বই পড়ি মনের টানে, অন্তরের আকর্ষণে, শেখার আগ্রহে…
॥ সাধনা সাহা ॥
“আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি
এ আপনারই আবরণ!
খুলে দেখ দ্বার,
অন্তরে তার আনন্দ নিকেতন।”
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
বন্ধ আবরণের মোড়কে মোড়া আমার পোড় খাওয়া জীবনটা। বই, রবীন্দ্রনাথ আর ভাষাচিত্র সবাই মিলে মনের আগল ভেঙে এক আনন্দ নিকেতনের পথ কিছুটা হলেও মসৃণ করে দিয়েছে।
আমি সাধনা সাহা। জন্ম মধুমতীর পাড়ে গড়ে ওঠা সবুজ, শ্যামলে পরিবেষ্টিত ছায়া ঘেরা, মায়া জড়ানো এক মফস্বল শহরে। যার নাম গোপালগঞ্জ। গোপালগঞ্জ শহরের পুরাতন বাজার রোডে ৭ ডিসেম্বর আমার জন্ম। বাবা মায়ের প্রথম সন্তান। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়ো আমি। প্রথম বিদ্যাপীঠ হলাে ” বীনা পাণি সরকারি (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) বালিকা বিদ্যালয়”। প্রথম শ্রেণি থেকে এসএসসি (১৯৮৪) পর্যন্ত। তারপর গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু মহাবিদ্যালয় (বর্তমানে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এইচ.এস.সি. (১৯৮৬) এবং বিএসসি (১৯৮৮) পাস করি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে এমএসসি শুরু করি। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আগে বাবা বিয়ে দিয়ে দেন। মধ্যবিত্তের যূপকাষ্ঠে এমএসসির বলি হয়।
বৈবাহিক সূত্রে আমি বাগেরহাট জেলার বাসিন্দা হলাম। আর বর্তমানে স্বামীর চাকরিসূত্রে খুলনায় বসবাস। বিয়ের এক বছর পর খুলনা থেকে ‘বি.এড’ কোর্স করি। কিন্তু সংসার নামক বিশাল বটবৃক্ষের ডালপালা, শিকড়ে এমনভাবে আটকে গেলাম যে নিজের অস্তিত্ব নামক স্বপ্নটা ম্লান হয়ে গেল। শাশুড়িমার হঠাৎ অসুস্থতায় আমাকে সংসারের শৃঙ্খলে বাঁধা পরতে হলো।
এবার বইয়ের কথায় আসি। চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণিতে যখন, তখন থেকেই পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বাড়তি বই পড়ার সুযোগ আসে। বই পড়ার ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহ পেয়েছি মায়ের কাছ থেকে। প্রতিদিন বিকেলে মা মহাভারত, রামায়ণ সুন্দর সুর করে পড়তেন। আমার জেঠামহাশয়কে পড়ে শোনাতেন। মায়ের গলার সুরেলা ছন্দ ঐ বয়সেই রামায়ণ, মহাভারত পড়ার আগ্রহ তৈরি করেছিল।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘ছুটি’ পাঠ্য বইয়ে থাকায় রবীন্দ্র আকর্ষণ শুরু হয়। ছুটি গল্পটি কতবার যে মাকে পড়ে শুনিয়েছি তার কোনো হিসেব আমার নথিতে নেই। তবে আমি যতবার গল্পটা পড়েছি ততবার আমার মা আঁচলে চোখ মুছেছেন। আস্তে আস্তে রবীন্দ্র ক্ষুধা বাড়তে থাকে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দুজন বান্ধবী পেয়েছিলাম যাদের বইয়ের দোকান ছিল। স্কুলে ওরাই আমাদের বান্ধবীদের বইয়ের যোগান দিত। ঠিক লাইব্রেরির মতাে।
সেবা প্রকাশনীর মাসুদ রানা সিরিজের ধ্বংস পাহাড়, রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা সিরিজ দিয়ে শুরু হয় বইয়ের সাথে সম্পর্ক। প্রথম উপন্যাস শুরু হয় ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের ‘চিতা বহ্নি মান’ দিয়ে। নায়িকা তপতী এখনও হৃদয়ে বাসা বেঁধে আছে। ওনার অনেক বই পড়েছি। যেমন আশীর্বাদ, বঁধু, চিরদিনের সাথী, সোহাগ সিঁদুর, রিক্তের বেদন, স্ত্রীর পত্র, সবার উপরে, জীবন নদীর তীরে, কাটা ও কেঁয়া, শাপমোচন, মন ও মানসী, এই শুভক্ষণে, ডাক্তার কিউসহ আরও কিছু বই। তারপর প্রেমে পড়ি নীহার বাবুর কিরিটি রায়ের। হীরা চুনি পান্না, মুক্তোর মালা, রাতের রহস্য, রাত নিঝুম, রাত্রি শেষের তারা, ধূপ শিখা, বন্দী বিহঙ্গ, বিষের ধোঁয়া, আশীর্বাদ, মায়া মঞ্চ, মেঘকালো, রাগীনি, অপারেশন, লাল চিঠিসহ আরও কিছু বই। শরৎ বাবুও কম যান না। উনার দেবদাস, শুভদা, বিরাজ বৌ, পরিণীতা, শ্রীকান্তসহ প্রায় সব উপন্যাস আর ছোটোগল্পগুলোও করায়ত্ত হলো। শাপমোচন বইটা ক্লাসের বইয়ের ভেতরে ঢুকিয়ে সারারাত জেগে শেষ করি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো শেষ মুহূর্তে এসে মায়ের কাছে ধরা খাওয়া, সঙ্গে মায়ের বকুনির টক, ঝাল, মিষ্টি স্বাদ অনুভব করা- আজও স্মৃতিতে বিরাজমান।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে। তখন বই পড়ার সাথে শুরু হয় টুকটাক কলম যুদ্ধ। কলেজ ম্যাগাজিনের জন্য বন্ধুদের প্রেরণায় হাতে ওঠে কলম। কলেজে আমরা দেয়াল পত্রিকাও বের করি। টুকটাক লেখালেখির পাশে চলে বইয়ের সাথে প্রেম। তখন পড়ার বিষয়ে আসে একটু ভিন্নতা। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ দিয়ে শুরু হয় হুমায়ুন আহমেদকে জানা। মিসির আলী, হিমু হয়ে ওঠে প্রিয় চরিত্র। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদাও মনে আঁচড় কাটে। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী আজও হাতড়ে বেড়ায় রেললাইন দেখার অদম্য স্পৃহা, অপু দূর্গার খুনসুটি। নিমাই বাবুর মেমসাহেব, বঞ্চিতা, নাচনী, মনের মনিকোঠায় জ্বলজ্বলে হয়ে আছে। সমরেশ মজুমদারের সাতকাহনের দীপাবলি সমস্ত অন্তর মন জুড়ে। মানিক বাবুর পদ্মানদীর মাঝির কুবের আর কপিলার অতৃপ্ত প্রেম মনকে বিচলিত করে। প্রভাবতী দেবীর সোনার সংসার, যে মন নীরবে কাঁদে; মৈত্রেয়ী দেবীর বিধি ও বিধাতা; সমরেশ বসুর ধর্ষিতা; আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের এবার লগ্ন, শেষ প্রহর, সেই তুমি সেই আমিসহ আরও আরও অনেক লেখকের বই। দুঃখ একটাই সংগ্রহে নেই। বিয়ের পরে দেবরের সংগ্রহ থেকে পড়েছি তসলিমা নাসরিনের লজ্জা, ফেরা, শোধ, নির্বাচিত কলাম, উচিত জবাব। পড়েছি বুদ্ধদেব গুহের হলুদ বসন্ত, একটু উষ্ণতার জন্য, বাবলী; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অন্দরমহল, বিমল মিত্রের সংসার সীমান্তে, কৃষণ চন্দরের এক বেশ্যার চিঠি, গাদ্দার, বঙ্কিমবাবুর রচনা সমগ্রও শেষ করি। ছেলের সুবাদে জাফর ইকবাল সাহেবের সায়েন্স ফিকশন সমগ্রসহ কিশোর থ্রিলারগুলোও বাদ পড়েনি। সুকুমার রায়ের রচনাবলীও মনের কোণে ঠাই পেয়েছে। এখন চেষ্টা করছি নতুন লেখকদের লেখাগুলো পড়তে। নতুনদের লেখাগুলো নতুনভাবে টানে আমায়। বই দেখলেই আমাকে পড়তে হবে এমন একটা ভাব কাজ করে আমার ভেতর। তবে দুঃখ একটাই স্কুল কলেজ জীবনে পড়া বইগুলো বান্ধবী মারফত পাওয়ার কারণে সংগ্রহে নেই। তবে এখন চেষ্টায় আছি বই সংগ্রহ করার।
আমার শখ! সে তো অনেক কিছুতেই বিরাজমান। বই পড়া তো আছেই সঙ্গে সেলাইয়ের কাজ যেমন- সূচ-সূতার কাজ, কুশি কাঁটার কাজ, চটের কাজ, সেলাই মেশিনের কাজ।পুঁথি দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করাও আমার একটা শখ। এ কাজগুলোও আমাকে অনেক আনন্দ দেয়। বাগান করাটাও আমার একটা বিশেষ শখ। ঘুরতে যাওয়া, গান শোনা বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীতের প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল আমি।
বিয়ের পরে সংসারের মারপ্যাচে লেখালেখি একদমই ভুলে গিয়েছিলাম। বড়ো ছেলেটা পুরনো কাগজপত্র ঘাটতে গিয়ে আমার কলেজ জীবনের টুকিটাকি লেখা খুঁজে পায়। ওরই উৎসাহে আবার কলম হাতে ওঠে। আর একটা কথা না বললেই নয়। লেখক গিয়াস আহমেদ আমার সহপাঠী। ওনার এবং ওনার ভাই, বন্ধুজনদের ফেসবুকে লেখা দেখে উৎসাহী হয়ে উঠি। বলা যায় ওনাদের লেখা আমাকে অনেকটা অনুপ্রাণিত করে। গিয়াস আহমেদের “চন্দ্রযান – দ্য লুনাটিক এক্সপ্রেস” এর রিভিউ দিয়ে শুরু হয় আমার রিভিউ লেখা। তবে আমার ছেলের উৎসাহই আজ আমাকে ভাষাচিত্রের দ্বার গোড়ায় এনে হাজির করেছে। ১৯৯২ থেকে ২০১৮ বিশাল গ্যাপে হাতে কলম তুলি। ভাষাচিত্রের সংস্পর্শ আমাকে নতুনভাবে জীবন সাজাতে শিখিয়েছে।
বই নিয়ে কোনাে প্রাপ্তি বা সম্মাননা আমার জীবনে আসেনি। আসলে সম্মাননার কোনাে যোগ্যতাই আমার নেই। আমার অবস্থা হলো,
“যে ডাল ধরি, সে ডাল ভাঙ্গে,
ডাল তো আমায় ধরে না…!”
তবে হ্যা একটা প্রাপ্তি হয়েছে তাও আবার খন্দকার সোহেল ভাইয়ের কল্যাণে। ‘চন্দ্রযান’ এর রিভিউটা “দেশের বই ” নিউজ পোর্টালে প্রকাশ করে দিয়েছেন। এই প্রাপ্তিটা আমায় কিছুটা হলেও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে।
ইচ্ছে আছে একটা ঘরোয়া লাইব্রেরি করার। দুই-তিন হাজার বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন লেখকের বই থাকবে। বার্ধক্যের সঙ্গী করতে চাই বইকে। ধর্মীয় থেকে শুরু করে সব ধরনের অল্প বিস্তর বই থাকবে আমার বুকসেলফ জুড়ে। আর লেখালেখি…!
“ইচ্ছেরা কীভাবে ডানা মেলবে তা ইচ্ছেরাই জানে।”
বই পড়া আমার জীবনের প্রথম শখ। বই পড়ি মনের টানে, অন্তরের আকর্ষণে, শেখার আগ্রহে, ভালো মন্দ বিচার বোধের তাগিদে, জ্ঞানের অন্বেষণে। যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন বইয়ের প্রতি ভালোবাসা অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাব। আমার শুরুটা যেমন রবীন্দ্রনাথ দিয়ে করেছি শেষটায়ও তার আশ্রয় নিয়ে বইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলি,
“তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার। ”
ভালো থাকুক পাঠক, ভালো থাকুক লেখক, ভালো থাকুক ভাষাচিত্র।
[ আপনি যদি বইপ্রেমী পাঠক হয়ে থাকেন, আপনার সম্পর্কে, আপনার বই পড়া সম্পর্কে, আপনার অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ পাঠক প্রোফাইল পাঠিয়ে দিন আমাদের ই-মেইলে। আপনার প্রোফাইল প্রকাশিত হবে আমাদের অনলাইলে। এছাড়া বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের যে কোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : boideshnews@gmail.com ]
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD