কলমটা হাতের কাছে খুঁজে পাচ্ছে না তন্ময়। অথচ মাথার ভেতর একগুচ্ছ শব্দ এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বের করে ঠিকঠাক সাজাতে পারলেই হয়ে যায় দুর্দন্ত কবিতা। সব সময় যা হয়, দরকারের সময় দরকারি জিনিসটা হাতের কাছে পাওয়া যায় না। অন্যদিন কলমটা ঠিকই থাকে, কিন্তু কাজ থাকে না, লেখার মত মন থাকে না, আজ হয়েছে উল্টোটা। সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজেও কলমটা পাওয়া গেলো না। বিরক্ত হয়ে বৌকে ডাকে।
-শ্রাবণী, আমার কলমটা কোথায়? কলমটা খুঁজে পাচ্ছি না।
-তোমার কলম রান্না ঘরে, আমি নিয়ে তরকারি কুটছি। এসে নিয়ে যাও! সুললিত কণ্ঠের জবাব ভেসে আসে।
-আহ্, ঠাট্টা করো না প্লিজ। কিছু শব্দ এসেছে মাথায়। একদম নতুন বর্ষার জলে মাছের ঝাঁকের মতো, ধরে তুলতে না পারলে গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যাবে।
-ভাল করে খুঁজে দেখো, পড়ার ঘরেই আছে।
ঠিক তাই। পুরাতন ডাইরির ভেতর কলমটা খুঁজে পায় তন্ময়। কলম নিয়ে তাড়াতাড়ি লেখে-
‘জলের গভীরে আমি ফেলে রাখি অমৃত ভাণ্ডার,
নিয়ে যাও তোমাদের প্রয়োজন আছে যার।
সবটুকু নিয়ে যাও একদিন হারায় যে সব,
অজস্র শব্দমালা হারিয়ে যায়, যখন কাছে না থাকে লেখার কলম’।
কিছুক্ষণ আগে হারিয়ে যাওয়া কলমটাও জুড়ে দেয় নতুন কবিতার গায়। তারপরই এলোমেলো হয়ে যায় সব। হঠাৎ পাওয়া শব্দটা জুড়ে দিয়ে তার সাথে মিল রেখে আর কোনো নতুন শব্দ মাথায় আসে না। সব খেই হারিয়ে ফেলে। কিছুক্ষণ আগেও কিছু দারুণ শব্দ মাথায় এসেছিল, তা আর খুঁজে পায় না তন্ময়। অথচ অনেকগুলো পত্রিকার লেখা দেওয়ার তাগিদ রয়েছে। এক পত্রিকার সম্পাদকের সাথে পরিচয় হয়েছে, তিনি বলেছেন, কিছু কবিতা দিয়ে যান, আমি দেখবো। নতুন কবি হিসেবে উৎসাহের জন্যও পত্রিকায় লেখা ছাপা হওয়ার একটা তাগিদ অনুভব করে। আর পেশা হিসেবে যখন লেখাকেই বেছে নিয়েছে, তখন লিখতে তো হবেই।
আর লিখতে না পেরে লেখা ছেড়ে রান্নাঘরে ঢোকে তন্ময়। কেয়া তখন সকালের নাশতা তৈরিতে ব্যস্ত। সকালে সাধারণত রুটি আর আলু অথবা ডিমভাজি আর ডাল। মাঝে মাঝে খিচুড়ি। খুবই ব্যস্ত সময় কাটে কেয়ার, বিশেষ করে সকালটা। তন্ময় প্রতিদিন আটটায় বাসা থেকে বের হয়। ভোরে উঠে একটা বিস্কুট আর চা খেয়ে তন্ময় চলে যায় শুভ্রকে স্কুলে দিয়ে আসতে। শুভ্র পড়ে একটা কিন্ডারগার্টেনে, বাসার পাশেই। অথবা বলা চলে, বাসাটা নেওয়াই হয়েছে শুভ্রর স্কুলটা কাছে বলে। স্কুলে দিয়ে এসে বসার ঘরে লেখা বা পড়া নিয়ে বসে, কেয়া তখন রান্নাঘরে। সকালের নাশতা শেষ হলে দুজন একত্রে বের হয়, কেয়া যায় শুভ্রকে আনতে, তন্ময় যায় অফিসে। নতুন একটা পত্রিকায় সবে কাজ নিয়েছে সে। বার্তা বিভাগে, সাংবাদিকদের পাঠানো খবরগুলো সম্পাদনা করে বার্তাসম্পাদকের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া তার কাজ। ওদের সেকশনে আরও তিনজন আছে। এভাবেই যে দিনটা শুরু হয়, তা শেষ হয় রাত দশটারও পর।
এখন হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে ঢুকতেই জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় কেয়া-
-কি চাই?
-কিছু না, লেখাটা মাথায় আসছে না।
-আমি দেবো?
-না, ভাবলাম, তোমাকে দেখলে যদি আসে!
-শোন, বৌকে দেখে কবিতা আসে না, কবিতা আসে মানসীকে দেখে!
-তুমিই তো আমার মানসী!
ততক্ষণে মাথাটা আবার সচল হয়, কিছু শব্দ মনে আসে। ফিরে আসে লেখার টেবিলে।
‘কত স্মৃতি গিয়েছে হারায়, যেন গহন জলের মাছ,
মানসীর কপালের স্বেদবিন্দুর মতো চকচক করে
সহসাই হাওয়ায় মিলায়।
আমি তারে তুলে এনে রেখেছি সাজায়ে
আমার এই কবিতার খাতায়।
তবু কিছু অসচেতন মূহুর্তে
তোমাকে নিয়ে কত না মধুর স্মৃতি
কতবার গিয়েছে হারায়’।
রান্নাঘর থেকে তাগিদ দেয় কেয়া, তাড়াতাড়ি গোসল করে এসো, আমি নাশতা দিচ্ছি। অগত্যা লেখাটা অসমাপ্ত রেখেই গোসল করতে যায় তন্ময়।
শ্রাবণী ওর বউয়ের নাম নয়। বউয়ের নাম শারমীন সুলতানা কেয়া। বিয়ের পর একদিন বলে, তোমাকে যদি আমি মাঝে মাঝে অন্য কোনো নামে ডাকি, তুমি কিছু মনে করবে?
-কোন নামে?
-ধরো শ্রাবণী নামে, শ্রাবণে আমাদের বিয়ে হলো তো, তাই।
-আচ্ছা বেশ, তুমি ডেকো। যদি তোমার ভালো লাগে।
আসল কথাটা সেদিন বলতে পারেনি তাকে। কাউকেই বলেনি। একমাত্র মা জানে। সব কথা সবাইকে বলা যায় না। কিছু কথা থাকে হৃদয়ের গভীরে নীরব স্মৃতি হয়ে। তারপর সময় গড়ায়, আরও স্মৃতি জমা হয়। এভাবেই একদিন গহন অতলে চাপা পড়ে যায়। কিন্তু সব চাপা পড়লেও অন্ধকার খনিতে কালো কালো কয়লার স্তুপের মাঝে যেমন হীরের টুকরো দ্যুতি ছড়ায়, কিছু স্মৃতি তেমনই মনের মাঝে দ্যুতি ছড়াতে থাকে।
সেই শৈশবের সূচনালগ্নে আত্মীয়ের বাড়িতে দেখেছিল তাকে। তখন তন্ময়ের বয়স কত? বছর দশেক হবে হয়ত। সবে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। দূর সম্পর্কের এক মামার বাড়িতে গিয়েছিল মায়ের সাথে। সেখানে দেখেছিল ছোট্ট ফুটফুটে পুতুলের মতো একটা মেয়েকে। সে তখন শিশু, কত আর বছর পাঁচেক বয়স হবে। মুগ্ধ হয়ে হাত ধরেছিল।
-নাম কি তোমার?
-শ্যাবণী ! যেন শ্রাবণের ধারার মত ঝরে পড়ে শিশু কণ্ঠের মিষ্টি সুর।
-কি? শ্যাবণী? তার সেই আধো উচ্চারণে তার মুখে সেই নাম এক অপূর্ব ব্যঞ্জনা তোলে তন্ময়ের মনে।
শ্রাবণী ওর নাম। পাশ থেকে হাসিমুখে জবাব দেন শ্রাবণীর মা। এগিয়ে আসে তন্ময়ের মাও। কথা হয় তাদের। সকলে বিয়ের আনন্দে মশগুল থাকে। কেটে যায় কয়েকটা দিন। তন্ময় মগ্ন থাকে শ্রাবণীতে। সারাদিন দুজনে খেলা করে, কথা বলে। কত যে কথা তাদের, যেন শেষই হয়না। বিয়ে বাড়ি থেকে একদিনেই বিদায় নেয় তারা। তারপর ভাগ হয়ে যায় পথ। ভাগ হয়ে যাওয়ার সময় জেদ ধরে তন্ময়। মাকে বলে, শ্রাবণীকে নিয়ে চলো।
শ্রাবণীর মা বলে, এবার না, পরে একদিন যাব।
-না, আজই চলো।
-অনেক দিন আমরা বাড়ি থেকে এসেছি, ঠিক আছে যাবো তোমাদের বাড়ি।
-ঠিক আছে, শ্রাবণীকে দাও। ওকে নিয়ে যাব।
-আচ্ছা, তুই বড় হলে শ্রাবণীকে বউ করে নিয়ে আসব।
এভাবেই সেদিন অবুঝ কিশোরকে ভুলিয়ে বাড়ি আসে তারা। একসময় সকলেই ভুলে যায়, কিন্তু কিশোরের মনে দাগ কেটে যায়, বড় হলে বউ করে নিয়ে আসব। তার মর্মে গেঁথে যায় সেই কথা। উদাস কোন মূহুর্তে কিংবা একাকী কোনো ক্ষণে মনে পড়ে অনিন্দ্য সুন্দর সেই মুখ।
মনে আছে, ছোট কাকা একবার একটা পার্কার কলম কিনে দিয়েছিলেন, এতো সুন্দর ছিল সে কলম। কলম পেয়ে খুশিতে কি লিখবে ভেবে পায় না। তারপর গোটা গোটা অক্ষরে লেখে, শ্রাবণী! ব্যস আর কিছু না। কলমটা বন্ধুদের দেখাতে উদগ্রীব তখন ও। স্কুলে গিয়ে ক্লাস শুরুর আগে বন্ধুদের দেখায়। কাগজে সুন্দর দাঁগ টেনে দেখায়। কিন্তু আর কিছু লেখা হয় না। ক্লাস শুরু হলে শিক্ষককে কলমটা দেখায়। তিনি কলমটা দেখে ভীষণ প্রশংসা করেন। এ তল্লাটে কারো এতো দামি কলম নাই বলে জানান। তন্ময়কে বলেন, কলমটা সাবধানে রাখবি। আর লিখবি। মানুষের শক্তি থাকে মনে। তা কলমে লিখে প্রকাশ করতে হয়। কলম হলো তরবারির মতো। এর শক্তি অসীম।
সেই থেকে তন্ময় কলমটাকে অতি যত্নে আগলে রাখে। স্কুলে নেয় না। বাড়িতেই লেখে। কিন্তু পরীক্ষার সময় সে ঠিকই কলম নিয়ে আসে। পরীক্ষা শেষ হলে বন্ধুরা সবাই খেলায় মেতে ওঠে। এসময় সুখেন বলে, সে খেলবে না। ওরা সকলেই সুখেনের কাছে কলম দিয়ে খেলতে নামে। খেলতে খেলতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। তখন খেলা বন্ধ করে বাড়ির দিকে রওনা হয়। কলমের কথা মনে থাকে না। বাড়ি গিয়ে মনে পড়ে, কলমতো সুখেনের কাছে। চিন্তায় চিন্তায় ঘুম হয় না। শুধুই মনে হয়, কলম ফেরত পাবেতো? ভাবে, রাতেই সুখেনদের বাড়ি যাবে। কিন্তু ওদের বাড়ি অনেক দূরে। স্কুল থেকে উত্তর দিকে। একবার মনে হয়, ছোট কাকাকে বলে, আবার ভাবে, বললে যদি বকে। সে রাতটি নিদারুণ উৎকণ্ঠায় কাটে।
পরদিন একটু আগেই স্কুলে যায়। কিন্তু তখনও সুখেন স্কুলে আসে নাই। আবার সেই উৎকণ্ঠা তাকে পোড়াতে থাকে। ভাবে, সুখেন আসবে তো?
একসময় সুখেন আসে। ওকে দেখে ছুটে যায় তন্ময়।
আমার কলম দে!
কলম? কোন কলম? যেন আকাশ থেকে পড়ে সুখেন!
কাল তোর কাছে কলম দিয়ে খেললাম যে!
খেলা শেষে কলম নিয়ে নিলি তো!
না, নিইনি। আমি ভুলে গেছিলাম।
না, না, আমি কলম দিয়ে দিয়েছি।
পরিস্কার মিথ্যে বলল সুখেন। অথচ কাউকে কিছু বলতেও পারছে না তন্ময়। সবাই যখন জানবে, বিশেষ করে ছোট কাকা জানলে ওকে ঠিক মারবে। তাই কাউকে কিছু না বলে নীরবেই কলম হারানোর কষ্টটা সহ্য করে। এই কলম দিয়েই শ্রাবণীর নাম লিখেছিল সে।
তারপর কত সময় চলে গেছে। আস্তে আস্তে ভুলে গেছে সব। বাস্তবতার কাছে আমাদের কল্পনাগুলো হেরে যায়। সময়ের সাথে সাথে মানুষ বদলায়। আজকের শিশু একদিন কিশোর, তারপর যুবক হয়। তার বিয়ের কথা হয়। মা একদিন বিয়ের জন্য মেয়ে দেখার কথা বললে তন্ময় বলে, মেয়ে দেখার দরকার কি? মেয়ে তো দেখাই আছে।
-মানে?
-কেন, শ্রাবণীকে তুমি দেখোনি?
-কোন শ্রাবণী?
-সেই যে মামাবাড়ি বিয়েতে গিয়ে দেখেছিলে? বলেছিলে বউ করে এনে দেবে?
-তুই তাকে মনে রেখেছিস? মা অবাক হয়ে যান।
-আমার সেই পার্কার কলমটার কথা মনে আছে মা? ঐ কলম দিয়ে শ্রাবণী নাম লিখেছিলাম।
মা শ্রাবণীর খবর নেয়। যে খবর আসে তাতে যেন তন্ময়ের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। সেই সূদুর কৈশোর থেকে যে নাম লিখে রেখেছিল কাগজে, যে কলমে লিখেছিল, সেই কলমের মতো সেই নামও হারিয়ে গেছে। সেই ছোটবেলাতেই শ্রাবণী পানিতে ডুবে মারা গিয়েছে!
খবর শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় তন্ময়। এক অদৃশ্য ব্যথা তাকে যেন বিবশ করে দেয়। সে কোনো কিছুতেই স্বস্তি পায় না। এক সীমাহীন কষ্ট মুহ্যমান করে দেয়। বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায় তন্ময়। কিন্তু মায়ের একমাত্র ছেলে, অনেক অনুনয় করে তাকে বিয়েতে রাজি করায়। বিয়ের পর কেয়াকে তাই শ্রাবণী বলে ডাকে ও। শ্রাবণী যেন কেয়ার মাঝেই বেঁচে থাকে । কেয়াকে শ্রাবণীর কথা সব বলেছে তন্ময়। সেই হারানো কলমে লেখা নামটাকে হারাতে না দেওয়ার এক ব্যর্থ প্রয়াস।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD