মামলা

রবিবার, ২৪ জানুয়ারি ২০২১ | ৫:৪৮ অপরাহ্ণ | 533 বার

মামলা

দারুণ ব্যস্ত উকিল সাহেব। কারও সাথে ঠিকমত কথা বলারও যেন সময় নেই তার। আমার মামলা করার বিষয়ে কথাবার্তা বলার মাঝখানেই তার সেলফোনে আসছে ঘন ঘন কল। মামলা বিষয়ক এসব বিভিন্ন খুঁটিনাটি পয়েন্ট নিয়ে আলাপ আলোচনার মাঝপথে আসা এসব বিভিন্ন লোকের ফোনকল রিসিভ করে আবার আমার সাথে দুচার কথা বলতে না বলতেই আবারও বেজে উঠছে তার সেলফোনের রিংটোন। আবারও তাই বাধ্য হয়ে আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে ফোন রিসিভ করতে হয় তাকে।

 

মামলা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ এসব আলোচনার মাঝখানে এরূপ ঘন ঘন ফোনকলের বাঁধাতে অস্বস্তি বোধ করি, তার সাথে ঠিক মতো কথা বলার সুযোগও নেই দেখে মনে মনে বিরক্ত বোধ করি! কিন্তু করার কিছু নেই। তবে দারুণ এক করিৎকর্মা উকিলের কাছেই আমাকে পাঠিয়েছেন আমার বন্ধু মহোদয়- এই সময়টুকুর মধ্যেই এই বিষয়টি বেশ বুঝে যাওয়ায় বিরক্তি চেপে রেখে নিরুপায়ভাবে অপেক্ষা করতে থাকি। অন্য উকিলের মতো ইনি বাটপার নন বলেই মনে হচ্ছে, তার টেলিফোনিক ব্যস্ততায় এবং কথাবার্তায়। সুতরাং ভরসাও পাচ্ছি যে, আমার কাজ হবে।

ফোনে কথা বলেন উকিল সাহেব- ‘হ্যাঁ, বলছি বলুন। কোন কেস? ও আচ্ছা! ঐ যে ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যাওয়া ঘুষ নেবার, কম টাকা দেখে টাকা ফিরিয়ে দেবার, ড্রয়ারে রাখা ঘুষের টাকা নিয়ে প্যান্টের পকেটে রাখা… ঐ কেস তো? আচ্ছা আচ্ছা। কে বলেছে আপনাকে আমার কথা? না, জানতে চাচ্ছি যে, আমার মোবাইল নাম্বার কার কাছ থেকে পেয়েছেন। ও আচ্ছা। হ্যাঁ হ্যাঁ হবে, হয়ে যাবে। স্টে অর্ডার হয়ে যাবে, কোন সমস্যা নাই। পাঠিয়ে দিন। আচ্ছা, ঠিক আছে। আরে না না। কোন চিন্তা নাই, স্টে অর্ডার হয়ে যাবে, বললাম তো। আরে, কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে- এসব বিষয়ে আপনার তো চিন্তার কারণ নেই। উনি আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন- এটাই বড় কথা। এ বিষয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। এখন চিন্তা আমার। আরে, ওনাকে একদম টেনশন করতে মানা করে দেন, কোন টেনশন নাই.. বললাম তো, স্টে অর্ডার হয়ে যাবে, চাকরিতে সাত দিনের মধ্যেই জয়েন করবে ইনশাল্লাহ…’।

এরপরে আমার সাথে আগের সূত্রধরে আবার পরবর্তি আলাপ শুরু করেন। আবার ফোন আসে। আবারও ফোন ধরেন তিনি- ‘হ্যালো, জ্বি। বলছি, বলুন। ও আচ্ছা। আমার কথা কে বলেছে আপনাকে? ও আচ্ছা। আমার না সময় খুব কম। একটু খোলাসা করে বলুন। কি কেস? ফেন্সিডিল, নাকি… ইয়াবা…? ও আচ্ছা! হাতেনাতে ধরেছে? ও! গাড়ি থেকে সরাসরি মাল বের করে জব্দ করেছে! আচ্ছা, আচ্ছা! কতগুলো মাল উদ্ধার করেছে? আচ্ছা! কতদিন জেলে আছে? ২৪ দিন। আচ্ছা, সমস্যা নাই। জামিন হয়ে যাবে… হ্যাঁ হ্যাঁ। বললাম তো- জামিন হবে। জামিন করে দেব। কোনো সমস্যা নাই। একদিনেই জামিন করে দেব। হ্যাঁ হ্যাঁ। কো সমস্যা নাই। তবে খরচটা কিন্তু বেশি লাগবে। আচ্ছা, ঠিক আছে, চলে আসুন… কালকে। তবে দুপুর একটার পরে আসবেন। একটা পর্যন্ত কোর্ট। একটা পর্যন্ত কোর্টে থাকি। তাই একটার পরে আসবেন। হ্যাঁ। সব কাগজপত্র নিয়ে আসবেন…’

কথার মাঝখানে আবারও ফোন আসে। ‘দাদা, স্যরি’ বলে আবারও ফোন রিসিভ করেন উকিল সাহেব – ‘কে বলছেন? হ্যাঁ, বলছি, বলেন। রেপ কেস। আচ্ছা। ঠিক আছে। কোনো সমস্যা নাই, জামিন করা যাবে। কাগজপত্র সব নিয়ে আসেন…’।

আমার বিষয়ে আলোচনা আর শেষ করে উঠতে পারি না। এর মধ্যে চা আসে। চা খেতে থাকি। উকিল সাহেবের একটির পরে একটি ফোন আসতে থাকে, আর তিনি একটির পর একটি ফোন ধরে কথা বলতেই থাকেন।

ইয়াং উকিল। লম্বা ছিপছিপে উজ্বল ফর্সা চেহারা। এসি রুমে থেকে থেকে চেহারার রোশনাই যেন আরও ফুটে উঠে এক গ্ল্যামার জেগে উঠেছে তার চোখে মুখে।

তার বসার রুমের চতুর্দিকে বইয়ের তাক। বই আর মামলার ফাইলের স্তুপ। আশেপাশে দুই তিনজন হেলপার, পিয়ন। তিনি বেশিরভাগই রীটের মামলা নিয়ে ব্যস্ত। সুনাম আছে তার রীট মামলায়।

দুদিন হল তার কাছে একটি মামলার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে আসছি একজনের রেফারেন্সে। এর মধ্যেই তার সাথে একটু জানাশোনা হয়ে গেছে। পরিচয় জানার পর একটু খাতির করছেন আমাকে। তিনি নিজেও বেশ আলাপি আর খোলামেলা মানুষ।
আলাপে আলাপে তাই এক সময় বলেই ফেলি- ‘ভাই, মনে কিছু করবেন না, একটা কথা বলি…’
‘বলেন, সমস্যা নাই, খোলাখুলি বলেন…’।
‘না, মানে মনে কিছু করবেন না। আমার একটু জানতে ইচ্ছে করছে যে, এই যে আপনি ঘুষখোর, চোরাচালানকারি, ধর্ষক এসব সমাজবিরোধী অপরাধীদের মামলা নিচ্ছেন, কেনো নিচ্ছেন? আপনার তো মামলার সংখ্যা কম না। লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করছেন, সুনামও কম না। আপনার সামাজিক দায়িত্ববোধ ন্যায়বোধ এসব কি মনে দাগ কাটে না’?

কোন রকম মাইন্ড না করে হা হা করে হাসেন দিলখোলা তরুণ উকিল সাহেব। বলেন, ‘দাদা, ওকালতিতে নীতিবোধ বা বিবেক বলে কিছু থাকতে নেই। যারাই বিপদে পড়ে আমার কাছে আসবেন, তাদের সবাইকেই সাহায্য করা একজন উকিল হিসেবে আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। দেখেন না, খুন করেছে জেনেও কোনো না কোনো উকিল তো সেই খুনির পক্ষে দাঁড়ান, জেনেশুনে আদালতে দাঁড়িয়ে সেই খুনিকে নির্দোষ প্রমাণে প্রাণপন চেষ্টা করেন, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। আমিও তাই করি’।

‘কিন্তু এই যে ঘুষ নেবার ভিডিও ভাইরাল হয়ে যাবার কেসটি আপনি নিলেন, ভিডিও তো একটা দারুণ প্রমাণ। সারাদেশ তোলপাড়। তাকে তার ডিপার্টমেন্ট সাসপেন্ড করেছে। সে সাসপেন্সন উইথড্র করবেন কীভাবে? কীভাবে প্রমাণ করবেন- তিনি নির্দোষ?

আবারও হা হা করে হাসেন উকিল। বলেন, ‘শোনেন, ছবি, ভিডিও এডিট হয় না? আমি কোর্টকে জানাব যে, তার সাথে তার আত্মীয় স্বজনের শত্রুতা আছে। তারাই এই লোককে বিপদে ফেলতে এই ভিডিওটি এডিট করে ফেসবুকে ছেড়ে দিয়েছে। তিনি পরিস্থিতি এবং ষড়যন্ত্রের শিকার। আইন কিন্তু ভিকটিমের পক্ষে। এ ক্ষেত্রে তিনি ভিকটিম। তিনি কোনো রকম ঘুষ নেন নাই। ভিডিও এডিট করে আমার মক্কেলকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে। তাহলে…? তাই তিনি জামিন পাবেন…’।

আমার দিকে তাঁকিয়ে মিটমিট করে হাসতে হাসতে তিনি প্রশ্ন করেন- ‘এখন আপনি যদি বিচারক হতেন, আপনি এই যুক্তিতে কি করতেন? এখন তো ডিজিটাল যুগ। কত ফটো এভাবে এডিট করে ফেসবুকে দেয়া হচ্ছে। কত ভিডিও এডিট করা হচ্ছে। আমার ক্লায়েন্টের ক্ষেত্রেও যে এডিট করে এটি ফেসবুকে দেয়া হয় নাই- তার প্রমাণ কি? আরে ওয়ান ইলেভেনের সময়ে ঘুষ নিতে গিয়ে আর্মিদের হাতে, দুদকের জালে ‘হাতেনাতে’ ধরাপড়া অফিসারেরা পর্যন্ত চাকরি ফিরে পেয়ে পদোন্নতি নিয়ে ডাটের মাথায় চাকুরি করে যাচ্ছে- আর এসব তো চুনোপুটি কেস…’।


দেশের বই পোর্টালে লেখা ও খবর পাঠাবার ঠিকানা : desherboi@gmail.com

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD