॥ শা হা দ ৎ রু ম ন ॥
—
দুপুরের খাবার শেষে বিছানায় গা’টাকে ভিড়িয়েছে রহিম খাঁ। বিছানায় যেতে যেতে নিজের বিরক্তি প্রকাশেও দ্বিধা করে না সে। কারণ চৈত্র মাস এলেই দুপুরের খাবার তাকে অলস থেকে অলস করে তোলে- কেন তা হয় সে বোঝে না। তার ভেতরে কেবল একটা যন্ত্রণা দেখা দেয়। তবু সে প্রতিবছর চৈত্রের দুপুরে ঘুমায়। অথচ এটা তার অনভ্যাস। চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ এই তিন মাসের অলসতা কিংবা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেওয়া সময়ের অপব্যায় ব্যতীত আর কিছুই মনে হয় না তার। এই রহস্যময়তার কুল-কিনারা পয়তাল্লিশ বছরেও করতে না পেরে শীতকাল আসলে সে সাপের শীত নিদ্রায় যাওয়ার রহস্য খুঁজে। সে দেখে যে সাপের শীত নিদ্রার মতোই সেও অবহেলা করতে পারে না চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠমাসের দুপুরের ঘুমটাকে। বরং ঘুম তাকে এই সময়ের দীর্ঘতায় আপন থেকে আপনতর করে ঘনিষ্ঠ করে নেয়। ঘুমের ব্যাপ্তি বাড়ে, বাড়ে তার বিরক্তি ও অপব্যয়ের খাতায় সময়ের বাজে খরচ। রহিম খাঁ বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রতি দুপুরের ঘুমের আগে এসব ভাবনা বিষয়ের সাথে সাথে ভাবে তাদের বংশের পূর্বসূরি কোনো পুরুষ হয়তো রাজ প্রতিনিধি ছিল। আর তাই তাদের গত এক দুই পুরুষের রাজত্ব ও সারা বছরের ঘুম দূরে সরে গেলেও কেবল চৈত্রের দুপুরের ঘুমের মিষ্টতা চলে যায়নি। পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার রূপে এই ঘুমের মিষ্টতা খড়ের ছাউনির বাসিন্দা রহিম খাঁরও আপনরূপে আজও প্রবাহমান। সেই বনেদি পূর্বপুরুষ চিত্র কল্পনায় হাসি পায় রহিম খাঁর- সে মনে মনে এক চিলতে হাসি হাসে। আর ভাবতে ভাবতে তাকায় ঘরের ছাউনির দিকে, এক পরম স্নিগ্ধতায় প্রখর সূর্য রশ্মির ঝলক তাকে এক ভিন্ন স্বাদ দেয়- সেই স্বাদে তার কাছে আর খড়ের ছাউনি কিংবা ঘরের ভাঙা বেড়ার যন্ত্রণা অনুভূত হয় না। সে তৃপ্ত হয়, এই ভেবে- সূর্য রশ্মি কিংবা চাঁদের আলোর স্বাদ ঘরে শুয়ে উপভোগ করতে পারে না প্রাসাদ নিবাসী। এ ভাবনাতে রহিম খাঁ মুগ্ধ হয়-তৃপ্ত হয়-সুখ পায়। সুখের আবেশে ঘুমে ঢেকে যেতে থাকে দু’চোখ; অলস দেহটা আর কিছু ভাবতে দেয় না তাকে। ঘুমের পরশ নেয় রহিম খাঁ।
রহিম খাঁ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুনতে থাকে ভবানীর আওয়াজ। ভবানী ঘরের দরজার কাছে এসে হা-ম্-বা-আ-আ… হা-ম্-বা-আ-আ রবে বাড়িটাকে মাথায় তোলে। ভবানীর আওয়াজের এই প্রলম্বনটা হারমোনিয়ামের সুরের মতোন নিচু থেকে উঁচুতে উঠে যায়। ঘুমের চোখে ভবানীর আওয়াজ অসহ্য লাগে রহিম খাঁর। তার চোখের ঘুম পালিয়ে যায় রাগে, দুঃখে। তবু সে বিছানা ছাড়ে না। মৃতের মতো পড়ে থেকে চিৎকার করে- ‘ফালানী, ফালানী ওই ফালানী শুওরের বাচ্চা, আমারে কি ঘুমাইতে দিবি না!? গরুটা যে ডাকতে ডাকতে মইর্যা গেল, একটু মাড় পানি দে।’ ফালানী কিংবা রহিম খাঁ নিজ স্ত্রীর কোনো সাড়া না পেয়ে রাগে গজগজ করতে করতে বিছানা ছাড়ে। ঘরের বাহির হতে হতে- ‘আমি মইর্যা গেলেই সবাই শান্তি পায়। বাড়িডারে খালি কইর্যা নতুন নতুন মাউগের মুখ দেখতে চইল্যা যায়।’ স্ত্রী কন্যার উদ্দেশে এরূপ শ্রাব্য-অশ্রাব্য গালি-গালাজ করে। ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় রহিম খাঁ। সে দেখে ভয়-ভালোবাসার অপূর্ব মেলবন্ধনে ভবানীর চোখ তীক্ষ্ণ। ভবানীর অস্থিরতার কারণ রহিম খাঁ বোঝে না। সে ভবানীর সারা শরীর পরীক্ষা করে-কিন্তু কোনো কিছুই খুঁজে পায় না। যে কারণে ভবানী এত অস্থিরভাবে আওয়াজ তুলেছিল।
রহিম খাঁ রান্নাঘর থেকে মাড় পানির বালতি এনে রাখে ভবানীর মুখের সামনে। তাতে চুমুক দেয় না ভবানী। সে কামড়ে ধরে রহিম খাঁর লুঙ্গি, লুঙ্গিটা প্রায় খুলে যায়। রাগের মাঝে আরো রাগ হয় রহিম খাঁর। সে ভবানীর মুখে সজোরে আঘাত করতে গিয়ে দেখে ভবানীর দু’চোখ সাগরের উত্তাল ধারায় সিক্ত। আঘাত করে না রহিম খাঁ। ভবানীর ছিন্ন রশি আটকে ধরে, আর ভবানী সুযোগ বুঝে প্রথমে একটা লাফ দেয়; অতঃপর কোনো দিকে খেয়াল না করে দ্রুত বেগে বাড়ির বাহিরে এসে পার্শ্ববর্তী বনের দিকে ছুটতে থাকে। তার পিছু পিছু ছুটতে থাকে রহিম খাঁ। রহিম খাঁ ভবানীর পিছু নিতে গিয়ে দু-একবার হোঁচট খায়। তবু সে দৌড়ায় যথাসাধ্য। তার চোখ বাতাস বেগে দৌড়াতে থাকে ভবানীর দিকে।
এক সময় ভবানী এসে থামে বনের ধারে। কিছুটা দূর থেকে তা খেয়াল করে দৌড়ে আসে রহিম খাঁ। ভবানী থেমে গেছে দেখে সে দৌড় থামিয়ে হাঁটতে থাকে। খানিক পর সে দেখে, ভবানী শিয়ালের মতো কয়েকটা প্রাণীকে গুঁতো দিতে দিতে তাড়ানোর চেষ্টা করছে। তখন সে পুনরায় দৌড়াতে দৌড়াতে ভবানীর কাছে আসে। ভবানীর কাছে এসে সে যা দেখে তা তার পৃথিবীটাকে সেকেন্ডের ভেতর প্রবলভাবে তছনছ করে দেয়। সাগরের হুংকার তার চোখে, সুনামির পর থেকে যাওয়া জলধারা ছাড়া আর কিছুই ভাসে না। রহিম খাঁ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে, তার সামনে শেয়ালের কামড়ে কামড়ে দেহের নানা স্থান থেকে মাংস চলে যাওয়া ফালানীর লাশ। রহিম খাঁ পিছনে ফিরে দেখে, লাশটির দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একটি হাত, প্রায় দশ-বার হাত দূরে ঘাসের ভেতর থেকে কামড় দিয়ে নিয়ে আসছে ভবানী। সে দৌড়ে গিয়ে ভবানীর মুখ থেকে হাতটিকে নেয়। তারপর একবার ছিন্ন হাতের স্থানে রাখে হাতটি। আবার ছিন্ন হাতের পরশ নিতে চায় কপালে বেদনার যন্ত্রণায়। হঠাৎ সে বনের দিকে তাকায়। দেখে কয়েকটি উৎসুক শেয়াল তাকিয়ে আছে। উন্মাদের মতো সে দৌড়ে যায় বনের ভেতর যেন একটা আণবিক বোমা হয়ে ফেটে পড়বে সন্তানের হন্তারকের উপর। কিন্তু সে ফিরে আসে পুনরায় ভিন্ন জগৎবাসী সন্তানের নৈকট্যে। কারণ সে যখন শেয়াল তাড়া করে বনের ভেতর দৌড়াচ্ছিল, তখন অলক্ষ্যে একটি গাছের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খেলে হন্তারকের চেয়ে সন্তানের দেহটাই হয়ে উঠে মুখ্য। সে চিৎকার করে গ্রামের মানুষের নাম ধরে ডাকে। আর নিজ গায়ের ছেঁড়া গেঞ্জি খুলে ঢেকে দেয় সন্তানের গোপনাঙ্গ। কারণ ফালানীর দেহের উপরের আবরণটি শেয়ালের টানা হেঁচড়ায় ছিঁড়ে গিয়েও থেকে যায়। কিন্তু নিম্নাঙ্গের আবরণটির চিহ্ন আশে পাশে কোথাও খুঁজে পায় না রহিম খাঁ। তাই বাধ্য হয়েই গায়ের গেঞ্জি খুলে পরিয়ে দেয়। গেঞ্জি পরানোর পূর্বে রহিম খাঁ দেখে ফালানীর যোনিপথ বেয়ে নেমে গেছে রক্তের প্রবাহধারা। সেই প্রবাহধারার কিছুটা পাশেই ঊরু ও তলপেটের কাছে শেয়ালের কামড়ে ক্ষত হয়ে যাওয়া অংশগুলোও দেখতে পায়। এমনতরো আরো অনেকগুলো ক্ষত ফালানীর চেহারাটাকে নষ্ট করে দেয়। বিকৃত করে দেয় চোখ-মুখ-নাক ও মুখটাকে পর্যন্ত। রহিম খাঁ সন্তানের দেহটাকে আঁকড়ে ধরে কোমলতায়।
তার চোখ পৌঁছায় স্মৃতির জানালায়। সে দেখে, আট বছর আগের একদিন বৃষ্টির ভেতর অনাহারী-বানভাসী, নদীর ছোবলে সর্বহারা এক মা এসে দাঁড়ায় তার ঘরের দুয়ারে। কোলে বছর খানেক বয়সের এক মেয়েশিশু। ক্ষুধার জ্বালায় সন্তানকে স্তন দিতে পারছে না সেই মা। কেমন করে স্তন পান করাবে সন্তানকে- নিজে না খেতে পারলে দুধ যে আসে না বুকের ভেতর। যন্ত্রণার সেই বালুচর থেকে উদ্ধারে সন্তান বিক্রির পথে নামে মা। তা শোনে নিঃসন্তান রহিম খাঁ ও তার স্ত্রী নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় মানবের আদিমতা। তারা একসের চালের বিনিময়ে কিনে নেয় মেয়েটিকে। সেই মেয়ে ফালানী। আপন মায়ের বিক্রি করে যাওয়া সন্তান বলেই সেদিন রহিম খাঁ মেয়েটির নাম রেখেছিল ফালানী। সেদিন রাত থেকেই এক অদ্ভুত আবেশে স্বপ্নময়তায় ভরে উঠে রহিম খাঁর জীবন। সে ভাবে ফালানীর ভাগ্যের কারণেই তার গোয়ালে এসেছে নতুন বাছুর- এড়ে বাছুর। রহিম খাঁ একদিকে যেমন এতে নিশ্চিত হয় ফালানীর দুগ্ধের ব্যবস্থায় তেমনি আনন্দে এই প্রথম বাছুরের নাম রাখে ভবানী। ফালানী আর ভবানী। রহিম খাঁ আলাদা করে ভাবে না, ভাবে উভয়েই তার কন্যা। ফালানী-ভবানী একসাথে বড়ো হতে থাকে; একসময় রহিম খাঁ দেখে, ফালানী ভবানীর নৈকট্যে সুখ পায়। আর ভবানীও ফালানীর দেয়া খাবার ছাড়া কিছু খেতে চায় না। রহিম খাঁ মানুষ আর পশুর এই বন্ধনের কারণ খুঁজে না। তার কাছে এটা রহস্যময়তায় ঘেরা।
রহিম খাঁর যখন ফালানীর কথা- পূর্বকথা মনে হচ্ছিল তখন গ্রামের বহুলোক এসে জড়ো হয় তার চারপাশে। গ্রামের লোকজন রহিম খাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে না পেলেও, মুহূর্তের মাঝে ব্যস্ত হয়ে উঠে লাশ নিয়ে। এর কারণ রূপে থানা পুলিশের ঝামেলা এড়ানোটাও ছিল সক্রিয়। ফলে ঘণ্টা দুয়েকের মাঝেই রচিত হয়ে যায় চিরস্থায়ী আবাস ফালানীর। যার উপর দিয়ে কেবল শোনা যায়, ফালানীর পালিত মায়ের চিৎকার, বুকফাঁটা আর্তনাদ। সেই সঙ্গে গ্রামের মসজিদের মাইকে মাইকে ঘোষণা করা হয়- ‘বনের শেয়াল পাগল হয়ে গেছে। এখন থেকে রাতে কেউ ঘরের বাইরে একা বের হবেন না। ছেলে-মেয়েদের একা একা দিনে ও রাতে বাড়ির বাইরে যেতে দিবেন না।’ এমনকি শেয়াল মারার জন্য সকলকে লাঠি-সোটা নিয়ে প্রস্তুত থাকার কথাও ঘোষণা করা হয় মসজিদের মাইকগুলোয়। এভাবে অল্প কিছুক্ষণের মাঝেই গ্রামে তৈরি হয়ে যায় এক আতঙ্কময় পরিবেশ। আর ফালানীর স্থান নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর রহিম খাঁ খুঁজে ফিরে ভবানীকে। খুঁজতে খুঁজতে এক সময় হাজির হয় ইদরিস মাতব্বরের বাড়ি। রহিম খাঁ দেখে ভবানী ইদরিস মাতব্বরের স্ত্রীর রান্নাঘরের পাশে শুয়ে জাবর কাটছে। ক্ষণিক মুহূর্তে তার চোখে ভেসে উঠে ভাত খাওয়ার পর ফালানীর পান চিবানোর দৃশ্য। রহিম খাঁ দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ভবানীর গলা। ভবানী তার পা চাটতে শুরু করে। এমন সময় ঘরের বাহিরে আসে ইদরিস মাতব্বরের বিধবা স্ত্রী। রহিম খাঁকে দেখে বলে- ‘কী আর কমু ভাই। আমার বাপের জনমে শেয়ালে জ্যান্ত মানুষ খাওনের কথা শুনি নাই। আহ্হারে! ফালানীর মতো মাইয়্যাডারে…।’ মাতব্বরের স্ত্রী আর কিছু বলতে পারে না। সে দেখে, রহিম খাঁর চোখ থেকে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। অনেক মেঘ জমে আছে সে চোখের ভেতর। তখন সে বলে- ‘তোমার গরুডাও অনেক লক্ষ্মী; সেই দুপুরে দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির ভেতর আসে। প্রথমে তো আমি ভয় পেয়ে যাই। তারপর যখন তোমার অবস্থার কথা মনে হইল- মাড় পানিডা আইন্যা দিলাম, অমনি গরুডা খাইতে শুরু করলো।’ মাতব্বরের স্ত্রীর কথা শেষ হলে কান্না ভেজা-ভাঙা কণ্ঠে রহিম খাঁ বলে- ‘ভাবিসাব, আপনাদের কোনো ক্ষতি করে নাই তো ভবানী?’
‘আরে না না। এই গরুডার মতো লক্ষ্মী গরু আমি দেখি নাই আজ পর্যন্ত!’ – এই বলে মাতব্বরের স্ত্রী চলে যায় ঘরের ভেতর, রহিম খাঁ ভবানীর রশি ধরে টানাটানি করে বাড়ি নিয়ে আসার জন্য। ভবানী কিছুতেই উঠে না, শুয়ে থাকে। রহিম খাঁ ধীরে ধীরে ভবানীর মাথায় হাত দেয় নিজ সন্তানের মতো করে বোঝানোর চেষ্টা করে এবং ভবানীর চোখের দিকে তাকায়। ভবানীর চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয় রহিম খাঁ। সে দেখে ভবানী কিছু একটা অনুসন্ধান করে ফিরছে চারদিকে। রহিম খাঁ সহজেই তা বুঝে যায়; কারণ রহিম খাঁ ফালানী আর ভবানীর মাঝে তফাৎ করেনি কোনো দিন। সে ফালানীর দৃষ্টি কল্পনায় পড়ে নেয় ভবানীর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টির পাঠ। অতঃপর সে ভবানীর গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বাড়ি নিয়ে আসে।
তারপর থেকে প্রায় পনেরদিন পর্যন্ত একই ঘটনা ঘটতে থাকে। সকালে গোয়াল ঘর থেকে বের করে যেভাবেই বেঁধে রাখা হোক কিংবা যত শক্ত রশি ও খুঁটির সাহায্যে মাঠে দিয়ে আসা হোক- ভবানী নিজ শক্তি ও বুদ্ধিমত্তায় বাঁধন মুক্ত হয়ে চলে যায় ইদরিস মাতব্বরের বাড়ি। বিষয়টি প্রথম প্রথম রহিম খাঁ ও মাতব্বরের বাড়ির লোকজন মেনে নিলেও একসময় তেতো হয়ে ওঠে। কিন্তু, ইদরিস মাতব্বরের স্ত্রী বিষয়টিকে মেনে নেয়। ভবানী যখনই তাদের বাড়ি যায়, তখন সে মাড় পানি এনে দেয়। ভবানী তা পান করে আর জিহ্বার আদরে আদরে সাজিয়ে দেয় মাতব্বরের স্ত্রীর পা দুটো। এভাবে মাতব্বরের স্ত্রী ভবানীর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হয়ে যায় ক’দিনেই। তবু ভবানীকে নিয়ে মাতব্বরের বাড়িতে এক বিদ্ঘুটে পরিবেশ তৈরি হওয়ার পাশাপাশি ফালানীর মৃত্যুর পর থেকে ভবানীর এ বাড়িতে আসার কারণও খুঁজতে থাকে কেউ কেউ। তবে সকলেই ভবানী একটা গরু হওয়ায় ভাবনার বাহিরে পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। কিন্তু ভবানীর এরূপ আচরণে রহিম খাঁ ভীত হয়ে ওঠে। সে এক সন্ধ্যায় যখন ভবানীকে নিয়ে আসে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বোঝায় ‘অন্যের বাড়ি যাইতে হয় না, মাতব্বরের বউ ভালা মানুষ হইলেও ছেলেগুলান খারাপ।’ এভাবে ভবানীকে মাতব্বরের বাড়ি যেতে নিষেধ করে রহিম খাঁ। ভবানী সে কথা শোনে না। পনেরদিনের দিন সন্ধ্যায় যখন মাতব্বরের বাড়ি থেকে ভবানীকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল রহিম খাঁ- ঠিক তখন, রাস্তায় মাতব্বরের মেজো ছেলে সবুজের দেখা পেয়ে ভবানী উন্মাদের মতো তাড়া করে। সবুজ দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। ভবানী সজোরে মাথা দিয়ে দরজা ভাঙার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। ততক্ষণে রহিম খাঁ ও মাতব্বরের স্ত্রী এসে পড়লে ভবানী পুনরায় শান্ত হয়ে যায়। উভয়ের পায়ে আদর করে যায় জিহ্বার লেহনে লেহনে। ভবানীর চোখের ভাষা পাঠ করে রহিম খাঁ মাতব্বরের স্ত্রীকে জানায়- ‘ভাবিসাব ভবানী তার পাগলামির জন্য মাফ চাইতাছে। আপনি মাফ করে দেন।’ মাতব্বরের স্ত্রী রহিম খাঁর কথা শোনে অবাক হয়। সে বোঝে না, গরুর ভাষা কী করে বোঝে রহিম খাঁ। সে ভবানীর মাথায় হাত দিয়ে বলে- ‘না রে আমি তোর উপর রাগ করি নাই। এখন তর মালিকের লগে বাড়িত যা। আর কুনুদিন এইরকম করিস না। যুদি করিস অনেক রাগ করুম। যা বাড়ি যা।’ মাতব্বরের স্ত্রীর একথা বলার পর ভবানী মাথা নিচু করেই পথ ধরে রহিম খাঁর বাড়ির। তা দেখে পিছু নেয় রহিম খাঁ। সেদিকে তাকিয়ে থাকে ভবানী ও রহিম খাঁর আচরণে অবাক বনে যাওয়া মাতব্বরের স্ত্রী। হঠাৎ মাতব্বরের ছেলে রহিম খাঁ ও ভবানীর চলে যাওয়ার পদশব্দ শোনে চিৎকার করে বলে ওঠে- ‘গরু রাখতে না পারলে বেইচা দে। এইডা তোর দাদার তালুক না যে গরুডা প্রত্যেক দিন চইল্যা আইসবো। আর যুদি একদিন গরুডা এই বাড়িত আসে তবে হয় তরে না অইলে গরুডারেই জব কইর্যা ফেলমু কইয়াদিলাম। কথাডা মনে রাখিস।’ রহিম খাঁ কোনো উত্তর দেয় না। তবে তার ভাবনায় থেকে যায় এ কথার পীড়ন। বাড়ি ফেরার পর থেকে সারারাত ধরে সবুজের কথার তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার ঘা থেকে যায় রহিমের মস্তিষ্কে। সে বোঝে না ভবানী কেন মাতব্বরের ছেলে সবুজকে পথে পাওয়ামাত্রই আক্রমণ করে বসল। কেনইবা প্রতিদিন নতুন নতুন রশি দিয়ে বেঁধে রাখলেও প্রতি দুপুরেই রশি ছিঁড়ে মাতব্বরের বাড়ি চলে যায় ভবানী! তার এ ভাবনার কারণ এর পূর্বে কখনো ভুল করেও কোনো শিশুকে পর্যন্ত আক্রমণ করেনি ভবানী। অথচ ফালানীর মৃত্যুর পর থেকে ভবানীর এই পরিবর্তন ভাবিয়ে তোলে তাকে। রহিম খাঁ উত্তর খুঁজে পায় না। সে রাতের শেষ দিকে গোয়াল ঘরে যায়, ভবানীকে জিজ্ঞাসা করে কারণ! তারপর সে ভবানীর চোখের দিকে তাকায়। রহিম খাঁ ভবানীর চোখ পাঠ করে দেখে, ভবানীর হাতেই মৃত্যু লেখা সবুজের। এক অজানা আতঙ্ক আর ভয়ে সে ঘরে চলে যায়। আর ভাবতে থাকে উত্তরণের উপায়। কোনো পথ কিংবা জবাব না পেয়ে ভবানীকে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হয় রহিম খাঁ। সে স্ত্রীকে জানায় আগামী শনিবার বাজারে নেয়া হবে ভবানীকে। রহিম খাঁর স্ত্রী বাধা দেয়, সে বাধায় তার সিদ্ধান্তের নড়চড় হয় না। কারণ একমাত্র সেই ভবিষ্যৎ বক্তা অন্ধ টিরেসিয়াসের মতো জেনে গেছে ভবানীর ক্রোধের কথা; যে ক্রোধ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ ভবানীকে বিক্রি দেয়া কিংবা জবাই করার মাঝেই আবদ্ধ। অতঃপর শনিবার না আসা পর্যন্ত সারাদিনের সকল কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে ভবানীর সঙ্গী হয় রহিম খাঁ। ফলে ভবানী আর ইদরিস মাতব্বরের বাড়ি যেতে পারে না। এই ক্ষোভে তার খাবার বন্ধ হয়। আর দুই-তিন দিনে ভবানীর শরীরটা শুকিয়ে যায় বেশ খানিকটা। তারপরও ভবানী রহিম খাঁর অবাধ্য হয় না। এমনকি কোনো আঘাতও করে না রহিম খাঁকে। বরং সারাটা সময় সে জিহ্বার লেহনে লেহনে রহিম খাঁর সারা গায়ে জড়িয়ে দেয় আদরের পরশ। তবু রহিম খাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয় না। শনিবার আসলে বাজারে নিয়ে যাওয়া হয় ভবানীকে। অনেক দর কষাকষির পর দশ হাজার টাকার বিনিময়ে ভবানী হয়ে যায় ভিন্ন গ্রামের নতুন মালিকের গোয়ালের সদস্য। কিন্তু ভবানী সেই মালিকের হয় না। বাজার থেকে যখন তাকে নিয়ে পথে নামে নতুন মালিক, তখনই ভবানী উন্মাদের মতো ঝড়ের বেগে ছুটে পরিচিত পথে। সে ফিরে আসে রহিম খাঁর গোয়ালঘরে। ভবানীকে দেখে রহিম খাঁর স্ত্রী বালতি ভরে পানি নিয়ে এসে মুখের সামনে দেয়; দৌড়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত ভবানী তা পান করে। অতঃপর বাড়ি এসে যখন রহিম খাঁ সব জানতে পারে, তার কিছুক্ষণ পর রহিম খাঁর বাড়ি এসে হাজির হয় ভবানীর নতুন মালিক। অনেক কথাবার্তা ও রাতের খাবার গ্রহণ করে রহিম খাঁ অতিথিকে নিজেদের ঘরে ঘুমানোর জায়গা করে দেয়। আর স্বামী-স্ত্রী মিলে ঘুমাতে যায় ভবানীর পাশে গোয়ালঘরের ভেতর। ভবানীও সারারাত তাদের পাশে শুয়ে থাকে। আর কষ্টে নিবারণ করে নিজের প্রাকৃতিক কর্মক্রিয়া। আর্শ্চয হলেও সত্য সারা রাত ধরে প্রাকৃতিক কর্মে সাড়া দেয়নি ভবানী। কাক ডাকা ভোরে রহিম খাঁর স্ত্রী ওঠে গিয়ে রান্না করলে ভবানীর নতুন মালিক অনিচ্ছা সত্ত্বেও খাবার খেয়ে রওনা হয় বাড়ির উদ্দেশে। সাথে কিছু দূর রহিম খাঁও যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। শুরু হয় ভবানীর নতুন গন্তব্যের যাত্রাপথ।
তখন প্রায় সকাল দশটা, ভবানীকে নিয়ে যখন তারা দু’জন ইদরিস মাতব্বরের বাড়ির উঠোন পাড়ি দিচ্ছিল, সেই মুহূর্তে মাতব্বরের ছেলে সবুজ পুকুরে গোসল করে বাড়ি ফিরছিল। আর অনিচ্ছা অনাগ্রহ থাকা সত্ত্বেও মুখোমুখি হয়ে পড়ে ভবানীর। ভবানীর উন্মাদনা বেড়ে যায়, কোনো প্রকার উস্কানি ছাড়াই এক লাফে সে আক্রমণ করে বসে সবুজকে। বাধা দিতে আসা তার নতুন মালিক ও রহিম খাঁকে এবার আর ক্ষমা করে না ভবানী। গুঁতো দেয়। গুঁতোর ভয়ে দূরে সরে যায় উভয়েই। আর ভয়ে জবুথবু হয়ে যায় সবুজ। সে ভবানীর বাঁকা শিং দুটো ধরে ভেঙে দেয়। ভবানীর শান্ত হওয়ার নাম নেই তবু। বরং শিং দুটো ভেঙে যাওয়ার পর পেছনের দুই পায়ের উপরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যায় স্ফিংস স্বরূপ হয়ে যাওয়া ভবানী। অতঃপর সামনের দুটো পা দিয়ে সবুজকে মাটিতে ফেলে দিয়ে ভেঙে যাওয়া শিং দুটো দিয়ে মাটিতে ঠেসে ধরে থেমে থাকে ভবানী। সবুজের আর্তনাদ ও চিৎকার শুনে উঠানে এসে উপস্থিত হয় ইদরিস মাতব্বরের স্ত্রী। আর মাতব্বর বাড়ির অন্যান্য পুরুষরা ব্যস্ত হয়ে ওঠে লাঠি খোঁজায়। তারা লাঠি নিয়ে এসে যতক্ষণে হাজির হয় ততক্ষণে ভেঙে যাওয়া শিং-এর স্থান থেকে রক্ত ঝরে ঝরে ভয়ংকর এক রূপ ধারণ করে ভবানীর লাল মুখ। যেনবা ইটের ভাটায় দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের শিখায় পুড়ে পুড়ে জন্ম নিচ্ছে এক একটি লাল ইট। সেই জ্বলন্ত আগুনের প্রজ্বলনে নিস্তেজ হয়ে আসে সবুজ। আর বিজ্ঞতার সঙ্গে ভবানী তার সামনের পা দুটোর ক্ষুরধার শক্ত ক্ষুর দিয়ে সবুজের অণ্ডকোষটাকে চেপে ধরে মাটির সঙ্গে। এই শেষবারের মতো ভবানীর ক্রোধে সবুজও চিৎকার করে ওঠে। আর ফালানী হত্যার প্রতিশোধ নিশ্চয়তায় শান্ত হয়ে যায় ভবানী। সঙ্গে সঙ্গে ভবানীর দেহে পড়ে কয়েকটি লাঠির আঘাত। মাতব্বরের স্ত্রীর চিৎকার ও হুকুমে ভবানীকে আঘাত করা বন্ধ হয়। ভবানী নীরবে রক্তমাখা মুখ নিয়ে আশ্রয় খুঁজে মাতব্বরের স্ত্রীর পায়ে চুম্বনের পর চুম্বনের চিহ্ন আঁকতে আঁকতে। ভবানীর এরূপ আচরণে সন্তান হারানোর বেদনায় সিক্ত মাতব্বরের স্ত্রী চোখের পানি মুছতে মুছতে ভবানীর মাথায় হাত দেয়, প্রদান করে এক নিশ্চয়তা। মাতব্বরের স্ত্রী রহিম খাঁকে বলে-‘রহিম ভাই, গরুডা তুমি বেইচা দিছ! যে টাকায় বেচ্ছো হেই টাকাডা ফেরত দিয়ে দাও। আমি তোমারে আরো বেশি টাকা দিমু।’ তারপর কান্না ভেজা চোখ নিয়েই মৃত সন্তানের মুখে হাত রাখে মাতব্বরের স্ত্রী। আর উপস্থিত অন্যান্যদের লাশ দাফনের কাজ-কর্ম দ্রুততার সঙ্গে শেষ করতে বলে ভবানীকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। সে দিকে তাকিয়ে থাকে নির্বাক বনে যাওয়া রহিম খাঁ ও উপস্থিত সকলেই। তারা সবাই ভবানী ও মাতব্বরের স্ত্রীর আচরণের কারণ ভাবতে ভাবতে ভুলে যায় সবুজরে লাশ দাফনের কথা।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD