॥ হাসান তারেক চৌধুরী ॥
প্রত্যাবর্তন (১ম পর্ব)
ভরা পূর্ণিমার কোনো এক রাত। মায়াবি জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক।
ভরা জোছনার সেই রূপালী আলোতে বিশাল এক বৃক্ষের নিচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে এক বিষণ্ন যুবক। কিছুক্ষণ পরপরই আরামদায়ক এক শীতল বাতাস ভাসিয়ে নিচ্ছে চারপাশ। জোছনার সেই নেশাধরানো মায়াবি আলো আর হিমেল বাতাসের মাতাল স্পর্শে যে কোনাে মানুষেরই শ্রান্তি দূর হয়ে যাবে নিমিষেই। কিন্তু যুবকটিকে যেন কোনাে কিছুই স্পর্শ করছে না আজ। অজানা কোনাে কারণে ভীষণ ক্লান্ত আর চিন্তিত সে।
যুবকটি যেখানে বসে আছে, সেখান থেকে যতদূর চোখ যায় দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ। দমকা হাওয়ায় মাঝে মাঝেই উত্তাল সাগরের মতাে ঢেউ উঠছে সেই মাঠে। যুবক আর ফসলের মাঠ, তার মাঝখানে একফালি শান্ত ছোট জলাশয়। দেখে যেন মনে হয় কোনো এক রূপসী নারীর এলিয়ে দেয়া শাড়ির আঁচল। জলাশয়ের শান্ত রূপালী পানিতে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে। মাঝেমাঝেই প্রতিফলিত সেই আলোক রশ্মি আলো-আঁধারির এক অপূর্ব ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করছে যুবকের মুখমণ্ডলে।
এদিকে এলোমেলো মাতাল বাতাস মাঝে মাঝেই আলোড়ন তুলছে জলাশয়ের পানিতে, সেটা এলোমেলো করে দিচ্ছে পানিতে চাঁদের অবয়ব। তারপর বাতাস ধরে আসতেই, আবার তা ফিরে পাচ্ছে পানিতে চাঁদের পূর্ণ প্রতিবিম্ব। আলো-আঁধারির সেই মায়াবী ব্যঞ্জনা আর চাঁদের ভাঙা-গড়ার এই অদ্ভুত খেলা যুবক চোখ মেলে দেখছে বটে, কিন্তু উপভোগ করতে পারছে না কিছুতেই। থেকে থেকেই ভ্রূ-জোড়া কুঁচকে যাচ্ছে তার। ক্রমাগতভাবে অস্থিরতা বেড়ে চলেছে যুবকের। চেহারায় ফুঁটে উঠছে এক নিদারুণ বিষন্নতার ছাপ। অশুভ একটা অনুভূতি তাকে ক্রমান্বয়ে গ্রাস করে চলেছে তাকে।
জলাশয়ের ওপাড়ে দৃষ্টি যেতেই খানিকটা কৌতূহলী হয়ে উঠলো যুবক। মানুষের মতো দেখতে, ছায়ার মতো কিছু একটা বসে আছে ওখানে। জোছনার আলোতে ঠিক ভালভাবে বোঝা যাচ্ছিল না সেখান থেকে। একটু মনোযোগ দিয়ে তাকাতেই সে বুঝতে পারলো, কোন ছায়া না ওটা, বরং ধুসর রঙের একটা চাদর গায়ে দিয়ে কোন এক অশতিপর বৃদ্ধ লোক বসে আছে ওখানে। আশ্চর্য তো! এত রাতে ওখানে কি করছে এই লোক? তাছাড়া বৃদ্ধের বসে থাকার ভঙ্গিটাও বেশ অদ্ভুত। হঠাৎ করে দেখলে যেন মনে হয়, যেন চারপায়ে উবু হয়ে বসে আছে সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই যুবক বুঝতে পারলো, বৃদ্ধের গায়ের পোশাকটাও যেন ঠিক স্বাভাবিক না, পাখির পালক যেমন হয়, অনেকটা সেরকম দেখতে। হঠাৎ বৃদ্ধের চোখের দিকে চোখ পড়ল তার। সাথে সাথে ভীষণভাবে কেঁপে উঠল তার পুরোটা শরীর। লোকটা ভয়ঙ্কর রকম ভীতিকর এক চাহনি নিয়ে সরাসরি তাকিয়ে আছে তার দিকে, একেবারে চোখাচোখি! এই চাঁদের আবছা আলোতেও যুবক পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে বৃদ্ধের চোখ। টকটকে লাল ভয়ানক একজোড়া চোখ! হিমশীতল সেই দৃষ্টির মুখোমুখি হয়ে, একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে গেল যুবক। ওদিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না সে কিছুতেই।
হঠাৎ যুবকের চোখের সামনেই ক্রমান্বয়ে বড় হতে শুরু করলো বৃদ্ধের শরীর। অল্পক্ষণের মধ্যেই যুবক বুঝতে পারল, ওটা আসলে কোন বৃদ্ধলোক না, অতিকায় এক দানব! এই পাশ থেকে তিনটা মুখ দেখা যাচ্ছে ওর – সামনে, ডানে আর বাঁয়ে। অন্যপাশেও নিশ্চয়ই আরও একটা মুখ আছে তার! ধীরে ধীরে গায়ের পোশাকটাও স্পষ্ট হয়ে উঠছে এখন। যেটাকে দেখে চাদর মনে হয়েছিল, ওটা আসলে চাদর না, বিশাল একজোড়া ডানা দানবটার পুরো শরীরকে ঢেকে রেখেছিল। পোশাকের উপরে যে জিনিসগুলোকে পাখির পালকের মতো মনে হয়েছিল যুবকের, এখন সে দেখতে পাচ্ছে ওগুলো আসলেই এক একটা বিশাল বড় পালক!
দানবটার শরীর বড় হতে হতে একসময় পুরো দৃষ্টি ছেয়ে ফেলল যুবকের। পালকগুলোও এবার একেবারে স্পষ্ট। ওগুলোর দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেল তার। পাখির পালকের সাথে ওগুলো কী! এক একটা পালক যেন একটা করে মানুষ। প্রতিটি পালকের দুপাশে আবার ছোট্ট দু’টি হাত, আর তার শেষ মাথায় উল্টো হয়ে ঝুলে আছে একটা করে মাথা। ঝুলে থাকা ওই মাথাগুলো আর কিছু না, যেন হুবহু একজন মানুষের মুখ!
আতংকের একটা ভয়াল স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে পা পর্যন্ত নেমে গেল যুবকের। হায় আল্লাহ! একটা পালকের মাথায় লাগানো মুখটা তো ঠিক তারই মত দেখতে!
ইয়া মাবুদ! চেঁচিয়ে উঠল যুবক।
চোখের সামনেই হঠাৎ দুলতে শুরু করলো ওই পালকটা। দেখতে দেখতে দোলনের বেগ বেড়ে গেল কয়েকগুন, তারপর ভাল করে কিছু বুঝে উঠার আগেই টুপ করে খসে পড়ল ওটা!
আতঙ্কের অনুভূতিটা ভয়ানকভাবে চেপে বসছে বুকে, ক্রমেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যুবকের। নিজের সাথেই প্রচন্ড এক লড়াই শুরু হল তার। হাত-পা নাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছে সে, কিন্তু শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করেও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে, হাল ছেড়ে দিবে, এমন সময় প্রচন্ড এক ঝাঁকিতে কেঁপে উঠল যুবকের সমস্ত শরীর।
ঘুম ভেঙে যেতেই, ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল মামুন। বুঝতে পারলো সে আসলে স্বপ্ন দেখছিল – ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন। আতংকে গলা শুকিয়ে কাঠ, সমস্ত শরীর যেন একেবারে ঘেমে নেয়ে উঠেছে। বিছানায় হাত রাখতেই বুঝলো সেখানেও অনেকখানি জায়গা ঘামে ভিজে আছে।
ঘোরের প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে যেতেই টিভির দিকে নজর পড়লো যুবকের, এখনও চলছে ওটা। ঘুমের আগে ভলিয়ম কমিয়ে খবর দেখছিল, কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতে পারেনি সে। টিভির স্ক্রলে বার বার ঘুরে আসছে করোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন সংবাদ,
“বিশ্বব্যাপী করোনায় মৃত্যু সংখ্যা পৌনে দু’লাখ ছাড়ালো … মোট আক্রান্ত ছাব্বিশ লক্ষ ছুঁয়েছে … সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা … সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে, প্রতিদিন বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা … একই সাথে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা …. লকডাইন স্বত্বেও, মানুষকে ঘরে আটকে রাখতে হিমশীম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী … পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে আরো কঠোর হতে নির্দেশ … অতিমাত্রায় করোনা আক্রান্ত এলাকা, বিশেষ করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে কারফিউ জারির আহবান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা … এদিনে ভয়াবহ খাদ্য সংকটের মুখে ল্যাটিন আমেরিকা … সারা পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ার আশংকা …”
এটুকু দেখেই টিভি বন্ধ করে দিলো মামুন। বিছানা থেকে নেমে টেবিলে রাখা পানির বোতল থেকে একগ্লাস পানি খেলো সে, তারপর বাইরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। নিচ থেকে সাইরেনের শব্দ ভেসে আসছে। পুলিশের একটা ছাদখোলা টহল ভ্যান নিচ দিয়ে চলে গেলো। মানুষের চলাচল সীমিত করতে এখন চব্বিশ ঘন্টাই টহল দিচ্ছে ওরা। কিন্তু জাতিগতভাবে অসচেতন একটা দেশের মানুষকে নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা যে কত কঠিন, তা এখন হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছে আমাদের পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনী। দিন-রাত্রি হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরও কিছুতেই মানুষকে বাড়িতে আটকে রাখতে পারছেন তা তারা। তার ওপরে, এই কাজে নিয়োজিত অনেক পুলিশ, র্যাব ও সেনাসদস্যও ইতিমধ্যেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
ফাঁকা রাস্তা আর পুলিশের টহল দেখতে দেখতে মামুন ভাবছিল, পৃথিবীর ইতিহাসে মহামারী নতুন কিছু নয়, যুগে যুগে মহামারী এসে কেড়ে নিয়েছে অগণিত মানুষের জীবন। উইকিপিডিয়া থেকে সে জানতে পেরেছে, তেরশ ছেচল্লিশ থেকে তেপ্পান্ন সালের মধ্যে ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়া বিখ্যাত প্লেগ বা কালো মৃত্যুতে সারা পৃথিবীতে মারা গিয়েছিল আনুমানিক পঁচাত্তর থেকে দুইশত মিলিয়ন মানুষ। একইভাবে গত শতকে স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা যায় সতের থেকে পঞ্চাশ মিলিয়ন মানুষ। গত পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে এরকম আরো অসংখ্য মহামারীর মখোমুখি হয়েছে পৃথিবীর মানুষ।
খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগে চীনের হামিন মাঙ্গার মহামারী থেকে শুরু করে, গত দুই শতকে ছড়িয়ে পড়া পীতজ্বর, কলেরা, পোলিও সহ সাম্প্রতিককালের সোয়াইন ফ্লু, ইবোলা, সবই পৃথিবী থেকে নির্মুল হয়ে গিয়েছে বা অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে একসময়। তেমনি এই করোনা মহামারীও নিশ্চয়ই চলে যাবে একসময়, ইতিহাস হয়ে যাবে একদিন। মানুষ যুগ যুগ ধরে স্মরণ করবে সেই ইতিহাস। কিন্তু চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এই মহামারী যে কেড়ে নিবে কতগুলো তাজা প্রাণ কে জানে? কত পিতা-মাতা হারাবে তার প্রিয় সন্তানকে, কত সন্তান তার পিতা-মাতাকে, অথবা কত স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, ভাই-বোন চিরতরে হারাবে তাদের প্রিয়জনকে, তার পূর্ণ হিসেব কি কেউ দিতে পারবে কখনো? যে চলে যাবে, সে তো চলেই যাবে ওপারে কোনো অজানার পথে; কিন্তু পৃথিবীতে রয়ে যাবে অসংখ্য মানুষ, যারা সারা জীবন ধরে বুকে বয়ে বেড়াবে তার প্রিয়জন হারানোর বেদনা।
এগুলো ভাবতে ভাবতে মামুন কিছুক্ষণের জন্য আনমনা হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ, মসজিদ থেকে ভেসে আসলো আজানের ধ্বনি …..
আল্লাহু আকবর …
আল্লাহু আকবার …
আশহাদু আল্লাইলাহা ইল্লাহ …
অজু করে আসলো মামুন। মনটা এখনও ভীষণ অস্থির হয়ে আছে তার, স্বপ্নের রেশ যেন কিছুতেই যেতে চাচ্ছেনা মন থেকে। একবার ভাবলো মসজিদের গিয়ে ফজরের নামাজটা আদায় করে আসবে, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়লে মনটা হয়তো একটু শান্ত হবে। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে পড়লো যে সেটা এখন আর সম্ভব নয়। করোনার কারণে হঠাৎ করেই যবদলে গিয়েছে সবার জীবন। চেনা মানুষ, অফিস, প্রতিদিনের যাওয়া-আসা, এমন কি রাস্তার মোড়ের কাবাবের দোকানে বসে নিত্যদিনের আড্ডা, সবই মনে হয় যেন সেই কোন সুদূর অতীতের কথা!
সরকার ঘোষিত দেশব্যাপী লক-ডাউনের কারণে বলতে গেলে প্রায় সবকিছুতেই এক ধরণের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একে লক-ডাউন বলা হলেও, মসজিদ বা জনসমাগম হতে পারে এমন সব জায়গায় কার্যত রীতিমত এখন কারফিউয়ের মতো পরিস্থিতি। মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন, খাদেম আর কর্মচারী ছাড়া জনসাধারণের মসজিদে যাতায়াতের উপর ইতিমধ্যেই পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এই ভোরবেলা বাইরে বাড়ি থেকে বের হয়ে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনা-সামনি পড়লে বিরাট ঝামেলায় পড়ার আশংকা রয়েছে। তাই, মসজিদে যাওয়ার ইচ্ছে হলেও অন্যদিনের মতো বাড়িতেই নামাজ পড়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো সে।
নামাজ শেষ হতেই, একটা চেয়ার নিয়ে বারান্দায় বসল মামুন। দিগন্তে আলোর কমলা আভা দেখা যাচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য উঠবে। ভোর বেলাতে বাইরে ঠান্ডা হওয়ার কথা, কিন্তু আজ পরিবেশ তুলনামূলক ভাবে বেশ গরম। মাঝে মাঝে ঝিরঝিরে একটা বাতাস বয়ে যাচ্ছে সেখান দিয়ে, তবে তাতে বিশেষ কোন আরাম বোধ হচ্ছে না তার। রাতের দুঃস্বপ্নটা এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে মামুনকে।
বার বার চোখের সামনে ঘুরে ফিরে ভেসে উঠছে সেই দানবটার চেহারা। ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরে, স্বপ্ন যতই গভীর হোক না কেন, খুব একটা পরিস্কারভাবে মনে থাকে না। কিন্তু, এই স্বপ্নটা যেন একেবারেই অন্যরকম। রীতিমত ছবির মত চোখের সামনে ভেসে উঠছে সবগুলো দৃশ্য। প্রতিটা দৃশ্য, খুঁটিনাটি সবকিছু মনে করতে পারছে সে। ব্যাপারটা নিয়ে যতই ভাবছে ততই অবাক হচ্ছে মামুন।
দানবটার চেহারা আরো একবার মনে করার চেষ্টা করলো সে। আকাশের মত বড় দেহ, বিশাল দু’টি ডানা, মানুষের মতো চেহারা, বড় বড় পালকগুলো আর চারটা মুখ; কেন যেন এই বর্ণনা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে তার কাছে। কোথায় যেন শুনেছে এর কথা! ছোটবেলায় পড়া কোন রূপকথার বইতে? ঠাকুরমার ঝুলি?
নাকি অন্য কোথাও?
মনে করতে পারছে না মামুন।
সকাল প্রায় সাতটা বাজতে চলেছে…
করোনার সময়ে দৈনন্দিন রুটিন রীতিমত তছনছ হয়ে গিয়েছে মামুনের। অফিস নেই, তাই প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়েই ঘুমিয়ে যায় সে। তারপর ঘুম থেকে জাগে একেবারে সকাল নয়টায়, নাস্তা খেতে। কিন্তু, নামাজের পর আজ আর কিছুতেই ঘুম আসছিল না তার, বারান্দায় বসেই কাটিই দিয়েছে এতটা সময়। ভোর বেলা দীর্ঘ সময় জেগে থাকার ফলে প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে তার। রান্না ঘরে গিয়ে দু’টা ডিম সিদ্ধ করতে দিয়ে, বিস্কুটের টিন নিয়ে বিছানার উঠে বসল সে।
এই ছোট্ট ফ্লাটে মামুন সাধারণত একাই থাকে। স্ত্রী বাঁধন থাকে নাটোরে মামুনের বাড়িতে তার মায়ের সাথে। এক মাস পর পর মেয়েকে সাথে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য এখানে এসে থাকে বাঁধন। ঢাকায় করোনা ছড়িয়ে পড়ায় এই মাসে তাকে আসতে বারণ করেছিল মামুন, তাই এই ফ্লাটে এখন একাই থাকছে সে। শুধু এই ফ্লাটটাই না, পুরো বিল্ডিংটাই বলতে গেলে একেবারে খালি। লকডাউনের সরকারি প্রথম নির্দেশের সাথে সাথেই বিল্ডিং এর সবাই বাড়ি খালি করে গ্রামে চলে গিয়েছে। অফিস ছুটি না দেয়ায় মামুন তখন থেকে যায়। ফলে এখন সে একেবারে আটকা পড়ে গিয়েছে ঢাকা শহরে। চারতলা বাড়ির তিনতলার দুটি ফ্লাটের একটাতে থাকেন বাড়িওয়ালা রহমান সাহেব ও তার স্ত্রী, আর চারতলার এই ফ্লাটে আছে মামুন, শুধুমাত্র এই তিনজনই এখন বসবাস করছে এই বাড়িতে। জরুরি প্রয়োজনে এই বাড়ি থেকে মামুন সবসময় একাই বের হয়। বাড়িওয়ালার অনেক বয়স হয়েছে, তাই তার দায়িত্বটা নিজে থেকেই নিয়েছে সে।
বাড়িতে কাজের লোকসহ সব রকমের বাইরের মানুষ নিষিদ্ধ করা হয়েছে গত সপ্তাহের শুরুতেই। তারপর থেকে বাড়িওয়ালি তিনজনের রান্না নিজেই করে থাকেন। বিপদের এই দিনে, তারা তিনিজন একটা পরিবারের মত তিনবেলা একসাথে খাওয়া-দাওয়া করে। বাড়িওয়ালার দুই ছেলেমেয়ে দেশের বাইরে থাকে, হয়তো সেই কারণেই মামুনের প্রতি দু’জনের বেশ একটা স্নেহসুলভ টান আছে।
টিন থেকে একটা বিস্কুট বের করে একটা কামড় দিতে না দিতেই, ভোরের স্বপ্নটা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো মামুনের। স্বপ্নটা মনে পড়লেই এখনও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে তার। দানবীয় শরীর, বিশাল ডানা, মানুষের মত আকৃতির পালক, ওই পালকটার দুলতে দুলতে হঠাৎ ঝরে পড়ার দৃশ্যটা, যেন খুব খারাপ কিছু একটার ইংগিত দিচ্ছে তাকে – খুবই অশুভ অপার্থিব একটা অনুভূতি! চিন্তার গভীরে হারিয়ে গেল সে।
রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা এক ধরণের টকটক শব্দে আবারো সম্বিত ফিরে পেল মামুন। ডিম সেদ্ধ হয়ে এলুমিনিয়ামের পাতিলের সাথে বারবার টোকা লাগায়, এমন একটা শব্দ হচ্ছে। রান্না ঘর থেকে ফিরে এসেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে, একটু পরেই বাড়িওয়ালার বাসায় গিয়ে স্বপ্নের বিষয়টা তাঁকে জানাতে হবে। উনি জ্ঞানী মানুষ, এই স্বপ্নের কোনো একটা ব্যাখ্যা তিনি হয়তো দিতে পারবেন তাকে।
[চলবে]
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD