পাঁচটি প্রশ্ন

ছাপাখানা বা মুদ্রণ ব্যবস্থাপক নয় প্রকাশক হয়ে উঠতে চাই

মঙ্গলবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১০:৪১ অপরাহ্ণ | 590 বার

ছাপাখানা বা মুদ্রণ ব্যবস্থাপক নয় প্রকাশক হয়ে উঠতে চাই

বইদেশ-এর একটি নিয়মিত আয়োজন পাঁচটি প্রশ্ন। লেখক-প্রকাশকের কাছে বই প্রকাশনাসংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্নগুলো করা। আজকের পাঁচটি প্রশ্ন আয়োজনে আমরা মুখোমুখি হয়েছি পাললিক সৌরভ-এর স্বত্বাধিকারী ও প্রকাশক মেহেদী হাসান শোয়েব-এর


প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

এই প্রশ্নের উত্তরের আগে দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর প্রথম পড়ে নিলে এই সাক্ষাতকারের ধারাবাহিকতা থাকবে ভালো। যাই হোক, প্রকাশক হবার সিদ্ধান্ত নেবার পর ছোটভাইকে বললাম, বই তো করতে হবে। বইমেলায় স্টল নিতে হলে কী করতে হয় খোঁজ নাও। সে খোঁজ নিয়ে জানালো, ২৫টা বই ডিসেম্বরের ৩১ তারিখের ভেতর করতে হবে। তার ভেতর বেশ কয়েকটা বিখ্যাত লেখকের বই লাগবে। অক্টোবরে এই তথ্য জানতে পারলাম। প্রশ্ন করলাম, বিখ্যাত লেখকরা আমাদের মতো নতুন প্রকাশনা যারা কোনো বই প্রকাশ করেনি, তাদের পাণ্ডুলিপি কেন দিবে?

 

সেভাবে পরিচিত কেউ নই আমরা। তবু সাহস করে পাণ্ডুলিপি চাইলাম কবি অসীম সাহা, রবিশঙ্কর মৈত্রী, শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজনের কাছে। সবাই প্রথম চাওয়াতেই দিতে রাজি হলেন। বেশ আবেগাপ্লুত হলাম। ফেসবুকে প্রচার করে নতুন অনেক লেখকের সাড়াও পেলাম। বিখ্যাত লেখকের বই করতে হবে, আবার ব্যবসাও হতে হবে- এই চিন্তা নিয়ে চলে গেলাম রাজশাহীতে হাসান আজিজুল হক-এর বাসায়। উনি আমাদের দীর্ঘ সময় দিলেন এবং একটা প্রবন্ধের পাণ্ডুলিপি হাতে-হাতেই দিয়ে দিলেন। চলে গেলাম সিলেটে, মুহম্মদ জাফর ইকবাল-এর সাথে দেখা করতে। তিনি তখনই দিতে না পারলেও দিবেন বলে কথা দিলেন। এর ভেতর রবিশঙ্কর মৈত্রী আর অসীম সাহার পাণ্ডুলিপি পেলাম। শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীও দিলেন। পাণ্ডুলিপি পেলাম কানাডা প্রবাসী ফরিদ আহমেদের সম্পাদনায় যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর বিচারের রায়ের বাংলা অনুবাদ।

 

এতগুলি পাণ্ডুলিপি তো পেলাম নভেম্বরের শেষের দিকে। হাতে ২ মাস মাত্র সময়। ২৫টা বই। আমার কবি ছোট ভাই বাংলার ছাত্র ছিল। স্বল্প সময়ে প্রুফ দেখার কাজ সে করে দিতে থাকলো। আরও কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষী এই বিষয়ে সহযোগিতা করলো। কিন্তু মুশকিল হয়ে গেল পেজ মেকাপসহ অন্যান্য যে টেকনিক্যাল কাজগুলি করতে হয়, সেসব বিষয়ে আমাদের জ্ঞান ছিল একেবারেই শূন্য। তখন পরিচয় হলো শতাব্দী ভবর সাথে। পরিচয় আগেই ছিল। কিন্তু তার প্রিন্টিং ম্যানেজমেন্ট কাজের বিষয়ে জানা ছিল না। টিএসসিতে একদিন সে জানালো, সে আমাদের এই কাজে প্রফেশনালি সহযোগিতা করতে পারে। আমরা তার সাথে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ১ মাসে ২৫টা বই প্রকাশ করতে পারায় শতাব্দী ভব আমাদেরকে অসাধারণ সাপোর্ট দিয়েছে সেইসময়। কিন্তু পেজ মেকাপের জন্য কাটাবনে একজনের সাথে সে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, এই কাজটা এই লোককে দিয়ে করিয়ে তাকে দিতে হবে। আমি এক সপ্তাহ ঘুরলাম ঐ লোকের পেছনে। দেখলাম, তার যা গতি তাতে ২৫টা বইয়ের কাজ শেষ করতে সে ৬ মাস অন্তত লাগাবে।

 

সিদ্ধান্ত নিলাম, এই কাজ নিজেই চেষ্টা করবো। এমএসওয়ার্ডে পেজ মেকাপ তো আসলে কঠিন কিছু না। অন্য সফটওয়্যার ব্যবহার করলে কঠিন। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ওয়ার্ডেই মেকাপ দিবো। নিজে চেষ্টা করলাম এবং ২৫টা মেকাপই নিজে দিলাম প্রথম প্রকাশিত বইগুলির। তারিখ মনে নেই, ডিসেম্বরের ১৬-১৭ হবে হয়তো, প্রকাশিত হলো আমাদের প্রথম বই। তবে একটি নয়, একসাথে বেশ কয়েকটা বই। অন্যরকম অনুভূতি ছিল। বই লেখকের সন্তান যতখানি, প্রকাশকেরও ততখানিই। এর আগের ১ মাস সারারাত কাজ করেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রেসের বিভিন্ন সেক্টরে দৌড়াদৌড়ি করছি। অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। কিন্তু বইগুলি হাতে পেয়ে যে কী আনন্দ হচ্ছিল তা প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

 

প্রকাশক হবার ইচ্ছেটা কেন হলো কেমন করে হলো?

প্রকাশক আমি ইচ্ছা করে বা পরিকল্পনা করে জেনে-বুঝে হইনি। প্রকাশক হঠাৎ করেই হয়ে গেছি। ঢাকা শহরে আমি গিয়েছিলাম মূলত লেখক হবো স্বপ্ন নিয়ে। পড়াশোনাটা ছিল বাবা-মা’কে বোঝানোর অজুহাত। তবে, লেখক হবার জার্নিটা সহজ না। আমিও নানারকম জীবন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে চলতে চলতে বুঝে গেলাম, লেখক হওয়া আমার হবে না। কিন্তু কিছু শুরু করার জন্য যে সাহস লাগে, হয়তো বাস্তব জ্ঞান কম থাকবার কারণেই, সেই সাহসটা আমার ভেতর আছে। তাই জীবনে অনেক কিছু শুরু করেছি, চেষ্টা করেছি। হয়তো তার বেশিরভাগ ব্যর্থই হয়েছি। তবু নতুন কিছু আবারও চেষ্টা করেছি। আমার এই সাহসের কথা পরিচিত মহলের জানা ছিল।

 

আমার শহরেরই এক ছোটভাই ও কবি। ওর ইচ্ছা হলো প্রকাশক হবে। কিন্তু ওর সাহসের অভাব। একদিন আমার কাছে এসে বলল, ভাই আপনি যদি সাথে থাকেন তো একসাথে একটা প্রকাশনা শুরু করতে পারি। আমি বললাম, আমি তো এই বিষয়ে কিছুই জানি না। সে জানাল, তার পরিচিত অনেকেই আছে প্রকাশনা জগতে। সে তাদের সহযোগিতা পাবে। আর পাণ্ডুলিপি তার কবি বন্ধুদের কাছ থেকে নিবে।

এভাবেই শুরু করতে চায়। আমি বললাম, আমি থাকতে পারি সাথে। কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে। সেইসব শর্তের ভেতর মূল কথা ছিল, প্রকাশনা সেই চালাবে মূলত। কিন্তু আমার কথা বা সিদ্ধান্তের গুরুত্ব বেশি থাকবে। সে রাজি হলো। সেটা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে। একদিনের আলোচনায় প্রকাশনা সংস্থা খোলার সিদ্ধান্ত নিলাম। নামও দিলাম আমিই। লোগো করে দিলো কাব্য কারিম।

 

প্রকাশক জীবনের মজার কোনো অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

প্রকাশক জীবনের সবচেয়ে মজার এবং সবচেয়ে বিরক্তিকর বা অপমানজনক অভিজ্ঞতা একই। প্রায়ই নানানজন প্রশ্ন করেন, ভাই একটা কবিতার বই করতে চাই বা একটা গল্পের বই করতে চাই। খরচ কেমন পড়বে একটু বলবেন? তখন মজাও লাগে। বিরক্তিও কাজ করে। অবশ্য এর দায় সাধারণের নয়। আমাদের প্রকাশকদেরই। প্রকাশকের কী ভূমিকা সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই আমাদের দেশে। আমার মতো না জেনে, না বুঝে বা ছাপাকাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে হওয়া প্রকাশকের সংখ্যা খুব কম নয় এদেশে।

 

বাংলাদেশে সৃজনশীল লেখালেখির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।

সৃজনশীল লেখালেখির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে চাই না। বর্তমান নিয়ে ভাবতে চাই। বর্তমানের কাজ আর কাজের পদ্ধতিই অনেকাংশে ঠিক করবে ভবিষ্যৎ কেমন হবে। কেবল লেখালেখির বেলায়ই নয়, সব সৃজনশীল কাজের বেলাতেই একইরকম ঘটনা ঘটছে। ভালো কাজ যেমন হচ্ছে, খারাপও হচ্ছে প্রচুর। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রচার বা প্রকাশ মাধ্যম সহজ হয়ে যাওয়ায় খারাপের প্রকাশও হচ্ছে বিনা বাধায়। আর আমাদের মতো অর্ধশিক্ষিত জাতির মানুষ চিন্তাশীল বিনোদনের চেয়ে স্থুল বিনোদন বেশি গ্রহণ করে। ফলে ভালো কাজের চেয়ে খারাপের বিস্তার বেশি হচ্ছে। তাই অনেক সৃজনশীল লেখকের খোঁজ পাঠকের কাছে, এমনকি আগ্রহী পাঠকের কাছেও পৌঁছাচ্ছে না। এটা একটা বড় সংকট তৈরি করছে বলে আমি মনে করি। পাশাপাশি, বাংলাদেশে প্রকাশনার কাজটা তো সহজ নয়, এখানে ব্যবসাটা কঠিনই বেশ। তাতে করে কেউ ভালো লিখলেই তার পেছনে প্রকাশক বিনিয়োগ করবে- তেমনটা হয় না। তার চেয়ে কম ভালো লিখছে এবং পরিচিতি আছে, এমন লেখকের বই প্রকাশে প্রকাশক আগ্রহী হয়ে উঠতে আজকাল। তাই লেখকদেরও এখন কেবল লেখায় মন দিলেই চলে না। ফেসবুক সেলিব্রেটি হওয়ার চেষ্টা করতে হয়। তাতে করে লেখায় মনোযোগ একটু হলেও কমে। তবু ভালো লেখা হয়, হচ্ছে, হবে এবং দিনশেষে সোশ্যাল মিডিয়ায় হাইপ তোলা বই হারিয়ে যাবে। আর যে ভবিষ্যতের কথা আপনি জানতে চাইলেন সেই ভবিষ্যতে ভালো লেখাগুলি ঠিকই টিকে থাকবে, পৌঁছে যাবে ভবিষ্যৎ পাঠকের কাছে।

 

প্রকাশনা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ স্বপ্ন?

প্রকাশনা নিয়ে আমার ভবিষ্যৎ স্বপ্নও আলাদা করে বলার মতো কিছু নেই। যেভাবেই হোক, নামের সাথে প্রকাশক শব্দটা তো জুড়ে গেছে। আমি তাই প্রকাশক হয়ে উঠতে চাই। ছাপাখানা বা মুদ্রণ ব্যবস্থাপক নয়। ভালো বই প্রকাশ করতে চাই, ছাপতে চাই না। প্রকাশক কী তা জানতে বুঝতে চাই এবং তা হয়ে উঠতে চাই। এতটুকুই।

 


[ বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের যে কোনো সংবাদ প্রকাশের জন্য আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : boideshnews@gmail.com ]

 

Facebook Comments Box

কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না

Design & Development by: TeamWork BD