খারাপ শিল্পী মাত্রই অপরাধী, কেননা তাঁরা জীবনের ভুল ছবি তুলে ধরেন। একজন শিল্পী তো কালের দলিলরক্ষক, রেকর্ড কিপার। একজন প্রকৃত শিল্পী তো তিনিই যিনি তাঁর কাল ও পরিপার্শ্বের বিশ্বস্ত ছবিকে আগামী পৃথিবীর সজীব অনুভূতির জন্য রেখে যান। এই দরকারের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি যা আঁকতে যাচ্ছেন তার উপর যদি ফিরে ফিরে কেবলই নিজের ছোপ লাগাতে থাকেন, তবে আগামীকালের পৃথিবী তাঁর লেখার ভেতর থেকে তাঁকে খুঁজে পেলেও তাঁর অব্যবহিত পৃথিবীকে খুঁজে পাবে না। একজন শিল্পী যা কিছুই আঁকেন তাকে তাঁর ভিতরকার রুচি ও পরিশীলন দিয়ে আলোকিত করে তুলতে পারেন, তাকে জ্বলন্ত বাস্তব বোধের স্পর্শে বিশ্বাসযোগ্য ও রক্তমাংসময় করে তুলতে পারেন-উচ্চায়ত মূল্যবোধ ও জীবনদৃষ্টির সংক্রমে তাকে বড় করে তুলতে পারেন, কিন্তু তার সাহিত্য-পরিচয় থেকে তাকে সরিয়ে অন্যকিছু করে তুলতে পারেন না। এটা করতে গিয়ে শিল্প শক্তিহীন হয়ে পড়ে। – এজরা পাউন্ড
তিনি, রাবেয়া খাতুন এই মহানগরীর অন্যতম ‘সিনিয়র সিভিলিয়ান’ ও বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের প্রবীণ কুশীলবদের একজন। বাংলা-সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি একাডেমি ও রাষ্ট্র কর্তৃক সম্মানিত, স্বীকৃতি প্রাপ্ত। তাঁর পরিণত বয়সের রচনা জীবন ও সাহিত্য আমাদের আলোচ্য বিষয়।
একজন সাহিত্যিক ঘটনার বর্ণনা নিমিত্তে তথ্যের উপস্থাপনকালে নিজেকেও প্রকাশের প্রয়াস পান, সচেষ্ট হন। আর তিনি তো ঘোষিতভাবেই তাঁর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে আলোচনা জারি করেছেন। তৎ-প্রণীত অধিকাংশ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট বয়ানকল্পে তিনি আমাদেরকে তাঁর জীবন-সংগ্রাম, সাহিত্যিক-জীবন, সাহিত্য-ভাবনা, পঞ্চাশের দশক থেকে প্রায় সমসাময়িক কাল পর্যন্ত বাংলা-সাহিত্যের অন্দর-বাহিরের পর্যবেক্ষণ জানাচ্ছেন। বাদ যাচ্ছে না তাঁর সৃষ্টিকর্মের অন্যান্য দিক, যেমন: ছোটগল্প, গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপান্তর, ভ্রমণকাহিনীও। সঙ্গে সঙ্গে উদ্দিষ্ট সময়ে আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন বাঁক পরিবর্তনে সৃষ্ট সামাজিক অভিঘাতের বয়ান তো থাকছেই। ঘটনার উপস্থাপনে, বাস্তবের পর্যবেক্ষণে তিনি বেশ নির্মোহ। তাঁর দৃষ্টিও তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছ-গভীর। বাস্তবতার দ্বন্দ্ব কিংবা স্ববিরোধকে তিনি কোনোরূপ পবিত্রতা আরোপ না করেই অবলোকনে সক্ষম। উপরন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিপুল জীবন-অভিজ্ঞতা, তাই তিনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন –
…ভাবই আসল, ভাষা তার বাহকমাত্র।…প্রচলিত এ তথ্য আমার অভিজ্ঞতায় সঠিক বলে মনে হয়নি। ভেতরে ভেতরে আবেগ ফুটন্ত টগবগে কিন্তু শব্দে, ভাষার কিশলয় সেখানে জন্ম নেয় নি। চোখের সামনে দেখা, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধিগত চিত্র ফোটেনি ভাষার অসহযোগিতায়। আমার তীব্র অভিজ্ঞতা কখনো বরং উল্টোটাই মনে করিয়ে দিয়েছে।
অভিজ্ঞতা হয়তো তাঁকে যথার্থই মনে করিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় পঠন-পাঠনে জানি ঐতিহাসিকের ইতিহাসচর্চা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর রাজনীতির বয়ান, সমাজবিজ্ঞানীর বিভিন্ন সামাজিক অভিঘাতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, ভাষাবিজ্ঞানীর ভাষাসংক্রান্ত ভাবনা-চিন্তার পদ্ধতির সঙ্গে সাহিত্যিকের চর্চার পদ্ধতিগত ফারাক বিদ্যমান। পরীক্ষণ নকশা ( Experimental Design) যেটাই হোক (RBD, CRBD, LSD ), চলক (veriable)-কে যেভাবেই চয়ন করা হোক না কেন, অভিজ্ঞতা অভিজ্ঞতাই। অন্যকিছুই এর বিকল্প নয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, তাঁর শৈশব-কৈশোরের যে ঢাকার চিত্র তিনি এঁকেছেন তাকে আমলে নিতেই হয়। যেমন নিতে হয় বুদ্ধদেব বসুর আমার যৌবন-এ চিত্রিত তৎকালীন ঢাকার বর্ণনাকে। একই কথা তৎকর্তৃক পর্যবেক্ষিত রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও প্রায় সমভাবে প্রযোজ্য।
২.
বিদ্যমান সামাজিক বাস্তবতা ও কাঠামোর ভেতরও শিল্পী-সাহিত্যিকেরা তাদের নিজস্ব সামাজিক বাস্তবতা ও কাঠামো সৃজন প্রয়াসী। একজন সাহিত্যিকের সামাজিক-জীবন ও সাহিত্যিক-জীবনের মাঝে প্রায়শই ভেদরেখা দৃশ্যমান। রাবেয়া খাতুনও এর ব্যতিক্রম নন। সফলতার সঙ্গেই তাঁর পারিবারিক তথা সামাজিক ও সাহিত্যিক জীবন-চক্রকে উপস্থাপনের প্রয়াস পেয়েছেন। ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক জীবনের উপস্থাপনায় তিনি বেশ সাহসীও। তাঁর ব্যক্তিজীবনের বিষাদময় দুর্ঘটনার শালীন উপস্থাপন সুবেদী পাঠকের দৃষ্টি যেমন এড়ায় না, তদ্রুপ এড়ায় না তাঁর জীবন-সংগ্রামও। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঝুঁকি নিয়েই তাঁকে জীবনের প্রয়োজনে বিভিন্ন পত্রিকা অফিসে ছুটতে হয়েছে। সাহিত্যিক-সত্তা লালনের নিমিত্তে কৈশোরে তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে পারিবারিক ও সামাজিক বিরুদ্ধতার। এই বিরুদ্ধতার স্বরূপ থেকেই অনুধাবন করা যায় সময়ের চাইতে তাঁর প্রাগ্রসরতাকে।
পরবর্তীকালে এই প্রাগ্রসরতাই তাঁর সামাজিক ও সাহিত্যিক-জীবনে সফলতার অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। বাস্তবতাকে সফলভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কিংবা অনুধাবনই যথেষ্ট নয়, সফলতার জন্য প্রয়োজন দ্রুত কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা ও গৃহীত সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়নের দক্ষতা। মহানগরী ঢাকা শুধুমাত্র দেশেরই নয়, সাহিত্যেরও রাজধানী। এখানে নবাগতের মনস্তত্ত্ব নিয়ে তিনি যে বক্তব্য হাজির করেছেন, কিংবা নারী-সাহিত্যিকের করণকৌশল নিয়ে তাঁর অভিমত আমাদেরকে এমনটিই ভাবতে প্রাণিত করে। তাছাড়া লেখকের সঙ্গে প্রকাশকের সম্পর্ক নিয়ে তাঁর ভাবনা এবং পাঠকের মতামত চাহিদার নিরীখে তৎগৃহীত করণকৌশলও আমাদের সপক্ষেই কথা বলবে। সব মিলিয়ে তাঁর দৃষ্টিতে –
…প্রকৃত লেখক কেউ কারো অনুকরণে তৈরি হয় না। গোড়া থেকেই তার নিজস্ব রূপ গড়ে ওঠে। নিজস্ব বক্তব্য এবং মতামত। প্রকৃতি, পরিবেশ, অভিজ্ঞতার মনোনীত নিরীখে তার পথচলা। সেখানেই সে আলাদা অপর থেকে। সেখানে যারা অন্য মানস-ভাবনার প্রতিচ্ছবি আশা করে তারা করুণার পাত্র ছাড়া আর কিছু নয়।
এই স্বাতন্ত্র্যপিয়াসিতার কারণেই হয়ত তিনি তাঁর লেখা বিষয়ে সমালোচকের মতামতকে গভীর আগ্রহ নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন। এমনকি একাধিক সমালোচকের সম্পূর্ণ বক্তব্য তিনি পরিণত বয়সের এই রচনায় উদ্ধৃতও করেছেন। পক্ষে যায়নি, স্বাদেও কটু এমন সমালোচনার রেফারেন্সও তিনি তাঁর পাঠককে জানিয়েছেন। কেননা তিনি জানতেন সমালোচকের বক্তব্য তাঁকে শ্রেয়তর শুদ্ধ হতে সাহায্য করেছে, তাঁর সৃষ্টিকর্মকে করেছে অধিকতর নিখুঁত।
৩.
কথিত আছে, ঔপন্যাসিকের মনস্তত্ত্ব বিজ্ঞানীর মনস্তত্ত্বের নিকটবর্তী। কেননা, উপন্যাসের প্রথম লাইনটির বক্তব্যও ঘটনার বিন্যাস ও কাহিনীর পরম্পরা রক্ষার স্বার্থে ঔপন্যাসিক বিস্মৃত হতে পারেন না। তাছাড়া জীবনকে বৃহৎ পরিসরে গভীরভাবে অবলোকনের মাধ্যমে বিশ্বজগৎকে মানব-জগতে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় উপন্যাস একটি বড় সহায়। ফলত বিজ্ঞানী ও ঔপন্যাসিকের ব্যবহৃত যুক্তির শৃঙ্খলায়, দৃষ্টির অনুপুঙ্খতায়, মিলের মাঝে অমিল ও অমিলের মাঝে মিল খোঁজার প্রবণতায় নিকটবর্তী সাযুজ্য বিদ্যমান। অত্র গ্রন্থকারের উপন্যাস-রচনার প্রেক্ষাপট, গঠনশৈলী ও ‘কৌশল-বর্ণনা’ কাহিনীতে বর্ণিত ঘটনার অনিবার্যতা ও সম্ভাব্যতা নির্ধারণ কিংবা নিরূপণের যে ধরনের প্রয়াস আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তা উপর্যুক্ত সাযুজ্যের কথা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেয় বৈকি।
তাছাড়া তৎবর্ণিত বিভিন্ন সাহিত্য-সম্মেলনে নানা সংগঠন কর্তৃক সাহিত্যিকদের নিবেদিত-চর্চার স্বীকৃতি-প্রদান অনুষ্ঠানের, সাহিত্যিকদের ঘরোয়া অনুষ্ঠানের বয়ানে, সাহিত্যিক সতীর্থ কিংবা অনুজ-অগ্রজ সংক্রান্ত বচনে, এমনকি নিজস্ব পঠন-পাঠন ও ভ্রমণ অভিজ্ঞতার উপস্থাপনে, ঘনিষ্ঠ অথবা সাহিত্যিক বন্ধু-বান্ধব-সুহৃদের সঙ্গে অতিবাহিত সময়ের চিত্রণে তিনি যে তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়েছেন সেখানে নিজস্ব ভাব প্রতিষ্ঠায় তিনি সফল। সাহিত্যের সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত পরিব্রাজনাবস্থায় তাঁর উপলব্ধি-
…সওদাগরী সাহিত্য রচনাকারীরা পুঁজির সেবাদাস, এক জাতীয় প্রকাশককে [এরা-লেখক] যেমন খুশি করছে, তেমনি তৈরি করছে নিম্ন বিকৃতরুচির পাঠক। সাহিত্যের নামে অসাহিত্যের ড্রাগস খাইয়ে অর্বাচীন পাঠকদের নেশাগ্রস্ত করে সাহিত্যকে তুলে দিচ্ছে পণ্যের বারবাজারে।
কোয়ালিটি নয় কোয়ানটিটির জয়জয়কার। একজন যথার্থ লেখকের জন্য থাকে যন্ত্রণাজটিল নানা অধ্যায়। সেই সঙ্গে যোগ করা বিপুল শূন্যতাবোধ, দ্বান্দ্বিক অস্থিরতা, দুঃসহ নিঃসঙ্গতা। সব লেখকের চলার পথ একধরনের হয় না। জীবনও সবসময় বাঁক ছাড়া নয়। স্খলন, পতন, ত্রুটি, নানামুখী মোড়। যাই থাক শিল্পসৃষ্টির প্রক্রিয়া শিল্পীকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করেই রাখে। গুরুত্বপূর্ণ লেখার পাশাপাশি হালকা বিষয়ভিত্তিক বই হতে পারে। সে সম্পর্কে দু’মুখী বিচার হওয়াও বিচিত্র নয়। বাস্তবতার স্বরূপ এক একজনের অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞানে ভিন্ন ব্যাখ্যায় ধরা দেয়। কিন্তু প্রয়োজনে এপাশ-ওপাশ ঘুরলেও প্রকৃত লেখক ছায়ারূপ অনুভবে বেশিক্ষণ হাবিজাবি চাপাতে পারেন না। গুরুমুখী বিদ্যা না হলেও যুগ যুগান্তের শুদ্ধ সাহিত্য-গুরুরা যে মন্ত্র তাদের কানে রেখে যায়, সেখান থেকে কেবল ব্যক্তিস্বার্থে বাণিজ্যিক বাজারে পণ্যের স্তরে নামা যায় না।
… পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সাহিত্য যদি ব্যবসায়ীর পণ্য হিসাবে উপযোগী হয়ে ওঠে তবে অনিবার্য হয়ে ওঠে শিল্পমান থেকে পুজিনির্ভর বস্তুর প্রবেশ। কারো মতে বুর্জোয়া যুগের এটা অর্থনীতিঘটিত পরিস্থিতি। দেশভেদে, শিক্ষিতের সংখ্যা, আর্থিক সংস্থান অনুযায়ী বাজার। সাহিত্যের পরোয়া করে না। বিশেষ করে গল্প উপন্যাসের ক্ষেত্রে। পণ্য লেখক এবং পুুঁজিবাদী প্রকাশক যখন একসঙ্গে হাত মেলান, সাহিত্যের আকাশের জন্য সে এক দুর্যোগপূর্ণ ভয়ংকর ক্ষতিকর সময়।
একই লেখক যিনি সৃজনশীল অথচ প্রয়োজনে প্রমোদ জাতীয় সাহিত্যেও পিছিয়ে থাকেন না। স্বদেশে বিদেশে এর ভালো নজির রয়েছে। বালজাক, এমিল জোলা যাদের সামগ্রিক রচনার শিল্পমূল্য উঠেছে হাতে গোনা সৃষ্টিতে। …জেনে শুনে যারা বিশেষ খান ( হবে বিষ খান- লেখক) তারা ভয়াবহ নন। কিন্তু পান করবেন বিষ, বিশ্লেষণ দেবেন অমৃতের, চোরা শত্রুতায় এরা সাহিত্যের ঘরে চৌদ্দটা বাজিয়ে ছাড়ে।
শুধুমাত্র তথ্যহিসেবেও তিনি যা উপস্থাপন করেছেন তাও বেশ প্রাসঙ্গিক। এই তথ্যগুলো কোনো কোনোটা যেমন সাহিত্যের ইতিহাস হতে চয়নকৃত ঠিক তেমনি তৎউপস্থাপিত বেশকিছু তথ্যও হয়ত বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় কাজে দেবে। বিভিন্ন সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক ঘটনার তথ্যের উপস্থাপনেও তিনি চমৎকারিত্ব প্রদর্শন করেছেন। সোস্যাল ভ্যালুর পক্ষে (যেমন সুইডেন) তাঁর তথ্যের ব্যবহার বিষয়ানুগ ও কৌতূহল উদ্দীপক।
৪.
জীবন ও সাহিত্য একটি আত্মজৈবনিক রচনা। ফলত এতে উপস্থাপিত বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমতের তেমন কোনো সুযোগ বিদ্যমান নেই। শুধুমাত্র উপস্থাপিত বক্তব্যের কোনো স্ব-বিরোধ, এর বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বর্ণিত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা সাহিত্যিক অবস্থা-ব্যবস্থার বয়ানকে নির্মোহভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলে মাত্র। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে লেখক এই সব ক্ষেত্রেও সাফল্যের সঙ্গে উৎরে গেছেন। ছয়টি মানবিক মূল্যের (Value)- তাত্ত্বিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও নন্দনতাত্ত্বিক-মধ্যে তাঁর উপস্থাপিত বক্তব্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যের অবস্থান সর্বাগ্রে। তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক মূল্যের অবস্থানও দৃশ্যমান কিন্তু ততটা প্রবল নয়। আর ধর্মীয় ও নন্দনতাত্ত্বিক মূল্য নামকাওয়াস্তে বিরাজিত। তাঁর উপস্থাপিত বক্তব্যে নগর যতটা দৃশ্যমান, গ্রাম ঠিক ততটা নয়। তাছাড়া, গ্রন্থটি পাঠশেষে ‘লেখকের ইচ্ছাসমাজ’ সম্পর্কে পাঠক কোনো স্পষ্ট ধারণা কিংবা অবয়বের সন্ধান পায় না।
Text-এর উপস্থাপনে যেসব ত্রুটি থাকা কিংবা হওয়া সম্ভব তার প্রায় সবকটিই অত্র গ্রন্থে বিরাজিত। যেমন : বানান ভ্রান্তি যে কোনো বিচারে মাত্রা ছাড়িয়েছে। বাক্যগঠনে গড়বড়, একশব্দের বর্ণ অন্য শব্দের সাথে যুক্ত হওয়া, একই বাক্যের একাধিক বার স্বতন্ত্র রূপে কিংবা অন্যবাক্যের সাথে সংযুক্তভাবে উপস্থিত হওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সব ক্যারিক্যাপচারে দুচারটি বাক্য অশ্লীল অর্থ ও অবয়ব নিয়ে পাঠকের সম্মুখে হাজির হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও জন্ম দিয়েছে হাস্যরসের। তাঁর স্তরের একজন লেখক যিনি তিন ডজন উপন্যাসের ‘স্রষ্টা’ তিনি সফল বাক্যগঠনে সক্ষম নন একথা বিশ্বাস করা কঠিন। বরং আমরা ধরে নিতে পারি এটা প্রকাশনা সংস্থাটির পেশাগত অদক্ষতার নমুনা। আমাদের প্রকাশনা সংস্কৃতির দৈন্যের একটা দৃষ্টান্ত হিসেবেও একে অভিহিত করা যায়। এইসব বাধা অতিক্রম করে গ্রন্থটির পাঠ অভিনিবেশ আশা করা কঠিন, হয়ত অনুচিতও। তবে যদি কেউ তা করেই ফেলেন, তার সময় নেহায়েত অপচয়িত হবে না এ-কথা বলা যায়।
বই : জীবন ও সাহিত্য
লেখক : রাবেয়া খাতুন
প্রকাশক : অনন্যা
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি-২০১১
মূল্য : ৩০০ টাকা
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD