থ্রিলার উৎসব

যুক্তি ও পাল্টা যুক্তিতে জমে উঠেছিল থ্রিলার উৎসবের সপ্তম দিন

শনিবার, ২৫ মে ২০২৪ | ১১:৪৬ অপরাহ্ণ | 75 বার

যুক্তি ও পাল্টা যুক্তিতে জমে উঠেছিল থ্রিলার উৎসবের সপ্তম দিন

অভিযান বুক ক্যাফেতে তখন ভাঙনের সুর। একদিন পরই শেষ হয়ে যাবে কলকাতায় প্রথমবারের মতো আয়োজিত প্রথম কলকাতা থ্রিলার লিট ফেস্ট ২০২৪। এদিন আলোচনা পর্ব ছিল চারটি। যুক্তি ও পাল্টা যুক্তিতে জমে উঠেছিল থ্রিলার উৎসবের সপ্তম দিন। দিনের প্রথম পর্বে আলোচনার বিষয় ছিল ‘হুকাকাশি থেকে টাকাশি কেশোরুগি, গোয়েন্দা ভাদুড়ি, পাণ্ডব গোয়েন্দা, ফেলুদা ও বসন্ত সাহা’। আলোচক হিসেবে ছিলেন শ্যামলেন্দু চৌধুরি, মোস্তাক আহমেদ, মহ. সাইফুল ইসলাম, অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রণিত দাশগুপ্ত।

আলোচনায় শ্যামলেন্দু চৌধুরি বলেন, ‘জল, স্থল সবকিছুর মধ্যেই থ্রিলার বিদ্যমান। বাংলা থ্রিলারকে জনপ্রিয় করেছেন মহিলারা। হুকাকাশি প্রথম অবাঙালি গোয়েন্দা হলেও পরবর্তীতে বাঙালি হয়ে উঠেছিলেন।’ তিনি এর পাশাপাশি শিবরাম চক্রবর্তীর কলকে-কাশি এবং সায়নদেব মুখোপাধ্যায়ের টাকাশি কেশোরুগির অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে কথা বলেন।

মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘থ্রিলার সবসময় একটা জিজ্ঞাসা ও বিস্ময় আমাদের সামনে রাখে। সমবেতভাবে কাজ করতে শেখায় পাণ্ডব গোয়েন্দা। নারী, পুরুষের সমান অধিকার, পশুপ্রেম, ভূগোলের সীমারেখা অতিক্রম করে প্রকৃতি বর্ণনা সবকিছুই সমানভাবে আদৃত এই পঞ্চপাণ্ডব গোয়েন্দা কাহিনি।’

মহ. সইফুল ইসলাম নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর গোয়েন্দা ভাদুড়ি নিয়ে আলোচনা করেন।
অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘১৯৬৩ থেকে সত্যজিতের খেরোর খাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। সত্যজিত রায় ১১ দিনে ৩টি উপন্যাস লেখা শেষ করে ফেলেছেন।’ তিনি ফেলুদার অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে আলোচনা করেন।

রণিত দাশগুপ্ত বলেন, ‘বসন্ত সাহার আবির্ভাব ২০১৭ সালে প্রচেত গুপ্তের হাত ধরে। বসন্ত সাহা সৎ, বুদ্ধিমান এবং ক্ষ্যাপাটে পুলিশ অফিসার।’ এছাড়াও আলোচনায় উঠে আসে হুকাকাশি থেকে হুকা-কাশি হওয়ার গল্প, ১৯৬৫ সালে লেখা ফেলুদা গল্পে কি সত্যিই থ্রিলারের অভাব রয়েছে? সত্যজিতের থ্রিলার গল্পে নারী চরিত্রের অভাব, ফেলুদা রচনার পেছনে সাগরময় ঘোষের অবদান, বসন্ত সাহা বাঙালি পাঠকের কাছে কতটা জনপ্রিয়? “Criminal is creative Artist” এই মন্তব্যের মাধ্যমেই শেষ হয় এই অংশের আলোচনা।

চৌদ্দতম পর্বের বিষয় ছিল ‘ক্রাইম থ্রিলার ও সময়–সমাজ সচেতন লেখক’। আলোচক ছিলেন রজত পাল, তপোব্রত ভাদুড়ি, অনির্বাণ মুখার্জি।

রজত পাল বলেন, ‘থ্রিলার শুধুই গোয়েন্দা নয়। সাহিত্যের এমন কি কোনো ঘরানা আছে যেখানে থ্রিলার নেই? এমনকি মহাভারতেও লুকিয়ে আছে থ্রিলারের কাহিনি।’

তপোব্রত ভাদুড়ি বলেন, ‘থ্রিলার লেখার উৎসাহ দেয় বাজার বা বাণিজ্য। ক্রাইম থ্রিলার আর ইনভেস্টিগেট থ্রিলার কিন্তু এক নয়। থ্রিলারের মূল সোপান হলো প্লট নির্মাণ।’

অনির্বাণ মুখার্জি বলেন, ‘থ্রিলারের ইতিহাস বহু পুরোনো। প্রায় ২০০০-৩০০০ বছরের পুরোনো। কোনো সামাজিক উপন্যাস বা কোনো প্রেমের উপন্যাসও থ্রিলার হওয়া সম্ভব। সময় এবং সমাজকে বাদ দিয়ে কখনও থ্রিলার লেখা হয়নি।’ থ্রিলার কিভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদল হয়েছে, তার ইতিহাস তুলে ধরেন তিনি। থ্রিলার কি রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে গলা তুলতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের কিশোর পাশা ইমনের থ্রিলারের উদাহরণ উঠে আসে। যেখানে তিনি রাষ্ট্র ও সংখ্যাগরিষ্ঠের বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন।

পনেরোতম সেশনের বিষয় ঐতিহাসিক ও মিথোলজিকাল থ্রিলার। তাপস বিশ্বাস জানাচ্ছেন, ‘ঐতিহাসিক থ্রিলার আর ইতিহাস এক নয়। লেখক এই থ্রিলার লিখছেন মানে তিনি ইতিহাস চর্চা করছেন। মানুষ গয়না ধারণ করে, কিন্তু গয়না ভারী হয়ে গেলে চেপে বসে। তাই বেশি তথ্যের ভারিক্কি থাকলে সেটা প্রবন্ধ। কিন্তু গল্পের ছলে কাহিনীর মধ্যে ঢুকলে সেটা থ্রিলার।’

শৌভিক মাইতির মতে, ‘লেখকের স্বাধীনতা চলে মাইথোলজিকাল থ্রিলারের ক্ষেত্রে কিন্তু ঐতিহাসিক থ্রিলারের ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই। এ কথা বলতে গিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি লেখার উল্লেখ করেন। যেখানে রাবণের সীতা হরণের কাহিনির পরবর্তী সময় চিত্রিত রয়েছে। তিনি বলছেন লব, কুশ রামের সন্তান নাকি রাবণের? এটাতে কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে তাই ইতিহাসের কোনো দায় নেই।’

স্বাতী তলাপাত্র বলেন, ‘ঐতিহাসিক থ্রিলার আর ইতিহাস নির্ভর থ্রিলারের মধ্যে তফাৎ আছে। ঐতিহাসিক থ্রিলার হলে লেখকের ইতিহাসের প্রতি অনেকটা দায় থাকে। অন্যটায় অতটা থাকে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘শুধু বিজ্ঞান পড়লে বাচ্চাদের একটা অংশ অনেক পিছিয়ে যাবে। যে দেশের বাসিন্দা তারা সেখানকার ইতিহাস জানা খুব জরুরি, নইলে শেকড়ই হারিয়ে যাবে। আর সেক্ষেত্রে থ্রিলারের মাধ্যমে কিছুটা ইতিহাস, কিছুটা গল্প জানবে তারা।’

সুশোভন রায় বলেন, ‘বিক্রির ক্ষেত্রেও দেখা গেছে যখন একই সঙ্গে থ্রিলার এবং তারই সঙ্গে ইতিহাস পাওয়া যাচ্ছে পাঠকের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে।’ সুশোভন আরও যোগ করেন, ‘মহাভারত শুধু না, থ্রিলারের আভাস পাওয়া যায়, মুদ্রারাক্ষসেও। বহু প্রাচীন কাল থেকেই সাহিত্যে এর চর্চা হয়েছে।’

অন্তরা বিশ্বাসের মতে, ‘ছোটো ছোটো গল্পের মাধ্যমে যদি বলা যায় তাহলে থ্রিলারের মাধ্যমেও পাঠকেরা ইতিহাস জানতে আগ্রহী হয়ে উঠবে।’

 

পরের পর্বের বিষয় ছিল ‘থ্রিলারের বিক্রি ও বিপণন’। এ পর্বের আলোচক প্রীতম সেনগুপ্ত বলেন, ‘থ্রিলার বইয়ের ডিস্ট্রিবিউশন আরও বাড়াতে পারলে ভালো।’

অনিমেষ প্রামাণিক বলেন, ‘বই যদি ইন্ড্রাস্ট্রি হয়, তাহলে অবশ্যই বিপণনে জোর দিতে হবে। প্রকাশকদেরই দায়িত্ব নেওয়া উচিত পাঠক তৈরি করার। থ্রিলারকে পাঠক তৈরির ক্ষেত্রে মিসিং লিংক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।’

সত্রাজিৎ দত্তের মতে, ‘ব্যোমকেশ বা ফেলুদা কতটা গোয়েন্দা, কতটা থ্রিলার সেটা একটা বিতর্কিত বিষয়। তবে থ্রিলারের চাহিদা যে বেশি সেটা ওটিটি প্ল্যাটফর্ম থেকেই বোঝা যায়। তবে দুঃখের বিষয় বাংলা সাহিত্য নিয়ে এই প্ল্যাটফর্মে কাজ খুব কম।’

সায়নদীপ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘থ্রিলার পড়ে পাঠক কখনও বোর হবেন না। থ্রিলারের যে উপঘরানা রয়েছে সেক্ষেত্রে একটা জিনিস লক্ষ করা যায়, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বইয়ের বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে ক্রাইম থ্রিলার তারপর দেখা যাচ্ছে সেটা ভৌতিক বিষয়। তখন পাঠক বিভ্রান্ত হচ্ছেন। এই বিষয়টা মাথায় রাখা উচিত।’

‘অন্য জিনিসের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বা প্যারামিটার মাথায় রাখলেই হয়। কিন্তু বইয়ের বিষয়ে বিস্তারিত জানা জরুরি’– এমনটাই মনে করেন অনিমেষ প্রামাণিক। একটু ভিন্ন মত প্রীতম সেনগুপ্তের। তিনি বলেন, ‘ক্রেতারও দায় থাকে বই কেনার ক্ষেত্রে’।

অনিমেষ প্রামাণিক বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে সম্পাদনা আরও নির্ভুল করে করা উচিত। একইসঙ্গে বইয়ের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করতে হবে।’

উত্তরে প্রীতম সেনগুপ্ত বলেন, ‘বিক্রির ক্ষেত্রে বইয়ের চাহিদা আছে। কিন্তু বই পাওয়া যায় না সময় মতো।’ অনিমেষ প্রামাণিকের পাল্টা মত, ‘যে মানুষের নেশা বই, সে মানুষ ঠিকই খুঁজে নেবেন।’
‘তবে ভালো লেখা হলে পাঠক খুঁজে নেবেন। কোনও আলাদা করে ব্র্যান্ডিং করার দরকার নেই’– এমনটাই জানাচ্ছেন সত্রাজিত দত্ত।

সায়নদীপ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘ব্র্যান্ডিংয়ের দায়িত্ব শুধু প্রকাশকের নেওয়া উচিত। লেখকরা শুধু লিখবেন। পাঠক এখন অনেক বেশি অ্যাকটিভ। তাঁরা চিনে নেবেন ভালো লেখা।’

 

উল্লেখ্য, অভিযান পাবলিশার্সের আয়োজনে এবং বিভা, অক্ষর সংলাপ, অভিনব মন প্রকাশনা, কলকাতা ক্রিয়েটিভ পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় প্রথম কলকাতা থ্রিলার লিট ফেস্ট-এর  শেষ দিন ছিল ২৫ মে। ৮দিনব্যাপী এই উৎসবে ২২টি পর্বে শতাধিক আলোচক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন।

 


[ বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বুক ইন্ডাস্ট্রির যেকোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : boideshnews@gmail.com ]

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD