পাঁচটি প্রশ্ন

স্ট্রাইকিং লেখা মানুষের অনেক কিছু বদলাইতে পারে : মোস্তফা হামেদী

রবিবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২১ | ১:২২ অপরাহ্ণ | 675 বার

স্ট্রাইকিং লেখা মানুষের অনেক কিছু বদলাইতে পারে : মোস্তফা হামেদী

দেশের বইয়ের একটি নিয়মিত আয়োজন পাঁচটি প্রশ্ন। লেখক-প্রকাশকের কাছে বই প্রকাশনাসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্নগুলো করা। আজকের পাঁচটি প্রশ্ন আয়োজনে আমরা মুখোমুখি হয়েছি  কবি –মোস্তফা হামেদী-এর


প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

দুই হাজার পাঁচ সালকে ধরতে পারি আমার লেখালেখির আসল শুরুর সাল হিসাবে। এই সময়টাতে আমি ঢাকাই সাহিত্যের অলিগলি চিনতে থাকি। পড়া, দেখা আর বোঝা একই সঙ্গে চলতে থাকে। কিন্তু নিজের একটা ভাষাভঙ্গি খুঁজে না পাওয়ার কারণে বই করার সাহস হয় নাই। যখন মনে হয় যে, হ্যাঁ নিজের কিছু কথা আমি আমার ভঙ্গিতে বলতে পারতেছি, তখন বইয়ের দিকে আগাই। এটা দুই হাজার পনেরো সালের ঘটনা। নাম দিছিলাম ‘মেঘ ও ভবঘুরে খরগোশ’।

প্রথম বইয়ের আবেগে বইটার নির্দয় এডিট করতে পারি নাই। গোপন উচ্ছ্বাস ও চাপা উত্তেজনা তাতে বাধা ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে চিন্তায় বড়সড় পরিবর্তন হতে থাকে। কবিতার রাস্তাটা যে মোলায়েম কোনো কিছু না, এইটা আমি বুঝতে শুরু করি। যদিও বেশ কিছু কবিতা লোকে পছন্দ করছিল। আজ অবধি করে। কিন্তু বইটা সেলিব্রেটেড হয় নাই ঐভাবে। ফলে আমার শিল্পের লড়াইটা অনেক কঠিন হয়ে যায়। যদিও সেটা প্রকারান্তরে কবিতার প্রতি নিবেদন আরও বাড়িয়ে দেয়। যা পরের আমাকে আরও শার্পরূপে তৈরি করেছে। কা বুকস করছিল বইটা। কবি ও শিল্পী সঞ্জীব পুরোহিতের একটা স্বল্পায়ু স্বপ্ন ছিল এই প্রতিষ্ঠান।

 

লেখালেখির ইচ্ছেটা কেন হলো?

লেখালেখি একটা মহৎ ব্যাপার, বিশেষ ব্যাপার- এই রকম ধারনা আমাদের মধ্যে গড়ে উঠছিলো ছোটকালে। সম্ভবত একটা মহত্ত্বের লোভ দানা বাঁধছিল আমার মধ্যে। লেখা যে কোনো কিছুই সুন্দর, এমন একটা বোধ পাইছিলাম আমরা। আমরা যে সমাজে বেড়ে উঠছিলাম, সেখানে স্কুল পাশ দেয়াই ছিল বিরাট কাণ্ড। সেখানে বই লেখা ( লেখলেখিরে ঐ সমাজে লোকে বই লেখাই বলে) তো আরও বড় কিছু৷ আর লেখার সাথে মনে হতো পাওয়ারের যোগ আছে। অবচেতনে সেই পাওয়ারটারে পাইতে চাইতাম। উচ্চম্মন্যতার কারণও আছে এর লগে। লেখালেখি উচ্চ আকাঙ্ক্ষার ব্যাপার মনে হয়। আমার এখনো মনে হয়, লেখার একটা বিশাল শক্তি আছে। স্ট্রাইকিং লেখা মানুষের অনেক কিছু বদলাইতে পারে। মানুষের ইতিহাসের বড় বড় পরিবর্তনগুলা কোনো না কোনো বইয়ের উসিলায় হইছে। আজকাল দেখবো, এক লাইনের একটা স্ট্যাটাসও মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এই কারণে লেখক হিসাবে আমি গৌরব বোধ করি। এবং নিজেকে পাওয়ারফুল মনে করি। আমি মনে করি, লেখা দিয়ে চাইলে অনেকের ভীত কাঁপায়ে দিতে পারি। কারো একটা ভালো ঘুম বা আনন্দের উসিলাও হইতে পারে আমার লেখা। লিখতে পারলে আমি অনেক রিলিফ ফিল করি। কাউকে ভালোবাসি কইতে না পারার অক্ষমতাকে আমি লেখায় কওয়াতে পারি। কাউকে পিটাইতে চাওয়ার রাগ, কাউকে ঘৃণা করার তাড়না মিটাইতে পারি লেখার মাধ্যমে। ফলে অন্যান্য লোকের থেকে বাড়তি একটা এডভান্টেজ নিতে পারি আমি।

 

লেখক জীবনের মজার কোনো অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

একবার আমি আমার শিক্ষক মোহাম্মদ আজমের লগে সাক্ষাতের জন্য সময় নিছিলাম দুপুরের দিকে ওনার চেম্বারে। তৃতীয় বর্ষে পড়ি। ঠিক ঐ সময়ে প্রথম বর্ষের এহসান হাবীব স্যারের লগে দেখা করতে গেলে, স্যার তাকে বলে যে, এখন কবি হামেদীরে টাইম দেওয়া আছে। তারে পরে আসতে বলে। হাবীব তখন খুবই উৎসাহ নিয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হইছে। আর ক্যাম্পাসের কবি-লেখকদের সন্ধান করে বেড়াইতেছে। স্যারের রুম থেকে বাইর হইয়াই সে প্রথম কাজ হিসাবে নিল, কবি হামেদীরে খুঁইজা বার করা। আমি হল থেকে খেয়ে তখন লেকচার থিয়েটারের দিকে হাঁটতেছি। তখন মুজিব কিংবা রাসেল ভাই অথবা ফারুক হসেন কে দেখি এক সুর্দশন তরুণকে আমার দিকে ইঙ্গিত করে কী যেন দেখাইতে। কাছে আসতেই রাসেল ভাই, ফারুক হসেন, কিংবা মুজিব বইলা উঠলো, এই তো কবি হামেদী। বিস্ফারিত চোখে হাবীব তখন আমার দুই হাত নিজের হাতে নিয়া ছুঁইতে লাগলো। আর বলতেছিলাম, একজন কবির হাত ছুঁইতেছি আমি। তবে কিছুটা হতাশ হইছিল, কারণ তার ধারণা ছিল আজম স্যার যারে কবি কইলো, সে নিশ্চয়ই বিশাল বড় কেউকেটা কেউ হবে। সেই আনন্দ বহুদিন আমার আর হাবীবের মধ্যে ছিল। নিজেদের লেখক ভাবার আনন্দ। যদিও আজ আমরা হয়তো সেই বিস্ময়ের ঘোর থেকে অনেক বেশি বাস্তবের নিরস মানুষ।

 

বাংলাদেশে সৃজনশীল লেখালেখির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।

একটা সময় মনে হইতো, সবকিছু নগদে পাইতে চাওয়া যুগের ছেলেমেয়েরা লেখালেখির মতো ধীর অর্জনের পথে হাঁটবে না। এখন দেখতেছি লেখালেখিটারেই নগদ লাভের হাতিয়ার করে নিয়েছে। তাদের এই বুদ্ধির আমি তারিফ করি। লেখালেখি বহু লোকের করেটরে খাওয়ার/ ধান্দা ফিকিরের উপায় হয়েছে। কিন্তু মারাত্মক সুন্দর বা প্রভাবসঞ্চারী লেখার অভাবটা আমি খুব ফিল করি। সাহিত্যভাষা চর্চার ইতিহাস বদলাই দেওয়া লেখক কই আসতেছে আর! সম্ভবত সিস্টেমের মধ্যে মানাই নেওয়ার পর্বে আমরা আটকা পড়ছি। এটা একটা অচলায়তন মনে হয় আমার কাছে। নতুন চিন্তা আর স্বপ্ন দেখাইবার মতো সাহসী লেখক দরকার আমাদের। সত্য বলতে পারার মতো সৎ লেখক দরকার৷ দরকার জনগোষ্ঠীর সংবেদনাকে ধারণ করতে পারার মতো নরম/সরল হৃদয়। প্রতিভার বা মেধার জমিনে বড় সাহিত্য হয় না, বড় সাহিত্যের জন্য বড় কলিজাঅলা লোক লাগে। ঝুঁকি নিতে পারার মতো দৃঢ় মন দরকার। তা না হলে আরও দীর্ঘদিন হয়তো গড়পড়তার মধ্যে আমাদের দিন গুয়াইবে বলে সন্দেহ করি।অবশ্য গড়পড়তার দেয়ালে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কেউ ব্যাপক নন্দিত হয়ে উঠতেছে, এমন একটা আশাব্যঞ্জক দৃশ্য আমি কল্পনা থেকে বাদও দিতে চাই না ।

 

লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন?

আমার কবিতার বই চারটা। আরও কয়েক ফর্মা লেখা আছে, সেগুলাতে এডিট করতেছি। আছে কিছু গদ্য। লেখাটারে টানতে চাই যথারীতি বেঁচে থাকার আরও আটদশটা কাজের সাথে। জীবনের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা, আমার লেখারে নতুন নতুন চেহারা দিবে, এরকম একটা আশাবাদীতার মধ্যে আমি থাকতে চাই। একদিন প্রচুর লোক আমার লেখা পড়বে, সকলে পড়তে পারার মতো এক/দুইটা বই আমি কখনো লিখে উঠতে পারবো, এমন স্বপ্নের মধ্যে আমার লেখার বাসনাটা টিকায়া রাখতে চাই।

 


[ বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের যে কোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : boideshnews@gmail.com ]

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD