শামীমা ইসলাম
“যদি এই সমগ্র বসুন্ধরা আমার হাতে দিয়ে বলা হয় ভোগ কর, তাহলেও আমি এই ফলবত বসুন্ধরাকে নির্দ্বিধায় ছুড়ে ফেলে দেব। আমি জীবনের জন্য জীবনকে নোংরা করতে শিখিনি!”
মহামুনি পরাশর যমুনা নদীকে সাক্ষী রেখে ধীবরকন্যা কালীর রতি প্রার্থনা করেন। পরাশরের ঔরসে কালীর গর্ভে জন্ম নেয় এক আশ্চর্য বালক, কৃষ্ণ। বিবাহপূর্ব সন্তানকে প্রতিপালনের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় কাছের দীপে পরাশরের সাময়িক আশ্রম। দীপে জন্ম ও বেড়ে ওঠা বলে কৃষ্ণ পরিচিত হোন দ্বৈপায়ন নামে, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। তপস্যাবলে মহর্ষিত্ব প্রাপ্ত হয়ে বেদকে চারভাগ করেছিলেন বলে নামের সাথে যুক্ত হয় বেদব্যাস বা ব্যাস। তাঁর তপস্যাস্থান ছিলো বদরিকাশ্রম এই কারণে তিনি বাদরায়ন নামেও পরিচিত ছিলেন।
তবে শাহযাদ ফিরদাউস বেদব্যাসকে বর্ণনা করেছেন পুত্র, পিতা, মুনী, জ্ঞানী, গুরু, মহর্ষি নানা রুপে।
সময়ের পরিক্রমায় কৃষ্ণ জ্ঞানার্জনের জন্য দীপান্তরিত হোন। জ্ঞানের পথে তিনি ব্রাহ্মণ শুদ্রের ভেদ করেন নি। তারই সূত্র ধরে পিতা পরাশরের সাথে তার বাকবিতণ্ডা হয়, হয় সম্পর্কের অবনতি ও বিচ্ছেদ।
অপরদিকে কৃষ্ণের মাতা সত্যবতী সম্রাট শান্তনুর পাণিগ্রহণ করেন যার কারণে যুবরাজ দেবব্রতকে চিরকালের জন্য সংসারধর্ম তথা সিংহাসনের দাবী ত্যাগ করতে হয়।
সময় সাক্ষী এই প্রতিশ্রুতির কারণে জন্ম নেয় নতুন এক ইতিহাস। সেই ইতিহাসের বিশদ বর্ণনা আছে ব্যাসে।
সত্যবতী যথারীতি সম্রাটের দুই পুত্রের মাতা হোন, চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। এক যুদ্ধে নিহত হয় চিত্রাঙ্গদ এবং অপুত্রক দশায় যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে দেহত্যাগ করে বিচিত্রবীর্য। ভরতবংশ যখন নির্বশ হবার যোগাড়, তখন মহাপ্রাজ্ঞ ব্যাসদেবকে স্মরণ করে মাতা সত্যবতী। রাজবধূ অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে সন্তান আসে। সাময়িকভাবে বিনষ্টের হাত থেকে রক্ষা পায় ভরতকূল। কিন্তু মহাকাল তখন ক্রুর হাসি হেসে অন্য উপাখ্যান লেখায় ব্যস্ত।
ব্যাসদেবের ঔরসে অম্বিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র, অম্বালিকার গর্ভে পাণ্ডু ও দাসীর গর্ভে বিদুরের জন্ম হয়। যথাসময়ে গান্ধারীর সাথে ধৃতরাষ্ট্র, মাদ্রী ও কুন্তির সাথে পাণ্ডুর বিবাহ সম্পন্ন হয়।
ধৃতরাষ্ট্র হোন শতপুত্রের জনক, ভরতবংশের এই শাখা কৌরব বলে পরিচিত এবং পাণ্ডুর পাঁচপুত্র পরিচিত পাণ্ডব নামে।
ভরতবংশের এই দুই শাখা ক্ষমতা, অর্থ, সাম্রাজ্যের লোভে নিজেদের ভেতর কলহে লিপ্ত হয়। লোভ, ক্ষোভ, ঈর্ষা ও ইন্ধন তাদের টেনে নিয়ে যায় কুরুক্ষেত্র অবধি।
ব্যাসদেব প্রাণান্ত চেষ্টা করেন নিজের সন্তানকূলকে রক্ষা করতে কিন্তু ব্যর্থ হোন। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সাক্ষী হোন নিজের সন্তানকূল ধ্বংসের।
যুদ্ধের প্রান্ত ছেড়ে ব্যাসদেব আগামীর পথে এগিয়ে চলেন। বুক ভরা বেদনা নিয়ে তিনি নির্ধারণ করেন তার কর্মযজ্ঞ। তখনো তাঁর অনেক কাজ বাকি, অর্জিত জ্ঞান বন্টন করতে হবে ভবিষ্যতের হাতে। চলতে চলতে ক্লান্ত হোন আর হারাতে থাকেন প্রাণপ্রিয় শিষ্যদের। প্রথমে পৈল, তারপর সুমন্ত এবং অবশেষে জৈমিনি।। সঙ্গী হিসেবে রয়ে যায় বৈশম্পায়ন।
হাঁটতে হাঁটতে বেদব্যাস পরিচিত হোন বার্ধক্যের সাথে, জীবনের সাথে, জ্ঞানের সাথে, মহত্ত্বের সাথে, পরিচিত হোন মৃত্যুর সাথেও। কিন্তু তার আগে নির্ধারণ করে যান আর সারা জীবনের অর্জিত জ্ঞানের ভবিষ্যত।
পরবর্তীতে তার জ্ঞান বৈশম্পায়নের স্মৃতি থেকে পুস্তকে পরিণত হয় যার নাম ‘জয়’।
এই ইতিহাসের সত্য মিথ্যার তল খুঁজতে যাওয়া বাতুলতা। চিরায়ত জনারার নিখাদ এক রত্ন পাঠ করাই ছিলো আমার মূল লক্ষ্য। জীবনবোধের এমন গভীর আলোচনা খুব কম পুস্তকেই খুঁজে পাওয়া যায়।
বর্ণনার প্রাঞ্জলতা ঘটনাপ্রবাহের সাবলীলতায় “ব্যাস” বাংলা সাহিত্যে শক্তিশালী জায়গা দখল করে নিয়েছে। এই বইয়ের সাহিত্যমান বিচার করার মত বালখিল্যতায় না গিয়ে বলতে চাই যারা জীবনের পথ ধরে দর্শনের পথে হাঁটতে চান তারা পড়ে দেখতে পারেন ব্যাস।
যদিও বাংলাসাহিত্যের এই রত্নটি এখনো তার যোগ্য সম্মান পায় নি তার প্রমাণ বইয়ের গ্রুপগুলোর বুক রিভিউ সেকশন। অনেক খুঁজেও এই বইয়ের কোন রিভিউ পাই নি আমি। লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ ও সাহিত্যের প্রতি প্রীতি থেকে আমার এই সামান্য প্রচেষ্টা। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
বই : ব্যাস
লেখক : শাহযাদ ফিরদাউস
প্রকাশনী : ভাষাচিত্র
মুদ্রিত মূল্য : ২৫০ টাকা
[ বই-পুস্তক-প্রকাশনা এবং বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের যে কোনো সংবাদ-ফিচার-তথ্যমূলক লেখা প্রকাশের জন্য সংশ্লিষ্ট ছবিসহ আমাদের ই-মেইল করতে পারেন : desherboi@gmail.com
কপিরাইট © ২০১৭ - ২০২০ ।। বইদেশ-এ প্রকাশিত কোনও সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না
Design & Development by: TeamWork BD