॥ সু ম ন কু মা র ॥
—
দ্বিতীয়বার সুগন্ধ্যার সাথে সম্পর্ক ভাঙার সময় আমি স্নাতকোত্তরের ছাত্র। প্রথমবারে চতুর্থ বর্ষে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ফিরে আসবে। সে ফিরে এসেছিল। দ্বিতীয়বারও আমার একই রকম আস্থা ছিল ওর উপর। কারণ কখনোই সম্পর্কে মনোমালিন্য হয়নি! কিন্তু সে আর ফিরলো না। উপরন্তু নতুন একটি সম্পর্কে জড়িয়ে গেল। আমি জানি আমার গুরুতর কিছু ভুল ছিল। কিন্তু সে নতুন একটি সম্পর্কে জড়িয়ে যাবে এটা মেনে নেয়া অসম্ভব।
স্নাতকোত্তর পরীক্ষা খুব মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে দিলাম। বন্ধুদের সহায়তা ছাড়া পরীক্ষায় পাশ করা তো দূরের কথা হয়তো পরীক্ষার হলেও বসতে পারতাম না। ক্রমে ক্রমে আমার আচরণ অস্বাভাবিক হয়ে যেতে শুরু করলো। তাকে দেখলে জোর করে কথা বলতে চাইতাম। রিকশা থেকে টেনে নামাতাম। একাধিকবার তার নতুন প্রেমিক আমাকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করলো। হলে ফিরে বুঝতাম কাজটি আমার পক্ষ থেকেই খারাপ হয়েছে। যে মাছ খালুই থেকে লাফ দিয়ে আবার জলে চলে যায় সেই মাছ পুনরায় যে শিকারি ধরে তার। আমার নয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে নিজেকে বেঁধে রাখতে পারতাম না।
বন্ধুরাও আমার জন্য ওর নতুন প্রেমিকের কাছে হেনস্তার শিকার হলো। তারা আমাকে জোর করে ঢাকায় আমার ভাইয়ের বাসায় পাঠিয়ে দিল। অন্য কোনো উপায়ও ছিল না আমাকে রক্ষা করার জন্য। কারণ আমি মানসিকভাবে স্বাভাবিক ছিলাম না। এমনকি এটা মানসিক রোগের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ভাইয়ের বাসায় সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমাতাম। ভাই চাইছিল আমি কোনো কাজে মনোনিবেশ করি। কিন্তু সেরকম মানসিক জোর আমার ছিল না।
সবাই যখন চাকরির জন্য পড়াশোনা করছিল বা কোনো চাকরি করছিল তখন আমি কেবল সুগন্ধ্যার পুরাতন নম্বরগুলোতে বৃথা কল করে সময় কাটাচ্ছিলাম। ভাইয়া একটি টেক্সটাইলস গ্রুপের বড়ো কর্মকর্তা, সে একটি কাজে লাগিয়ে দিতেও চাইছিল। কিন্তু কোনো কাজে যোগদান করা যেন আমার কাছে আরো একটি চাপের বিষয়। ভাবি প্রথম প্রথম আমাকে বোঝাতো, কাজ করতে উৎসাহ দিত। কিন্তু এভাবে অনেকদিন হয়ে গেল সেও উৎসাহ হারিয়ে ফেলল, এমনকি বিরক্ত হয়ে গেল।
ভাইয়ের বাসাও আমার আর ভালো লাগছিল না। আমি বিকালে বিকালে সংসদ ভবনের সামনে গিয়ে বসা শুরু করলাম। ক্রমাগত সময়টা বাড়তে থাকলো। কখনো সারাদিন, তারপর টানা কয়েকদিন। এমনকি পুরো সপ্তাহ, দিনরাত সংসদ ভবনের সামনে কাটানো শুরু করলাম। এসময় ভাইয়াও চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে গেল। জানতে চাইল সারা সপ্তাহ আমি কোথায় থাকি, কী করি। আমার কাছে উত্তর ছিল না। কারণ আমি ঠিক জানতাম না আমি কী করি। একসময় ওই সংসদ ভবনের সামনেই স্থায়ী হয়ে গেলাম।
একটা মেয়েকে অদূরে বসে থাকতে দেখতাম। বয়স তেইশ চব্বিশ কিংবা পঁয়ত্রিশ চল্লিশও হতে পারে। নোংরা পোশাক ও শরীরে তার বয়স অনুমান করা কঠিন। আমারই মতো, ঘর ছিল না। দিনরাত সংসদ ভবন এলাকায় থাকতো, রাতে ফুটপাতে কিংবা রাস্তার ডিভাইডারে ঘুমাতো। এসব মানুষদের দেখে আমিও এমন ঘুমানো অভ্যাস করেছিলাম। মেয়েটা সিগন্যালে ভিক্ষা করত।
আমার স্যান্ডেল জোড়া হারিয়ে গেল। পোশাক নোংরা হয়ে ছিঁড়ে গেল। চুল-দাড়ি বড়ো হয়ে গেল। শুরুতে লোকের ফেলে দেয়া খাবার, ডাস্টবিনের খাবার খেতাম, পরে ভিক্ষা করা শুরু করলাম। মেয়েটা অবসরে আমার কাছাকাছি বসা শুরু করলো। আমি দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করতাম। অচিরেই দূরত্ব কমে আসলো।
মেয়েটা কোনো খাবার কিনলে আমার দিকে ছুড়ে দিত। প্রথম প্রথম অস্বস্তি লাগত। পরে কুড়িয়ে নেয়া শুরু করলাম। এ হলো ক্ষুধার্ত মানুষের সহজাত প্রতিক্রিয়া। আমিও সামর্থ্য অনুযায়ী ফেরত দেয়া শুরু করলাম। একসময় হাতে হাতে বিনিময় শুরু হলো। দূরত্ব একেবারেই কমে গেল।
একবার অসময়ের বৃষ্টিতে তার সাথে আমার শরীরে শরীর লেগে গেল। ঠান্ডায় গায়ে গা লাগিয়ে বসে থাকলাম। এ তো শখে বৃষ্টিতে ভেজা নয়। জ্বর এসে গেল। আমাকে সেবা করার মতো এখানে কোনো মানুষ নেই, টাকা নেই, ওষুধ নেই। কেবল মেয়েটি আছে। সে কোথা থেকে ভাঙা পাত্রে জল এনে মাথায় দিত। কথা হতো না। যখন খুব জ্বর উঠতো তখন কমদামি সিগারেটে গাঁজা ভরে টানতে দিত। অচিরেই গাঁজা খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেল। দুজনের মধ্যে কোনো কথা হতো না কিন্তু আমরা দুজন জুটি হয়ে গেলাম।
অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের একটি সংসার হয়ে গেল। দিনের শেষে দুজনের ভিক্ষার টাকায় খাবার কিনে ভাগাভাগি করে খেতাম। আমি যখন খাবার কিনতে যেতাম সে পানি আনতো। খাবার শেষে দুজনে একটু আড়ালে গিয়ে গাঁজা টানতাম, রাতে জড়াজড়ি করে ঘুমাতাম।
বর্ষা চলে এলো। প্রয়োজন দেখা দিল একটি ঘরের। কোথা থেকে মেয়েটা কয়েক হাত দৈর্ঘ্য-প্রস্থের এক টুকরো বাতিল পলিথিন নিয়ে এলো। সেই পলিথিন দিয়ে পার্কের দেয়ালের সাথে আমরা ঘর বানাতে শুরু করলাম। আমিও নানা সামগ্রী এনে ঘরটিকে যথাসম্ভব মজবুত ও বৃষ্টিতে কার্যকর করে তুললাম। দিনে সংসদ ভবন এলাকায় ভিক্ষা করতাম আর রাতে ওখানে গিয়ে ঘুমাতাম।
মেয়েটা সত্যিই সংসারী ছিল। সেই ছোট্ট ঠাঁইয়ের মধ্যে কয়েকটা ইট দিয়ে চুলা বানালো। পরিত্যক্ত বাসন-কোসন কুড়িয়ে আনলো। আমরা রান্না করে খাওয়া শুরু করলাম। মেয়েটা ভিক্ষা বাদ দিয়ে প্লাস্টিকের বোতল আর কাগজ কুড়ানো শুরু করলো। রাতে সে আমার চুল টেনে দিত, পা টিপে দিত। রাস্তায় স্থায়ী হবার পর সাত-আটমাস পার হলো। মেয়েটার সাথেও পাঁচ ছয় মাস হয়ে গেল। এতদিনেও তার সাথে আমার কথা হয়নি। এমনকি ইশারায়ও না। সে মুখ দেখেই আমার চাওয়া বুঝে নিত। আমিও সেভাবেই তাকে বুঝতাম।
একসাথে জড়াজড়ি করে শতছিন্ন পরিত্যক্ত এক কাঁথার নিচে আমরা ওই বর্ষায় ঘুমাতাম। রান্না করতাম, গাঁজা খেতাম। আমি তার সাথে থাকতাম কিন্তু সে তো রাস্তার মেয়ে, আমি তো তা নই। তাকে তো আমি ভালোবাসতাম না। প্রয়োজনটুকু ছাড়া জগতে বাকি সমস্ত বিষয়ে তাকে আমি নোংরা আর রাস্তার মেয়ে মনে করেই একসাথে ঘুমাতাম। একজন মানসিক রোগীরপক্ষে হয়তো এর চেয়ে ভালো আর কিছু ভাবা সম্ভব হয় না। ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে আমাদের ঘরে আসা সোডিয়াম লাইটের আলোয় মেয়েটা আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকতো। তার অভিব্যক্তি বোঝার জন্য যে বোধ-বুদ্ধি মানুষের থাকতে হয় তা আমার ছিল না।
কোনো এক বর্ষার রাতে সে আমার শরীর আর আমাকে জাগালো। আমি রাগত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়েছিলাম। সে ভয় পেল না। আমার দিকে চেয়ে থাকলো। সেদিন আমি তার অভিব্যক্তি বুঝতে পেরেছিলাম। এতগুলো দিন একসাথে কাটানো একজন পুরুষ কীভাবে একজন নারীর এই আহ্বান অগ্রাহ্য করতে পারে। জগত কী জানতো আমি জানি না কিন্তু আমি তো জানতাম আমি পাগল নই। তাই আর যাই ঘটুক এই নোংরা, রাস্তার মেয়েটির গর্ভে আমার কোনো সন্তানের জন্ম হোক এমন ঘটনা ঘটতে দেইনি। মানুষ অনেক সময় স্বপ্নের মধ্যেও স্বপ্ন দেখে। এ যেন আমার পাগলামির মধ্যেও এক ধরনের পাগলামি। আমাদের দাম্পত্য জীবন শারীরিক অর্থেও শুরু হলো। অচিরেই নোংরা এবং রাস্তার মেয়ে এটা মনে রেখেই তার প্রতি আমি সত্যিকার দুর্বল এবং নির্ভরশীল হয়ে পড়লাম।
এক রাতে কোনো এক আগন্তুক আমাদের ঘরে ঢুকে পড়লো। ধ্বস্তাধ্বস্তিতে ঘুম ভাঙলো আমার। আমি লোকটাকে ওর শরীরের ওপর থেকে ঠেলে নামিয়ে দিলাম। লোকটার শরীরে বিশেষ কোনো পোশাক ছিল। কী পোশাক অন্ধকারে বুঝতে পারলাম না। হতে পারে পুলিশের, আনসারের, চৌকিদারের কিংবা বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের। লোকটা বিরক্ত হয়ে আমার কোমরে লাথি দিয়ে বলল, ‘বাইরা খানকির পোলা।’ আমি হতবাক হয়ে উঠে বসলাম। সে আবার মেয়েটার সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করলো। আমি আবারো তাকে ঠেলে দূরে সরানোর চেষ্টা করলাম। লোকটা পাশ থেকে একটা লাঠি নিয়ে আমাকে কয়েকবার আঘাত করলো। আমি মার খেয়ে দরজার মুখ থেকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলাম। লোকটা বলল, ‘কইলাম তো, টাকা দিমু। ওই মাদারচোৎ তুই বইসা কী দেখস, বাইরা।’ এই কয়েকমাসে তো দেখেছি মেয়েটা বেশ্যা ছিল না, ধস্তাধস্তি করতেই থাকলো। ফুটো দিয়ে আসা আলোয় তার মুখ চেয়ে বুঝলাম সে আমার সাহায্য চায়। কিন্তু এরকম ঘটনা প্রতিরোধ করার জন্য একজন মানুষের যতটা মানসিক শক্তি দরকার তা তো আমার ছিল না। আমি কিছুই করতে পারলাম না।
ধস্তাধস্তিতে পরাজিত হয়ে সে হাল ছেড়ে দিল। একটা পোঁটলা ছুড়ে দিল আমার দিকে। ওর মধ্যে গাঁজা থাকে। বুঝলাম সে চায় আমি আপাতত এখান থেকে চলে যাই। বাইরে এসে দাঁড়ালাম। খুব কষ্ট লাগতে শুরু করলো। লোকটার মুখের পশুর মতো শব্দ, মেয়েটার চাপা কান্না সবই আমার কানে আসছিল। এই শব্দ আমার কাছে অসহনীয় ছিল। অসহনীয় কেবল একজন নারীর উপর অত্যাচার বলে নয়, অসহনীয় কারণ আমি তাকে ভালোবাসি।
প্রতিরোধ করার শক্তি আমার ছিল না, আবার দাঁড়িয়ে সহ্য করাও অসম্ভব। দ্বিতীয় চিন্তাটি কাজে পরিণত করা সহজ। গাঁজার পোঁটলা ফেলে হাঁটা শুরু করলাম। শেষ হলো আমার রাস্তার জীবন।
একদিন আমার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য অফিসের দেয়া গাড়িতে সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে যেতে জ্যামে পড়লাম। ছিন্ন বস্ত্রের নোংরা একটি মেয়ে এগিয়ে এলো। তার মুখ দেখে আমি চমকে উঠলাম। সেও আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তার চেয়ে থাকার অর্থ নিয়ে আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম। এই মেয়েটিই তো আমার নতুন জীবনের দিশারী। টাকা দিব কিনা ভাবছি। একটি নতুন জীবনের দাম কত হতে পারে! কত টাকা দিলে তার ঋণ শোধ হতে পারে! আমি মানিব্যাগে হাত দিলাম। ওদিকে সবুজ লাইট জ্বলে গেল, পিছনের গাড়িটা বারংবার হর্ন লাগলো…
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD