সাক্ষাতকার

যুগস্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন : সাহিত্যের রবিন হুড

বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারি ২০২২ | ৭:১২ অপরাহ্ণ | 664 বার

যুগস্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন : সাহিত্যের রবিন হুড

জাহাঙ্গীর হায়দার


 

“১৯৬৫ সালের মে মাসে ‘সেবা প্রকাশনী’ নামে ঢাকার একটা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘ধ্বংসপাহাড়’ নামে ‘এসপিওনাজ থ্রিলার’ ঘরানার একটি পেপারব্যাক বই নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছেপে স্বল্পমূল্যে প্রকাশ করে, যার মূল চরিত্র জাতীয় কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স’র অন্যতম সেরা স্পাই ‘মেজর (অবঃ) মাসুদ রানা’, এবং পাঠকপ্রিয়তা পাওয়ার কারণে স্বল্প সময়ে ‘মাসুদ রানা’ একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় সিরিজে পরিণত হয়।”

উপরের বাক্যটাতে যতটুকু তথ্যের উপাদান আছে তা নিয়ে গবেষণা করে যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস বিভাগের অনার্স বা মাস্টার্স ক্লাসে নিদেনপক্ষে একটা মৌলিক টার্ম পেপার করা সম্ভব। যেমন, বর্তমানে সুপ্রচলিত ব্যবসায় ধারণাগুলোর ভিত্তিতে বলা যায়:
১) ‘সেবা প্রকাশনী’ ছিল একটা ‘স্টার্টআপ’
২) সেই স্টার্টআপের ‘ইনোভেশন’ ছিল
– ‘এসপিওনাজ থ্রিলার’ যা ছিল তার ‘ইউনিক সার্ভিস’
– ‘পেপারব্যাক বই নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা’ যা ছিল ‘কস্ট এফিসিয়েন্সি’
– ‘স্বল্পমূল্যে প্রকাশ করা’ যা ছিল পাঠকদের জন্য ‘এ্যাফোর্ডাবিলিটি’
৩) ‘মাসুদ রানা’ ছিল ‘ব্র্যান্ড’
৪) ‘সিরিজ’ তৈরি করেছিল ‘লয়্যাল কাস্টমার’

 

এই যে বই প্রকাশ করে এতগুলো কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলা হলো, তার প্রতিটির সম্পূর্ণ কৃতিত্ব একজন মানুষের- কাজী আনোয়ার হোসেন। একজন প্রতিভাবান ইনোভেটর, সুলেখক এবং কুশলী উদ্যোক্তা।

বাংলা গদ্য সাহিত্য যেহেতু বিশ্ব গদ্য সাহিত্যে অনেক পরের সংযোজন, তাই বিশ্ব সাহিত্যের সব ঘরানার ছায়াই বাংলা সাহিত্যে পড়েছে, তবে কিছু পরে। সেই ধারাবাহিকতায় সেই সময়ে কাজী আনোয়ার হোসেন প্রথমবারের মতো এসপিওনাজ থ্রিলার পেশ করলেন বাঙালি পাঠকের সামনে, তাও একাধিক অভিনবত্বের মোড়কে। প্রথমত এসপিওনাজ থ্রিলার, যেখানে আছে একজন হিরো ও তার বস্সহ একটা টিম, দ্বিতীয়ত পটভূমি সারা দুনিয়া, তৃতীয়ত দারুণ টানটান উত্তেজনা আর অ্যাকশনে ভরা কাহিনি, চতুর্থত বই বের হলো স্বল্পমূল্যের পেপারব্যাকে, এবং, পঞ্চমত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার – বইয়ের প্রচ্ছদে ছাপা হলো ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’! হ্যাঁ, মাসুদ রানায় অ্যাডাল্ট কনটেন্ট ছিল।

 

কাজী আনোয়ার হোসেনের একক উদ্যমে সৃষ্ট এত অভিনবত্বের সমাহার বইয়ের জগতে একটা নতুনত্বের আর চমৎকারিত্বের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। পাঠকদের আপ্লুত করেছিল। তারা সাদরে, সানন্দে গ্রহণ করেছিল মাসুদ রানা’কে। এটাই তো সফল ‘ইনোভেশন’!
কিন্তু এটা তো ছিল কেবল শুরু!
সত্তর, আশি, নব্বই দশকের পাঠকমাত্রই জানেন মাসুদ রানা কি এবং কেমন। মনের পরতে পরতে দেশপ্রেম, কোষে কোষে সততা আর অণু পরমাণুতে ত্যাগ নিয়ে এই অকুতোভয় বীর বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছে মিশনের পর মিশনে। কখনো দেশ রক্ষার জন্য, কখনো দুনিয়া রক্ষার জন্য। আর রানা’র জীবন বাজি রাখা বিপদসংকুল মিশনের সাথে চলতে চলতে পাঠকের রক্ত টগবগ করে ফুটেছে। যতটুকু অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনায়, ঠিক ততটুকুই দেশের ভালো চেয়ে। মনে হয়েছে, ইশশ, আমিও যদি পারতাম!
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে বিটিভি’তে ‘ফেরা’ নামে একটা মিনি সিরিজের এক চরিত্র (অভিনয়ে ছিলেন আসাদুজ্জামান নূর) দেশের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বলেছিল, ‘আমার এক পকেটে এটম বোম, আরেক পকেটে মাসুদ রানা’। প্রজন্মের পর প্রজন্মের বুকে দেশের জন্য বিশুদ্ধ ভালোবাসার পাহাড় আর সাহসের দূর্গ তৈরি করেছে মাসুদ রানা, আর তার মিশন!
কিন্তু কেউ কি কখনো লক্ষ্য করেছেন, রানা একজন সরকারী কর্মকর্তা? কারো কি কখনো চোখে পড়েছে, রানা কাজ করে ‘কাউন্টার’ ইন্টেলিজেন্সে, অর্থাৎ তার সব মিশন দেশের প্রতিরক্ষার জন্য, কখনোই আগ বাড়িয়ে আক্রমণ করার জন্য নয়? তার মানে দাঁড়াচ্ছে দেশকে ভালোবাসা আর রক্ষা করা, সমাজকে সুন্দর করা, সততা ও মনুষ্যত্ব নিয়ে জীবনযাপন করা সবার দায়িত্ব, শুধু প্রতিবাদী জনতার নয়। পাশাপাশি পৃথিবীর বুকে শান্তিপ্রিয়, সহিষ্ণু ও দায়িত্ববান আচরণ করে নিজের দেশ ও তার মানুষের সুনাম প্রতিষ্ঠাও সবার কর্তব্য।
মাসুদ রানা – বুদ্ধিমত্তা, এ্যাকশন, দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধের অদ্ভূত ভারসাম্যে ভরা এক ব্যক্তিত্ব! সংবেদনশীলতা আবার কঠোরতার সংমিশ্রণে তৈরি এক অনুকরণীয় চরিত্র! এটাই তো সফল ‘ব্র্যান্ডিং’, আর যুগে যুগে তার হাজার-লক্ষ পাঠকই তো ‘লয়্যাল কাস্টমার’! এখানেই প্রস্ফুটিত কাজী আনোয়ার হোসেনের দূরদর্শিতা ও স্মরণীয় চরিত্র সৃষ্টির যাদুকরী ক্ষমতা।
আমি নিশ্চিত, যদি সত্যি কোনোদিন এ বিষয়ে একটা গবেষণা হয়, তার প্রধান ফলাফল আসবে যে সেবা প্রকাশনী এবং মাসুদ রানা ও তৎপরবর্তী অন্যান্য প্রকাশনা দিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন বাংলা সাহিত্যের জগতে সৃষ্টি করেছিলেন একটি সম্পূর্ণ নতুন যুগ! এবং এই যুগ সৃষ্টির চিন্তা ও পদ্ধতির বিশদ বিশ্লেষণ করে প্রভূত উপকৃত হবেন বর্তমানের সকল প্রকাশক, লেখক, এমনকি পাঠকও।

হ্যাঁ, কাজী আনোয়ার হোসেন মনের আনন্দে বিদেশি থ্রিলারের কাহিনি অনুমতি ছাড়াই ব্যবহার করে বাংলায় কুয়াশা আর মাসুদ রানার বই লিখেছেন, লিখিয়েছেন- তাও কয়েক’শ। যদিও মাসুদ রানার প্রথম দু’টি বই ‘ধ্বংসপাহাড়’ ও ‘ভারতনাট্যম’ মৈালিক। পরবর্তীতে যাবতীয় ওয়েস্টার্ন, তিন গোয়েন্দা আর কিছু সমসাময়িক বইও এভাবেই আমরা বাংলায় পেয়েছি। সব মিলিয়ে হাজারখানেক বই হবে। সময় পেরিয়ে যাওয়ার কারণে শুধুমাত্র অধিকাংশ ওয়ার্ল্ড ক্ল্যাসিকগুলোর বাংলা অনুবাদ আইনের আওতামুক্ত।
তো, কাজী আনোয়ার হোসেন বেআইনি কাজ করে গেছেন। বিদেশি লেখক ক্রেডিট পায় নাই, টাকা পায় নাই। তা’তে কি হয়েছে? হয়েছে এই যে, বাংলাভাষী হাজারও পাঠক যে বইগুলো সহসাই নাগালে পেত না, দু’চারটা পেলেও বিদেশি ভাষার বই দেখে হয়তো অনেকেই জীবনেও পড়তো না, সেগুলো তারা পড়তে পেরেছে। এই হাজারখানেক বই পাঠকেরা আনন্দ নিয়ে উপভোগ করেছে, আগ্রহ নিয়ে কাহিনির গতি-প্রকৃতির সাথে থেকেছে, উত্তেজনা নিয়ে অ্যাকশন আস্বাদন করেছে, বিস্ময়ের সাথে এই নতুন ধারাগুলোর রসে অবগাহন করেছে।

 

এইভাবে বিদেশি গল্পের ব্যবহারে কাজী আনোয়ার হোসেনের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল পরিষ্কার। তার একটা উদাহরণ দেই। শুরুর দিকে সেবা’র বইয়ের শেষে চিঠিপত্র বিভাগ ছিল। সত্তর দশকের কোনো একটা বইয়ের চিঠিপত্র বিভাগে এক পাঠক অভিযোগ করেছিলেন যে মাসুদ রানা’র একটা গল্পের সাথে ‘দস্যু মোহন’এর একটা গল্প প্রায় হুবহু মিলে যায়, এবং সেই পাঠক জানতে চেয়েছিলেন কে কারটা নকল করেছে। কাজী আনোয়ার হোসেন তথা সেবা প্রকাশনী উত্তর দিয়েছিল যে দু’টো বইয়েরই গল্প ব্রিটিশ লেখক ‘লেসলি চার্টারিস’এর ‘দ্য সেইন্ট’ সিরিজের ‘সেইন্ট ওভারবোডর্’ থেকে নেওয়া – তাই এত সাদৃশ্য। কি নির্বিকার সৎ জবাব! এর কারণটাও সহজেই অনুমেয়।

 

সদ্য স্বাধীন একটা দরিদ্র দেশের পুরো জাতি যখন সাধারণ জীবন যাপন নিয়েই প্রবল সংগ্রামে রত, তখন এমন একটা জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন ছিল নিত্যদিনের কষ্ট, পরিশ্রম, দুশ্চিন্তা ভুলে কিছুটা সময় নির্ভার কাটানোর মতো কিছু জানালা। ‘দস্যু মোহন’, ‘দস্যু বাহরাম’, ‘দস্যু বনহুর’, ‘কুয়াশা’, ‘মাসুদ রানা’ ছিল বড়দের জন্য মানসিক স্থৈর্য ধরে রাখার মতো একটা পথ, আর ছোটদের জন্য স্বপ্ন-দেখানো, সাহস-যোগানো একটা জগৎ। ঠিক যেমন ছিল ‘আজম খান-ফিরোজ সাঁই-ফেরদৌস ওয়াহিদ’দের পপ সঙ্গীত, বেইলি রোডের যাবতীয় মঞ্চ নাটক, বিদেশী গান ক্যাসেটে রেকর্ডিংএর জন্য এলিফ্যান্ট রোডের ‘রেইনবো’, এমনকি বিটিভি’র ‘নতুন কুঁড়ি’র মতো শিশু-কিশোরদের প্রতিযোগিতামূলক রিয়্যালিটি শো অথবা ‘সকাল সন্ধ্যা’ ও ‘রোজ রোজ’ এর মতো সিরিজ নাটক।

এমন একটা সময়ে কাজী আনোয়ার হোসেন গড়ে তুলেছিলেন এক ঝাঁক প্রতিভাবান লেখকদের একটা বাহিনী – যাতে ছিলেন শেখ আব্দুল হাকিম, রকিব হাসান প্রমুখ। তাঁরা নিয়মিতভাবে বাংলাভাষী পাঠকদের দিয়ে গেলেন একের পর এক বই। শুধুই কি কুয়াশা আর মাসুদ রানা? না, বিষয়বৈচিত্র্যে ভরপুর সব বই। আশির দশক আসতে আসতে ওয়েস্টার্ন, তিন গোয়েন্দা আর ওয়ার্ল্ড ক্ল্যাসিকস্ সিরিজের পাশাপাশি হরর, সায়েন্স ফিকশন, এ্যাডভেঞ্চার, রোমান্স, বিদেশী সিনেমার নভেলাইজেশন, আশ্চর্য সত্য ঘটনা, রিপ্লের অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্যি তথ্য, এমনকি এলিয়েন, ইউএফও, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের মতো বিষয়েও আসতে থাকলো বইয়ের পরে বই। এই সব বইয়ের অরিজিনাল পাওয়া যেত না বললেই চলে, আর দু-চারটা পাওয়া গেলেও কেনার সামর্থ্য ছিল খুব কম মানুষের। সেবা’র বইয়ের উল্লেখযোগ্য দু’টি দিক হচ্ছে, বই পাওয়া যেত অবশ্যই সুলভে, এবং বই পাওয়া যেত ডাকযোগে (জি, হোম ডেলিভারি)। সবচাইতে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে বইয়ের ভাষা ঝরঝরে, প্রাঞ্জল, সাবলীল – যেন বইটি অরিজিনালি বাংলাতেই লেখা।

এইভাবে দশকের পর দশক ধরে কাজী আনোয়ার হোসেনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সেবা (সেগুন বাগান) প্রকাশনী তৈরি করলো এক বিশাল কৌতুহলী, পিয়াসী, নিয়মিত বই পড়া পাঠকগোষ্ঠী। আর আইন, নীতি, বৈধতার কোনো তোয়াক্কা না করে বিশ্বের আনাচে কানাচে থেকে বিচিত্র বিষয়ের লেখা যোগাড় করে বাংলায় প্রকাশ করে সত্যিকারের ‘সেবা’ দিতে থাকলো লাখো বইপ্রেমিককে।
ঠিক এ কারণেই আমার কাছে কাজী আনোয়ার হোসেন সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের ‘রবিন হুড’! বিশ্বের সাহিত্যের বিশাল ভান্ডার থেকে ছিনিয়ে এনেছেন অযুত-নিযুত মণি-মানিক্য, আর বিলিয়ে দিয়েছেন অতি সাধারণ বাংলাভাষী হাজার-লক্ষ পাঠকের মাঝে!

এই স্বল্প পরিসরে যার কর্ম ও অবদান নিয়ে এতোক্ষণ আলোচনা হলো, সেই লেখক ও প্রকাশক কাজী আনোয়ার হোসেন পরিণত বয়সে সময়ের অমোঘ নিয়মে এই ক্ষণিকের দুনিয়া থেকে মাত্রই চিরবিদায় নিয়েছেন। অগণিত স্বজন, ভক্ত, শুভাকাঙ্খী আজ ব্যথিত। সকল মাধ্যমেই আজ শোকের হাজারও প্রকাশ।
আমিও তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্ত। আমার মননের গঠনে, আমার রুচির বিকাশে তাঁর অবদানের প্রভাব প্রবল। তাই তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার নিবেদনও আবেগমথিত, অবশ্যই পক্ষপাতদুষ্ট। কিন্তু পাশাপাশি আমার পর্যবেক্ষণের চোখ, বিশ্লেষণের ধারা, চিন্তার পদ্ধতিও যে তাঁরই নিবেদিত প্রখর চরিত্র আর অভিনব কাহিনীর প্রভাবে বেড়ে ওঠা!
তাই সর্বৈব বিচার করেই আমার কাছে কাজী আনোয়ার হোসেন এক যুগস্রষ্টা!

তাই মনের কোণে চিন্তাশীলতার প্রগতি রক্ষার আশ্বাস জমিয়ে রেখেও আমার কাছে এই কীর্তিমানের প্রয়ান যেন এক যুগের অবসান! তাই চোখে অশ্রু নিয়েও এই গুণী মানুষটার অবদানের প্রতি অর্ঘ্য দিতে আমায় লিখতে হলো এমন আলেখ্য!

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD