ভিনসেন্ট স্টারেট বলেছেন, ‘আমরা যখন বই সংগ্রহ করি, তখন আমরা আনন্দকেই সংগ্রহ করি। আর দেকার্তের মতে, ভালো বই পড়া যেন গত শতকের মহৎ লোকের সাথে আলাপ করার মতো। এসব মন্তব্য থেকেই বোঝা যায় বই-ই মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু হতে পারে শুধু। আর যারা বইয়ের সাথে এমন বন্ধুত্ব করতে চান, তারা চলে যেতে পারেন বেঙ্গল বইয়ে। বেঙ্গল বইয়ে থাকা দেশ-বিদেশের হাজারো বইয়ের সমারোহে আপনাকে কাঙ্খিত বন্ধুর কাছেই পৌঁছে দিবে।
২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর রাজধানীর লালমাটিয়ার ডি-ব্লকের দুইটি ভবনে যাত্রা শুরু করে বেঙ্গল বই। করোনা মহামারীকালে বন্ধ হয়ে যায় এটি। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের সময়টাতে মূলত জায়গা স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ‘বেঙ্গল বই’ স্থানান্তর হয়ে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কের বেঙ্গল শিল্পালয় ভবনের নিচতলায় নতুন ভাবে কার্যক্রম শুরু করে। বেঙ্গল শিল্পালয় বভনের নিচতলায় গেলেই বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। কল্পনা করা যায় না, বাংলাদেশেও এমন একটি বুকশপ!
দেশের আট-দশটা বইয়ের দোকানের মতো নয় এটি। এর পেছনে রয়েছে ভিন্ন রকম এক ভাবনা। সেটাই বিস্তারিত জানালেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। বললেন, ‘শুধু ভালো একটা বইয়ের দোকান করার করার চিন্তা আমাদের কখনো ছিল না। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সমাজের যে নানা অবক্ষয়, তা নিয়ে একটা কিছু করা। বইয়ের ভেতর দিয়ে প্রজন্মের মনন-রুচি তৈরির আবহ তৈরি করা।’
বই বিক্রির বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে বেঙ্গল বইয়ের কার্যক্রম শুরু হলেও সাহিত্যবোধসম্পন্ন রুচিশীল পাঠক তৈরির লক্ষ্যে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মিলন-আবহে তৈরি পরিবেশে পাঠকেরা এখানকার বই না কিনেও পড়তে পারবেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। প্রায় ৪০ হাজার বইয়ের সংগ্রহশালা থেকে পাঠক তার পছন্দ অনুযায়ী বই পড়তে পারেন।
বেঙ্গল বইয়ে গেলে সবার আগে নজর কাড়বে উঠানের বিশেষত্ব। ইট-পাথর আর যন্ত্রদানবের শহরকে ভুলে আপনার মনে পড়বে গ্রামের কথা। বাঁশঝাড়, নানান ফুলের গন্ধ আপনাকে নিয়ে যাবে প্রকৃতির কাছাকাছি। আর এখানকার নান্দনিক কারুকার্যে ভাস্বর শিল্পিত আয়োজন মুগ্ধ করবে আপনাকে।
বেঙ্গল বই ঘুরে দেখা যায়, প্রাঙ্গণ জুড়ে বইয়ের আবহ। উঠোনে রয়েছে বই পড়া ও আড্ডা দেওয়ার জন্য বিস্তর জায়গা। ইচ্ছে করলেই যে কেউ তার একান্ত মূহুর্ত কাটিয়ে দিতে পারেন এখানে। ভবনের নিচতলায় রয়েছে দেশি-বিদেশি নানা বইয়ের সংগ্রহ। ছোট-বড় সবার জন্য বইয়ের বিপুল সমারোহ প্রশংসার দাবি রাখে। বেঙ্গল বইয়ের উঠোনে সব শ্রেণির পাঠকের জন্য আছে বই ও ম্যাগাজিন, সঙ্গে চা-নাস্তার ব্যবস্থা। দোতলায় রয়েছে আধুনিক ক্যাফে। চাইলে এখানে বসেও কফি খেতে খেতে করা যাবে গল্প; দেওয়া যাবে আড্ডা কিংবা গাওয়া যাবে গান।
প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ড ও কমিউনিকেশন বিভাগের উপ ব্যবস্থাপক এ আর এম আখতার হোসেন জানান, পাঠকদের জন্য আমাদের তরফ থেকে যেসব আয়োজন আছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, দুটি যেকোনো পুরাতন বই দিয়ে আমাদের সংগ্রহ থেকে পছন্দমতো একটি পুরনো বই নেওয়ার সুযোগ। পাশাপাশি লেখক ও পাঠকদের নিয়ে আমরা নিয়মিতভাবে প্রতিমাসে অন্তত একটি ‘আলাপে বিস্তার’ শিরোনামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকি।
এছাড়া সরকারি ছুটির দিনে বাগানের উঠানে বই পড়ার পাশাপাশি থাকছে সকালের নাস্তার ব্যবস্থা। লুচি, খিচুরির মতো খাবারের মাধ্যমে বাঙালি ঐতিহ্যের ছোঁয়া নিতে পারবেন পাঠকরা।
বেঙ্গল বই এ প্রতিদিন প্রায় চার থেকে পাঁচ’শ দর্শনার্থী আসেন। আর ছুটির দিন হলে পাঠক-দর্শনার্থীর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়।
বেঙ্গল বই এ আসা তেমনি কয়েকজন পাঠকের সাথে কথা হয় দেশের বইয়ের। বই না কিনেও পড়া যায় বলে প্রায়ই এখানে আসেন বলে জানান মোহাম্মদপুর সরকারি কলেজের ছাত্র সুবিত হাসান।
তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমার বই পড়ার আগ্রহ। আগ্রহ থাকলেও অনেক সময় বই কিনে পড়তে পারি না। কিন্তু বেঙ্গল বই আমাদের সেই সুযোগটা করে দিয়েছে। এখানে বই যেমন কিনতেও পারি, আবার না কিনেও পড়তে পারি।
আবার অহেতুক সময় নষ্ট না করে বই এর সাথে সময় কাটাতে বেঙ্গল বইয়ে প্রায়ই আসেন বাঙলা কলেজের ছাত্র মিজান। তিনি বলেন, ফ্যামিলি থাকে গ্রামের বাসায় আর আমি একা মেসে থাকি। আমাদের মতো ছেলেরা অবসর সময় পেলে দেখা যায় আড্ডা দিচ্ছে। পরিবার থেকে দূরে থাকায় অনেকেই এই আড্ডা থেকে বিপদগামীও হচ্ছে। কিন্তু এসব আড্ডার থেকে এখানে এসে বই পড়লে, সেসব থেকে দূরে থাকা যায়। তাছাড়া বইপড়া জীবনের জন্যও কাজে লাগে । তাই সময় সুযোগ হলেই অন্য কোথাও আড্ডা না দিয়ে বই পড়তে আসি। মাঝে মাঝে আমার কিছু বন্ধুরাও আসে। সময় কেটে যায়।
বেঙ্গল বইয়ে নিয়মিতভাবে আয়োজন করা হয় পাঠচক্র, কবিতা পাঠের আসর, নতুন লেখা ও লেখকের সঙ্গে পরিচিতিমূলক সভা, প্রকাশনা উৎসব, চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, শিশুদের নিয়ে কর্মশালা ইত্যাদ। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে বেঙ্গল বই।
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD