালয়েশিয়া বা ব্যাংকক। এসব ট্যুরে মহা হ্যাপা আজকাল। ছুটির সাথে মিলিয়ে ভিসা পাওয়াটা মুশকিল হয়ে যায়। তবে যত হ্যাপাই হোক না কেন, আমরা তার চেয়ে বেশি ক্ষ্যাপা। যাব সিদ্ধান্ত যখন নেই, তখন যাবই। জীবনে যত ট্যুর করেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক আর রোমাঞ্চকর ট্যুরের কথাটি শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছি না।
সেটি ছিল আমাদের দশম সূর্য উৎসব। সালটাও ২০১০। এর আগে সূর্য উৎসব করতে আমরা সেন্টমার্টিন, সুন্দরবন, নিঝুম দ্বীপ, কেওক্রাডাং, খাগড়াছড়ি, পঞ্চগড়, বিরিশিরি, রাঙামাটির পাবলাখালী গিয়েছিলাম। এবার আমাদের গন্তব্য সুন্দরবনের কটকা। এটি দ্বিতীয়বারের মতো সুন্দরবনে সূর্য উৎসব আর আমার তৃতীয়বার সুন্দরবন যাওয়া।
ডিসেম্বরের ২৮ তারিখ পই পই করে অংশগ্রহণকারী সবাইকে বলে দেয়া হয়েছে- সূর্য উৎসব কোনো প্লেজার ট্রিপ নয়। এতে অংশ নেয়া সবাইকে মেলা কষ্ট করতে হবে। থাকা, খাওয়া, বাথরুম সব কিছুতেই কষ্ট। আসলে আমরা একটু বাড়িয়েই বলি। পারতপক্ষে কাউকেই তেমন কষ্ট করতে হয় না। তবুও বলে নেই, যাতে সমস্যা-টমস্যা হলে কেউ কোনো অভিযোগ করতে না পারে। সবাই একমত হয়ে তবেই তার যাওয়া নিশ্চিত করেছে।
৩০ ডিসেম্বর সকাল এগারোটায় লঞ্চ ছাড়ার কথা। কিন্তু সদরঘাট থেকে আমাদের নিয়ে পারাবত- ১ ভেঁপু বাজাল দুপুর দুইটায়। যথারীতি শেষ সময়ে এটা-সেটা কেনা, অনেকের না এসে পৌঁছান, নতুন করে কারো কারো আমাদের সফরসঙ্গী হওয়া…। যাই হোক, জাহাজ ছাড়ার পরই সবাইকে তার কেবিনের চাবি (যদিও বলা ছিল- শিশু এবং বৃদ্ধদের শুধু কেবিন দেয়া হবে। এরপর কেবিন বাকি থাকলে অন্যদের দেয়া হবে) দিয়ে দেয়া হলো। খাবারে খানিকটা বিলম্ব হবে, সেজন্য সবাইকে মুড়ি-চানাচুর মাখা দেয়া হলো। আমরা যে যার কাজে নেমে পড়লাম। জাহাজের লোক, সাউন্ডের লোক আর বাবুর্চিসহ প্রায় দেড়শো মানুষ।
আমাদের লঞ্চ চাঁদপুর পেরিয়ে যাবার পর জানা গেল- এ জাহাজের চালক জীবনেও সুন্দরবন এলাকায় যায়নি। মংলা পর্যন্ত চেনে। তবে টেনশন নেই, মংলা থেকে লোক নেয়া হবে। যে আমাদের রাস্তা চিনিয়ে দেবে। শুনেই টেনশন বেড়ে গেল। মংলা থেকেই যদি লোক নেবে, তাহলে ঢাকা থেকে নেয়নি কেন? সন্তোষজনক কোনো জবাব নেই। মাথার চুল ছিঁড়ে আর কমাতে চাইনি। সিগারেট খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেল আমাদের কয়েকজনের। অন্যরা কিছুই জানে না। সারারাত চালিয়ে সকাল আটটার দিকে মংলায় থামলাম। ঘণ্টাখানেক থামার পর জাহাজের মাস্টার এসে বলল- সব ঠিক আছে। রাস্তা চেনাবার জন্য লোকও নিয়েছে। এখন জাহাজ ছাড়বে কি না? জাহাজ ছাড়তে বললাম। জাহাজ চলছে…। আমাদের রুট ছিল- ঢাকা থেকে শরণখোলা, রায়েন্দা হয়ে কটকা। অথচ মংলায় এসে লোক নেবার কারণে এখন অন্তত দশ সাত-আট ঘণ্টার রাস্তা ঘুরে যেতে হচ্ছে আমাদের।
সন্ধ্যা নাগাদ আর কোনো ঝামেলা ছাড়াই পৌঁছলাম হিরন পয়েন্ট। সেখানে ২০০৯ সালের শেষ দিনের সূর্যাস্তটা দেখলাম। জাহাজের লোক জানাল- রাতটা এখানে কাটাতে পারি। আবার চাইলে ঘণ্টাখানেক দূরের কটকাতেও কাটাতে পারি। যেহেতু আমাদের গন্তব্য কটকা এবং ভোরে আমরা মাটিতে নামব, নতুন সূর্যকে বরণ করে নেব, মাটিতে বেশ কিছু ইভেন্ট আছে- তাই আমরা কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, কটকাতেই আজ রাতটা কাটাব। ফলে কটকার কাছাকাছি গিয়ে আমাদের জাহাজ নোঙ্গর করা হলাে।
সেদিন ছিল ৩১ ডিসেম্বর। দশটার মধ্যে রাতের খাবার দিয়ে দেয়া হলো। আমাদের রাতের প্রোগ্রামের প্রস্তুতি চলছে। প্রথম প্রহরে আমরা মঙ্গল দ্বীপ জ্বালিয়ে নদীতে নামাব। রঙিন কাগজ দিয়ে মাটির সরাকে ঢেকে তার ভেতরে ছোটো পিদিম জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। দেড়শোর মতো মঙ্গল দ্বীপ ভাসিয়ে দেয়া হবে। আর এ কাজটিতে নেতৃত্ব দেবেন আমাদের এ উৎসবের প্রধান অতিথি, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী মিলি রহমান। প্রচণ্ড বাতাস আর ভয়ঙ্কর সব ঢেউয়ের মাঝেও আমরা আমাদের মঙ্গল দ্বীপগুলো ভাসিয়ে দিলাম নদীতে। প্রথম পর্বের সমাপ্তি এখানে। সবাইকে বলে দেয়া হলাে- সকাল ছয়টায় জাহাজের নীচতলায় রিপোর্ট করার জন্য। সাতটায় আমরা মাটিতে নামব।
প্রায় সবাই সকাল ছয়টার মধ্যেই শীতের কাপড় পরে রেডি হয়ে নীচে নেমে এলাে। বেগুন ভাজা আর ডিম দিয়ে খিচুড়ি। এরপর গ্লাস ভরতি রং চা। এটা ছিল আমাদের ২০১০ সালের প্রথম দিনের নাস্তা। জাহাজ চলতে শুরু করেছে। গাইডের কথা অনুযায়ী আধাঘণ্টার মধ্যে আমাদের কটকা বিচে পৌঁছানোর কথা। কিন্তু আটটা নাগাদ জাহাজ ছোটো একটা খাল দিয়ে চলতে শুরু করল। আমার কেমন জানি সন্দেহ হলো। গরম চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে জাহাজের তিন তলায় উঠে এলাম। জাহাজের ম্যানেজার লাভলু ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম আমরা কোথায়? তিনি জিজ্ঞেস করলেন- সারেং কে। সারেং জিজ্ঞেস করল গাইডকে…। বুঝলাম, ভুল পথে ঢুকেছি।
আশপাশ দিয়ে ছোটো ছোটো মাছের ট্রলার ছুটে যাচ্ছে। অবাক হয়ে এত বড়ো তিনতলা জাহাজটাকে দেখছে ওরা। ওদের কাছে জানলাম, আমরা কটকার উলটোদিকে আছি। এখান দিয়ে কটকা যেতে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা লাগবে। বঙ্গোপসাগর দিয়ে যেতে হবে আমাদের। আমি বুঝলাম না, কটকার সাথে বঙ্গোপসাগরের কী সম্পর্ক ? হাতের গ্লাস থেকে ছলকে গরম চা পড়ল গায়ে…। ঘটনা কী? দৌড়ে জাহাজের ব্রিজে গেলাম। সারেং জানাল- এই খাল দিয়ে সামনে যাওয়া যাবে না, পানি কম।
ইতোমধ্যে জাহাজ থেমে গেছে মানে থামাতে বাধ্য হয়েছে। এখন উপায়? মংলা থেকে আমাদের সাথে আনা ট্রলারে করে আমি আর লাভলু ভাই পাশের মাছ ধরার ট্রলারের কাছে গেলাম। ওদের বুঝিয়ে বললাম, আমরা কী বিপদে পড়েছি…। ওদের মধ্যে দুজনের মায়া হলো। আমাদের কে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে রাজি হলো। ওদের নিয়ে জাহাজে ফিরে আসলাম। কখনো খালের ডান পাশ, কখনো বাম পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে আমরা চলছি। এতক্ষণ না বুঝে বোকার মতো মাঝখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে আমরা মানে আমাদের বাহন বঙ্গোপসাগরে। নতুন গাইডদ্বয়ের পরামর্শ মতে আস্তে আস্তে জাহাজ এগুতে থাকল।
ঘড়িতে প্রায় সকাল দশটা। সবাই নামার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। আমি আর রাশেদ নতুন গাইড মোতাহার আর কালাম সর্দারসহ জাহাজের ব্রিজে। চারদিকেই ডুবো চর। খুব সতর্কতার সাথে জাহাজের ডানে আর বামে বাঁশ ফেলে পানি মেপে মেপে আমরা ততক্ষণে মাঝ সমুদ্রে। ঘণ্টা দুয়েক চলার পর ওদের দেখানাে পথে তাকিয়ে দেখলাম- মাইল খানেক দূরে সাধের কটকা দেখা যাচ্ছে। মনের আনন্দে প্যাকেটের শেষ সিগারেটটায় আগুন ধরালাম। দু’এক টান দিয়েছি মাত্র! টের পেলাম, আস্তে করে জাহাজের তলা ঠেকে গেল মাটিতে। হায় হায় করে উঠল নতুন গাইড দু’জন। সারেং কে বকা দিচ্ছে। ওদের কথা শুনতে পাচ্ছি- ‘আপনাকে বললাম, জাহাজ ডানে ঘোরাতে। আপনি বায়ে ঘোরালেন ক্যান? এখন তো আটকে গেলেন!’ রাগে গজ গজ করছে ওরা। ঘড়িতে বেলা বারোটা বেজে দশ মিনিট। আর আমাদের বেজে গেছে বারো দুগুণে চব্বিশটা!
তিন তলা থেকে নীচে নেমে আসলাম। সবাই জানতে চাইছে, কী হয়েছে? কাউকে কিছু না বলে মাইক্রোফোনটা হাতে তুলে নিলাম। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
‘আমরা বঙ্গোপসাগরের নাম না জানা চরে আটকে গেছি। এখান থেকে ছাড়া পাবার জন্য জোয়ারের অপেক্ষা করা ছাড়া বিকল্প নেই। জোয়ার আসার আগে আমরা আমাদের সাথে থাকা দুটো নৌকায় চড়ে ত্রিশ জন করে করে কয়েকবারে কটকা ঘুরে আসতে পারি। কে হবেন সে প্রথম ত্রিশ জন?’
আমার কথা শেষ হবার আগেই সবাই একসাথে নৌকার দিকে দৌড়াল। আমি যতই বলি, ত্রিশ জনের বেশি একসাথে যাওয়া যাবে না- ততই বাকিরা উত্তেজিত হয়ে উঠে। এক পর্যায়ে দশ-বারোজন যাত্রী বিদ্রোহী হয়ে উঠল। ঘোষণা দিল, সবাই একসাথে যেতে পারলে যাবে- নতুবা কেউ যাবে না। লে হালুয়া! তাহলে তো জোয়ার আসার আগে কারোরই যাওয়া হবে না…। জোয়ার আসতে কমপক্ষে ছয়-সাত ঘণ্টা।
বিদ্রোহী কয়েক জনের কারণে অভিযাত্রীরা নিজেদের মধ্যেই দুই ভাগ হয়ে গেল। নীচে নামতে না পাবার কারণে মন-টন খারাপ করে সবাই যে যার রুমের দিকে গেল। নীচে দুপুরের খাবারের আয়োজন চলছে। আমি, রাশেদসহ রুমে বসে জোয়ারের অপেক্ষা করছি। হঠাৎ সমবেত কণ্ঠের চিৎকার শুনে আতঙ্কে বাইরে বেরিয়ে এসে যা দেখলাম…! সেটা যারা সেদিন আমাদের সাথে ছিলেন না, তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে। আমাদের জাহাজের বামদিকে অন্তত পাঁচশো গজ এলাকায় একরত্তি পানি নেই। শুধু ভেজা বালি আর বালি। জাহাজের তলায় প্রফেলর দেখা যাচ্ছে। অতি সাহসী দু’চারজন লাফ দিয়ে বালিতে নেমে পড়েছে। মিনিট দশেকের মধ্যে জাহাজের প্রায় সবাই নেমে গেল বালুর চরে…। আমাদের শিল্পী বন্ধু রাশেদ আর রিয়াজ তাদের সাথে আনা ইভেন্টের কাপড়-টাপড় নিয়ে নেমে পড়ল জাহাজ থেকে। সবাই ধরাধরি করে ইভেন্টের কাজ শুরু করে দিল বালুতে। যা আমাদের করার কথা ছিলো কটকা বিচে…। আনন্দে নাচছে সবাই। মাটিতে নামতে পারার কারণে না বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে চরে নামতে পারার কারণে, সেটা গবেষণার বিষয়। আপাতত বিদ্রোহ দূর হয়েছে দেখে আমিও আনন্দিত। নতুন প্যাকেট থেকে সিগারেট ধরালাম…।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। খাবারের জন্য জুয়েল বারবার মাইকে ঘোষণা দিচ্ছে। কে শোনে কার কথা! কেউ মাটি ছেড়ে জাহাজে উঠতে রাজি নয়। অবশেষে ধীরে ধীরে জোয়ারের পানি আসা শুরু হলো। মুখ কালো করে সবাই জাহাজে উঠতে শুরু করল। রুই মাছ ভাজি, সবজি আর ডাল দিয়ে খেয়ে নিল সবাই। বাইরে ভীষণ ঠান্ডা বাতাস। এর মধ্যে টুক করে ডুবে গেল বছরের প্রথম দিনের সূর্য। কটকাতেই রাত্রী যাপন করব। মাঝসমুদ্র খুব বেশি নিরাপদ নয়। এমনিতেই একটা দিন চলে গেছে। অদূরের কটকাতে দুটো জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলোর আলো দেখা যাচ্ছে। ওখানটাই আপাতত আমাদের গন্তব্য। এখান থেকে বড়ো জোর আধা ঘণ্টা লাগবে। জাহাজের আলো দেখা যাচ্ছে। এখন শুধু পরিপূর্ণ জোয়ারের অপেক্ষায়…
জাহাজ চলার মতো জোয়ার এলো রাত নয়টায়। আমরা রওয়ানা হলাম কটকার পথে। ওখানে নোঙ্গর করা জাহাজের বাতি দেখে ধীরে ধীরে এগােচ্ছে আমাদের জাহাজ। বাইরে ঠান্ডার পাশাপাশি তীব্র কুয়াশা। জাহাজের বাতি দেখা যায়, আবার যায় না। জাহাজের ব্রিজে আমি, রাশেদ আর আমাদের গাইড মোতাহার। জাহাজের ডান আর বাম থেকে আওয়াজ আসছে- এক বাঁও, এক হাত… এক বাঁও, ২ হাত….। পানি মাপছে জাহাজের লোকেরা। না চলার মতো করে চলছে জাহাজ। বামে পানি কমতে শুরু করল। জাহাজ ডানে ঘুরলো। এতটাই ঘুরলো যে, কিছুক্ষণ পর আর অন্য জাহাজের বাতি দেখতে পাচ্ছিলাম না। বাইনোকুলার দিয়েও কিছু দেখা যাচ্ছিল না। খালি চোখে তো নয়ই। আবার অথৈ সাগরে। ঠান্ডায় জমে যাবার দশা আমাদের। একটার পর একটা সিগারেট ধরাচ্ছি। অবশেষে আমাদের গাইড মোতাহারের চোখে জাহাজের লাইট ধরা পড়ল। আমরা অন্যরা কিছুই দেখছি না। ওর উপর ভরসা করতেই হলো। আস্তে আস্তে জাহাজের মুখ ঘুরানো হলো বাঁয়ে। কটকায় অন্য জাহাজের কাছে আমরা যখোন পৌঁছলাম, রাত তখন প্রায় এগারোটা। জাহাজের নোঙর ফেলা হলো। আমরা নীচে নেমে খেয়ে নিলাম।
নোঙর করা তিনটা জাহাজের মধ্যে দুইটা জাহাজের মাস্টারের সাথে কথা বলে এলাম। তাদের একজন যাবেন একদিন পর। বাকিজন ভোর চারটায় রওয়ানা হবেন। তার পেছন পেছন আমরা যাব, বলে এলাম। তার কোনো আপত্তি নেই। আমাদের জাহাজে ফিরে এসে সুকানীকে বললাম- ভোর চারটায় যেন রওয়ানা করে। ওই জাহাজের পেছন পেছন। তাহলে আর পথ হারানোর কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। জাহাজের ম্যানেজার, সুকানী আর মাস্টারকে সব বুঝিয়ে দিয়ে ঘুমাতে গেলাম রাত দুইটার দিকে। ওদের ডাকে ঘুম ভাঙল।
জাহাজ মাত্র ছেড়েছি- বললেন ম্যানেজার। ঠিক আছে বলে মোবাইলের ঘড়িতে দেখলাম- ভোর চারটা বেজে দশ মিনিট। সব্বোনাশ ! ওই জাহাজ ছেড়েছে দশ মিনিট আগে। তার মানে আবার পথ হারাব আমরা। দৌড়ে ব্রিজে উঠে এলাম। সুকানীকে বললাম- ওই জাহাজটা কতদূর? বেটা নির্বিকারভাবে বলল, সামনে কোথাও…। ওর কথা শুনে পিত্তি জ্বলে গেল। কী বলব? ডান-বাম-সামনে-পিছে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু ঘন কুয়াশা। হাল ছেড়ে দিলাম। মিনিট পনেরো চলার পর জাহাজ থেমে গেল। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আর যেতে পারবে না। রোদ ওঠার অপেক্ষায় থাকতে হবে। তারপর রাস্তা দেখে এগোবে…
রোদ খানিকটা ঠিকই উঠল। কিন্তু কুয়াশা আর কমে না। দশ হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। সকাল দশটা নাগাদ একটু একটু করে চারপাশ পরিস্কার হলো। আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। ঘণ্টাখানেক বাদে আমরা সাগরকে একপাশে ফেলে তীরের দিকে এগােলাম। পশুর নদীতে ঢুকলাম। ডান আর বামে সুন্দরবনের গাছপালা। সে এক অন্যরকম সুন্দর! দেখার জন্য জাহাজের সবাই ছাদে উঠে গেল।
আশেপাশে বন দেখার পর সবার মধ্যে স্বস্তি ফিরে এলাে। এখন যে আমরা সঠিক পথ ধরে আগাচ্ছি, সেটা সবাই বুঝে গেছে। এখান থেকে মংলা যেতে আমাদের সময় লাগবে তিন ঘণ্টার মতো। নীচে নেমে এলাম। এতক্ষণে টের পেয়েছি- প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। নাশতা সেরে নিলাম। একহাতে গরম চায়ের গ্লাস, অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। চায়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখলাম। তারপর মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে নাটকীয় ঘোষণা দিলাম-
`উৎসবে আগত সকল অভিযাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। এই জাহাজের স্ব-ঘোষিত ক্যাপ্টেন বলছি। আমরা ঠিকপথে জাহাজ নিয়ে ঢাকার পথে যাচ্ছি। চিন্তা করার কিছু নেই। আশা করছি দুপুর তিনটা নাগাদ আপনাদের ঘণ্টাখানেকের জন্য মাটিতে নামাতে পারব। ধন্যবাদ সবাইকে।’
এরপর কোনো রকম নতুন ঝামেলা ছাড়া বিকেল সাড়ে তিনটায় আমরা এসে করমজল নামক ট্যুরিস্ট স্পটের মাটিতে নামলাম। খানিক সময় ঘুরে আমাদের সাথে থাকা নৌকা এবং সাথে আরও দুটো বড়ো ট্রলার ভাড়া নিয়ে সবাই পাশের খাল দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বেশ কিছুটা বনের মধ্যে ঢুকে পড়লাম আমরা। মধু কিনল কেউ কেউ। সূর্যাস্তের বেশ কিছুটা আগেই সবাই জাহাজে ফিরে এলাে। পেটের অবস্থা কাহিল সবার। তখন দুপুরের খাবার খায়নি। পড়িমরি করে দুপুরের খাবার খেলো সন্ধ্যায়। সবার চোখে-মুখে তৃপ্তির ছাপ।
মংলা থেকে আমাদের জাহাজ পারাবত-১ যখন ঢাকার পথে ছাড়লো তখন রাত আটটা। এখান থেকে এক নাগাড়ে জাহাজ চালালে ঢাকা যেতে আমাদের সময় লাগবে বারো ঘণ্টার মতো। কাল ঢাকায় নেমে একটু দেরি হলেও সবাই অফিস করতে পারব। আমাদের এবারের গন্তব্য ঢাকা সদরঘাট।
—
দেশের বই পোর্টালে লেখা পাঠাবার ঠিকানা : desherboi@gmail.com
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD