পাঁচটি প্রশ্ন

বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে পড়তেই আমার লেখার আগ্রহ তৈরি হলো

সোমবার, ২৫ অক্টোবর ২০২১ | ৩:১০ অপরাহ্ণ | 547 বার

বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে পড়তেই আমার লেখার আগ্রহ তৈরি হলো

বইদেশ-এর একটি নিয়মিত আয়োজন পাঁচটি প্রশ্ন। লেখক-প্রকাশকের কাছে বই প্রকাশনাসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্নগুলো করা। আজকের পাঁচটি প্রশ্ন আয়োজনে আমরা মুখোমুখি হয়েছি কামরুন্নাহার দিপা-এর


 

প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা জানতে চাই

আমার প্রথম একক বই প্রকাশের আগে একটা সংকলনে গল্প এসেছিল। ষোলজন নবীন লেখকদের লেখা নিয়ে প্রয়াত সার্জিল খান ভাইয়ের সম্পাদনায় মেট্রোপলিটন গল্পগুচ্ছতে। সেটাই আমার বইয়ের পাতায় প্রথম নিজের নাম দেখা।

ফেসবুকে লেখালেখির সুবাদেই অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে। তখন নিজের উপর বিশ্বাস এসেছিল যে আমারও বই আসতে পারে। সাহস দিয়ে অনেকেই বলতো লিখতে থাকুন, আপনার বই আসবে ইনশাআল্লাহ।
এমনই পরিচিত একজন একদিন বললো,”আপু এখন থ্রিলারের যুগ। আপনি থ্রিলার লেখেন। প্রকাশের ব্যবস্থা আমি করবো।”

সাহস পেলাম। খুশিও লাগলো খুব। যদিও সবসময় মাটির কাছাকাছি মানুষের গল্প লিখতে পছন্দ করি কিন্তু বই প্রকাশের উৎসাহে লেখা শুরু করলাম থ্রিলার। দশ হাজার শব্দ মত লিখেও ছিলাম। কিন্তু লেখা খুব একটা আগাচ্ছিল না। এর মধ্যে নহলী প্রকাশনীতে একটা প্রতিযোগিতায় টিকে পান্ডুলিপি জমা দেয়ার সুযোগ পেলাম। মানসম্মত হলে বই করবে প্রকাশনীর খরচে। তবে জমা দিতে হবে তিন মাসের মধ্যে।

তখনও আমি “আঙ্গারীঘাট” লেখা শুরু করিনি। অনেকের সাথে পরামর্শ করি। যারা আমার থ্রিলারের লেখাটুকু পড়েছিলেন তাঁরা বললেন, ওটা শেষ করেন, ভালো হচ্ছে। কিন্তু আমার মন টানছিল না। মোটামুটি রিস্ক নিয়ে “আঙ্গারীঘাট” লেখা শুরু করলাম। সারাদিন সময় পাই না। সব কাজ সেরে রাতে বাচ্চা ঘুমালে লেখা শুরু করতাম।

তিনমাসের জায়গায় চার মাস লেগেছিল কাজটা শেষ করতে। তারপর পান্ডুলিপি জমা দিলাম। জমা দেয়ার মাস দুয়েক পর বই হয়ে এসেছে। বেটা রিডিংয়ের মত রষকষহীন ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। নহলীর অফিসে যেতে হয়েছে দুইবার। পুরো পরিবার নিয়ে গিয়ে কাজ করেছি ওখানে। এর মধ্যেও এই বইয়ের অসংখ্য প্রচ্ছদ করানো হয়েছে। এমনকি স্বনামধন্য প্রচ্ছদ শিল্পী ধ্রুব এষের করা প্রচ্ছদও বাতিল হয়েছে। মন খারাপ হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত আঙ্গারীঘাট আমার প্রথম উপন্যাস হিসেবে বইয়ের রুপ পেয়েছে। প্রিঅর্ডারেই প্রায় একশ মত অর্ডার এসেছিল। নবীন লেখক হিসেবে তা আমাকে আপ্লুত করেছে। স্বপ্নকে বাস্তবে রুপান্তরিত করার উপলব্ধি দিয়েছে। সত্যি বলতে এই আঙ্গারীঘাট আমার আশার চেয়েও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছেছে। আমাকে পাঠক বিভিন্নভাবে তাঁদের মুগ্ধতার কথা জানিয়েছে। এইতো….

 

লেখালেখির ইচ্ছেটা কেন হলো?

আমি খুব ছোটবেলা থেকেই খুব গল্পপাগল মানুষ।
আমার গল্পের ক্ষুধা না মেটাতে পেরে মা আমাকে মোটামুটি চার বছর বয়সে বাংলা পড়া শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর গল্পের বই ধরিয়ে দিলেন।

এই বিভিন্ন ধরণের বই পড়তে পড়তেই আমার লেখার আগ্রহ তৈরি হলো। মনে হলো এই যে আমার চারপাশে এত রকমের মানুষ। একেকটা মানুষের একেকরকম গল্প। এদের কথা তো আমি লিখতে পারি। এদের গল্প গুলো যদি আমি লিখি তাহলে মানুষ এদের সম্পর্কে জানতে আমার লেখা পড়বে। আমাকে লেখক হিসেবে সম্মান করবে, ভালোবাসবে! লেখক মানেই আমার কাছে ছিল প্রচণ্ড সম্মানীয় মানুষ। যিনি নতুন কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন। বইয়ের পাতায় আস্তো একটা পৃথিবী গড়েন, যেখানকার পাত্র-পাত্রী সবাই লেখকের কলমের আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে। লেখক হয়ে ওঠেন সেই পৃথিবীর ইশ্বর। আমার এমন পৃথিবীর ইশ্বর হতে ইচ্ছা করতো। সেখান থেকেই মূলত লেখালেখি করার ইচ্ছা আমার। আমি খুব ছোট বেলায় কবিতা লিখতাম। বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাতাম। মাঝেমধ্যে ছাপাও হতো। যদিও সেগুলো ছেলেমানুষী ভরা লেখা।

কলেজে ভর্তি হবার পর পড়াশোনার প্রচুর চাপ পড়ে গেল। তার মধ্যেও লিখতাম। । আমি সাইন্সে ছিলাম। কিন্তু বাংলা, ইংরেজি ক্লাস সব গ্রুপের ছেলেমেয়েদের একসাথে হতো। বাংলা ক্লাসে একদিন রফিকুর রশীদ রিজভী স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা পড়েছো?”

আমি উঠে দাঁড়ালাম। বঙ্কিমচন্দ্রের কি কি লেখা পড়েছি জানতে চাইলেন। বলার পর উনি খুবই আশ্চর্য হয়ে আমার পরীক্ষা নেবার মত করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিভিন্ন উপন্যাস সম্পর্কে জানতে চাইলেন। মিনিট দশেক প্রশ্ন-উত্তর চলার পর উনি বললেন,” তুমি সাইন্স পড়ছো কেন? তোমার আত্মা ডুবে আছে সাহিত্যে। বাংলা পড়ো, খুব ভালো কিছু করতে পারবে।”

আমাদের গাংনী ডিগ্রী কলেজের ছেলেরা কবিদের নিয়ে একটা সংগঠন করেছিল। তাতে সভাপতি ছিলেন রফিকুর রশীদ রিজভী স্যার। উনি খুব ভালো লিখেন। অনেক প্রকাশিত বই উনার। ভারিক্কি ধরনের লেখা লিখেন। স্যার সেই সংগঠনে আমাকে ডেকে নিলেন। লেখা পাঠ শেষে বলতেন,”এই মেয়েকে চিনে রাখো। একদিন খুব নাম করবে এই মেয়ে।”

ষোল,-সতেরো বছরের আমি আমার মধ্যে অন্যরকম একজনকে যেন দেখতাম। মনে হতো আমাকে লেখক হতেই হবে!

 

ক্লাসের পড়ার চেয়ে সাহিত্য আমার আরও প্রিয় হয়ে গেল। ফলাফল এইচএসসি ফাইনালে গিয়ে পেলাম। ভয়াবহ বিপর্যয়। মন ভেঙ্গে গেল। সব বাদ দিয়ে ক্লাসের পড়াশোনায় মনোযোগী হলাম। বই পড়া হয়, পড়ার নেশা আমার যায় না কিন্তু লেখাটা যেন আর হয় না। মোটামুটি এরপর দশবছর আমি কিছু লিখিনি। এর মধ্যে লেখাপড়া শেষ করেছি এবং নিজেকে তৈরি করেছি। অতঃপর লেখালেখি শুরু করেছি। কতটুকু লেখা হয় জানি না। তবে চেষ্টা করছি, প্রতিনিয়ত শিখছি। তবে লেখার ইচ্ছাটা আবার পুরো মাত্রায় ফিরে এসেছে।

 

লেখক জীবনের মজার কোনো অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

বর্তমানে আমার লেখালেখির প্রায় পুরোটাই অনলাইনভিত্তিক। মানে লেখা, প্রকাশনীর সাথে যোগাযোগ, ওদের পান্ডুলিপি পাঠানো সবকিছুই অনলাইনে হয়। একমাত্র বইমেলা ছাড়া কোনো পাঠকের সাথে আমার সরাসরি যোগাযোগ হয় না। ইনবক্সে কমেন্টে তো অনেকেই অনেক কিছু লিখে চমকে দেন। তাঁদের ভালো লাগার কথা বলেন। সেগুলো ভালো লাগে। তবে আমার গ্রামের একটা মজার ঘটনা বলি।

আঙ্গারীঘাট বের হবার পর আমাদের এলাকার স্কুল মানে যে হাইস্কুলে লেখাপড়া করেছি সেখানকার বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীরা আঙ্গারীঘাট ত্রিশ কপি কিনে নিয়েছিল। স্কুলে একটা অনুষ্ঠান ছিল। বিশিষ্ট মেহমানদের উপহার দেয়া হয়েছিল সেই বই।

তাদের মধ্যে একজন বইটা পড়েছেন। স্থানীয় বিশিষ্ট প্রভাবশালী নেতা। আমরা ছোটবেলা থেকেই উনাদের খুব বড় মাপের মানুষ হিসাবেই চিনতাম। বইটা পড়ে তারপর লেখক পরিচিতিতে গিয়ে দেখেন আমি তাদের এলাকার মেয়ে। আমার আব্বা-মাকে খুব ভালোভাবে চেনেন। উনার এত ভালো লেগেছে যে সেদিনই আমার আব্বার দোকানে গিয়ে দেখা করেছেন। আমার খুব প্রশংসা করেছেন। আব্বার কাছ থেকে ফোন দিয়ে আমার সাথে কথা বলেছেন।
সত্যি বলতে বিষয়টা আমার খুব ভালো লেগেছে। এটুকু তো আমার লেখালেখির জন্যই হয়েছে।
আর একটা মজার কথা বলি আঙ্গারীঘাট লেখার পর এই নদীটা নিয়ে কেউ কোনো কথা আমার সাথে বলতে গেলেই বলেন,” তোমার আঙ্গারীঘাট “। যেন পুরো নদীটা একমাত্র আমার। বেশ লাগে এটা।

 

বাংলাদেশের সৃজনশীল লেখালেখির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।

ইদানিং একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় তা হলো, “এখন পাঠকের থেকে লেখকের সংখ্যা বেশি। ভালো লেখা কিছুই হচ্ছে না। না পড়াশোনা করে একটা গল্প লিখেই নিজেকে বিরাট লেখক ভাবে একেকজন।”

কিন্তু বিষয়টা আমার কাছে এমন মনে হয় না। একটা মানুষ কিছুই না পড়ে লিখতে পারে না। লিখতে হলে তাকে পড়তেই হবে। শুধুমাত্র হুমায়ূন আহমেদ পড়ে যদি কেউ লেখা শুরু করে তাহলেও কিন্তু সে পড়েছে। তার থেকে লেখার চেষ্টা করছে। আর এটা করতে গিয়েই সে নিজের দুর্বলতা আজ হোক,কাল হোক বুঝতে পারবে। নিজের পড়ার গন্ডি প্রতিদিন ছাড়িয়ে যাবে। প্রথিতযশা লেখকদের লেখা যেমন পড়বে তেমনি পড়বে তার সময়ের লেখকদের লেখা। একটা দেশের,একটা সময়ের সব মানুষ কিন্তু সৃজনশীল লেখা পড়ছে না,পড়েও না কখনো। কারণ মানুষের সৃজনশীলতা একদিকে না সবার। একেকজন একেক দিকে শাইন করে। সেগুলো আবার সেই ধারার লোকজন পছন্দ করে। ইদানিং তো আমার মনে হয় ছেলেমেয়েরা আগের তুলনায় পড়ছে। আলোচনা করছে। সেখান থেকে লেখকরাও লেখার উৎসাহ পাচ্ছেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে একেকজন একেক জনরাই নিজের সাফল্য দেখাচ্ছেন। এতে তো বাংলাদেশের অদূর ভবিষ্যতে সাহিত্যের ভান্ডার সৃজনশীল লেখায় আরও পূর্ণ হবে এমনটা আশা করতেই পারি আমরা।

 

লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন 

লেখালেখি তো সবে শুরু করলাম। মোটে দুটো বই এসেছে। বাচ্চাদের সময় দিতে গিয়ে বর্তমানে লেখার গতি অনেক স্লথ হয়েছে। তবে আমি হারিয়ে যাইনি। এবং সৃষ্টিকর্তা সহায় থাকলে হারাবো না ইনশাআল্লাহ।
হাতে দুটো কাজ আছে। করছি খুব ধীরে সুস্থে। তবে আমি যেহেতু মেহেরপুরের মেয়ে। ওখানে বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগর। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মেহেরপুর নিয়ে বৃহৎ পরিসরে কাজ করার ইচ্ছা আছে। পড়াশোনা করছি। কিন্তু সরেজমিনে গিয়ে মানুষজনের সাথে কথা বলা, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলা এগুলো করতে হবে।তার জন্য সময় লাগবে কাজটা করতে।
সেই সাথে “মানতাসার জঙ্গলে” লেখার পর আমার মনে অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করছে। এক ধরনের পবিত্র আনন্দ যাকে বলে। তাই বাচ্চাদের জন্য লেখাটাও ধরে রাখবো। বছরে অন্তত একটা ভালো মানের লেখা বাচ্চাদের জন্য লিখবো। যাতে ওরা পড়ার আনন্দ পাবে, রঙিন একটা পৃথিবী পাবে, এবং গ্রাম বাংলার মাটির গন্ধ পাবে।
দেখা যাক কতদূর কি করতে পারি…


 

[ বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের যে কোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : boideshnews@gmail.com ]

 

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD