সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক-এ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘ভাষাচিত্র’ ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘দেশের বই’ যৌথভাবে ভাষাচিত্রের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ‘ভাষাচিত্র বুক ক্লাব’-এ নিয়মিত বুক রিভিউ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে।
আয়োজনের অংশ হিসেবে বাছাইকৃত ও নির্বাচিত বুক রিভিউ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে আমাদের পোর্টালে। আজ প্রকাশিত হলো মৌরি মরিয়ম-এর উপন্যাস ‘সুখী বিবাহিত ব্যাচেলর’-এর রিভিউ।
—
রিভিউ করেছেন ফাইজা হাবিব নীবুলা
—
॥ ফাইজা হাবিব নীবুলা ॥
একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক একদল তরুণ-তরুণীকে নিয়ে এই উপন্যাস।এ যুগের তথা আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা একদল মানুষ। তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, ভালো লাগা, ভালোবাসা, বোহেমিয়ান জীবনের পেছনের নানা গল্প নিয়ে এই উপন্যাস।
উপন্যাসের সারমর্ম
বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যার সর্বোচ্চ সোপানেই দেখা হয় এই উপন্যাসের একঝাঁক তরুণ-তরুণীর। দীপ, মোহ, প্রজ্ঞা, সিধু, অন্যা, জিসান, আকাশ সপ্তমন্ডলীর এই সাত নক্ষত্রের মেলায় আলোকিত বন্ধু মহলের আকাশ।তবে এই আকাশ জোড়া নক্ষত্রের মেলায় দীপ, প্রজ্ঞা, সিধু, মোহ সবচেয়ে উজ্জ্বল তাদের বন্ধুত্বের দীপ্তিতে। হিরন্ময় আলোকছটায় উজ্জ্বল সেই বন্ধুমহল। তবে নক্ষত্র যেমন নিজেকে পুড়িয়ে আলো ছড়ায় চারদিকে, তেমনি এই চারজনের জীবনেও আছে নানা যন্ত্রণা। প্রজ্ঞা নিঃশব্দ ভালোবাসে চারুকলার এক সিনিয়রকে, যে নিজের জীবনযুদ্ধের তরীকে কূলে ভিড়াতে ব্যস্ত। মা হারা মোহ, এক সময়ের রাজকুমারী আজ সৎ মা আর পরিবারের চাপে নিজের বাড়িতেই নিজে পরাশ্রিত।পুরান ঢাকার ধনকুবেরের আদরের পুত্র হওয়া সত্তেও নিজের অব্যক্ত কষ্ট নিয়ে দিন শেষে গুমরে গুমরে মরে।এভাবেই প্রতিটা চরিত্রের নিজস্ব রসায়নে গড়ে উঠেছে আস্ত এক বন্ধু গাঁথা…
উপন্যাসের ধরন
এই উপন্যাসটি একটি সমকালীন উপন্যাস। সমকালীন উপন্যাসে সে সময়ের সমাজের হালচাল, সংস্কৃতি, জীবনযাপন, কুসংস্কার- সব ফুটে ওঠে। আর এ উপন্যাসে এ যুগের ছেলে-মেয়েদের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা সব ফুটে উঠেছে।
আবার আরেকদিক দিয়ে এটিকে একটি ভ্রমণ উপন্যাসও বলা চলে।ভ্রমণের স্থানের বর্ণনা, বিখ্যাত স্থান, সেই স্থানের খাবার নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আবার গল্পের চরিত্রের মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, তাদের মনের মিথস্ক্রিয়ার ফলে এ উপন্যাস ভ্রমণের পাশাপাশি প্রেমের উপন্যাসও বটে।
চরিত্র বিশ্লেষণ
শরৎঃ: উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র। বাড়ির বড়াে সন্তান, চিত্রকর। তবে খেয়ালি মানুষ একসময় হলেও আজ বাস্তবতার নিদারুণ নিষ্ঠুর চাবুকের আঘাতে এক লৌহমানব। এক সময়ের করা ভুলের মাশুলে জীবন বিপর্যস্ত। তাই তো আজ তার ভয়, ভালোবাসাও যে তার কাছে গলার কাঁটা। তার পায়ে পড়ানো বেড়ি।
প্রজ্ঞা : প্রজ্ঞা তার নামের মতোই আলোকিত। জ্ঞান, ধৈর্য, সব কিছুর মিশেলে মমতার এক আঁচল। কখনো সে শিল্পীর প্রেরণা, কখনো সে প্রিয়তমের প্রেয়সী নারী, কখনো সে আদুরে কন্যা, কখনো সে চিরায়ত বধূ, কখনো সে আপন কর্মক্ষেত্রে নিজের উজ্জ্বলতায় চির উজ্জ্বল এক তারা। প্রজ্ঞার চরিত্র বিশ্লেষণে একটা কথাই মাথায় আসে, সে আজকের নারী, যে ঘর বাহির এক সাথে সামলাতে পারদর্শী, দশভূজার মতো সে নিয়োজিত আপন কর্মে।
মোহ : সুন্দরী, বাবার আদরের রাজকন্যা। রাণীমার প্রয়াণের পর তার জীবনে নেমে এলো অমানিশা। সৎ মা আর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে অবিরাম যুদ্ধ করে চলেছে। পিতৃগৃহে আজ সে পরাশ্রয়ী। প্রচন্ড লক্ষী, বিদুষী হয়েও জীবনের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে সে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখে আনমনে।
দীপ : ধনকুবের বাবার ছেলে হয়েও ব্যক্তিগত জীবনে সাধাসিধে মানুষ।এই সাধারণ মানুষের মাঝে লুকিয়ে আছে চমৎকার একটা মন। বন্ধুদের বিপদে যে জীবন দিতেও পিছপা হয় না, আবার অন্যায় আচরণে সেই বন্ধুকে আচ্ছামত ধোলাই দিতে দেরি করে না। ভ্রমরের মতো বিভিন্ন ফুলের মধু খেয়ে বেড়ালেও নিজের ভালোবাসার সামনে সে বোবা হয়ে যায়, পূর্বের দুঃসহ স্মৃতি তাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে দেয় না।
সিধু : দীপের সেরা বন্ধু আর দুঃখী মানুষ। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে বাস করে মনের মানুষ খুঁজে পায় না সনাতন ধর্মাবলম্বী এই সিধু।প্রেয়সীকে পাওয়ার পথে সবচেয়ে বড়াে বাধা ধর্ম।
উপন্যাসের প্রয়োজনে এসেছে আরো চরিত্র। নানা চরিত্রের বর্ণিল সমাবেশে উপন্যাসের পটভূমি হয়েছে আরো চিত্তাকর্ষক।
শরতের ছোটাে বোন বর্ষার উপস্থিতি সমাজের বর্ণবৈষম্যকেই আঙুল তুলে দেখিয়েছে। উপন্যাসের অন্যতম প্রিয় চরিত্র ছিলো জাফরউল্লাহ সাহেব।একজন মমতাময়ী বাবা, কখনো মোমের মতো নরম, কখনো বজ্রের মতো কঠিন, তবে দিলখোলা, দরাজ দিলের এই মানুষটা যেন ছায়ারূপী এক বটগাছ, যার ছায়া তলে সুরক্ষিত পরিবারের সবাই।
এই গল্পের অন্যতম দুইজন খলনায়ক নায়িকা হলো ইশিতা আর অনিক।ইশিতা চরিত্র লোভী এক মানুষের, যে নিজের স্বার্থ উদ্ধারে হতে পারে নির্লজ্জ, বেহায়া কখনো বা সেয়ান পাগল।
আর অনিক বর্তমান সময়ের সেই সকল ছেলেদের প্রতিনিধিত্ব করছে যারা প্রেমের নামে শরীর সর্বস্ব বৈ আর কিছুই নয়।
গল্পের আরেক খলনায়িকা হলো তুলি। লোভের বশবর্তী হয়ে ভালোবাসার মানুষকে ঠকিয়ে আজ নিজেই ঈর্ষার আগুনে ঝলসে যাচ্ছে।
ভাষা
ভাষা ব্যবহারে লেখিকা এ যুগের ছেলেমেয়েদের চলমান সময়ে ব্যবহৃত ভাষার যে প্রয়োগ তা উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণে ব্যবহার করেছে।কুয়াকাটা ভ্রমণে প্রজ্ঞার বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার বা দীপের খাস ঢাকাইয়া ভাষার ব্যবহার চরিত্রগুলোকে পাঠকের সামনে জীবন্ত করে দিয়েছে। পুরা উপন্যাসে গুরুগম্ভীর বা দুর্বোধ্য শব্দের ব্যবহার হয়নি। তবে প্রচলিত শব্দের ব্যবহার করতে গিয়ে, লেখিকা কিছু স্ল্যাং ব্যবহার করেছেন।
প্রচ্ছদ
চমৎকার এ প্রচ্ছদে দেখা যায় খোলা নীল আকাশের নীচে দুইটা দাঁড়কাক বসে আছে মাটিতে। শুভ্রনীল আকাশ আমাদের মনের চারণভূমি আর দাঁড়কাক দুটি প্রেমিক সত্তা যারা সেই অসীম আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে চায়। কিন্তু তা আদৌ কি সম্ভব? মানুষের জীবনের মতো তাদের পায়েও সংসারের পরানো শিকল।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
গল্পের অন্যতম আকর্ষণ এর ভ্রমণ অংশটুকু। ভ্রমণ স্থানের নিখুঁত বর্ণনা, সেই স্থানের বিখ্যাত খাবার, দর্শনীয় স্থানের মনোরম বর্ণনা সাথে চরিত্রের মধ্যে চলা নানা টানাপোড়েন, মানসিক দ্বন্দ, এসবের সাথে গল্প দারুণ এক গতিতে ছুটে চলে নিজস্ব ছন্দে।
চরিত্রগুলো নানা সমস্যায় কীভাবে সমাধানের পথে এগিয়ে চলে তাও ছিল দেখার বিষয়। এই উপন্যাস পড়তে পড়তে আমিও হয়ে গিয়েছিলাম বন্ধুমহলের এক সদস্য। এ যুগের ছেলে-মেয়েদের সামনে যে সব সমস্যা সামনে এসে দাঁড়ায় তাই লেখক লেখার জাদুতে বুঝাতে চেয়েছেন, উপন্যাস পড়তে পড়তে পাঠক চরিত্রগুলোর সাথে একাত্মতা প্রকাশে বাধ্য।
উপন্যাসের সব চেয়ে ভালো লাগা ছিল, উপন্যাসের চরিত্রগুলো যেই সমস্যায় পড়ছিল, হোক তা মননে বা বাস্তবে তা একদম আজকের তরুণ প্রজন্মের সমস্যা, একদম বানোয়াট মনে হয়নি।
প্রিয় লাইন
মানুষের মন খারাপ হওয়ার ব্যাপারটা বড্ড উদ্ভট। একটার সাথে আরেকটা বাঁধা। অনেকটা রেলগাড়ির মতো। একসাথে অনেকগুলো আলাদা আলাদা বগি। প্রত্যেকটা বগিতেই একেকটা মন খারাপের গল্প থাকে। একটায় টান পড়লে সবগুলোতেই টান পড়ে।
সমালোচনা
প্রজ্ঞার সাথে ভোলাতে শরৎ যে ভ্রমণ অংশটুকু বর্ণিত তাতে নিয়াজ সাহেব (প্রজ্ঞার বাবা) আর মায়ের পারমিশনের যে ব্যাপারটা লেখিকা দেখিয়েছেন তা কি আদৌ সম্ভব? কোনো পিতা একজন কুমারী মেয়েকে অচেনা মানুষের সাথে যেতে দেয়?
ইশিতার পাগলামির পেছনের রহস্য এত দেরীতে শরৎ এর উদঘাটন! ইশিতার এতো নাটক সত্তেও শরৎ তা সাদির মাধ্যমে ইশিতার পরিবারকে জানালো না কেন?
তবে বর্ণবৈষম্য নিয়ে শরৎ এর আঁকা মায়াবতী ও মায়াবতীর পেছনের গল্প সমাজে আজও চলমান বর্ণ বৈষম্যের দর্পণ সদৃশ।
গল্পের প্রয়োজনে ব্যবহৃত বিভিন্ন চিত্রশিল্পের বর্ণনা মনোমুগ্ধকর তেমনি গল্পের চরিত্রদের মনের পরিস্থিতি বুঝাতে ব্যাবহৃত বিভিন্ন গানের ব্যবহার পাঠকের কাছে সেই মুহুর্তের চিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছে।
গল্পের প্রয়োজনে কিছু ব্যাক্তিগত মুহূর্তের অবতারণা গল্পের সাহিত্য সৌন্দর্য বৃদ্ধি করলেও সকল স্তরের পাঠকের জন্য কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্রেক করে। এই ব্যাক্তিগত মুহূর্তগুলি যদি লেখিকা রূপকের আড়ালে বলতো এতটা খোলামেলা আলোচনা না করে তাহলে উপন্যাসের সৌন্দর্য আরও কয়েকগুণ বেড়ে যেত।
বিয়ে ব্যাতিরেকে অবৈধ যৌনাচার আর ভালোবাসার নামে ঠকবাজির পরিণতি ও ফলাফল দুইটাই লেখিকা সমান তালে দেখিয়েছেন।
গল্পের অন্যতম একটা অংশ ছিল দুই প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যকার ধর্মের বিভেদ। ধর্মের এই বিভেদে ঝরে যায় কত প্রাণ তাও লেখিকা দেখাতে চেয়েছেন। তবে দিশার আচরণ খানিকটা পাঠকের জন্য বিভ্রান্তিকর ছিল।
তবে সব আলোচনা বা সমালোচনার উর্ধ্বে লেখকের মানসভূমিতে চলমান গল্প সব কিছুর উপরে। বন্ধুত্বের যে কঠিন এক শক্তি তার ক্ষমতা আবার পাঠককে বন্ধুত্বের শক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলে।
[২৪ মে ২০২০]
—
বইয়ের নাম : সুখী বিবাহিত ব্যাচেলর
লেখক : মৌরি মরিয়ম
প্রকাশক : অধ্যয়ন
প্রচ্ছদ : আরাফাত করিম
মুদ্রিত মূল্য : ৮০০ টাকা
—
প্রিয় লেখক-পাঠক-প্রকাশক
আপনার ভালোলাগা যে কোনো বইয়ের রিভিউ পাঠাতে পারেন আমাদের। বইয়ের একটি ভালো ছবিসহ আপনার লেখা ইমেইল করুন এই ঠিকানায় : desherboi@gmail.com
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD