পাঁচটি প্রশ্ন

লেখালেখিতে আমি লক্ষ্যহীন হলেও নিরন্তর পথিক : রয় অঞ্জন

সোমবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২১ | ৫:০১ অপরাহ্ণ | 794 বার

দেশের বইয়ের একটি নিয়মিত আয়োজন পাঁচটি প্রশ্ন। লেখক-প্রকাশকের কাছে বই প্রকাশনাসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্নগুলো করা। আজকের পাঁচটি প্রশ্ন আয়োজনে আমরা মুখোমুখি হয়েছি লেখক রয় অঞ্জন-এর


প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

বই আমার একটাই বেরিয়েছে। অভিজ্ঞতা বলতে এককথায় বলতে পারি “স্তব্ধ”। আমি স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। লেখালেখি, এডিটিং, প্রচ্ছদ পর্ব সেরে যখন ছাপার ঘরে গেল, তখনো বুঝিনি, আমার বই প্রকাশিত হলে প্রথম মুহূর্তটা কীভাবে সামাল দেব। ২০১৯, ফেব্রুয়ারি’৪, একুশে বইমেলার ভাষাচিত্রের স্টলে প্রথম যেদিন বইটা হাতে নিলাম, আমি যেন হারিয়ে গেছিলাম। এটা কি আনন্দ! নাকি উচ্ছ্বাস, নাকি দায় কোন প্রশ্নের উত্তরই আমার বোধে আসেনি। স্থানু হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, কতক্ষণ, আমার মনে নেই।

‘রবি বাউলের শান্তিনিকেতন’কে হাতে নিয়ে আমার মনে হচ্ছিল, লেবার রুম থেকে টাওয়ালে মুড়ানো সদ্য ভূমিষ্ট তুলতুলে একটা শিশু যেন আমার হাতে। শারিরীকভাবে আমি ভাষাচিত্রের স্টলে দাঁড়ানো থাকলেও, আমার মন ছুটে গেল শান্তিনিকেতনে। চোখের সামনে শান্তিনিকেতনের প্রতিটি গাছপালা, ঘর-কুটির, মাঠের দূর্বাঘাসের পরশ মেখে ছুটে গেলাম ছাতিম তলায়, যেখানে রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন একান্তে, নিভৃতে। আমি ছুটে গিয়ে বইটা যেন তাঁর পায়ে অঞ্জলী দিলাম। রবীন্দ্রনাথকে বলছি “গুরুদেব, তোমার এখানে এত বার এসে যা কিছু পেয়েছি, তার যৎকিঞ্চিৎ এই বইয়ের পাতায় পাতায় আছে, তুমি অঞ্জলী লহ মোর”। যেন রবীন্দ্রনাথ স্মিত হেসে আমাকে বলছেন, “জানতাম… হবে”।

 

যেদিন বইটা নিয়নের আলোর নিচে এলো, সেদিন, আমার ছোট বেলার একটা গল্প মনে পরেছিল খুব। আমরা তখন ছোট। আমাদের এক পাড়াতুতো দিদি, খুব স্নেহ করতেন আমাদেরকে, কিছুটা পাগলাটেও ছিলেন। পাড়ার ছোটদেরকে প্রায়ই বলতেন, আমার বিয়ের বরকে বলে একটা লাল জামা এনে দেব, কাউকে কাঠি লজেন্স, মালাই আইসক্রিম আরো কতকিছু, সবই দিদির বিয়ের পর। সবার মুখে মুখে পাগলি দিদি হয়ে গেলেন বিয়ে পাগল দিদি। সেসময়ে নিজের মুখে নিজের বিয়ের কথা বলা ছিল ভীষণ লজ্জার। একদিন ঠিকঠিক দিদির বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের আসরে দিদিতো আর মন্ত্র পড়েন না, কেবলি কান্না করছেন আর বলছেন, সত্যিই বিয়ে হয়ে গেল! বিয়েটা হয়েই গেল! আমার বইটা বেরোনোর অভিজ্ঞতার কথা না বলে যদি বলি উপলব্ধির কথা, তাহলে দিদির মতোই বলব, “বইটা বের হল! সত্যিই বের হয়ে গেল! আমার বই!” এই অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধির কথা বলে বা লিখে প্রকাশ করার মতো শব্দ মজুত আমাতে নেই, তাই সেদিন স্তব্ধই ছিলাম অনেক্ষণ।

 

লেখালেখির ইচ্ছেটা কেনো হলো?

লেখালেখি বলতে তেমন কিছুই হয় না আমার। তবে মনেপ্রাণে আমি একজন ভ্রমণ বিলাসী মানুষ, বলতে পারেন পিপাসুও। ফুসরত পেলেই বেরিয়ে পরি। যখন যেখানে যাই, যা কিছু পাই সবই আমি মনের চোখে দেখার চেষ্টা করি। আমার দেখার ধরনটা একটু কেমন যেন। পথের নুড়ি পাথর থেকে শুরু করে নিস্তব্ধ দুপুরে গাছের কোটরে মা পাখি যখন তার ছানাদের মুখে খাবার তুলে দেয়, তাও যেন দেখি। সে দেখাটাই লিখে রাখার চেষ্টা করি। লিখতে লিখতে কখন যে লেখা হয়ে গেল, টের পাইনি।

আমি আমার স্মরণ শক্তিকে নিয়ে গর্ব করি, গ্রামে বেড়ে ওঠা ডানপিটে শৈশবের প্রতিটা দিন যেন আজো দেখতে পাই। বিলের জলে হাতিয়ে মাছ ধরা, বন্ধুরা দল বেঁধে পুকুরে ডুবানো, মাছ ধরতে গিয়ে সাপে কাটা কিংবা পাগলা কুকুড়ের কামড় খাওয়া সবই যেন আজো দেখতে পাই।

ছোটবেলায় আমি খুব সিনেমা দেখতাম, আমরা বলতাম বই দেখতে যাই। পকেটে কোনো রকমে সাড়ে তিন টাকা জামাতে পারলেই ফ্রন্ট স্টলের টিকিট কেটে বই দেখতে ঢুকে যেতাম। তখনকার বেশিরভাব সিনেমাই নির্মিত হতো কোনো না কোনো বিখ্যাত উপন্যাস বা নাটকের কাহিনী অবলম্বনে, তাই হয়তো সিনেমাকে বইই বলা হত। সিনেমা দেখতে দেখতে কত যে সিনেমার স্ক্রিপ্ট লিখেছি! লিখতাম আর লুকিয়ে রাখতাম, মনে মনে নিজের সিনেমার পাত্র-পাত্রীও নির্বাচন করতাম। রাজ্জাক-শাবানা-জসিম-সুচরিতা… সবই করতাম লুকিয়ে লুকিয়ে, যেন মায়ের হাতে ধরা না পরি। হারিকেনের তেল পুড়িয়ে এসব লেখা ছিল মায়ের দৃষ্টিতে গর্হিত অপরাধ।

বই পড়তাম খুব, এতে মায়ের দারুণ সায় ছিল। শ্রীকৃষ্ণ গোপাল বসাক এর রিক্তের বেদন বইটি যেদিন ধরলাম। খুব সম্ভবত প্রথম লাইনটা ছিল “প্রফেসর সঞ্জয় মিত্রের দুই ছেলে, বড় ছেলে অঞ্জন আর ছোট ছেলের নাম রঞ্জন। বইটা যত পড়েছি, ততোই কেঁদেছি। কাকতালীয় ভাবে সঞ্জয়, অঞ্জন, রঞ্জন এই তিনটা নামই আমার পরিবারের। আমাদের তিন ভাইয়ের নাম। তখনি মনে হলো, আমার পরিবার, আমার গ্রাম, আমার পরিচিত পরিসর নিয়েও লেখালেখি করা যায়। হয়তো আমার পরবর্তী বইতে নিজের গ্রামটা থাকবে।

কোথায় যেন পড়েছিলাম, যে যত কল্পনা করতে পারে, তার জগৎ ততো বড় হয়। আর যার কল্পনার জগত যত বড় হয়, তার প্রকাশও ততো সমৃদ্ধ হয়। লেখালেখিতে আমার প্রকাশ ক্ষমতা ততোটা নেই, তবে একটা দুর্দমনীয় আগ্রহ আছে। কে জানে, সেই আগ্রহ থেকেই লেখালেখির ইচ্ছেটা জাগলো কি না।

 

লেখক জীবনের মজার কোনো অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

‘লেখক জীবন’ শব্দটাতেই আমার দীনতা খুব বেশি। বিশেষ করে ‘লেখক’ শব্দটাতে। একটা বইতেই যদি লেখক হয়ে যাওয়া যায়, তবে এই জীবনের বয়স মাত্র একবছর। একবছরের এই ‘লেখক’ নামক জীবনের অভিজ্ঞতা বলতে গেলে ‘অপ্রত্যাশিত’ শব্দটাই সবার আগে ছুটে আসে। ‘রবি বাউলের শান্তিনিকেতন’ বইটার পাঠ প্রতিক্রিয়া বা পাঠ বিশ্লেষণ এতো পেয়েছি যে তা ধারণ করার ব্যপ্তি-শক্তি কোনোটাই আমার নেই। এতো নমস্যজনরা এই বইটা আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন, বইয়ের ভিতরে শান্তিনিকেতনকে দেখেছেন, যারা আগে গিয়েছেন তারা তাঁদের দেখা এবং আমার লেখার সাথে মেলাতে গিয়ে মিল পেয়েছেন বলে যে তৃপ্তির প্রকাশ আমাকে করেছেন, আমার শীর্ণ কাঁধ তার ভার বইবার শক্তি রাখে না। অন্যদিকে আট বছরের শিশু চাঁদনী যখন তার বালিশের পাশে বইটা রেখে ঘুমায়, প্রতি রাতে পড়তে পড়তে ঘুমায়, এটা ভাবলেও আমি কুঁকড়ে যাই। এই অভিজ্ঞতার নাম ‘মজা’ কি না জানি না, তবে এটা যে তৃপ্তির, তা বলতে পারি। আর এই পাঠক তৃপ্তিটা আমার দায় অনেক বাড়িয়ে দিল সামনের দিনের জন্য।

 

বাংলাদেশে সৃজনশীল লেখালেখির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।

সৃজনশীলতা আর সৃষ্টিশীলতা দুটো শব্দই আমার কাছে পরিপূরক অথবা সমার্থক মনে হয়। বঙ্কিম-রবীন্দ্র আমল থেকে শুরু করে আশুতোষ-নীহার রঞ্জন হয়ে সুনীল-সমরেশ এই যুগটাকে যদি আমরা হিসেবে আনি, তবে বলব এই সময়টাতে বাংলা সাহিত্যের জোয়ার ছিল প্রচণ্ড। এরপরে অনেকদিন সেই গ্রাফটা ক্রমাগত নিম্নগামী হয়েছে। বর্তমানে অন্তর্জালের যুগে আবার লেখালেখির গ্রাফটাকে আমি উর্ধ্বগামী দেখতে পাচ্ছি। আমি আশাবাদী মানুষ, আশার মৃত্যু চাই না, সেই আলোকে বলতেই পারি লেখালেখির ভবিষ্যৎ আশাপ্রদ।

আসছি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। বাংলাদেশ বরাবরই সাগর নদীর দেশ, পাহাড়- প্রকৃতির দেশ আবেগ আর ভালোবাসার দেশ। একটা দেশ যার বুকে এতো সম্ভাবনার রসদ ধরে আছে, সে দেশে অবশ্যই লেখালেখির ভবিষ্যৎ উজ্জল থেকে উজ্জলতর হবেই। শুধু দরকার একটু সাহিত্য কেন্দ্রিক পরিচর্চা।

 

লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন?

দেখুন, আমি একজন অস্থিরমতি মানুষ। লক্ষ্য নির্ধারণ করে যখন চলতে শুরু করি, স্বভাবগত কারণেই পথ পাল্টাই। এতে করে কখনো লক্ষ্য অতিক্রম করি, কখনো বা লক্ষ্যভ্রষ্ট হই। তবে লেখালেখিতে আমি লক্ষ্যহীন হলেও নিরন্তর পথিক, একজন স্বপ্নভুক মানুষ। যতদিন পারব লিখে যাব, এটা আমার প্রত্যয় বা উপাসনা যা-ই বলুন না কেনো। রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে একজন ধ্রুব তারা। যতটা পারি ধ্রুব তারাকে লক্ষ্য করেই আমার পথচলা হবে। আর স্বপ্ন যদি বলেন, তবে বলব, আমি মৌলিকতার পক্ষে। আগামীতে মৌলিকতাকেই আশ্রয় করে চলব।

 


[ বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের যে কোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : boideshnews@gmail.com ]

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD