১৯৭০ সাল। বিখ্যাত লেখক আহমদ ছফা ঠিক করলেন পিএইচডি করবেন। পেয়ে গেলেন ঢাকা ভার্সিটির ফেলোশিপ। এখন দরকার একজন অফিসিয়াল থিসিস সুপারভাইজার। বন্ধুদের পরামর্শে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের বাড়িতে গেলেন আহমদ ছফা। সেখান থেকে সখ্যতা, আস্তে আস্তে সম্পর্ক বৃদ্ধি। ১৯৭২ থেকে পরবর্তী এক যুগে প্রতি সপ্তাহে দেখা হতো গুরু শিষ্যের। এই দীর্ঘদিনের পরিচয়, আব্দুর রাজ্জাক স্যারকে নিয়েই আহমদ ছফার ‘যদ্যপি আমার গুরু’। এখানে ব্যক্তি আব্দুর রাজ্জাক, তাঁর বিভিন্ন ঘটনা ও দর্শন ভঙ্গি তুলে ধরেছেন আহমেদ ছফা।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। দেশের জাতীয় অধ্যাপকদের একজন। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট। দাম্পত্য জীবনে চিরকুমার। বাংলা সাহিত্যের সাথে জড়িত অনেক প্রবাদ পুরুষের সাথে তাঁর ছিল ঘনিষ্ট সম্পর্ক। আছে অনেক মজার ঘটনা। কথা বার্তা ও খানা খাদ্যিতে তিনি ঢাকার ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরেছিলেন। তাঁর মুখ হতে উচ্চারিত ঢাকাইয়া বুলি অনেক আধুনিক মনে হত। তাঁর সবচেয়ে বড়গুণ জ্ঞানের সেবা। নিজে যেমন জ্ঞান অর্জন করতেন, তেমনি অন্যকেও অনুপ্রেরণা দিতেন জ্ঞান সাধনায় ব্রত হওয়ার প্রতি।
আহমদ ছফা ‘প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের মতো আমাকে অন্য কোনো জীবিত বা মৃত মানুষ অতো প্রভাবিত করতে পারেনি’ কথাটার মধ্যে দিয়ে আব্দুর রাজ্জাকের অনুপ্রেরণা দেয়ার ক্ষমতাকে তুলে ধরেছেন। রাজ্জাক সাহেব তাকে প্রচুর বই পড়তে বলতেন। নোট রাখতে বলতেন। প্রয়োজনে ধমকও দিতেন। বলতেন, ‘যখন কোনো নতুন জায়গায় যাইবেন, দুইটা বিষয় পয়লা জানার চেষ্টা করবেন। ওই জায়গার মানুষ কী খায়। আর পড়ালেখা কী করে। কাঁচাবাজারে যাইবেন, কী খায় এইডা দেখনের লাইগা। আর বইয়ের দোকানে যাইবেন পড়াশোনা কী করে হেইডা জাননের লাইগ্যা।’
জার্মান কবি গ্যোতের ‘ফাউস্ট’ এর অনুবাদ করাকে নিজের একটা বড় কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন আহমদ ছফা। একই সাথে এই কাজের প্রধান অনুপ্রেরণাদাতা হিসেবে নাম নিয়েছেন আব্দুর রাজ্জাক স্যারের। কোনো প্রকাশক এই বই প্রকাশ করতে না চাইলে, রাজ্জাক স্যার নিজেই জার্মান হাইকমিশনারের সাথে যোগাযোগ করে জার্মান খরচে বইটা (‘ফাউস্ট’র অনুবাদ) প্রকাশের ব্যবস্থা করে দেন।
জ্ঞানের সেবা করতেই রাজ্জাক সাহেব চিরকুমার থেকে গেছেন। তাঁর সুবিশাল লাইব্রেরির পুরাতন বইয়ের সুমিষ্ট সুবাস আহমদ ছফাকে আকৃষ্ট করত। সেখানে ছিল দেশি বিদেশি নানা বই। রাজনীতি, অর্থনীতি, পৌরনীতি, সাহিত্য, ডিকশনারি সবরকমের বই। অর্ডার দেয়া ডিকশনারির জন্য দিনের পর দিন তিনি বইয়ের দোকানে ধর্ণা দিয়ে থাকতেন। বইয়ের দোকান নিয়ে তাঁর আছে এক অসাধারন দর্শন। কোনো সমাজের অবস্থা জানার জন্য সেখানকার বইয়ের দোকানে খোঁজ নিতে বলেছেন তিনি। তার কথায় সমাজের লোকেরা কি ধরনের বই পড়ে তা দেখেই বোঝা যায় সমাজটা কোন পথে আছে বা কোন দিকে যাবে। তাঁর বই পড়ুয়া স্বভাবই তাঁকে করে তুলেছে চলমান বিশ্বকোষ।
চলমান বিশ্বকোষ আব্দুর রাজ্জাক সাহেব রাজনীতি বিদ্বেষী ছিলেন না, ছিলেন রাজনীতি সচেতন। একই সাথে ছিলেন সংস্কৃতি সচেতন। দেশ ভাগ হওয়ার আগে তিনি ছিলেন মুসলিমলীগের সমর্থক। লন্ডনে তিনি হ্যরল্ড লাস্কির এক কথার প্রতিউত্তরে বলেছিলেন, ‘আই এম এ মেম্বার অব মুসলিম লীগ এন্ড ফলোয়ার অব মিস্টার জিন্নাহ’। ‘কেনো আমি পাকিস্তান চেয়েছিলাম’ শিরোনামে ইসলামী একাডেমিতে তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এই বক্তৃতায় তিনি দুই বাংলার সাহিত্যে ব্যবহৃত চরিত্রগুলোর মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম চরিত্রের অনুপাত করেছিলেন। তাঁর পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে থাকার অনেক কারণের একটা ছিল সাহিত্যে মুসলমানদের প্রাধান্য না দেয়া’।
আধুনিক বাংলা ভাষাকে তিনি প্রাকৃতিক (ন্যাচরাল) ভাষা হিসেবে মানতে নারাজ। তাঁর কথায় বাংলার সাথে আরবী-ফারসী মিলে ভাষার যে স্ট্রাকচার দাঁড়ায়ছিল সেটাই ছিল আসল বাংলা ভাষা। ভারতচন্দ্রের লেখায় যার নমুনা পাওয়া যায়। আধুনিক বাংলাতে , বাংলা ভাষা থেকে জোর করে আরবী ফারসী দূর করে সংস্কৃত শব্দের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে বলে মনে করতেন আব্দুর রাজ্জাক। তিনি ভাষা নিয়ে আরো বলেছেন, পড়াশুনা না জানলে আধুনিক বাংলায় কথা বলা যায় না। সাধারন লোকেরাই ভাষার স্তর নির্মাতা, সাহিত্যিকরা নন। মানুষ কথা বলে বলেই সাহিত্য রচিত হয়। ল্যাটিন ভাষায় কেউ কথা বলে না, তাই ল্যাটিন ভাষায় কেউ সাহিত্য লেখে না।
রাজা রামমোহনককে ধর্ম প্রচারের চাইতে সাহিত্যের সেবা করার জন্যই তিনি উপযুক্ত মনে করতেন। বাংলা পুঁথিসাহিত্যকে তিনি নেতিবাচক ভাবে না দেখে পাঠকের গ্রহণযোগ্যতার দিক বিবেচনা করে এই সাহিত্যের প্রতি ইতিবাচক ভাব ব্যক্ত করেছেন। সাহিত্যিক হিসেবে রবি ঠাকুরকে ক্রেডিট দিলেও , মানুষ হিসেবে বিদ্যাসাগরই তাঁর কাছে অনেক বড়। রবি ঠাকুরের গান তার ভালো লাগলেও ভাষার স্তর নির্মাণে রবি ঠাকুরের কোনো হাত আছে বলে তিনি মনে করতেন না। ভাষার স্তর নির্মাণের কাজ সাধারন মানুষের। বঙ্কিমকে নিয়ে অনেক কড়া কথা বলেছেন আব্দুর রাজ্জাক। বঙ্কিমের পড়াশোনা হয়েছিল মুসলমানদের টাকায়। মুহসিন ফান্ডের টাকায় পড়াশোনা করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কলম ধরে সেই ঋণ শোধ করেন বঙ্কিম।
চিত্রকলার প্রতি রাজ্জাক স্যারের একটা দুর্বলতা ছিল। জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম তার কাছে সমাদৃত। জয়নুলের ‘পালকি’ চিত্রকর্মের বেয়ারাদের উপযুক্ত স্পেসের ব্যবহারের জন্য তিনি শিল্পীর সুনাম করেছেন। তাঁর কথায় যথোপোযুক্ত স্পেস চিত্রকর্মটির আবেদন রক্ষা করেছে। চিত্রশিল্পি এস এম সুলতানের গাঁজা খাওয়ার কথা জেনেও নিজের বাসায় সুলতানকে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন রাজ্জাল স্যার। শুধুমাত্র চিত্রকলার প্রতি ভালোবাসা থাকার কারণে নিজের জমানো টাকা খরচ করে এস এম সুলতানের চিত্রকর্মগুলোকে বাঁচিয়েছিলেন।
বইটিতে প্রফেসর সাহেবের ধর্মীয় গবেষণার কিছু দিকও প্রকাশ পেয়েছে। জন্মান্তরবাদের ছিঁটাফোঁটাও বেদে নাই। এটা হিন্দু সমাজ দ্রাবিড়দের কাছ থেকে ধার করে একটা প্রথা হিসেবে চালিয়ে যাচ্ছে। বাইবেল মৃত্যুপরবর্তী জীবন নিয়ে অনেক কথা বললেও ইসলামের মত পার্থিব জীবন নিয়েও তেমন কিছু বলেনি। যেখানে ইসলাম ‘ফিদ্দুনিয়া ওয়াল আখেরাত’ এর কথা বলে দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যে একটা ভারসাম্যমূলক বক্তব্য দিয়েছে। এই বইটিতে কাজী মোতাহের হোসেন, শেখ মুজিব প্রমুখ ব্যক্তিদের নিয়ে কথা হয়েছে গুরু শিষ্যের। পাঠকদের পরিচয় করে দেয়া হয়েছে অনেক বইয়ের সাথে।
বই : যদ্যপি আমার গুরু
লেখা : আহমদ ছফা
প্রচ্ছদ : কাইয়ুম চৌধুরী
প্রকাশক : মাওলা ব্রাদার্স
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD