হাসান তারেক চৌধুরী
জীবনের চেয়ে বড় একজন মানুষের আজ পার্থিব জীবনের অবসান ঘটলো। তিনি কাজী আনোয়ার হোসেন। তাঁর মতো একজন মানুষের বেঁচে থাকার জন্য নশ্বর দেহের প্রয়োজন নেই, তিনি বাস করেন পাঠকের মনে ও অগণিত ভক্তের হৃদয়ে। তাই বুঝি আমাদের ছেড়ে গেলেন এভাবেই।
তাঁকে নিয়ে বিতর্ক হয়েছে প্রচুর। দুর্মুখের অভাব নেই এ জগতে। কিন্তু তাতে তাঁর বা তাঁকে যারা চেনে, তাদের কিছুই আসে যায় না। তিনি “মাসুদ রানা” চরিত্রের স্রষ্টা, কুয়াশা নামের আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্রও তাঁর তৈরি। লিখেছেন এই চরিত্র নিয়ে ৭৬টি বই। শামসুদ্দীন নওয়াব ছদ্মনামে অনুবাদ করেছেন জুলভার্নের বইগুলো, বিদ্যুৎ মিত্র ছদ্মনামে লিখেছেন আত্মউন্নয়ন সিরিজের বই। শুধু তাই নয়, অনুবাদ করেছেন অনেক ক্লাসিক সাহিত্য। এ-তো আমাদের কাজীদার লেখক সত্তা। আর কী কী তিনি করেছেন?
১) তিনি ও পরবর্তীকালে হুমায়ুন আহমেদ আমাদের শিখিয়েছেন, ভাষা নিয়ে কুস্তি না লড়ে, কীভাবে সরল ও সহজবোধ্যভাবে পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছানো যায়।
২) তিনি শিখিয়েছেন, বই সেলফে সাজিয়ে রাখার জন্য নয়, পড়ার জন্য। তাই তিনি বইয়ের সৌন্দর্যের চেয়ে বইয়ের খরচের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। বই প্রকাশ করেছেন পেপার ব্যাক কাভারে ও নিউজপ্রিন্ট কাগজে। পাঠক বই পেয়েছে সম্ভাব্য সবচেয়ে কম মূল্যে। দুই-তিন দিনের টিফিনের পয়সা থেকে বাঁচিয়ে আমি একটি সেবা প্রকাশনীর বই কিনতে পারতাম।
৩) তিনি শিখিয়েছেন কীভাবে বইয়ের ডিসট্রিবিউশন করতে হয়, পৌঁছাতে হয় পাঠকের দোরগোড়ায়। সক্রিয়ভাবে ব্যবসায়িক দেখভাল তিনি ছেড়েছেন বহুদিন আগেই। কিন্তু আজও টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, যে কোনো ছোট বইয়ের দোকানে, রাস্তার পাশের ছোট স্টলে, লঞ্চ, জাহাজ, বাস, রেলস্টেশন কোথায় পাওয়া যায় না সেবার বই? অবিশ্বাস্য!
৪) তিনি হাতে-কলমে প্রস্তুত করেছেন বিপুল সংখ্যক লেখক ও অনুবাদক, যারা আজও সাফল্যের সাথে লিখছেন এবং পাঠকের মন জয় করে চলেছেন।
৫) বই প্রকাশ করে কি তিনি উপার্জন করেননি? অবশ্যই করেছেন। প্রচুর উপার্জন করেছেন। কিন্তু সেটা কীভাবে? যেভাবে হওয়া উচিত। অল্প খরচে বই ছাপিয়ে বিপুল সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌছানো এবং অল্প অল্প মুনাফার যোগফলে বড় উপার্জন করা। যেসব প্রকাশকগণ আজও প্রকাশনা জগত নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, তাদের উচিত গভীর মনোযোগ দিয়ে তাঁর কাজের পদ্ধতি ও বই বিতরণ ব্যবস্থা অধ্যয়ন করা।
আমি কেন তাঁর এত ভক্ত? তাও বলি–
প্রথম যে বইটি আমার কিশোর মনে তোলপাড় তুলেছিল তার নাম “রহস্যের দ্বীপ”। শামসুদ্দীন নওয়াব ছদ্মনামে তিনি বইটি অনুবাদ করেছিলেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বইটি আমি প্রথম পড়েছিলাম। তারপর এক বছরে ওটা আরও পাঁচবার পড়ি। আমার পড়া প্রথম ক্লাসিক অনেকগুলো বই সেবা প্রকাশনীর অনুবাদ। এগুলোর মধ্যে আছে দ্য ওল্ড ম্যান অ্যা দ্য সী, প্রাইড অ্যান্ড প্রিজুডিস, অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট– এর মতো বই। কৈশোরে বই পড়ার যে এক উন্মত্ততা কাজী আনোয়ার হোসেন আমার ভেতরে জাগিয়ে তুলেছিলেন, পরবর্তীকালে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সেটায় পুষ্টি জুগিয়েছেন। আমি পাঠক হতে পেরেছিলাম বিশ্বসাহিত্যের অফুরান রত্ন-ভাণ্ডারের। একটি জীবন বা দুইটি জীবন এই ঋণ পরিশোধের জন্য যথেষ্ট নয়।
ওপারে ভালো থাকুন হে মহান মানব।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD