বইদেশ-এর একটি নিয়মিত আয়োজন পাঁচটি প্রশ্ন। লেখক-প্রকাশকের কাছে বই প্রকাশনাসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্নগুলো করা। আজকের পাঁচটি প্রশ্ন আয়োজনে আমরা মুখোমুখি হয়েছি প্যারাসাইকোলজি ও বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক হাসান তারেক চৌধুরীর
প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
উত্তর : এটি ছিল একটি সুখস্মৃতি। অন্যদের অভিজ্ঞতা থেকে আমার ধারনা জন্মেছিল, বই প্রকাশ করতে হলে প্রচুর বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয়। কিন্তু অনেকগুলো দৈবসংযোগের কারণে আমার অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথমত, যিনি আমাকে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ভাষাচিত্র-এর প্রকাশক খন্দকার সোহেল ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, সেই রাব্বী ভাই ছিলেন সোহেল ভাইয়ের খুব কাছের মানুষ। আমার প্রথম মিটিং সে কারণেই অনেকটা আড্ডার মতো ছিল। দ্বিতীয়ত, আমি পাণ্ডুলিপি জমা দেয়ার পর যার কাছে এটা রিভিউ করতে দেয়া হয়েছিল, সেই ব্যাচেলর রুমন (নিজেও দক্ষ লেখক), কীভাবে যেন আমার গল্পের নায়িকার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। তাতেই আমার বইটি, বলা যায় ফার্স্ট ট্র্যাকেই ছাপাখানায় চলে গিয়েছিল। আর সেটা এতই ফার্স্ট যে, আমার প্রথম বইতে দৃষ্টিকটুভাবে বেশ কিছু বানান বিভ্রাট রয়ে যায়। প্রসঙ্গত বলি, আমার প্রথম বইয়ের নাম ‘দ্বিখণ্ডিত’। এটি ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ভাষাচিত্র থেকে।
লেখালেখির ইচ্ছেটা কেন হলো?
উত্তর : ছোটবেলা থেকেই আমি সিরিয়াস ধরনের পাঠক। পড়তেই ভালােবাসতাম, কখনও লেখক হওয়ার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। এর প্রধান কারণ, মাঝেমধ্যে নিজে যেটুকুই লিখতাম নিজেরই পছন্দ হতো না, তাই লিখতে সাহস হতো না।
লেখক হওয়ার ইচ্ছে জাগে নেহায়েতই ঘটনাচক্রে। “সময়” নিয়ে ইংরেজিতে লেখা একটি বিজ্ঞান বই পড়ছিলাম। বইটি আমাকে এতই চমৎকৃত করে যে, তখনই মনে হয় এ ধরনের একটি বই যদি বাংলায় থাকতো, কতই না ভালো হতো! কিন্তু আমি অনেক খুঁজেও তেমন কিছু বাংলায় পেলাম না। যা পেলাম সেগুলোর সিংহভাগই কোনো মৌলিক গ্রন্থ নয়, অধিকাংশই ঘোষিত বা অঘোষিত দূর্বোধ্য অনুবাদ। বিজ্ঞানকে কতটা সহজভাবে ও সুখপাঠ্য হিসেবে গল্পে গল্পে বলা যায়, তার সাথে আমাদের বেশিরভাগ পাঠকেরই কোনো পরিচয় নেই। তখনই আমি প্রথম সিদ্ধান্ত নেই বিজ্ঞান লেখার এই বিশেষ ধারাটির সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিবো। আমার মনে হয়েছিল এর মাধ্যমে একটি নতুন বিজ্ঞানমনষ্ক পাঠকশ্রেণি তৈরি করা সম্ভব। আমি শুরু করলে অন্যরা নিশ্চয় এটাকে বহুদূর টেনে নিয়ে যাবে। সত্যি বলতে কি, শুধুমাত্র এই একটি বই লিখতেই আমি লেখক হয়েছিলাম। বাকি বইগুলো আমার বাড়তি পাওনা।
লেখক জীবনের মজার কোনো অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
উত্তর : বলার মতো কোনো মজার ঘটনা নেই। তবে একটা অত্যন্ত বিব্রতকর ঘটনা আছে, যেটায় এখনও মজা পাই।
আমার এক পুরনো পরিচিতা, এক সময় তার সাথে যথেষ্ট আন্তরিকতার সম্পর্ক ছিল। আমার দ্বিতীয় বই ‘যুগল মানব’ প্রকাশ হওয়ারও বেশ কিছুদিন পর তার সাথে দেখা। তিনি ভীষণ রকম উত্তেজিত হয়ে বললেন, তার তারেক ভাইয়ের বই বের হয়েছে! অথচ তিনি জানতেই পারলেন না… খুবই কষ্ট পেয়েছেন, এখনই তার বই চাই… ইত্যাদি। এদিকে পরদিন ভোর বেলা তিনি বিদেশ রওনা হবেন, যাওয়ার পথে তিনি উড়োজাহাজে পড়বেন, তার এক কপি বই চাই-ই চাই। আমার তো আবেগের চোটে কেঁদে ফেলার জোগাড়। তাই বাসায় ফিরে রাত দশটায় ড্রাইভার দিয়ে এক কপি বই তার বাসায় পাঠিয়ে দিলাম।
এরপর প্রায় ছয়মাস পর যখন দেশে ফিরলেন তিনি, আমার সাথে তার আবারও দেখা হলো। আমি প্রশ্ন না করা সত্ত্বেও আমাকে দেখামাত্র প্রায় কৈফিয়তের সুরে বললেন, ভাই আপনার বইটি পড়ার সময় করে উঠতে পারিনি। তবে ‘আমার ছেলেকে দিয়ে পড়িয়েছি’। আমি নিজেকে ধন্য মনে করলাম। কোনাে পাঠক আমার বই পড়ার সময় না পেয়ে তার ক্লাস সেভেনের বাচ্চা দিয়ে ‘পড়িয়েছেন’। লেখক হিসেবে এটা অবশ্যই আমার বিশাল অর্জন!
বাংলাদেশের সৃজনশীল লেখালেখির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।
উত্তর : আমি চিন্তিত। সৃজনশীলতার প্রথম শর্তই হলো নতুন কিছু করা। একজন লেখক যখন গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে নতুন কোনাে লেখনশৈলী বা বিষয়বস্তু সৃষ্টি করতে পারেন, অথবা কোনো বিষয়কে নতুনভাবে উপস্থাপন করেন, আমরা সেটাকে সৃজনশীল লেখা বলি।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়াে অন্তরায় হলো আমাদের রক্ষনশীল মানসিকতা। জাতিগতভাবেই বাঙালিরা রক্ষনশীল এবং আমরা নতুন কোনো কিছু খুব স্বাভাবিকভাবে নিতে পারি না। অধিকাংশ পাঠকই এখন পর্যন্ত গত শতকেই আবদ্ধ আছেন, কেউ কেউ আবার শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কিংবা বড়োজোর বঙ্কিম-মানিকেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছেন (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে)। উপরন্তু আমাদের পাঠক সংখ্যাও খুব কম। এ কারণে নতুন এবং সৃজনশীল লেখা প্রথমেই পাঠক সঙ্কটে পড়ে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেকে ভালােভাবে প্রকাশের আগেই হারিয়ে যায়। এছাড়াও এ ধরনের লেখা ছাপাতে প্রকাশককে অনেক বেশি ঝুঁকি নিতে হয়। পাঠক সংখ্যা কম ও বইয়ের বাজার খুব ছোটাে হওয়াতে তাদের পক্ষেও এই ঝুঁকিটা নেয়া খুব কঠিন। আমার অভিজ্ঞতায় আমি একজন মাত্র প্রকাশককে (খন্দকার সোহেল) আগ্রহের সাথে এই ঝুঁকি নিতে দেখেছি, কিন্তু এ ধরনের খ্যাপাটে প্রকাশকের সংখ্যা নগণ্য।
তবে, আমি একেবারে হতাশ এ কথাও বলবো না। কারণ, সাম্প্রতিককালে নতুন বেশ কিছু নতুন লেখকের বই আমি আগ্রহ নিয়ে পড়েছি যাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি অত্যন্ত আশাবাদী। তাদের কেউ কেউ হয়তো এসব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাবে।
লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন?
উত্তর : এখন পর্যন্ত আমি দুটি ধারায় লিখেছি – বিজ্ঞান ও প্যারাসাইকোলজি তথা রহস্য ঘরানায়। ভবিষ্যতে আমি বিজ্ঞান লেখাকেই প্রধান ধারা হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। পাশাপাশি পাঠক সাড়া অব্যাহত থাকলে প্যারাসাইকোলজি তথা রহস্য ঘরানাতেও লেখালেখি চালিয়ে যাবো বলে আশা রাখি।
অনুলিখন : তাসলিমা তনু
[ বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের যে কোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : boideshnews@gmail.com ]
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD