।। রয় অঞ্জন ।।
গনেশ টকিজ, ২৬৭, রবীন্দ্র স্মরণী, জোড়াসাঁকো, কলকাতা ০৭, সাদা সিঁথীর উপরে মেটে সিঁদূরে রং এর বাড়িটা আমার কাছে পূণ্যভূমি। অসুখে-বিসুখে আমার কলকাতায় যাবার সংখ্যা খুবই কম। কাজে অথবা ভ্রমণে। আগে কোলকাতায় গিয়ে একদিন অবসর পেলে জোড়াসাঁকো, দু’দিন পেলে শান্তিনিকেতন। জোড়াসাঁকোর এই অঞ্চলটির আগের নাম ছিল মেছুয়াবাজার। রাস্তার নাম ছিল চিত্পুর রোডের দ্বারকানাথ ঠাকুর লেন। গা ছমছমে এক উত্তেজনা নিয়ে প্রথম যেদিন প্রবেশ করেছিলাম, বছর সাতেক হবে। সেদিন আকাশ গলে নেমেছিল ঝিরঝিরে বৃষ্টি, কে জানে একেই পুষ্প বৃষ্টি বলে কি না। মন্দিরে পূজো দেয়ার মতো করে উপোস করেই গিয়েছিলাম। কাষ্ট আয়রণের বিশালে গেটের ওপাড়ে উর্দি পড়া কয়েকজন রক্ষী।
ডান পা আগে প্রবেশে মাংগলিকের লক্ষণ ভেবে ডান পা বাড়িয়েই ঢুকলাম। প্রথমবার মাটি ছোঁয়ার অনুভূতি প্রকাশে অপ্রতুল আমার জ্ঞানের পরিধি, বড্ড টের পাই আজও! সামনে সবুজে আচ্ছাদিত বড়োসড়ো চত্বর, কঞ্চির বেষ্টনীতে নানান প্রজাতির ফুলগাছ যেন চত্বরটাকে ‘পুস্পধাম’ সাজিয়ে রেখেছে। এত রং এর বোগেনভেলিয়া আগে কখনো দেখিনি। না এখানে এসে বোগেনভেলিয়া নামটা ঠিক আসছে না, মগজে জমে আছে গুরুদেবের নিজের দেয়া নাম বাগানবিলাস। এক মনোহর ল্যান্ডস্কেপ যেন! পুষ্পধামের ওপারে উঁচু বেদিতে স্মিতহাস্যে আবক্ষ হয়ে বসে আছেন আমার ‘মনমহাজন’। ফটকে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কড়জোরে প্রণাম জানাই অবচেতনভাবেই। ডানদিকে ঘুরলেই একটা লোহার শিকে আটকে রাখা গুরুদেবের কালো চিতাটা। WGF- 91কালো লিমুজিন, কত যুগ নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে কে জানে। গাড়িটি দেখেই এক অদ্ভুত শিহরণে অবশ হবার পালা!এই কিংবদন্তি গাড়িটি গুরুদেবের সাক্ষাৎ স্পর্শ পেয়েছে! খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, একবার ছুঁয়ে দেখি। সম্ভব হলাে না।
সে এক অদ্ভুত সম্মোহন! ইচ্ছে করলেও জুতোয় আওয়াজ উঠে না, গলা থেকে উচ্চস্বর বের হয় না, যেন ধ্যান না ভাংগার ফিসফিসানি শুধু। লন ধরে এগিয়ে বাম দিকে টিকিট ঘর। রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতের দস্তখত আজও বহন করছে টিকিটখানা। কী পবিত্র! কী প্রণম্য!। সিঁড়ি বেয়ে দু’তলায় উঠছি, নগ্ন পায়ে প্রবেশের রীতি আজও অলংগনীয়। দু’তলার যে কক্ষটিতে সবাই যখন প্রথমেই প্রবেশ করে, আমি করলাম অন্যটা। পা বাড়ালাম টানা বারান্দায়। মনের পাতা উলটে উলটে গুরুদেবের জীবনস্মৃতিতে লেখা কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে ঢেউ হয়ে যেন তীরে এসে ভিড়ছিল। না, কোনাে আছড়ানো, না কোনাে দুরন্তপনা, যেন তীরে এনে পৌঁছে দিয়ে গেল কথাগুলো ‘একদিন জোড়াসাঁকোর বাড়ির ছাদের উপর অপরাহ্ণের শেষে বেড়াইতেছিলাম। দিবাবসানের ম্লানিমার উপরে সূর্যাস্তের আভাটি জড়িত হইয়া সেদিনকার আসন্ন সন্ধ্যা আমার কাছে বিশেষভাবে মনোহর হইয়া প্রকাশ পাইয়াছিল। ভাবিতে লাগিলাম, পরিচিত জগতের উপর হইতে এই যে তুচ্ছতার আবরণ একেবারে উঠিয়া গেল এ কি কেবলমাত্র সায়াহ্নের আলোকসম্পাতের একটি জাদুমাত্র। কখনোই তা নয়।’ দক্ষিণের বারান্দাটা বেশি নষ্টালজিয়া করে দেয়, দক্ষিণের বারান্দা, যেখানে ছোটবেলায় কবি আতার বিচি পুঁতে রোজ জল দিতেন। আহা! পরম্পরার একটা আতা গাছ যদি পেতাম, একটু ছুঁয়ে দিতাম!
জয়রামের চার ছেলের মধ্যে নীলমনি ও দর্পনারায়ণের বংশই আজকের বিখ্যাত ঠাকুর পরিবার। নীলমনি ঠাকুরের নাতির নাতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৭৮৪ সালে চিত্পুর রোডের পূর্বদিকে, দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনে ‘সদর-অন্দর-দেউড়ি-দালানওয়ালা’ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির গৃহপ্রবেশ হয়। বাড়ির কর্তা নীলমণি ঠাকুরের বয়স ছিল তখন ৬০। দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের ৫ ও ৬ নং মিলে ছিল তখন ঠাকুর বাড়ি। ৫ নম্বরে বাড়িটিকে ‘ভদ্রাসন বাড়ি’ এবং ৬ নম্বরেরটাকে ‘বৈঠকখানা বাড়ি’ বলা হতাে। দুটি বাড়ির প্রবেশপথ ছিল একটাই। দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর উইল অনুসারে ৬ নম্বর বাড়িটি পান জ্যেষ্ঠ পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ও ৫ নম্বর বাড়ির মালিক হন গিরীন্দ্রনাথ। তবে ‘ভদ্রাসন বাড়ি’টি থাকলেও ৫ নম্বর দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের অবনীন্দ্রনাথের পিতামহ গিরীন্দ্রনাথের সেই বাড়িটি এখন আর নেই। সেটি আগেই নিলামে বিক্রি হয়ে যায়। বর্তমান বাড়িটির নাম‘মহর্ষি ভবন’।
মহর্ষি ভবনে দু’টি গ্যালারি, রেনেসাঁ ও অবনীন্দ্র গ্যালারি। তিন নম্বর ঘরে দ্বারকানাথের ব্যবহার্য জিনিসপত্র সাজানো। পাশে উপসনা কক্ষ নিয়ে চার নম্বর ঘরে থাকতেন দেবেন্দ্রনাথ। কবি সেই ঘর সম্পর্কে বলছেন, ‘… তাঁহার তেতলার ঘর বন্ধ থাকিত। খড়খড়ি খুলিয়া, হাত গলাইয়া, ছিটকিনি টানিয়া, দরজা খুলিতাম এবং তাঁহার ঘরের দক্ষিণ প্রান্তে একটি সোফা ছিল- সেইটিতে চুপ করিয়া পড়িয়া আমার মধ্যাহ্ন কাটিত। …’ নোবেল পুরস্কারের গ্যালারিটিও চমৎকার। গীতাঞ্জলি ও নোবেল পুরস্কারের ছোট ছোট গল্প ছাড়াও নাইটহুড বর্জনের কারণ বর্ণনা করে ইংরেজ সরকারকে লেখা পত্রটির কপিগুলো যেন আজও জীবন্ত। আহার ঘর, শয়ন কক্ষ, রাজা সাজার ঘর, দক্ষিণের বারান্দা, কবি পত্নির অন্তিম ঘর, এবং গুরুদেবের অগস্ত্য যাত্রার ঘরগুলো পেরোতে পা যেন জগদ্দল পাথরের মতাে ভারী হয়ে আসছিল, আঁতুড় ঘরে এসে একেবারেই থেমে গেলাম!
এখানে এসে রবীন্দ্রনাথকে আমারই রবীন্দ্রনাথ মনে হলাে কেন যেন! ঠাকুর বাড়ির এই ঘরটিকেই মনে হলাে আসল রত্ন গর্ভা। এই ঘরটি না থাকলে যেন আমার রবীন্দ্রনাথকে পেতাম না।
আচ্ছা, এই আঁতুর ঘরে দাঁড়িয়ে কেন ভারতী গোসাইকে মনে পড়ছে, আজ! নিমতলার আঁতুর ঘরটায় প্রবেশের আগে ভারতী গোসাই নাকি শচী রানীকে দৈববানীতে বলেছিলেন, “তোর ঘরে আসছে ভূবনকে মোহিত করতে এক শিশু, কিন্তু তুই তাকে ঘরে রাখতে পারবি না, জগদোদ্ধারে বেরিয়ে যাবে সে, সন্যাসে যাবে।” পিরালি ব্রাহ্মণ পত্নী সারোদা দেবীকেও কি আকাশের বৈশাখের মেঘহীণ পূর্ণ শশী এমন কোনাে দৈববানী শুনিয়েছিলেন, “বিশ্বে বাংলাকে উচ্চাসনে বসাতে আজ আসছে তোর চতুর্দশ সন্তান।” আজ কেন মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের সেই অমিত কবিতাখানি-
খোকা মাকে শুধায় ডেকে–
“এলেম আমি কোথা থেকে,
কোন্খানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে।’
মা শুনে কয় হেসে কেঁদে
খোকারে তার বুক বেঁধে–
“ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।
ছিলি আমার পুতুল-খেলায়,
প্রভাতে শিবপূজার বেলায়
তোরে আমি ভেঙেছি আর গড়েছি।
তুই আমার ঠাকুরের সনে
ছিলি পূজার সিংহাসনে।
শুভ জন্মদিন আমার মনমহাজন।”
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD