১.
মাঝরাত হতে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে কমে আসছে, কিন্তু থামছে না। অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে। বৃষ্টির তালের সাথে আজানের সুর মিশে এক মোহনীয় সিম্ফনি ভেসে আসছে- খায়রুন মিনান নাউম… খায়রুন মিনান নাউম…।
আড়মোড়া ভেঙ্গে বারান্দায় যাই। সারারাত আন্ধকার দূর করা ক্লান্ত বাতিটাকে নিভিয়ে গ্রীলের পাশে দাঁড়াই। একটা সিগারেট ধরাতেই কথা বলে ওঠে খাঁচায় পোষা ঘুঘু দম্পতির বউটি-
: সক্কাল সক্কাল সিগারেট! খুব খারাপ। খুউউব খারাপ।
বউটির কথার প্রতিবাদ করে স্বামী ঘুঘুটি বলে, ‘খাক না একটা সিগারেট। হয়তো টেনশনে আছে, দেখলে না সারারাত ঘুমোয়নি।
কথা শেষ হতে না হতে ঘুঘুবউটি চোখ পাকিয়ে এমনভাবে স্বামীর দিকে তাকালো যে বেচারা করুণ সুরে ডাকতে লাগলো। আমি হেসে উঠতেই ঘুঘুবউ ধমক লাগালো-
: হাসছো যে খুব! এখখনি সিগারেট ফেলো। আজ বারান্দায় কোনো সিগারেট খাওয়া চলবে না। ইট ইজ এন অর্ডার, পুরো ৫৭ ধারা।
মেঘের নরম ভোরে তর্কে যেতে ইচ্ছে করলো না। সিগারেটটি প্যাকেটে ভরে ঘুঘুবউকে জিজ্ঞেস করলাম-
: বারান্দায় ৫৭ধারা জারী হলো কবে?
: আজ, এবং এখন।
: বাহ! জারী করলেন কে?
: কে আবার জারী করবে! আমিই করেছি।
: মহামান্য আদালত, কতদিনের জন্য বারান্দায় ৫৭ ধারা জারী থাকবে?
: ২৪ঘণ্টার জন্য।
: মাত্র ২৪ ঘণ্টার জন্য! কেনো?
: কারণ, আজ আমাদের বাবুর প্রথম জন্মদিন। ওর জন্মের দিনে বারান্দায় কাউকে বাজে কাজ করতে দিবো না।
দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম-
: বেশ! আজ বারান্দায় কোনো বাজে কাজ হবেনা। যাই, একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি।
২.
বারান্দা হতে ঘরে ফিরি। খুব সাবধানে শব্দ না করে দরজা খুলি। সিড়ি ভেঙে একতলার চিলেকোঠায় দাঁড়াই। এলোমেলোভাবে কাকের কা কা শব্দ ভেসে আসছে। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সিগারেট ধরিয়ে টান দিতেই টিকটিক করে ওঠে এক টিকটিকি-
: ধুত্তোরি! সারা রাত সিগারেট খেয়েছো, আবার ভোরেও শুরু করেছো?
: হুম, আজ বড়ো সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। তৃষ্ণা মিটছে না।
: মানুষ! তোমার যে কি হয় এক একটা দিন! কিসের কিসের যে তৃষ্ণা পায়! সিগারেটের তৃষ্ণা, চায়ের তৃষ্ণা, গানের তৃষ্ণা, স্মৃতির তৃষ্ণা, শিমুল তুলো ওড়ানোর তৃষ্ণা, তারা গোনার তৃষ্ণা, গজলের তৃষ্ণা, কবিতার তৃষ্ণা, অভ্রবকুলের তৃষ্ণা, হারালো যে জন অন্ধকা….
কথা শেষ হবার আগেই ওকে থামিয়ে দিয়ে বলি-
: সব মুখস্থ করে রেখেছো দেখছি! আর কোনো কাজ নেই তোমার!
: দেখে দেখে মুখস্থ হয়ে গেছে।
: বাহ! বাহ। তুমি দেখি এক্কেবারে জিপিএ ফাইভ।
: জিপিএ ফাইভ না ছাই! তবে আজ বেশ কষ্ট পেয়েছি। তাই বারান্দা থেকে তোমার পিছুপিছু এলাম।
নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলাম-
: কে তোমাকে কষ্ট দিলো টিকটিমনি!
: কে আবার দিবে! তুমিই দিয়েছো, মানুষ।
: কখন কষ্ট দিলাম!
: ঘুঘুবউটি বললো আজ তাদের বাবুর জন্মদিন, আর তুমি একটু উইশও করলে না! আমার ভীষণ কষ্ট লেগেছে। মানুষ, তুমি এমন কেনো!
: এজন্য এতো কষ্ট!
: হু
: কিন্তু এ কষ্ট যে অর্থহীন।
: অর্থহীন! কেনো বলো তো!
: শোনো টিকটিমনি, উইশের ফিতায় কি মাপা যায় জন্মের পরিধি!
: কি যে বলো! কিছুই বুঝিনা।
: কিছু বোঝার দরকার নেই। মনে রেখো প্রতিটা দিনই জন্মদিন। প্রতিটা দিনই নতুন করে জন্মায় তার আগের দিনের স্মৃতি ও বিস্মৃতি নিয়ে, সাথে সাথে আমরাও জন্মাই প্রতিদিন। তবে এমন একটা দিন আসে, আমরা আর জেগে উঠিনা, সেখানে জম্মের শেষ।
টিকটিমনি একটা লম্বা হাই তুলে বললো-
: তাই না কি, মানুষ! তোমার কথা শুনে ঘুম পাচ্ছে।
টিকটিকির কথার উত্তর দেইনা। নিজের অজান্তেই দীর্ঘতম কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে, ছড়িয়ে পরে ভেজা হাওয়ায়। তুমুল বৃষ্টির একটানা শব্দকে কাঁপিয়ে তারস্বরে শিস দিয়ে যাচ্ছে দুটো দোয়েল, কে জানে এই সকালে কোন কারণে এমনতর কান্না!
৩.
আজ বৃষ্টি আর থামবে না। অপাকস্থালীর জীবন আকুতি জানায়- ‘আজ নিজের ভেতরে সাঁতার কাটো, তালদুপুরে মনপুকুরে দাও ডুব।’ কিন্তু খেঁকিয়ে ওঠে পাকস্থলীর জীবন, ‘সকাল সকালই আকাজের উস্কানি দিচ্ছো যে! কাজ না করলে খাবে কি! পেটে ক্ষিধে থাকলে তখন দেখা যাবে কোথায় থাকে তালদুপুর আর খালপুকুর, হু।’ যে জীবন পাকস্থলীর সে জীবন বোঝেনা পাখির ভাষা, পতঙ্গের আহ্লাদ, বৃষ্টির রোদন। সে জীবন জানে শুধু কামলার ব্যকরণে দীর্ঘশ্বাস গোপনের সকল কৌশল।
রাস্তায় জমে আছে ছিপছিপে পানি। হাটতে হাটতে রাস্তার মোড়ে যাই। সব রিকশা এখনো বের হয়নি, তাদেরও হয়তো উস্কানি দিয়েছে অপাকস্থলীর জীবন। স্বল্প পরিচিত এক রিকশাওয়ালা এগিয়ে আসেন-
: ভাই, ওঠেন।
: কোথায় যাবো জানেন?
: হ, জানি।
রিকশায় উঠে বসি। বৃষ্টির বেগ আবার বেড়েছে। তিনি প্লাস্টিকের পর্দাটা ভালো করে খুলে দেন, হুডেও গুজে দেন কিছু অংশ। রিকশা চালাতে শুরু করেন। রিকশা চলছে, পথে পথে অলস সকালের ঘুম ভাঙছে, পাকস্থলীর টানে ছুটেছে কামলা কামলাগিরির জেলে। রিকশাওয়ালা নীরবতা ভেঙে জানতে চান-
: এমুন আকাইল্যা বাদলা দেখছেন!
: এখন সব কালই আকাল। এই যে অপনি রিকশা চালাইতাছেন, আমি অফিসে যাইতাছি তার কারণও আকাল।
: কন কি ভাই! আকাল হইবো ক্যান!
: অকাল না হইলে তো ঘরে বইসা গপসপ করতাম, পেঁয়াজ কাঁচামরিচ আর চাইল ভাজা সরষা ত্যালে মাখায়া কুচুরমুচুর কইরা খাইতাম। দুপুরে বেগুন ভাজা, ইলশা ভাজা, মিষ্টি কুমড়া দিয়া গোশতের ঝাল তরকারি মাখায়া খিচুরী খাইতাম। আকাল বইলাই এই বাদলার মধ্যে আপনে প্যাডেল মারেন আর আমি কলম মারতে যাইতাছি।
রিকশাওয়ালা হেসে ওঠেন। তারপর বলেন-
: আইজ মাসের ২১তারিক, বাড়ির ভাড়া দিতে দেরী হইছে। জ্বরের লেগা ৭দিন গাড়ি চালাই নাই। আইজ ভাড়া না দিলে বাড়িওয়ালা পিডাইবো কইছে হাহাহাহাহাহাহা…. আকাইল্যাই তো..
মাথার ভিতর ঘুরতে থাকে আজ ২১তারিখ… আজ ২১মে… আজ ২১মে… আজ ২১মে। মাত্র চারটা ২১মে, ছোটো ছোটো কত যে স্মৃতি, আহ ২১শে মে…।
৪.
তুমুল রোদের দিন ছিলো সেদিন। বেইলি রোডের ফাস্টফুড শপে কলেজ ফাঁকি দিয়ে মুখোমুখি দুজন। ভিকারুন্নেসা আহ্লাদি গলায় বলে ওঠে-
: নটরডেম, আজ আমার জন্মদিন। খুব সুন্দর একটা উইশ করো, তা না হলে ঠিক ঠিক মরে যাবো।
: একটা উইশ না পেয়ে জন্মদিনের দিন ঠিক ঠিক মরে যাওয়া কাজের কথা না।
: এহহহ! অবশ্যই কাজের কথা। তোমার সুন্দর উইশ না পেলে ঠিক ঠিক মরে যাবো, তখন দেখো, হু।
ভিকারুন্নেসার মুখে মেঘ জমতে শুরু করে। বাইরে ঝাঝালো রোদ। নটরডেম কাঁপা হাতে ভিকারুন্নেসার কপালে নেমে আসা অবাধ্য এক গোছা চুল কানের পাশে সরিয়ে দিয়ে বলে-
: শুভ জন্মদিন, প্রিয় ভিকারুন্নেসা। মানুষ হয়ে ওঠো প্রতিদিন।
তীব্র অভিমান ভিকারুন্নেসার কণ্ঠে-
: আমি মানুষ নই! তোমার সাথে আজ আমার প্রথম জন্মদিন, আর তুমি এভাবে বলতে পারলে! নটরডেম, তুমি এভাবে
বললে!
ভিকারুন্নেসার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে, নটরডেমের বুকে কেনো যে ব্যাথা লাগে! ব্যাথা চেপে সে বলে-
: ভিকারুন্নেসা, উইশে ‘মানুষ হয়ে ওঠো’ থেকে গভীর কিছু আর খুঁজে পাই না যে। এর থেকে দামী উইশ কি আছে!
: এটা দামী উইশ!
: অবশ্যই দামী উইশ। কেনো অমূল্য তা কি শুনতে চাও?
: হ্যা, চাই। শোনার পরে যদি দামী মনে না হবে তবে কিন্তু ঠিকঠিক মরে যাবো, জেনে রাখো, নটর ডেম।
নটর ডেম বলতে শুরু করে-
: প্রতিজন মানুষ জন্মায় মানুষ হয়ে। তারপর একদিন মানুষ হতে না পেরে মরে যায়।
: যাহ! মানুষ তো মানুষ হয়েই মরে।
: না, ভিকারুন্নেসা। প্রতিজন মৃত মানুষই আসলে মানুষ হতে না পারা একজন মানুষ।
: কি যে বলো না, নটরডেম!
: জন্মানোর পরে মানুষকে মানুষ করে তুলতে শুরু করে পরিবার। তাকে শুধু মানুষ হলেই চলবেনা- তাকে হতে হবে সভ্য মানুষ, সফল মানুষ, শিক্ষিত মানুষ।
: তা তো হতে হবেই।
: ভিকারুন্নেসা, সেখানেই তো সমস্যা, মানুষের আর মানুষ হয়ে ওঠা হয়না।
: ধ্যাত! এর অর্থ কি!
: জন্মানোর পরেই বাবা-মা মানুষ করে তোলার অভিযানে নামেন। এই অভিযানে যোগ দেন আত্মীয়স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশী। স্কুল-কলেজের স্যাররাও নামেন মানুষ গড়ার কাজে, তারা সেই মানুষ গড়ে তুলতে চান যে মানুষ তারা হতে চেয়েছিলেন কিন্তু হতে পারেননি। কবি সাহিত্যিক ডাক্তার মোক্তার সবাই মানুষকে মানুষ বানাতে চায়। নিজের নিজের ছায়ার মাপের মানুষ, নিজের নিজের এইম ইন লাইফের মানুষ, নিজের নিজের বৃত্তভাঙার মানুষ।
: একটু থামো, নটরডেম। দম নাও। কিছুটা বুঝতে পারছি।
: গুড। তারপর কি হয় বুঝতে পারছো!
: কি হয়!
: অন্যদের মাপে মানুষ হতে হতে একটা সময় মানুষ নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায়। সে বুঝতে পারে যে মানুষটি সে হতে হয়েছিলো সে মানুষটি সে হতে পারেনি। তার দিন কেটে গেছে অকারণ অর্থহীন এক মানুষ হবার মোহে। তার আর মানুষ হয়ে ওঠা হয় না, বেলা ফুরোয়, খেলা ফুরোয়, মানুষ হতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে জীবনও ফুরোয়।
গভীর বিস্ময় নিয়ে নটরডেমের দিকে তাকিয়ে থাকে ভিকারুন্নেসা। টেবিলের উপরে রাখা হাতটা শক্ত করে ধরে জানতে চায়-
: আমি কেমন মানুষ হবো- বলে দাও।
: ভিকারুন্নেসা, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পৌছানোর যাত্রাটাই হলো মানুষ হবার জার্নি। প্রতিদিন নিজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন কোরো ‘কতটা মানুষ হবার পথে এগোলাম, কতটা পিছিয়ে পরলাম।’ প্রতিদিন একটু একটু মানুষ হয়ে ওঠো, নিজের মত মানুষ, যে মানুষটি তুমি হতে চাও অবিকল সে মানুষ।
: থ্যাংক ইউ নটর ডেম।
কিছুটা বিরতি দিয়ে ভিকারুন্নেসা আবেগঘণ স্বরে বলে-
: যতই মানুষ হয়ে উঠি না কেনো! তোমাকে না পেলে ঠিকঠিক মরে যাবো, হু।
: কথায় কথায় মরতে হবেনা, মনে রেখো– জীবন অনেক বড়। এক একটা জীবন জীবন থেকেও বড়, দীর্ঘতর আর দীর্ঘতম।
: এতোকিছু জানিনা নটরডেম। মানুষ হবার জার্নিতে যেনো কখনোই তোমাকে না হারাই।
হাসতে হাসতে নটর ডেম বলে-
: ভিকারুন্নেসা, এই একটা মাত্র জীবনে তুমি আমার বামপাশে থেকো, হারিয়ে যেওনা।
পৃথিবীতে আর কোনো শব্দ নেই, দুজন মুখোমুখি বসে থাকে, দুজনের চোখ মিনতি করে যায়- হারিয়ে যেওনা… হারিয়ে যেওনা… হারিয়ে যেওনা…
৫.
বৃষ্টির আজ কি যে হলো! বৃষ্টি বাড়ছে তো বাড়ছেই। ভাবনা হয়- বৃষ্টির ছাটে কি ভিজে যাচ্ছে ঘুঘুদম্পতির খাঁচা! ভিজুক, আজ তাদের কষ্টের দিন। ঠিক আজকের দিনেই ডিমফুটে বের হওয়া তাদের প্রথম বাবুকে পিপড়ার দল কামড়ে কামড়ে মেরে ফেলেছিলো। তার আর ঘুঘু হয়ে ওঠা হয়নি। মানুষ হবার জার্নিতে আজ কতটা এগিয়েছে ভিকারুন্নেসা জানা নেই, সে থাকেনি বামপাশে।
রিকশা ছুটেছে তাই ছপছপ শব্দ হচ্ছে পথে, কামলা ছুটেছে রিকশার পিঠে চেপে। জানি, এ রিকশা মনসুখিয়ায় যাবেনা, সে চিনেনা মনসুখিয়ার পথ। হঠাৎ, বাতাসে কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ ভেসে আসে, তাকে ফিসফিসিয়ে বলি, ‘প্রতিদিন মনসুখিয়ার দিকে ছুটে চলেছি আমি। অভ্রবকুল নিবে তো আমায়! আমার যে আর কোথায় যাওয়ার নেই!’ কোনো উত্তর পাইনা, শুধু কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ তীব্রতর হয়ে ওঠে, বাতাসে বিষাদ ছড়িয়ে একটা দোয়েল মাথার ভিতরে গেয়ে চলে-
‘চলরে মন চল তুই মনসুখিয়ার কাছে
তার কাছে জোছনা রঙা রৌদ্রনদী আছে…’
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD